রবিবার ০৬ অক্টোবর ২০২৪

সম্পূর্ণ খবর

বিনোদন | EXCLUSIVE: জয়-সুদীপ্তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে উষ্ণ শহর! সাক্ষী থাকতে ‘অহনা’র সেটে আজকাল ডট ইন

নিজস্ব সংবাদদাতা | | Editor: শ্যামশ্রী সাহা ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৫ : ৫৪


কখনও তাঁরা পরস্পরকে কাছে টানছেন। গলে যাচ্ছেন একে অপরের উষ্ণতায়। আশ্লেষে, সংরাগে ভালবাসাবাসির মাত্রাও তখন তীব্র। কখনও মারাত্মক বিকর্ষণ। দাম্পত্য কলহ বুঝি ম্লান করে দিচ্ছে তাঁদের যাবতীয় প্রেম! ঠিক এমনই দৃশ্যপট সাজানো জয় সেনগুপ্ত-সুদীপ্তা চক্রবর্তী থুড়ি প্রমিতা ভৌমিকের প্রথম বড় ছবি ‘অহনা’য় অহনা-রুদ্রনীলের জন্য। এক লেখিকার জীবন, টানাপোড়েন, দাম্পত্যের নিত্য ওঠাপড়া নিয়ে গল্প সাজিয়েছেন প্রমিতা। তারই শুটিংয়ের একমাত্র সাক্ষী আজকাল ডট ইন।

সুদীপ্তা মিশে গেলেন জয়ের মধ্যে...
দক্ষিণ কলকাতার এক ছিমছাম ফ্ল্যাট। বিছানার চাদরে সাদা-কালোয় মধুবনি প্রিন্ট। পর্দাগুলোতেও তার ছায়া। শীতবিকেলে অপার স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে অন্দরসজ্জা। এমনই এক সুখী গৃহকোণে অহনা-রুদ্রনীলের ভালবাসাবাসি ফুটিয়ে তুলছেন নায়ক-নায়িকা। শট রেডি। শোওয়ার ঘরের বিছানায় ওঁরা দু’জনে। মনিটরে জয় পরিষ্কার। সুদীপ্তা কোথায়? পিছন থেকে নেওয়া শট বলছে, তিনি জয়ের বাহুবন্ধনীতে মিশে গিয়েছেন! ক্লোজ শট নেওয়ার পরেই হঠাৎ হাসি। সুদীপ্তা হাসতে হাসতে বেরোচ্ছেন। ব্যাপারটা কী? কপট রাগ দেখিয়ে পরিচালকের কাছে ফাঁস করলেন জয়ের দুষ্টুমি, ‘‘একে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যর টেক। আর জয় কানের কাছে মুখে নিয়ে সমানে বলে যাচ্ছে, কখন কাট বলবে রে? আমি কি এভাবেই আদর করে যাব?’’

শুনে জয় মৃদু হেসে সামনের ঘরের ডিভানে। সাজসজ্জা বলছে, এটি তাঁদের বসার ঘর। রাতপোশাক বদলে নতুন সাজ সুদীপ্তার। তিনি ততক্ষণে নিজেকে রূপটানশিল্পী হেমা মুন্সির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন। সেই সুযোগে জয়ের মুখোমুখি আজকাল ডট ইন।



