শুক্রবার ১৭ জানুয়ারী ২০২৫
সম্পূর্ণ খবর
UB | ১৭ জানুয়ারী ২০২৫ ১৫ : ১৪Uddalak Bhattacharya
গৌতম রায়
বাবা আর তাঁর এক বন্ধু ,সহযোদ্ধা বিশেষ কোনও কাজে চলেছেন বাসে। পিতৃবন্ধুর কোলে ছোট্ট মেয়েটি। এ কালে যেমন হয়, ঠিক তেমনই সেকালেও , বাসে ভিড় থাকলে, বাচ্চা কোলে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে, বসে থাকা যাত্রীরা হয় জায়গা ছেড়ে দেন। নতুবা বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে নেন।
সেদিনও তেমনটাই হয়েছিল। হঠাৎই হাওয়া ব্রেক মেরেছে বাসের ড্রাইভার। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটি বাবার নাটকের সংলাপ একেবারে চেঁচিয়ে বলে উঠল; 'আরে রোক্কে রোক্কে কনডাকটার।মানুষ খুন করবেন নাকি মোশায়!'
ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে মজা করে শাঁওলী মিত্র বলতেন; গোটা বাসের লোকজনই বোধহয় ভেবেছিল, এ কাদের বাড়ির প্রোডাক্ট রে বাবা! শাঁওলীর বাবা শম্ভু মিত্রের সঙ্গে সেদিন ছিলেন বহুরূপীরই মহঃ জাকারিয়া। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের নতুন ভোরের দুই ফেরেশতা। তার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'বহুরূপী'। কলিম শরাফি যাঁর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার ও আগে শম্ভু মিত্র স্টেজ করেছেন রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী'। সেখানে তিনি তাঁর জর্জদা , দেবব্রত বিশ্বাসকে 'বিশু পাগলে'-এর চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। বিশু পাগলের পোষাকে ছিল শার্ট - প্যান্ট। সেকালের রবীন্দ্র ভক্তেরা তো 'যায় যায়' জুড়ে দিলেন। সেকালের সঙ্গীত সমিতির কর্তা ব্যক্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র(নজরুল গীতি গায়ক ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্রের সহোদর) একেবারে ফতোয়া জারি করেন আর কী। বিচারপতি মাসুদের হস্তক্ষেপে সেবার রক্ষা পেলেন শম্ভু মিত্র।
বিজন ভট্টাটার্যের 'নবান্ন' যখন প্রথম মঞ্চস্থ হল, শাঁওলীর, কলিমকাকাকে (কলিম শরাফি) দিয়ে চেরাগ (প্রদীপ) হাতে মুশকিল আসানের নৃত্যসহ গান অভিনীত করালেন শাঁওলীর পিতা। ১১-এ নাসিরুদ্দিন রোড, পার্ক সার্কাসের যে বাসায় শাঁওলীর শৈশব আর প্রথম কৈশোর কেটেছিল, সে বাসাও ভাড়া নেওয়া হয়েছিল তাঁর কলিমকাকার নামেই।
শাঁওলী তাঁর পারিবারিক মন্ডলের বাইরে কখনও তাঁর কলিমকাকাকে ভাবতেই পারেননি। আর কলিম শরাফির কাছে শম্ভু মিত্র ছিলেন 'মেজদা'। নিজের পরিবারের মেজভাই ছিলেন 'শম্ভু'। তাই পরিবারের সকলেরই 'মেজদা'। কলিমেরও ' মেজদা'। আর তৃপ্তি মিত্র, তাঁর 'বৌদি'। আমরা যাঁরা কলিম শরাফির জ্যোতির্ময় আলোকে বেড়ে উঠেছি, আমাদের কাছেও তাই শম্ভু মিত্র চিরদিনই 'মেজদা', আর তৃপ্তি মিত্র 'বৌদি'। সেই ধারার অনুবর্তিকায় শাঁওলী মিত্র ছিলেন আমাদের কাছে পরম আদরের, শ্রদ্ধার , ভালবাসার 'দিদি', শাঁওলীদি। তিনি যখন ঢাকায় গিয়েছেন তাঁর কলিমকাকার বাড়িতে, সেই আনন্দোচ্ছ্বল দিনগুলো চোখের সামনে ভাসে।
