বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
AM | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৭ : ০৮Rishi Sahu
বিশ্ব ভরা প্রাণ...
মৌ রায়চৌধুরীঃএবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল আমার কাছে বড় বিস্ময়। ফাইনাল ম্যাচের আগে কাতার যাচ্ছি ঠিক হল। ফাইনাল ডিসিশন হবার মাত্র চৌদ্দ ঘণ্টা পর ফ্লাইট। আর কাতারে পৌঁছে খেলা শুরু হবার ২২ ঘণ্টা আগে টিকিট কাটা। পুরোটাই আমার পুত্র ঋষির আবদার। যদিও আমার প্রাথমিক অনিহার কারণে সে আবদার আর আবদার থাকে না, জেদে পরিণত হয় শেষে। অতএব নাছোড় পুত্রের কাছে মায়ের 'না' আর ধোপে টিকলো না। আমি কাতারের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। আমার ঠাকুমা একটা কথা বলতেন, 'কপালে থাকলে লেখা, ভগবানও দেন দেখা'! সত্যিই তাই! অবশেষে ফাইনাল ম্যাচের দিন মাঠে পৌঁছে আমি তো অবাক। গ্যালারিতে বসে অসংখ্য মানুষ, আর তাদের ফুটবল উন্মাদনা। হ্যাঁ, সেই ফুটবল। 'সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল'! বাঙালি আমি একঝাঁক বিদেশীর মাঝে ফুটবল পুজোয় মাঠে নেমে গেছি। বিদেশী আবহেও আমার কানে যেন বাজছে, 'দ্যাখো রে নয়ন মেলে, জগতের বাহার।' চারিদিকে নীল-সাদা! জার্সির রঙ হলেও সেখানেও উপস্থিত আমার একটুকরো কলকাতা, 'নীল-সাদা'। 'মেসি-মেসি' গর্জন চারিদিকে। স্টেডিয়াম গমগম করছে। আমি প্রার্থনা করি মেসির হাতে যেন কাপ ওঠে। আসলে অসংখ্য মেসি-ভক্তের সে চিৎকার তো আমার সন্তানের অনুভূতিরই শরিক। মা হয়ে তাই এই 'প্রার্থনা-লোভ' আমি এড়াই কী ক'রে। আমি তো আমার ঋষির মেসিভক্তি, মেসিকে নিয়ে ওর তুমুল 'পাগলামি'র বিষয়ে জানি। তাই তো ফুটবল বিশেষজ্ঞদের ফ্রান্সকে ধারেভারে এগিয়ে রাখাকে আমল না দিয়ে আমি আর্জেন্টিনার হয়ে আমার প্রার্থনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ছেলের মুখে হাসি কে না দেখতে চায়, বলুন। ঋষি চায় জীবনের শেষ বিশ্বকাপে মেসি তাঁর দেশকে জিতিয়ে দিক। মেসির জিম্মায় তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারে প্রায় সব ট্রফিই রয়েছে, বিশ্বকাপ বাদে। আমিও তাই চাইছিলাম মেসি কাপ জিতুক। আমিও তাই ফ্রান্সের গ্যালারিতে বসে মনে মনে চেঁচিয়ে গেলাম, 'মেসি-মেসি' বলে। শেষ মুহূর্তে টিকিট কাটার কারণে আমাকে আলাদা বসতে হয়েছে। যে আমি সত্যম-ঋষি ছাড়া এক-পা এগোতে পারি না, সেই আমি কিনা প্রায় দৌড়ে ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে। জীবন বড় বিস্মিত করে মাঝেমধ্যে। অবাক লাগে, মানে ভালই লাগে। আসলে ওই যে বললাম, অপত্য স্নেহ। সেন্টিমেন্ট! তবে পরিস্থিতির কারণে 'শত্রুপক্ষ' ফ্রান্সের ডেরায় আমি একটুকরো 'আর্জেন্টিনা'! ভাবছি, গুচ্ছের লাল-সাদা-র মাঝে আমি একা নীল-সাদা! এ তো ভয়ানক 'খেলা হবে'। কাঁদো-কাঁদো অবস্থায় ঋষিকে ফোন ক'রে পরিস্থিতির কথা বললাম।'