‘অহনা’র কল্যাণে শীত উধাও...!!
প্রতি বছর এই সময়টা জয় কলকাতায় আসবেনই। শীতের কলকাতার রকমারি সংস্কৃতি উপভোগ করতে। তাঁর মতে, এই একটি শহরে শীতের মরশুম সাংস্কৃতিক উদযাপন থেকে পার্ক স্ট্রিট কালচার—সব হাজির করে। যা অন্য শহর দিতে পারে না। জয় নিজের মতো করে উপভোগ করেন শীতের ছুটি। এবারে তো শুটিং। হল উদযাপন? ‘‘হল তো’’, বললেন অভিনেতা। নির্দিষ্ট সময়ে শুটিং শেষ বন্ধুদের সঙ্গে দেদার আড্ডা। বাঙালি, সাহেবি খানাপিনায় ভরপুর উপভোগ। ছুটি ফুরোতেই আবার শুট। সম্প্রতি তিনি ‘দত্তা’য় নরেন। পেশায় চিকিৎসক। এবার ‘অহনা’য় সোসিওলজির অধ্যাপক। অভিনেতারা জলবৎতরলং। যে কোনও ভূমিকায় মানানসই। তবু প্রমিতার গল্পে কী এমন আছে যার জেরে লেখিকার স্বামী হতে রাজি হলেন? প্রশ্ন রাখতেই জবাব এল, ‘‘আমি চরিত্র নয়, ছবির প্রতি আগ্রহী। এমনও হয়েছে, একই চরিত্র একাধিক ছবিতে করেছি। সেখানে চরিত্র এক হলেও প্রত্যেকটা ছবি আলাদা। সেই কারণে রাজি হয়েছি। আর চরিত্র মানে, কী পেশায় তাকে দেখা যাবে সেটা নয়। আমি ভিতরকার চরিত্র বুঝি। পাশাপাশি, পরিচালকের বক্তব্যের প্রতিও সমান মনোযোগী। অনেক ছবি হয় যেখানে পরিচালকের সত্তা প্রকাশ পায় না। ফরমায়েশি ছবি বানান তাঁরা। প্রমিতা তাঁদের দলের নয়। ওঁর নিজস্ব বক্তব্য আছে। আমিও বরাবর এই ধরনের ছবি করে এসেছি।’’ আরও একটি কমন ফ্যাক্টর জয়ের রয়েছে। তিনি শুরু থেকে প্রায় প্রতি ছবিতে খুব ‘ভাল মানুষ’। এই ছবিতে তাঁর চরিত্র এই প্রথম ধূসর। যা তিনি উপভোগ করছেন। 

রুদ্রনীল পর্দায় সোসিওলজির প্রফেসর। দেশ-বিদেশের সম্মেলনে নারী স্বাধীনতা, নারী কল্যাণ নিয়ে বক্তৃতা দেয়। অহনা তার থেকে কতটা সম্মান পায়? বাস্তবে জয় নারী স্বাধীনতায় কতটা বিশ্বাসী?

জয় প্রথমে পরিবারের কথাই বললেন, ‘‘একটা সময় প্রচুর ধারাবাহিক করতাম। তখন ছবির নামীদামি পরিচালকেরা ধারাবাহিক বানাতেন। যেই ‘শ্বাস-বহু’ মার্কা ধারাবাহিক এল তখনই সরে এলাম। স্বাধীন পরিচালকদের ছবিতে কাজ করতে শুরু করলাম। এই ধরনের ছবি থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বেশি আয় হত না। তখন কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে আমার স্ত্রী অনেক এগিয়ে। আমি কিন্তু হীনমন্যতায় ভুগতাম না। এটাই হওয়া দরকার। বিভিন্ন আঙ্গিক বা দৃষ্টিকোণ থেকে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতাই নারী-পুরুষকে সম্পর্কে বাঁধে।’’ আর পর্দায় অহনাকে স্বাধীনতা দেবেন কিনা বা দিলেও কতটা দেবেন— তাই নিয়েই এই ছবি।

