সোমবার ১৭ মার্চ ২০২৫
সম্পূর্ণ খবর
Riya Patra | ১৭ মার্চ ২০২৫ ১৪ : ১৩Riya Patra
গৌতম রায়
আর দশটা জায়গার দোল খেলা বা হোলি উৎসবের সঙ্গে কলকারখানাতে ঠাসা এলাকাগুলোতে এই উৎসবের রকম-সকম একটু ভিন্ন হয়। আসলে অর্থনৈতিক কারণে, পেটের টানে, রুটি রুজির টানে ,কলকারখানা নিবিড় এলাকাতে যে সমস্ত মানুষদের বসবাস প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে আসছে, তার আঙ্গিকে এসব এলাকাকে 'মিনি ভারত' বলতে পারা যায়। হুগলি নদীর দু'ধার ঘিরে হাওড়া থেকে কল্যাণী, বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত আমাদের এই বাংলায় মিনি ভারত দেখতে পাওয়া যায়।
তাই এখানে ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যের আঞ্চলিক সংস্কৃতির, বিশেষ করে লোকায়ত সংস্কৃতির নানা ধরনের উপস্থাপনা আমরা দেখতে পাই। সাধারণভাবে আমরা দোল উৎসব বা তার পরের দিনের হোলি-কে ঘিরে উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতি ঘিরে একটা ধ্যান ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠেছি। বলিউডের ফিল্মের দৌলতে উত্তর ভারতের হোলি-কে কেন্দ্র করে নানা ধরনের গান বা কিছুটা আচার-আচরণের সঙ্গে এখন আমরা বাঙালিরা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
যদিও সাম্প্রতিক অতীতে বসন্ত উৎসব এই নামের আড়ালে, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে যে ভাবে বসন্তের আবাহন করতেন, সেই আঙ্গিকটা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে একেবারে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত বাঙালি সংস্কৃতির এক নতুন ছন্দবদ্ধ ধারার মধ্যে দিয়ে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দোলযাত্রার দিন যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মব্যতিরেকে একেবারে সংস্কৃতি কেন্দ্রিক ঋতু আবাহন পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত হয়েছে, তা সত্যিই আজকের দিনের নানা ধরনের সংস্কৃতির সঙ্কটের প্রেক্ষিতে একটা নতুন জন সচেতনতার বার্তা দিচ্ছে ।
বহুকাল ধরে বাংলার দোলযাত্রা জনিত সংস্কৃতির মধ্যে হিন্দি সংস্কৃতির একটা চাপানউতোর চলত। চটকল অধ্যুষিত এলাকায়, মূলত চটকল বা তার আশেপাশের ছোট-ছোট শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত বিহার, উত্তরপ্রদেশের মানুষজনেরা হোলি উৎসব একটা আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে পালন করতেন। যাঁদের এই চটকল অধ্যুষিত এলাকাগুলি সম্পর্কে কিছু ধারনা আছে, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, হোলির বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এই বিহার, উত্তরপ্রদেশের মানুষজনেরা সন্ধেবেলায় তাঁদের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে, ঢোল-করতাল ইত্যাদি সহযোগে হোলির দিন তাঁরা যে সমস্ত হোলি কেন্দ্রিক আঞ্চলিক সংস্কৃতির গান গাইবেন, গভীর রাত পর্যন্ত তার মহলা দিতেন । বহু বাঙালি মানুষজন সেইসব মহলা শুনতে যেত। একটা সুন্দর সামাজিক সেতু এভাবে গড়ে উঠত।