ঋষি আমি এখানে বসতে পারব না। এরা এখন থেকেই উৎসব শুরু ক'রে দিয়েছে। গান গাইছে। আমার খুব ভয় করছে।' শুনে ঋষি বললো, 'কোনো ভয় নেই। তুইও চিৎকার কর। গান গা। তুই একা লড়েই আর্জেন্টিনাকে জিতিয়ে দিবি। এ আমার বিশ্বাস।' ( প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার ছেলে আমাকে তুই সম্বোধন করে। কারণ আমরা খুব ভাল বন্ধু)। সত্যমের কাজ ছিল বলে আসতে পারেনি, তাই মনটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। তার ওপর এই পরিস্থিতি। ঈশ্বরের ওপর অভিমান হচ্ছিল। যাই হোক, বিশ্বকাপ-২০২২ এর ফাইনাল ম্যাচের অনুষ্ঠান শুরু হল। বিস্তর জাঁকজমক। দারুণ অনুষ্ঠান! তবুও প্রিয়জন পাশে না থাকায় আমার মনের অবস্থা খানিক ফিকেই ছিল।
সদলবলে মেসি প্রবেশ করলেন মাঠে। নায়কের প্রবেশে গ্যালারি জুড়ে আওয়াজ উঠলো 'মেসি-মেসি'! আমিও সেই আওয়াজে গলা মিলিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, মেসি-মেসি বলে। সঙ্গে শত্রুপক্ষ ফ্রান্সকে জানিয়ে দিলাম, আমি তোমাদের লোক নই মোটেও! আমার বাঁ-দিকে বসে থাকা ফ্রান্সের এক সমর্থক আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি হাসলেন। দেখে মনে হল বক্র হাসি। যেন ফ্রান্স জিতেই গ্যাছে। মনের জোর বাড়াতে সত্যমকে একটা মেসেজ করলাম। 'আমি তো একা। শত্রুপুরীতে বসেছি।' সঙ্গে সঙ্গে সত্যমের উত্তর, 'কিচ্ছু বলবে না। একদম চুপচাপ বসে খেলা দেখবে।'কারণ সত্যম জানে উত্তেজনায় আমি কী করতে পারি! আমি বসেছিলাম ফার্স্ট হাফে ফ্রান্সের গোলপোস্টের ঠিক পিছনে। ফলে খুবই কাছ থেকে খেলা দেখছিলাম। খেলা শুরু। সঙ্গে আমার টেনশন। আর সেই সঙ্গে দাঁত দিয়ে নখ কাটা। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, গোলপোস্টের খুব কাছে বল পায়ে মেসি! আহা! এত কাছ থেকে মেসিকে দেখছি!এ কি কম ঈশ্বর দর্শন বলুন? মেসির মত অনবদ্য এক ফুটবল-শিল্পীকে বল পায়ে এত কাছ থেকে দেখা! আমার চোখে জল চলে এল। তারপর এল সেই শট। মেসির পা থেকে দুর্দান্ত সেই গোল। আমার চারপাশে দেখলাম একটা বিস্তৃত মানুষের ঢেউ যেন হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। আর আমি আমার পায়ের ব্যথা, শরীরের ওজনকে এক লহমায় তোয়াক্কা না ক'রে মেসি বন্দনায় 'গোওওওওল' বলে চেঁচিয়ে উঠলাম, লাফিয়ে। আমার ঠিক সামনে বসা বছর ১০ এর এক খুদে ফ্রেঞ্চ আমার দিকে ছুঁড়ে মারলো এক হাওয়াই-ঘুষি । আমিও হাসি দিয়ে সেই মুষ্টি সামলালাম! তার আগে ঘটে গিয়েছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রথম গোলের পর লিওনেল ওপর দিকে তাকালেন। হয়ত স্বর্গীয় দিয়েগো মারাদোনাকে উৎসর্গ করলেন তাঁর এই গোল। কিন্তু আমার মনে হল যেন চোখাচোখি তো হল আমার সঙ্গে।