মহিলা পরিচালক হলে পুরুষ অভিনেতার সুবিধা কী? জয়ের কথায়, ‘‘এক মহিলার দৃষ্টি দিয়ে প্রেম, জীবনকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। কারণ, সমাজে এবং পর্দায় আমরা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। মহিলার দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে থেকেও নতুন রং, নতুন মানে বের করে আনতে পারে।’’ এও জানালেন, কিছু মহিলার দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষালি। যাঁরা এরকম তাঁরাই অন্য নারীর উপরে অত্যাচার করেন। পরের শট রেডি। লিফটে জয়-সুদীপ্তার একান্ত দৃশ্যের কিছু মন্তাজ তোলা হবে। কিন্তু প্রথম দৃশ্য যে তখনও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে! ওই দৃশ্যের পরে জয়ের কি আর শীত করছিল? দুষ্টু প্রশ্নের ততধিক দুষ্টু উত্তর, ‘‘এমনিতেই এবারের কলকাতায় শীত নেই। তার উপরে বুকের উপরে সুদীপ্তা শুয়ে। বেশ গরম লাগছিল!’’ দাবি, অনেক বছর আগে সুদীপ্তার সঙ্গে একটি ছবি করেছিলেন। তারপর এটি। দুটোতেই তাঁদের সম্পর্কে জটিলতা। জয়ের রসিকতা, ‘‘এটা কেন যে আমাদের সঙ্গে ঘটে কে জানে! সমস্যা ছাড়া আমাদের মাখোমাখো রসায়ন কেউ দেখালই না।’’ জবাব শুনে বসার ঘরে বাকিদের দরাজ হাসি।

মন্তাজ শটের পরে দুর্দান্ত ঝগড়া নায়ক-নায়িকার। বিপরীতধর্মী শট। কিন্তু তাতেও দু’জনে ছন্দে বাঁধা। তিন বার শট নেওয়ার পরে সুদীপ্তার কফি ব্রেক। সেই অবসরে রেকর্ডারের মুখোমুখি ‘অহনা’...




পরিচালক মহিলা মানেই ‘বেয়ার বডি’র নায়কের সঙ্গে রোমান্স...
সুদীপ্তা সবার ওয়র্কশপ করান। তাঁর তো মহড়া দিতে লাগে না? সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ, ‘‘মোটেই না। খুব ভুল কথা। আমারও মহড়া লাগে। এই চরিত্রে অভিনয়ের আগে প্রায় একমাস ধরে প্রমিতার সঙ্গে আলোচনা করেছি। চরিত্র বোঝার জন্য। তারপরে নিজের মধ্যে অনুশীলন। তবে ক্যামেরার মুখোমুখি হয়েছি। চিত্রনাট্য এত খুঁটিয়ে পড়েছি যে মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। গড়গড়িয়ে বলতে পারব। নিজের বেলাতেও কোনও ফাঁকি মারি না।’’ শহরে, দেশে অনেক মহিলা লেখক। মহড়া দিতে গিয়ে নিশ্চয়ই কাউকে অনুসরণ করেছেন? এবারেও সপাট দাবি, একেবারেই না। তিনি চিত্রনাট্য পড়ে আর পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝেছেন সেটাই নিজের মতো করে উপস্থাপিত করছেন।

অভিনয় করতে গিয়ে মন হচ্ছে, একুশ শতকেও একটা পেশা পুরুষদের জন্য একরকম। নারীদের জন্য অন্যরকম? লং কার্ল করা চুল ঘাড়ের পিছনে সরিয়ে দিতে দিতে সুদীপ্তার মত, তিনি এই ধরনের পার্থক্যে মোটেই বিশ্বাসী নন। পেশায় মহিলা-পুরুষের ফারাক মানতে নারাজ। যে কেউ যে কোনও পেশায় কাজ করতে পারেন। যে যেভাবে পেশাকে নেবে বা দেখবে সেটা তার ক্ষেত্রে সেরকমই হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি তুলে ধরনের নিজের চরিত্রের কথা। বলেন, ‘‘লেখক অহনার কোনও সমস্যা নেই। তার সমস্যা ব্যক্তিজীবনে। যেটা ডাক্তার হলেও হতে পারে। ওর বরের শারীরিক সমস্যা আছে, ইগো আছে, ইর্ষা আছে।’’ তারপরেই হাসতে হাসতে যোগ, এই সমস্যা সাংবাদিক হলেও আসতে পারে।