হোলির দিন এখন যে রকম বসন্ত উৎসবকে ঘিরে নানা ধরনের নাচ-গান সহযোগে শোভাযাত্রা হয়, ঠিক সেভাবেই এই চটকল অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দিভাষী মানুষজন তাঁদের দোলখেলার সঙ্গে আঞ্চলিক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে, আঞ্চলিক গান সহযোগে আকাশটাকে একেবারে রাঙিয়ে দিতেন। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছুটা গোলা রং নিয়ে, হোলি খেলবার পর, তাঁরা কোনও একটা জায়গায় বসে, এই গানের আসর চালিয়ে যেতেন বহু সময় ধরে।
তখন কিন্তু কারুর গায়ে জোর করে রং দিয়ে দেওয়া যাতীয় কোনও জুলুমবাজি ছিল না। দু-একটা ছেলে ছোকরা, তারা কখনও কোনও দুষ্টুমি করলেও হিন্দিভাষী প্রবীণেরা তাদের দোল খেলবার যে আঙ্গিক, সেটাকে সীমাবদ্ধ রাখতেন নিজেদের মধ্যেই ।
আর অনেক অনেক আগে দেখতে পাওয়া যেত হিন্দিভাষীদের দোল খেলবার মধ্যে রং এর থেকে গোবর, কাদামাটি এইসবের ব্যবহার অনেক বেশি ছিল। এগুলির কারণ যে, শুধুমাত্র তাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতির কোনও টান, তেমনটা ধরে নেওয়ার কারণ নেই। কারণ, তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার যে করুণ দশা ছিল, সেখান থেকেই তাঁদের পক্ষে সব সময় রং ,আবির ইত্যাদি কিনে বাঙালিদের আদলে দোল খেলা এটা সম্ভব ছিল না।
তার সঙ্গে আর একটা জিনিস ছিল। হিন্দিভাষী মানুষজন এই হোলির দিন তাঁদের নিজের নিজের অর্থনৈতিক সাধ্য অনুযায়ী বাড়িতে ভাল-মন্দ রান্না করবার চেষ্টা করতেন। আর বহু ক্ষেত্রে এইসব ভাল-মন্দ রান্না, তাঁরা প্রতিবেশী বাঙালি বাড়িতেও দিতেন। আর এখানে একটা কথা বলতে হয়, হোলিকে কেন্দ্র করে কিন্তু বাঙালি হিন্দু বা অবাঙালি হিন্দিভাষী হিন্দু, কারওর মধ্যে নিরামিষ খাওয়া জনিত কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। বরঞ্চ বাঙালি, অবাঙালি নির্বিশেষে দোলযাত্রা বা হোলির দিন পকেটের পয়সা বাঁচিয়ে পাঁঠার মাংস কিনবে, খাবে, আনন্দ করবে-এটা যেন একটা প্রচলিত প্রথা ছিল।
এখন যেমন দোল বা হোলি মানেই বসন্তের বাতাস লাগান ফুরফুরে মেজাজের কথা লিখতে কবি-সাহিত্যিক সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনের বারোমাস্যায় কিন্তু সেভাবে দোল কখনোই আসে না। দোল মানেই দল বেঁধে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব দেখতে যাওয়া, দোল মানে মাটিতে থেবড়ে বসে, সেখানে পলাশের মালা বিক্রি করতে আসা গরিব কোনও সাঁওতালের সঙ্গে এক টাকা ,দু-টাকা নিয়ে দরকষাকষি করা, আবার পরের দিনই দ্বিগুন দামে কালোবাজার থেকে মদের বোতল সংগ্রহ করা-এই যে আদত, তার সঙ্গে কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষদের দোল বা হোলিকে কখনওই এক বন্ধনীতে ফেলতে পারা যায় না। খেটে খাওয়া মানুষরা ফাগুয়ার আসন্ন আগমন বার্তায় চেষ্টা করে দুটো পয়সা জমাতে। ফাগুয়ার দিন যদি মাংস নাও খাওয়া যায়, অন্তত ঠেকুয়া, পোয়া --এগুলো যাতে বানাতে পারা যায় ,বাঙালিরা যাকে পায়েস, পরমান্ন ইত্যাদি নানা ধরনের ঘরোয়া নামে, আবার পোশাকি নামেও সম্বোধিত করে, বিহার- উত্তরপ্রদেশের দেহাতি মানুষজনের কাছে সেটাই হল 'তস্মৈ', কেউ কেউ বলে ক্ষীরও। বাঙালি কনসেপশনের ক্ষীর সেটা নয়।