খেলা চলছে সমানতালে। বাড়ছে উত্তেজনা।আমিও গ্যালারিতে বসে দ্বিতীয় গোলের অপেক্ষায়।
দ্বিতীয় গোল হতেই পুরো স্টেডিয়ামের সঙ্গে আমিও লাফিয়ে উঠলাম। তবে আনন্দের চোটে লাফ মারার সময় নিজেকে সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমার পাশে বসা 'শত্রুপক্ষ' মিত্রের মত আমায় ধরে না ফেললে ব্যপক চোট অবধারিত ছিল! সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন মিত্র ছুটে এসে আমায় আশ্বাস দিয়ে গেলেন যে তারা আছেন! ভরসা দিলেন, আমিও আস্বস্ত হলাম। শত্রুপক্ষের এরকম মিত্রতা দেখে আমি খানিক লজ্জিতই হলাম বটে।
প্রথমার্ধ শেষ হল। আর আমার প্রার্থনার দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হল। ফ্রান্স যেন গোল শোধ করতে না পারে, ঠাকুর।পায়ে একটা ব্যথার কারণে আমি হ্যুইল চেয়ার সাপোর্ট নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আধিকারিকরা বারবার এসে আমার খোঁজ নিচ্ছিলেন। আমার সাহায্যার্থে তাঁদের এই 'খেয়াল রাখা' আমায় মুগ্ধ করে। এরমধ্যে দেখি সত্যমের মেসেজ, ' তোমায় টিভিতে দেখলাম। এত লাফাচ্ছো কেন?' আমি লিখলাম, 'মিথ্যা কথা, কী রঙের পোশাক পরে আছি বলো তো?' উত্তর আসলো, 'সবুজ না হলে ডার্ক ব্লু'। ঠিকই বলেছিল। কিন্তু লাফানোর পর কী অঘটন ঘটতে চলেছিল, সেটা আর বললাম না মানুষটাকে। এমনিতেই বড্ড টেনশন করে আমায় নিয়ে!
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হল। আমারও আশপাশের ফেঞ্চদের সঙ্গে কিঞ্চিৎ কথাবার্তা, আদানপ্রদান শুরু হয়ে গিয়েছে। তারপরই ঘটলো সেই অঘটন। পরপর দুটো গোল শোধ ক'রে ফ্রান্স সমতায় ফিরল। আর আমি ফিরে গেলাম আবারও সেই টেনশনে। নখ খাওয়া শুরু হয়ে গ্যালো। পুতুলের মত স্থির হয়ে বসে আমি একা আর্জেন্টাইন। আর আমার পাশে চলছে ফ্রেন্স সমর্থকদের উৎসব! আমি সেই 'একা কুম্ভ রক্ষা ক'রে নকল বুঁদিগড়'-এর দশায় তখন। আমার আরাধ্য মা দয়াময়ীর সঙ্গে চেঁচিয়ে শুরু করে দিলাম এক নীরব ঝগড়া। মনপ্রাণ দিয়ে মায়ের শরণ নিলাম। জিতিয়ে দাও মা আমার ঋষির আর্জেন্টিনাকে, জিতিয়ে দাও মা! আবার গোল, আর গোল শোধ। একস্ট্রা টাইম। টেনশনে আমার হাতের নখ সব শেষ। এবার শুরু হবে এক্সট্রাটাইম-এর খেলা। আমিও জীবনে একটা এক্সট্রা-টাইম পেলাম বলে মনে হচ্ছিল। এই বিপুল টেনশনেও আমার 'হার্ট অ্যাটাক' হয়নি দেখে বিশ্বস্ত হলাম। পরিসংখ্যান নাকি বলে, 'ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের হার্ট অ্যাটাক কম হয়'! প্রমাণ পেলাম আমি বেঁচে আছি দেখে। তবে শরীর আমার সায় দিচ্ছিলো না মোটেও। দরদর ক'রে ঘামছিলাম। অসম্ভব মাথাব্যথা করছিল। চোখ বন্ধ ক'রে বসেছিলাম। প্রার্থনা ছাড়া তখন কী আর করতে পারি? সময় তো আর বসে নেই। সেই সময়ের হাত ধরেই খেলা এগোলো। আর সময়মতো আর্জেন্টিনা ওরফে মেসি ইতিহাসের কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। আমার আশপাশে তখন একরাশ নিস্তব্ধতা আর স্টেডিয়ামের বাকি অংশে তখন প্রবল গর্জন। জয়োল্লাসের কোরাস। ইতিহাসের সাক্ষী থাকার সাক্ষাৎ মুহূর্ত। আমিও দুহাত তুলে চেঁচাচ্ছি আর চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছে। অবশ্যই আনন্দের, আরামের কান্না। হঠাৎ টের পেলাম আমার পাশ থেকে কেউ আমার হাতটা ধরলো। তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে। আমার ছেলের বয়সই। তারও চোখে জল, মুখে হাসি। সেও বসে হ্যুইল চেয়ারে। হাতে-পায়ে প্লাস্টার। জানতে পারলাম কাতারের বাদিন্দা। আর্জেন্টিনার সমর্থক। তাঁর গলায় ঝোলানো নীল-সাদা মাফলারটা নিয়ে আমার গলায় পরে গলার জোরে চেঁচাতে লাগলাম। আমাকে দেখে তাঁর সে কী হাসি। সঙ্গে চোখে জল। আনন্দের অশ্রু। সবার চোখে জল। কারোর আনন্দে, কারোর কষ্টে। আবারও ছোটবেলার সেই আপ্তবাক্য চাক্ষুষ টের পেলাম, 'জলের অপর নাম জীবন'! আসলে জীবনে কোথাকার জল যে কোথায় গড়ায় কে জানে! ওই যে বললাম, বিশ্বকাপ এবার আমার কাছে বিস্ময়ের! সামনে বসে থাকা সেই 'হাওয়াই-ঘুষি' ছোঁড়া একরত্তি বাচ্চাটা এখন রাগে সেই ঘুষি তার সামনের চেয়ারে অনবরত মারতে লাগলো। আমি চিৎকার করে ধমকের সুরেই ওকে আটকালাম। ব্যথা লাগবে তো হাতে! ওর দুঃখে আমারও মনটা কেমন খারাপ হল বটে। ছোট্ট ঋষির নানা মুহূর্তে চোখের সামনে খেলে গ্যালো! ও বেচারা আমার মত একজন আর্জেন্টাইন সাপোর্টারের দিকে তাকিয়ে আরও রেগে গ্যালো। ওর পাশে বসে থাকা মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে করুনভাবে হাসলেন। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো, 'সরি'। বুঝতে পারলাম ওঁর কষ্টটা। উনি আমার হাত চেপে ধরলেন। দুচোখে জল।ফ্রান্সের সমর্থক এক মহিলা এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন 'কনগ্রাচুলেশনস'! আরও অনেকে এসে হাত মেলালেন। মনে হচ্ছিলো আমিই বোধহয় মাঠে খেলে ম্যাচটা জেতালাম। যাদের শত্রুপক্ষ ভেবে এতক্ষণ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখে গেলাম। হেরে যাওয়ার পরেও তাঁদের এই সৌজন্যবোধ আমার মন জিতে নিলো। জীবনের গ্যালারিতে সৌজন্যের এই ছবিটা ভালবাসার ফ্রেমে আমি আজীবন বাঁধিয়ে রেখে দেবো।
মনে হচ্ছিল ফুটবল খেলাটা ঠিক নারকেলের মত, ওপরটা শক্ত আর ভিতরে ভালবাসার জলে ভরা। এত ভদ্র,মার্জিত মানুষজনদের দেখে অনেক কিছু শিখলাম। 'আজকাল' থেকে যখন আমার অভিজ্ঞতা লিখতে বলেছিলো তখন ভেবেছিলাম ফুটবলের আমি কিই বা বুঝি। দু দলের সব খেলোয়ারের নামও মনে নেই। নিয়ম কানুন অত জানি না, মারাদোনাকে দেখে ফুটবল খেলা কে ভালবাসা। কী লিখবো আমি? তারপর ভাবলাম এইসব লেখার জন্য তো অনেক অভিজ্ঞরা আছেন, আমার কলমের জোর হচ্ছে ভালবাসা। ছোটখাটো, সহজ সরল, অতি ভদ্র,