অভিনয় করতে করতে সুদীপ্তা আরও অনুভব করেছেন, তিনি শহরের ক্রিম জায়গায় বসে যে সুবিধে পান, দূর-দূরান্তের মেয়েরা কিন্তু ততটাও পান না। এখনও নারীর সাফল্য মানেই তার নারীত্বের বাড়তি সুযোগ-সুবিধে। যার জোরে সে নাকি সব কিছু পায়। তার মধ্যেও বহু মেয়ে এগিয়ে আসছেন। তিলোত্তমা মজুমদার, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মল্লিকা সেনগুপ্ত-র মতো লেখক-সাহিত্যিকেরা আছেন। বলতে বলতেই পরের শটের জন্য ডাক। পরিচালক হাজির। তাঁকে দেখে কৌতূহলী প্রশ্ন, সুদীপ্তার মতো অভিনেত্রী বড় বড় পরিচালকদের পছন্দ। তিনি কেন প্রমিতার প্রথম বড় ছবিতে কাজ করতে রাজি হলেন? কফি মগে চুমুক দিতে দাবি, ‘‘আমার নতুনদের প্রতি দুর্বলতা আছে। ওটা খুব টাটকা ভাবনা ভাবতে পারেন। নতুন কিছু করতে পারেন। অসুবিধেও আছে। তাঁদের অর্থবল কম। টেকনিক্যালি হয়তো ততটাও পোক্ত নন। কিন্তু ওঁদের মধ্যে প্রমাণ করার তাগিদ খুব বেশি। এটা উপভোগ করি।’’ এবং মনে করিয়ে দিলেন, এর আগে প্রমিতার ছোট ছবিতে তিনি কাজ করেছেন। ফলে, তাঁরা একে অন্যকে বোঝেন। একই সঙ্গে চরিত্রটাও টেনেছে। উঠতে উঠতে জয়ের মতো তাঁরও দাবি, মহিলা পরিচালক অনেক বেশি সংবেদনশীল। তারপরেই চূড়ান্ত রসিকতা, ‘‘বেয়ার বডির হট নায়কের সঙ্গে রোমান্সের সুযোগ মেলে।’’

ঘরে আবার অট্টহাসি। ওপাশ থেকে জয়ের সংযোজন, ‘‘আমি সব বুঝতে পারছি। তখন তো জিজ্ঞেস করছিলে... শটটা আর কতক্ষণের?’’ 

নারীদের নিয়ে ছবি বানালে প্রযোজক মেলে না
শটের মধ্যেই আফসোস প্রমিতার। পরিচালক এর আগে দুটো ছোট ছবি বানিয়েছেন। দুটোই আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত। বড় ছবির ভাবনা অনেক দিনের। নিজের অর্থবল এবং কিছু সহযোগিতা জোগাড় করতে করতে করতেই সময় অনেকটা চলে গিয়েছে। অবশেষে স্বপ্ন সফল। তখনই জানিয়েছেন, এখনও কোনও মহিলা পরিচালক নারীদের নিয়ে ছবি বানালে প্রযোজকেরা টাকা দিতে রাজি হন না। কলকাতায় নারীদের নিয়ে কম গল্প বলা হয়। তাই ‘অহনা’ বানাচ্ছেন? প্রমিতার যুক্তি, ‘‘এই গল্প সবার। ছবিটা দেখলে বসলে, সবাই একাত্ম হতে পারবেন। এই গল্পও খুব জানা। যেখানে নারী উন্নতির পথে এগোলে পুরুষের অহং জেগে ওঠে।’’ আরও একটা ‘অভিমান’? একেবারেই না, জানালেন তিনি। এও আভাস দিলেন, ছবির শেষে ‘অহনা’ সমস্যাসঙ্কুল জীবন ইতিবাচক দিকে মোড় নেবে। সেটা ছবিতে দেখতে হবে। এই ছবিও দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানোর ব্যবস্থা করবেন প্রমিতা। তারপর মুক্তি। যুক্তি, এখনও আন্তর্জাতিক মঞ্চ বাংলা ছবি বলতে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনকে বোঝেন। এই প্রজন্মও যে কাজ করছে সেটা বোঝানোর জন্যও আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থিত থাকা দরকার। প্রমিতা তাই এমন গল্প বেছেছেন যেটা কলকাতা বা বাংলার নয়, ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবে। সারা দেশে এরকম অনেক ‘অহনা’ ছড়িয়ে রয়েছে।