হিন্দু বাঙালির বাড়িতেও মঠ, ফুটকড়াই, মুড়কি কেনার হুড়াহুড়ি পড়ে যায়। বাঙালি ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য সচেতন হয়। তাই রঙিন মঠের কদর কমতে থাকে আজ থেকে ২০- ৩০ বছর আগের তুলনায়। তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়ে রঙিন মঠের মধ্যে থেকে বেছে বেছে সাদা মঠগুলো কেনার দিকে ঝোঁক বাড়ে। বাঙালির বাজারে এই চাহিদা দেখে মঠ তৈরি করা মানুষজনেরাও রঙিন মঠের থেকে সাদা চিনির মঠ, কোনওরকম রং না মিশিয়ে , বেশি বেশি করে বাজারজাতও করে। আবার কোনও কোনও পুরোনো শহরে ,সেখানকার ছোট ছোট হোম-মেড মিষ্টির দোকানে ,বিদায় নেবার কালে খেজুর গুড়ের একটা বেশি কদর শুরু হয়ে যায় এই দোলের সময়। খেজুর গুড়ের মঠ আর খেজুর গুড়ের মুড়কি তৈরিতে কেন্দ্র করে।
হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে এই বসন্তকালকে ঘিরে একটা দারুণ মেয়েলি ব্রত আছে । এখনও বাংলার গহীনে গেলে সেই ব্রত পালনকারী ছোট-ছোট মেয়েদের দেখতে পাওয়া যায়। ব্রতটিকে ঘিরে এইরকম কাহিনী প্রচলন রয়েছে , শ্যাম পন্ডিত নামক একজন মানুষ, তার সাত সাতটি বউ । এদেরকে ঘিরে ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন; "ছোট -বড়ো আরো-বড়ো একেবারে বুড়ো -- কচি মেয়েটি, কাঁচা বয়সের বউ বেটা, পাকা গিন্নি আর বিষম শুকনো কর্তা।"(বাংলার ব্রত- ক্ষিতিমোহন সেন, বিশ্বভারতী, পৃ-৩৭)
এই ব্রতকে ঘিরে প্রায় লুপ্তপ্রায় একটি লোকায়তর ছড়াও তিনি উদ্ধার করেছিলেন ছড়াটি এইরকম; "অশথপাতা কুঞ্জলতা চমকা সুন্দরী! গঙ্গাস্নান করতে গেলেন শ্যামপন্ডিতেরঝি; সাত বউ যায় সাত দোলায়, সাত বেটা যায় সাত ঘোড়ায় , কর্তা যান গজহস্তিতে, গিন্নি যান রত্নসিংহাসনে। ঠাকুর ঠাকুরণ দোলনে যান।"( ঐ)
ক্ষিতিমোহন সেনের গবেষণা থেকে জানা যায় একটা সময় এই দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রকৃতির নানা ধরনের অনুবর্তনকে একটা বিন্দুতে স্থাপন করে, মেয়েরা 'অশতপাতার ব্রত ' নামে একটি ব্রত পালন করতেন। এই ব্রতটিকে ঘিরে আবহাওয়ার অদলবদল এবং তার নিরিখে মানুষের অবস্থান আর গাছপালা কে ঘিরে নানা ধরনের রূপক তৈরি হত। এই ব্রতের সঙ্গে কোনও বৈদিক দেবতার এতটুকু সম্পর্ক ছিল না। ধর্মচারণের থেকে অনেক বেশি ছিল উৎসব পালনের আকর্ষণ। সেখানে চিত্রকলা, নানা ধরনের গান-বাজনা, নাট্যকলা, খানিকটা সু-সন্তান কামনার একটা যৌন আকুতি তার সংমিশ্রণ ছিল। যার সম্পর্কে ক্ষিতিমোহন বলেছিলেন; "মানুষের ইচ্ছাকে হাতের লেখায় গলার সুরে এবং নাট্য নৃত্য এমনি নানা চেষ্টায় প্রত্যক্ষ করে তুলে ধর্মাচারণ করছে, এই হল ব্রতের নিখুঁত চেহারা।" ( ঐ, পৃ-৩৮)
বিশ্ববিশ্রুত নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক নির্মল কুমার বসুও এই দোল উৎসব পালনের সঙ্গে ধর্মীয় আকুতির কোনও সম্পর্কের কথা স্বীকার করেননি । অতি প্রাচীনকালের একটা যৌন আকর্ষণের বিষয়টি তিনি এই উৎসবকে ঘিরে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।