মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সম্পূর্ণ খবর

উত্তর সম্পাদকীয় | কাঁওয়ার যাত্রা ঘিরে বিজেপির অবস্থান

AM | ০৬ আগস্ট ২০২৪ ২১ : ৪৮Arijit Mondal


গৌতম রায়
নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর গোটা হিন্দু মৌলবাদী শক্তি তাদের সামাজিক বিভাজনের কৌশলকে আরও তীব্র করে তুলতে শুরু করেছে। গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে মোদির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যেভাবে সামাজিক বিভাজনের কর্মকাণ্ড চলছে সেগুলো দেখে শিউরে উঠতে হয়।
শ্রাবণ মাসে শিবের পুজো উপলক্ষে কাঁওয়ার যাত্রার একটা প্রথা একাংশের হিন্দুদের মধ্যে আছে । এই কাঁওয়ার যাত্রাকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ডে যেভাবে গোটা মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পর্কে এই দুই রাজ্যের বিজেপি সরকার ঘৃণা ছড়াচ্ছে ,তা সার্বিকভাবে ভারতের সংবিধানের মূল নির্যাসের পরিপন্থী।

কাঁওয়ার যাত্রাকে কেন্দ্র করে উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে, যে পথ দিয়ে ওই যাত্রা যাবে ,সেই পথের ধারে যে সমস্ত মসজিদ এবং মাজার রয়েছে, সেগুলির প্রত্যেকটি পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। সমাজমাধ্যমে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্কের জেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রতিবাদী মানসিকতা তৈরি হয় তাতে বাধ্য হয় সেখানকার প্রশাসন পর্দা সরিয়ে দিতে।
তার আগে অবশ্য উত্তর প্রদেশ সরকার এবং উত্তরাখন্ড সরকার এই কাঁওয়ার যাত্রার পথে যে সমস্ত খাবারের দোকান রয়েছে, প্রত্যেকটি দোকানের গায়ে দোকানদারের নাম লেখা বাধ্যতামূলক বলে আদেশ জারি করেছিল। উদ্দেশ্য এটাই ছিল, যে সমস্ত দোকানদার জন্মসূত্রে মুসলমান, তাঁদের সরাসরি প্রাণে না মেরে ভাতে মারা। আর এই ভাতে মারার ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়েই একটা ভয়াবহ বিভাজনের মানসিকতা তৈরি করা, যাতে স্থায়ীভাবে ওইসব মুসলমান দোকানীদের দোকানের বিক্রি বাট্টা বন্ধ হয়ে যায় তার ব্যবস্থা পাকা করা।

এই খাবারের দোকানে, দোকানে নাম লেখার বিষয়টিকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের জাল বিজেপি, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্য দু'টিতে বেশ অনেকদিন আগের থেকেই শুরু করে দিয়েছে। ধর্মকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিভাজনের প্রক্রিয়া স্থায়ী করে দেওয়ার যে হিন্দুত্ববাদী উদ্যোগ, সে বিষয়টি আদালত অবধি গড়ায় । দেশের সর্বোচ্চ আদালত খাবারের দোকানে, দোকানীর নাম লেখার বিষয়টি উপর স্থগিতাদেশ পর্যন্ত দিয়েছে।
এইরকম অবস্থায় যখন সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি নিয়ে শুনানির দিন ধার্য হয়েছে এবং পরবর্তীতে সেই স্থগিতাদেশ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বজায় রেখেছেন ,তখন ওই দু'টি রাজ্যের পুলিশের এই মাজার ও মসজিদ ঢেকে দেওয়ার পক্ষপাতমূলক আচরণ ঘিরে একটা ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া গোটা দেশব্যাপী শুরু হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ সরকার ও এই ধরনের বিভাজনমূলক কাজ সরাসরি তাদের পুলিশ দিয়ে করিয়েছে বিজেপি। যে কারণে মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড সরকারের কাছ থেকে জবাব সুপ্রিম কোর্ট চেয়েছেন ।এই শিব ভক্তির নাম করে যে রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছে ,তা যতো অগ্রসর হয়েছে, ততই নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। একাধিক জায়গায় এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী লোকজনেরা যে অঞ্চল দিয়ে গেছে , সেই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ, যাঁরা জন্মসূত্রে মুসলমান ,তাঁদের মারধর করেছে শোভাযাত্রাকারীরা। তাঁদের সম্পত্তি ভাঙচুর করেছে । মীরাটে একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। যে গাড়ির আরোহীরা চারজনই ছিলেন মুসলমান। পুলিশের সামনেই সেই গাড়ির চারজন আরোহীর মধ্যে একজনের জামা কাপড় ছিঁড়ে প্রায় তাঁকে উলঙ্গ করে দিয়েছিল এই কাঁওয়ার যাত্রার লোকজনেরা।
হরিদ্বারের রামনগর এলাকার মসজিদ এবং মাজারের সামনে যেভাবে পুলিশ পর্দা টানিয়ে দিয়েছিল তার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই জোরদার হতে শুরু করেছিল। জ্বোয়ালাপুরেও একটি মসজিদের সামনে এভাবে পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপাসনা স্থল গুলির সামনে পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে সরাসরি প্রশাসনের নির্দেশে ।মসজিদ এবং মাজার পরিচালন কমিটিগুলির পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছে ,প্রশাসন সরাসরি এভাবে পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সমস্যা এড়ানোর জন্যই নাকি তারা এই ধরনের কাজ করেছে । যদিও এই পর্দা টাঙানো ঘিরে সমাজমাধ্যম-সহ বিভিন্ন পর্যায়ে জোরদার প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার পর , যেদিন সকালে পর্দা টাঙানো হয়েছে , সেদিন বিকেলেই, পুলিশ পর্দা সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
মসজিদ এবং মাজারের পরিচালকেরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন, শিব উপাসকেরা দীর্ঘদিন এই ধরনের যাত্রা করেন। কিন্তু কখনও এই ধরনের যাত্রা কে ঘিরে কোনও ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি। এই প্রথম এই ধরনের বিভাজনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হল।

বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৎপাল মহারাজ সরাসরি এ ভাবে পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণকে সমর্থন জানিয়েছেন। এগুলি নাকি কোনও বড় বিষয় নয় এ কথাও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন। কোনও নির্মাণ কাজ চলবার সময় যেভাবে পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়, এই কাঁওয়ার যাত্রার সময়, মাজার বা মসজিদের সামনে পর্দা টাঙিয়ে দেওয়াকে তার সঙ্গেই তুলনা করেছেন মোদি সরকারের মন্ত্রী সৎপাল মহারাজ ।
 কাঁওয়ার যাত্রা , এটা হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত আদরনীয় একটি উৎসব । এই উৎসবের সঙ্গে এতকাল কোনওরকম বিদ্বেষমূলক রাজনীতির বা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সম্পর্ক ছিল না। শিবভক্তের দলকে স্থানীয় মুসলমানেরা জল, শরবত, খাবার ইত্যাদি সাদরে এগিয়ে দিতেন। শিবভক্তেরা সেগুলি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতেন। কোনওদিন কোনওরকম বিদ্বেষমূলক ভাবনা উভয়ের মধ্যে ছিল না। হরিদ্বারে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে একটা সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। অথচ সেই সৌভ্রাতৃত্বের জায়গাটিকে বিনষ্ট করবার উদ্দেশ্যে, ওই শিব ভক্তদের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক কর্মী , যারা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, এমন লোকজনদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেই বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠছে।

আর সেই সমস্ত লোকজনই নানা ধরনের সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি করে, যে হরিদ্দার বা মীরাট এই সমস্ত অঞ্চলে কখনও কোনও রকম অশান্তি এই কাঁওয়ার যাত্রাকে ঘিরে ছিল না, তা নতুন করে শুরু করা হয়েছে। একাধিক মাজারের পদাধিকারীরা জানিয়েছেন; প্রত্যেকবারই মসজিদ- মাজারের প্রাঙ্গণে গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পথযাত্রীরা বিশ্রাম নেন শিব ভক্তেরা। কখনও কোনোরকম অশান্তির বাতাবরণ এতকাল ধরে হয়নি।
 এটা অত্যন্ত স্বস্তির বিষয় যে ,উত্তরপ্রদেশ সরকার যেভাবে দোকানদারদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা বাধ্যতামূলক করেছিল, তার উপরে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির হৃষীকেশ রায় এবং বিচারপতি এস ভি এন ভাট্টি ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিতাদেশ দিয়ে গোটা পরিস্থিতিকে একটা বড় রকমের সমস্যার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আগামী পাঁচই আগস্ট পরবর্তী শুনানি।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের ভেতরেই দোকানিদের নাম লিখে, দোকানে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঠেলায় করে যাঁরা ফল বিক্রি করেন, সেই সমস্ত ঠেলাগুলিতেও দোকানীদের নাম লিখে দেওয়া হয়েছে অসহায় দোকানীরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, পেটের দায়ে সমস্ত কিছু মেনে নিতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। কোনও অবস্থাতেই তাঁরা কোনও অশান্তিতে যেতে চান না ।

 এ ভাবে ভারতে মুসলমান সমাজকে একটা বড়রকম অর্থনৈতিক সংকটের সামনে এনে দাঁড় করাতে চাইছে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। ক্রেতাদেরও ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে হিন্দু- মুসলমানের, যাতে হিন্দুর দোকান থেকে হিন্দু ক্রেতাই জিনিসপত্র কেনে , তার জন্য ক্রেতাকে বাধ্য করছে সরকার। আর মুসলমান ক্রেতার দোকানে যাতে কোনও অবস্থাতেই হিন্দু না যেতে পারে, সে জন্য সাধারণ নাগরিককে বাধ্য করছে সরকার। এ ভাবে মুসলমান সমাজের ভিতর একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনবার ঘোরতর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির।


#postedit#aajkaalonline



বিশেষ খবর

নানান খবর

শীঘ্রই আসছে...

নানান খবর



সোশ্যাল মিডিয়া



08 24