রবিবার ২০ এপ্রিল ২০২৫
সম্পূর্ণ খবর

Riya Patra | ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৩ : ৩৯Riya Patra
বুড়োশিব দাশগুপ্ত
ট্রাম্পের নয়া শুল্কনীতি আপাতত তিন মাসের জন্য স্থগিত হয়ে গিয়েছে। বিশ্ব বাজার হঠাৎ টালামাটাল হওয়ায় শেয়ার বাজারে বড়সড় পতন হয়েছে, সম্ভবত সেই কারণেই ট্রাম্প কিছুটা পিছিয়েছেন। তবে উদ্বেগের মেঘ এখনও কাটেনি। যদিও এর পাশাপাশি ট্রাম্প যা করেছেন, তা নিয়ে ততটা আলোচনা হচ্ছে না, যতটা হচ্ছে শুল্কনীতি নিয়ে। নয়া ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার প্রভাব সম্ভবত একইভাবে সুদূরপ্রসারী। যে মহান আমেরিকার ধুয়ো তুলে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলেন, তার মূল স্তম্ভ, শিক্ষা ব্যবস্থাকেই টলিয়ে দিতে চলেছে তাঁর সরকারের এই সিদ্ধান্ত। তাঁর নিজের স্লোগান ‘Make America Great Again’ এই শিক্ষাব্যবস্থাকেই অবজ্ঞা করছে।
ট্রাম্পের আমেরিকা ইজরায়েলের প্রতি একচেটিয়া সমর্থন করলেও, মার্কিন জনগন বা সে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি মোটেও তা সমর্থন করছে না। বরং সেখানে আছে বিরুদ্ধস্বর। তাই প্যালেস্টাইনের পক্ষে কোনও প্রতিবাদ হলে তা কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে আমেরিকায়। ট্রাম্প প্রশাসন ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ (anti-semitism)-এর অজুহাতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প USAID-এর উপর নির্ভরশীল, যেটা ট্রাম্প 'অপচয়' বলে বন্ধ করে দিয়েছেন। একটি অনুমান অনুযায়ী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ফেডেরাল ফান্ডিং ও গবেষণা অনুদান বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ বিলিয়ন ডলার অনুদান আটকে গিয়েছে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই ৮০০ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছে USAID বাবদ! এ ছাড়া আরও ৪ বিলিয়ন ডলার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ মিলিয়ন ডলার ফেডারেল ফান্ড আটকানো হয়েছে। প্রিন্সটন হারিয়েছে ২১০ মিলিয়ন ডলার। আর এই তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্পষ্ট সংখ্যা না জানালেও, তাদের নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখা এবং গবেষণা কমিয়ে দেওয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, ফেডারেল ফান্ডে কাটছাঁট ব্যাপক ভাবে করা হচ্ছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH) তাদের নতুন নীতিতে ইনডায়রেক্ট কস্ট রিইমবার্সমেন্ট – যেমন ল্যাব রক্ষণাবেক্ষণ, পরিকাঠামোর খরচ ইত্যাদি ৭০% থেকে কমিয়ে ১৫% করেছে, যাতে বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সরকারি খরচ কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। USAID এবং NIH – দুই ক্ষেত্রেই কাটছাঁট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ফান্ডিং-এ মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এই ছাঁটাই মূলত সেই গবেষণা ফান্ডকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে, যেগুলি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মূলাধার–যেমন ইহুদিবিদ্বেষ তদন্ত বা DEI (diversity, equity, inclusion) সংক্রান্ত উদ্যোগ।
ট্রাম্প এমনকী শিক্ষা দপ্তর (Department of Education) ভেঙে দেওয়ার কথাও বলেছেন। যে দপ্তর ফেডেরাল স্টুডেন্ট এইড ও শিক্ষা ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার রক্ষার কাজ করে। তিনি একটি অনলাইন আমেরিকান অ্যাকাডেমির ধারণাও দিয়েছেন–যার বিস্তারিত এখনও অস্পষ্ট–তবে এটা আমেরিকার প্রচলিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সমগ্র একাডেমিক জগতে অনিশ্চয়তার আবহ ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু পুরনোপন্থী নেতৃত্ব এই পরিবর্তনকে সমর্থন জানাচ্ছেন, তাঁরা মনে করেন এতে একাডেমিয়ার আদর্শগত পক্ষপাত এবং বামঘেঁষা প্রবণতা দূর হতে পারে। ট্রাম্প সরকার মনে করে এতে ‘অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক খরচ’ কমানো যাবে ও অপচয় বন্ধ হবে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এই পদক্ষেপগুলি ট্রাম্পের একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থাকে ট্রাম্প নতুন ধারণায় গড়তে চাইছেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার গোঁড়া, একবগ্গা ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন করে তৈরি করতে চাইছেন শিক্ষা ব্যবস্থাকে। সরে আসতে চাইছেন বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিকরণ-এর মতো আন্তর্জাতিক শিক্ষানীতির ধারণা থেকে।
এই সংঘাত সম্ভবত আমেরিকান সমাজের পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নতুনভাবে খাপ খাওয়াতে বাধ্য করবে। বর্তমানে একাডেমিক জগতের অধিকাংশই মনে করছেন, বহু বছরের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে ওঠা এক কাঠামো আজ ভেঙে পড়ছে। একাডেমিক স্বাধীনতা হারিয়ে গিয়েছে। অনেক প্রবাসী ভারতীয় গবেষক, যাঁরা একসময় ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে বিজেপির ‘হস্তক্ষেপ’-কে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও এখন ট্রাম্পের কৌশলের মধ্যে নিজের দেশের এক অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। যদিও ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ভারতীয় সে দেশে পড়ুয়াদের ভর্তি ২৩% বেড়েছে, তবুও ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা, স্কলারশিপ কমে যাওয়া এবং ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল দমন – সবকিছু মিলিয়ে অনিশ্চয়তা বহুগুণে বেড়েছে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, আমেরিকায় অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক ছাত্রদের মধ্যে (ভারতীয়রাও-সহ), প্রায় ৪২% ছাত্র এখন আমেরিকায় পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন করে ভাবছে – এর পেছনে মূল কারণ ভিসা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক পরিবেশ। বিকল্প গন্তব্য হিসেবে ইউকে, জার্মানি বা সিঙ্গাপুর জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন কলম্বিয়া, চাপের মুখে পড়ে কিছু অনুদান ফিরিয়ে এনেছে। তবে বেশিরভাগ এখনও তা পারেনি। আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব উঠলেও, ভবিষ্যতে আইনি লড়াইয়ের ফল কী হতে পারে, সেই বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে তারা এখনও দ্বিধায় রয়েছে। তবে ট্রাম্পের শিক্ষা দফতর (Department of Education) ভেঙে দেওয়ার হুমকি কার্যকর করতে হলে কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে – যা সহজ নয়।
সব মিলিয়ে, আমেরিকা এখন এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে – এবং দুর্ভাগ্যবশত, তার অভিঘাত গোটা বিশ্বের উপর পড়ছে।