রবিবার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সম্পূর্ণ খবর

TheArcArt

উত্তর সম্পাদকীয় | অধমের মাঝেও কালান্তরে অরুণ হয়ে রইলেন উত্তম ধ্রুবতারা

গৌতম রায় | | Editor: Arijit Mondal ২৪ জুলাই ২০২৪ ১৫ : ০৩Arijit Mondal


গৌতম রায়
মৃত্যুর এত বছর পরেও মৃত্যু সাম্রাজ্যকে অতিক্রম করে বাঙালির কাছে জীবন্ত উত্তমকুমার। বেঁচে থাকার এই ধারাবাহিক সাফল্যের চাবিকাঠি কী?

উত্তম কুমার প্রয়াণের এত বছর পরেও একজন অভিনেতার জনপ্রিয়তা প্রায় একইভাবে টিকে থাকা কিন্তু মুখের কথা নয়। উত্তম কুমার প্রয়াত হয়েছেন ১৯৮০ সালে। তারপর অনেক অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। প্রজন্মান্তর ঘটেই চলেছে। সংস্কৃতি জগতে নিত্যনতুন ভাবনা, সংস্কৃতির আগের দিনের চালচলনকে আজকের দিনে অকেজো করে দেওয়ার একটা প্রবণতা চিরদিন থাকে।

এটা বিশ শতকের মধ্যভাগে যেমন ছিল বিশ শতকের শেষ দিকেও তেমনই বিদ্যমান থেকেছে। কিন্তু উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়কে ঘিরে বাঙালি দর্শকদের মধ্যে শুধু জনপ্রিয়তা নয়, যাকে বলে ক্রেজ, সেটা কিন্তু সময়ের নিরিখে কমে যাওয়া তো দূরের কথা, বেড়েই চলেছে ।

আজকের প্রজন্মের মানুষ যাঁরা বিনোদনের দুনিয়াটাকে অনেক ক্ষেত্রেই পারিপার্শ্বিকতার চাপে একটু অন্যরকম ভাবে দেখতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের কাছেও উত্তমকুমার মানে একটা অন্যরকমের অনুভূতি। আজকের প্রজন্মের একজন মানুষ, তার পেশাগত দুনিয়াটা যখন আগের দিনের নিরিখে একদম বদলে গিয়েছে, দিনের প্রায় অধিকাংশ সময়ে তাকে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকতে হচ্ছে, এই যে প্রজন্ম, সেই প্রজন্মও কিন্তু বিনোদনের এই সময়ের নানা উপকরণ, সেই অনুভূতির মধ্যে দিয়েও যেমন যাচ্ছে, তেমনি নিজের বৌদ্ধিক জগত এবং চেতনা-- এই দু'টিকে আরও মেজে ঘষে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করলে,অন্যান্য অনেক উপকরণের মধ্যে উত্তমকুমারের অভিনয়টাকেও একটা প্রয়োজনীয় উপকরণ বলেই মনে করছে। 

একজন শিল্পীর পক্ষে এটা কম বড় প্রাপ্তি নয়। সময়কে এভাবে জয় করে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত করতে পারা, এটা কিন্তু কেবল বাংলা বিনোদনের জগতেই নয়, বিদেশি ফিল্ম , থিয়েটার ইত্যাদি সমস্ত জগতের নিরিখেই বলতে হয়, খুব একটা মুখের কথা নয় ।

চার্লি চ্যাপলিন যেভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কেবলমাত্র শ্রদ্ধা নয়, ভালবাসার একটা জায়গা দখল করে আছেন, তেমনটা কিন্তু সার্বিকভাবে অড্রে হেপবার্ন বা গ্রেটা গার্বোর জীবনে ঘটেনি। এমনকি আমাদের বাংলা ফিল্মের জগতে উত্তমকুমারের সঙ্গে যার নামটি একই বন্ধনীতে বার বার উচ্চারিত হয় ,সেই সুচিত্রা সেনের জীবনেও ঘটেনি। অভিনয় দক্ষতার দিক থেকে উত্তম বাবুর এই অনন্য সাধারণ প্রতিভার কথা তার প্রয়াণের অব্যবাহিত পরেই উত্তম যুগের পূর্ববর্তী সময়ে কিংবদন্তি অভিনেত্রী কানন দেবী বারবার উল্লেখ করে গিয়েছেন। তবে কানন দেবী, উত্তম বাবুর প্রয়াণের পর তার সম্পর্কে যে কথাটা খুব হৃদয় স্পর্শী ভাবে বলেছিলেন ,সম্ভবত সেটাই উত্তমবাবুর অভিনয় দক্ষতা এবং মানুষ উত্তম সম্পর্কে ব্যবহৃত চরম সত্যি কথা। 