পরিবারকেন্দ্রিক এক মানুষের প্রতি সারা বিশ্বের ভালবাসা, ফুটবলের প্রতি তার ভালবাসা এই তো আমার লেখার রসদ
তাই কলম ধরলাম। যে ছেলেটি আমার হুইল চেয়ারের দায়িত্বে ছিল, আমার সঙ্গেই খেলা দেখলো সে, ফ্রান্সের হয়ে গলা ফাটিয়ে। কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার পর আবার সে আমার সেবায় নিমগ্ন। এতটুকুও যেন অসুবিধা না হয় সে খেয়াল রাখলো। ঋষি তো বলেই দিলো আমি এখন বেরোব না যতক্ষণ না মেসিরা বেরোচ্ছে। তাই ছেলেটিও আমায় নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। তারপর ঋষি এলো । আমার জীবনে দেখা ঋষির মুখের অন্যতম সেরা হাসি। আমি তৃপ্ত সেই হাসি দেখে। পরে জানতে পারলাম, মেসির আর্জেন্টিনা জেতার পর ঋষি নাকি মাটিতে বসে হাউহাউ করে কাঁদছিলো। আনন্দের কান্না। সে দৃশ্য না দেখার আফসোস থেকে গ্যালো বইকি। আরেকটা বিষয় বলি, এবার বিশ্বকাপ চলাকালীন সত্যম সবকটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগেই আশ্চর্য ভবিষ্যৎবাণী ক'রে খেলার স্কোর পর্যন্ত মিলিয়ে দিচ্ছিল। ফাইনাল ম্যাচের আগেও আমাকে আর ঋষিকে বারবার বলছিল যে ফ্রান্স জিতবে, ২-১ গোলে। আমাদের রাগ তো হচ্ছিলই, আবার ভয়ও পাচ্ছিলাম কারণ ওর মুখের কথা তো বেশিরভাগ সময় ফলে যায়। এবার ব্যতিক্রম হল। খেলা শেষের পর ঋষি মেসেজ করলো, 'আমরা তো জিতে গেলাম!' আমার সামনে বসা একজনকে অনুরোধ ক'রে ভিক্ট্রি সাইন দেখিয়ে আমি একটা ছবি তুলে সত্যমকে পাঠালাম। তারপর ফোন করে ফেললাম। ফোনের অপর প্রান্তে সত্যম হেসে আমায় বললো, 'ফাটিয়ে দিয়েছো!'
স্টেডিয়ামের বাইরে বেরিয়ে আরও বিস্ময়। রাস্তার ধারে হাজার হাজার লোক বসে। গান গাইছে, নাচছে, ড্রাম বাজাচ্ছে, সবাইকে জড়িয়ে ধরছে। আমাদের তখন আর হোটেলে ফিরতে ইচ্ছা করছেনা। আমিও রাস্তার ধারে বসে পড়লাম। ঋষি আর তার বন্ধুরা পাগলের মত আনন্দ করছে। সেই দেখতে দেখতে আমি ভাবলাম এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেন আমি মাঝে মাঝে মরে যেতে চাই। সামনে চোখ চলে গেল এক সুন্দর আলোকসজ্জার দিকে। বিশাল এক সান্টাবুড়ো ঝোলা নিয়ে। সবাই ছবি তুলছে তাঁর সামনে। হঠাৎ আমার মনে হলো আমি তো বড়দিনের উপহার এবার পেয়েই গেছি। যা দিয়েছে আমার সান্টা, 'মেসি আর ঋষি'। আমার জীবনে এর থেকে বড় দিন আর কিই বা হতে পারে। মারাদোনাকে ভালবেসেছিলাম সেই কিশোরী আমি। মারাদোনার সঙ্গে দেখা করিয়েছিলো সত্যম, কথা বলেছিলাম, ছবি তুলেছিলাম। সত্যমও মারাদোনা ,মেসির ফ্যান, আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। ও পাশে না থাকায় মনটা খারাপ হয়েছিলো। এমন দিন তো আর আসবে না। তাই সত্যম সঙ্গে না থাকাটা খুব খারাপ লাগছিলো। মাঝ বয়েসে এসে ভালবেসে ফেললাম মেসিকে। আর সে ভালবাসার জোরেই দেখে ফেললাম এই ঐতিহাসিক ফাইনাল ম্যাচ। সম্ভব হল ঋষির জন্য। আর ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান হলো, সেই স্বপ্নপূরণ করলো লিওনেক মেসি। ভাবছিলাম কত পূন্য করেছিলাম তাই আজ এই দিন দেখলাম। আবার বিশ্বকাপের খেলা দেখবো, আর্জেন্টিনার হয়ে গলা ফাটাবো। কিন্তু মেসি কে সেখানে দেখতে পাবো না সেটাই বড় দুঃখ।