কানন দেবী, উত্তমবাবুর প্রয়াণের অব্যাহত পরে বলেছিলেন ; সবই ছিল উত্তমের, ছিল না কেবল বন্ধু।

কানন যেভাবে উত্তমকে উপলব্ধি করেছিলেন , সেই উপলব্ধি কিন্তু কেবলমাত্র আগের যুগের এক অভিনেত্রীর, পরের যুগের এক জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা অভিনেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন নয়। শ্রীমতি পিকচার্স প্রোডাকশন হাউজ তৈরি করে, কানন যখন বেশ কতগুলি বাংলা ফিল্ম প্রযোজনা করেছিলেন,সেগুলিতে অভিনয়ের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন উত্তম কুমারকে। 

সেই ফিল্মগুলিতে উত্তমবাবুর অভিনয় দক্ষতা নিরিখেই নয়, অভিনয়ের সময়কালীন বা ফিল্মগুলির পারিপার্শ্বিকতার দিনগুলিতে একটু বোধহয় বেশি কাছের থেকে মাতৃবৎ স্নেহ দিয়ে উত্তমকে দেখবার চেষ্টা করেছিলেন কানন। আর কাননের এই দেখবার চোখকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব জহর গাঙ্গুলীর একটা বড় রকমের ভূমিকা থেকে গিয়েছে। 

শ্রীমতি পিকচার্সের ছবিগুলিতে অভিনয়ের কালে সুলাল বাবুর সহচর্যের ভেতর দিয়ে উত্তমবাবু যে ভাবে কানন দেবী এবং তাঁর সামগ্রিকতার খুব কাছে এসেছিলেন, সেটাই কিন্তু পরবর্তীকালে ব্যক্তি সুচিত্রা সেন যখন দাম্পত্য জীবনের এক কঠিন সময়ে এসে দাঁড়ান শিশু কন্যাকে নিয়ে, তখন তাঁর প্রতি যে সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কানন, অনেকেরই হয়তো জানা নেই, এই গোটা ব্যাপারটিতে কী ভাবে অন্তরাল থেকে একটা অদৃশ্য হাত হিসেবে উত্তমবাবু তাঁর ভূমিকা রেখেছিলেন ।

সুচিত্রা সেনকে উত্তমকুমারের একজন সত্যিকারের ভাল বন্ধু মনে করতেন। কানন এইখানেই বোধহয় দুই ব্যক্তিত্বের একটা আপাত দূরত্ব, দু'জনেরই বন্ধুত্বের জগৎটাকে যে কোনও কারণেই হোক একটু ফিকে করে দিয়েছিল। আর সেই ফিকে করে দেওয়ার পর্যায়টা উত্তমবাবুর জীবনে এমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার কথাই বলতে চেয়েছিলেন। উত্তম যদি তাঁর প্রকৃত হিতাকাঙ্খীকে সঠিকভাবে চিনতে পারতেন, অনেক কিছু হয়ত অন্যরকম হতো। কিছু লোকের প্ররোচনায় একটা সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অহেতুক একটা দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। হেমন্ত কিন্তু প্রথম থেকেই জানতেন,বুঝতেন, যে; বন্ধু উত্তম তাঁকে ভুল বুঝছেন । কিন্তু হেমন্তের বিশ্বাস ছিল,আলাদা করে সেই ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করলে, সেই চেষ্টা খুব একটা সফল হবে না। হেমন্ত প্রত্যাশা করেছিলেন, উত্তম কুমার নিজেই একদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। আবার তাঁদের সম্পর্কটা সেই পুরনো জায়গায় ফিরে যাবে।

হ্যাঁ ,উত্তম তাঁর প্রিয় বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে যে ভুল ধারণার শিকার হয়েছিলেন, একটা সময় এসে তিনি আবার সেটা নতুন করে বুঝতে পেরেছিলেন এবং নিজের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আবার তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন । কিন্তু দেরি যা হওয়ার সেটা তখন হয়ে গিয়েছে। কানন দেবী অনেক সময় আক্ষেপ করতেন, হেমন্ত সম্পর্কে যে ভুল ধারণার শিকার হয়েছিলেন উত্তম কুমার, সেটা যদি না ঘটত, তাহলে হয়তো বম্বে পর্ব, ছোটি সি মুলাকাত ছবি ঘিরে উত্তমবাবুর যে ভয়ঙ্কর আর্থিক ক্ষতি, যে ঘটনাগুলো ব্যক্তি উত্তমকে ভেঙেচুরে দিয়েছিল এবং তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাকের জন্য যে ঘটনা অন্যতম প্রধান দায়ী, সে সমস্ত কিছুই হয়তো ঘটত না ।