এক ভদ্রলোক এসে আমায় বললেন তিনি নাকি আমার ফ্যান হয়ে গিয়েছেন। তিনি আর্জেন্টিনার কিন্তু ব্যবসার কাজে লন্ডনে প্রায়ই থাকেন। আমাকে দেখে ওনার মনে হয়েছে আমি ইন্ডিয়ান। আমার এই অবস্থায় অত দুর থেকে কষ্ট করে এসেছি শুধু মেসির খেলা দেখতে,আরজেন্টিনাকে সাপোর্ট করতে, তাতে তিনি মুগ্ধ। আমিও বিগলিত তাঁর কথা শুনে। খুশি হয়ে অপটু হাতে একটা সেলফি নিলাম। আমার ডানদিকে বসা ভদ্রলোক ফ্রান্স গোল করায় খুব লাফালাফি আর চিৎকার করছিলেন, আমি তাকাতেই বললেন “সরি” । আমি তো অবাক। আর এক আরজেন্টাইন এসে হাত মিলিয়ে গেলেন, তার নাম 'আলভারেজ'। ফ্রান্স থেকে আসা দুই বান্ধবী আমায় 'কনগ্র্যাচুলেশনস' জানিয়ে বললেন, 'আজ আমরা খুব ভাল খেললেও, আজ তোমাদের দিন ছিল। তাই প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ করো।' মেয়ে দুটির বয়েস হয়ত তিরিশের ঘরে। আমি ওদের জড়িয়ে ধরলাম। এ আমি কাদের শত্রু ভেবেছিলাম! নিজেকে ধিক্কার জানালাম। আমার আরজেন্টিনার ভালবাসায় তীব্রতা ছিলো, ওদের ভালবাসা ছিল শান্ত।মাঠে খেলার লড়াইয়ে ওরা হেরে গিয়েছে, কিন্তু সৌজন্যবোধ আর ব্যবহারে ওরা জিতে গ্যালো। শত্রু শিবিরে না বসলে এই অভিজ্ঞতা হত না আমার। মেসির কথা আর একটু না লিখলে এই লেখা অপূর্ণ রয়ে যাবে।কবে থেকে মেসির খেলা দেখতে শুরু করেছি মনে নেই। তবে ওই সরল শিশুসুলভ মুখটা হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল। মারাদোনা ফুটবলের ঈশ্বর হয়েও জীবন যাপনে বোহিওমান ছিলেন। অনেক অনিয়মের মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। তবু তিনি তো মারাদোনা, তাঁকে না ভালোবেসে উপায় নেই। তাই মারাদোনার জন্য পাগল ছিলাম। মেসির ব্যাপার একেবারে অন্য। আদ্যোপান্ত এক ভাল মানুষ। এই বয়েসে এমন সংযম দেখা যায়না। সমস্ত খারাপ হাতছানিকে হেলায় দুরে সরিয়ে দিয়েছেন। জীবনে তাঁর দুটি দিক। একদিকে ফুটবল আর এক দিকে স্ত্রী আর দেবশিশুর মত তিন সন্তান। তাঁর খেলার প্রতি অধ্যাবসায়, সততা, দৃঢ়তা অতুলনীয়। তিনি যখন বল পায়ে নিয়ে বিপক্ষ শিবিরের খেলোয়ারদের কাটিয়ে এদিক ওদিক করে ছুটে যান, আমার মনে হয় দক্ষ হাতে পিয়ানোতে কেউ সুর তুলছেন। মেসির পায়ের জাদুতে এই রুক্ষ ফুটবল খেলা আমার কানে সুরের ঝংকার তোলে। জীবনের শেষলগ্নে এসে এই কাপ জয় তার প্রাপ্য ছিল। তাই ভগবানও নিরাশ করেন নি। এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতেও জিতে গেল মেসি। মেসির আর্জেন্টিনা। আমাদের আর্জেন্টিনা।