এই সময়টায় আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় মহানায়ককে যেভাবে ভুগতে হয়েছিল সেটা যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে না দেখেছিলেন, তাঁরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবেন না। উত্তমের এই সময় তাঁর আর্থিক ক্ষতি, ধার -দেনা এগুলো মেটাবার তাগিদ থেকে, মাত্র পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে জলসাতে অংশগ্রহণ করতেন। শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে এইসব জলসায় অংশগ্রহণ, এগুলি কিন্তু অসুস্থ উত্তম কুমারকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে আরও বেশি অসুস্থ করে দিয়েছে। তবু কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না। কোনও অবস্থাতেই হতাশায় আকীর্ণ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ ছিলেন না।

বম্বেপ চিত্রজগৎ তাঁর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিল, বিশেষ করে যে আর্থিক ক্ষতির সামনে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, সেটা তিনি নিজেই সামলে নিতে পারবেন, এই বিশ্বাসটা কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল আর সেই বিশ্বাসটা ছিল বলেই খুব সহজে তিনি হার মানতে চাননি। কঠোর পরিশ্রম করে, প্রবল মানসিক চাপ সহ্য করে, নানা ধরনের সামাজিক টিটকিরিকে হেলায় অস্বীকার করে, সেই জায়গা থেকে তিনি নিজেকে উত্তরিত করেছিলেন।

এখনও মনে হয়, ঐরকম একটা সময়ে বসুশ্রী সিনেমা হলে মহালয়ার দিন আয়োজিত জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আসতে দেরি করছেন। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এসে গিয়েছেন। উত্তম কুমার নিজের পারফরমেন্স শেষ করে নেমে আসবেন। কিন্তু হঠাৎ কী মনে হল, 'সপ্তপদী'-র সেই বিখ্যাত ডুয়েট গানটা তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাইবেন । উত্তমের গানের কথা সে ভাবে মনে নেই । কিন্তু নিশ্চিন্ত হলেন তাঁর সন্ধ্যাদির কাছে, খাতায় লিরিক্স লেখা আছে বলে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও সাহস যোগালেন উত্তম কুমারকে। শুরু হল উত্তম -সন্ধ্যার সেই কালজয়ী গান ।

আসলে উত্তম কুমার বিনোদন জগতের গ্ল্যামারের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেকে উপস্থাপিত করেও যে কোনও রকমের এক্সপেরিমেন্টের প্রশ্নে ছিলেন একেবারে শিশুর মতো সরল। সেই কারণে, পাবলিক কী ভাবে নেবে, নেবে না। তার উপর খুব একটা নজর না দিয়ে, তাঁর সন্ধ্যাদিকে সঙ্গে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন;' এই পথ যদি না শেষ হয় ,তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।' পারফেকশনিস্ট হিসেবে আর দশ জন প্রথম সারির অভিনেতার মতোই উত্তম কুমারের মধ্যে একটা খুঁতখুতুনি ,ফ্লোরে যাওয়ার আগে বারবার রিহার্সালের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল এমনকি শ্য়ুটিংয়ের আগের দিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় পর্বগুলি ঝালিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে উত্তম কুমার যথেষ্ট সিরিয়াস ছিলেন। তা স্বত্ত্বে বলতে হয়, উত্তম কুমারের মধ্যে কিন্তু একজন শিশু ভোলানাথ বাস করত। আর সেটা করত বলেই বসুশ্রীতে সে ভাবে সেবার হঠাৎ কোনওরকম রিহার্সাল ছাড়া সপ্তপদীর সেই কালজয়ী গানটিকে, তাঁর সন্ধ্যাদির সঙ্গে গাইবার সাহস তিনি দেখাতে পেরেছিলেন। 

আর সেই জায়গা থেকে যেন উত্তম-কানন-সন্ধ্যা, এক অপূর্ব মনিকাঞ্চন যোগ ঘটেছিল। কানন দেবীর পুত্রের বিয়েতে শ্যামল গুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বেলা মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটি ছবি আছে। ওই ছবিটিকে সন্ধ্যা শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর শয়ন কক্ষে রেখেছিলেন । আর ছবিতে স্বামী শ্যামল গুপ্তকে দেখিয়ে তিনি বলতেন, উত্তম কুমারকে চিনতে পারছ? এই ঘটনাটি উত্তম কুমারকে খুব আনন্দ দিয়েছিল। শ্যামল গুপ্তকে বলতেন, দেখেছেন, শ্যামলদা? সন্ধ্যাদি কিন্তু আমাকে দিয়ে আপনার তুলনা করছে!


#UttamKumar#uttamkumar#aajkaalonline#aajkaal



বিশেষ খবর

নানান খবর

সংগ্রহ করুন... #aajkaalonline #pujovibes #durgapuja #DurgaPuja2024

নানান খবর



রবিবার অনলাইন

সোশ্যাল মিডিয়া



07 24