'দ্রুপননন্দিনী সে যে রাজার দুলালী, যজ্ঞের অগ্নি থেকে আবির্ভূতা নারী/যজ্ঞসেনী নাম তার নাম তার'.....নয়ের দশকের হেন কোনও বাঙালি নেই, যিনি শাঁওলী মিত্রের ইরাবতীদিদির (কার্বের) এই মঞ্চভাষ্যের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নেননি। শাঁওলী মিত্রের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের এই ফর্মের সঙ্গে একটা অদ্ভূত সেতুবন্ধন যেন তৈরি হয়েছিল অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ের তিজন বাঈয়ের। তিজনের নাম বা কাজের সঙ্গে তখন কলকাতার বিশেষ একটা পরিচয় হয়ে ওঠে নি। সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে এক-আধটা অনুষ্ঠান অবশ্য তিজন করেছেন।
শাঁওলী তাঁর মহাভারত ঘিরে 'নাথবতী অনাথবৎ'-এ ছত্তিশগড়ের লোকনাট্যের আঙ্গিককে এক অদ্ভূত সমসাময়িকতার অভিশ্রুতিতে মেলে ধরলেন। বাংলা থিয়েটারের দুনিয়াতে এক ব্যতিক্রমী ধারার সংযোগ হল। মহাকাব্যের দৃষ্টান্তকে আধুনিক সময়ের নানা অন্যায়ের প্রেক্ষিতে কিছু না বলেও এই নাটকে যা বললেন শাঁওলী মিত্র তা যে বাংলা থিয়েটারের দুনিয়া আগে আর দেখেনি। কলকাতায় এই থিয়েটারের শো, আর একদম দর্শক আসনের শেষের সারিতে বসে আছেন শম্ভু মিত্র , তখন তিনি চোখে খুব কম দেখেন- এ দৃশ্য দেখা ছিল যেন একটা ভাগ্যের বিষয়।
থিয়েটার দেখা ঘিরে চোখের দৃষ্টি প্রখর থাকাকালীন বা কমে আসার পর, সব সময়েই পিছনের সারির প্রতি শম্ভু মিত্রের একটা বিশেষ ভাললাগা ছিল। বিশেষ করে সাউন্ড এফেক্ট বোঝার ক্ষেত্রে এই পিছনের সারিতে বসার উপরে তিনি খুব জোর দিতেন। শম্ভু মিত্র নিজে গান জানতেন না , কিন্তু গান শোনার কান ছিল তাঁর অতি উচ্চমানের। শাঁওলী বেশ কিছুকাল গান শিখেছিলেন তাঁর জর্জ মামার (দেবব্রত বিশ্বাস) কাছে। অসাধারণ সুরেলা কন্ঠ ছিল তাঁর। নাথবতী এবং কথা অমৃতসমানের সব সুরারোপ তাঁর নিজের। কিন্তু সুরোরোপনকে একদম পারফেক্ট করতে বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর পিতার।
সুরযোজনা করে শাঁওলী শোনাতেন বাবাকে। কোনও কোনও জায়গা বারবার গাইতে বলতেন শম্ভুবাবু। তারপর হয়ত বলতেন; এই জায়গার সুরটা একটু খাদে করো তো। বা এই সুরটা একটু উঁচুতে বেঁধে দেখো তো। তিনি যে ভাবে নির্দেশ নয়, উপদেশ দিতেন, শাঁওলী দেখতেন , সেভাবে সুরটা করলেই বেশি শ্রুতি মধুর হচ্ছে। তাই শেষ পর্যন্ত পিতার অনুধ্যানের জায়গাটাকেই স্থায়ী রূপ দিতেন শাঁওলী।
এপিক ধর্মী দুটি নাটকের পর যে নাটকটির মধ্যে দিয়ে সকলের কাছে নিজেকে আবার একটা নতুন ফর্মে শাঁওলী মিত্র মেলে ধরেছিলেন, সেই নাটকটি হল, সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায়ের লেখা,'বিতত বিতংস'। এই নাটকটির শুরুটা দর্শকদের যেন একটা স্মৃতির কোলাজে এনে দাঁড় করাতো। নাটকটির একদম সূচনায় একটা চেয়ারে বসে সামনের টেবিলে রাখা টেলিফোনে কথা বলছেন শাঁওলী।
এই দৃশ্যপট সহজেই দর্শককে নিয়ে চলে যেতো 'আরদ্ধ'-র ', 'অপরাজিতা'-এর তৃপ্তি মিত্রতে। যাঁদের সুযোগ ঘটেছিল 'অপরাজিতা' দেখবার, 'বিতত বিতংস'-এর প্রথম দৃশ্য যেন চমকে দিত তাঁদের। শাঁওলীর 'মণি'-ই কী ফিরে এসেছেন? আসলে 'অপরাজিতা' সৃষ্টি এবং অভিনয়ের কালে সমকালীনতার মধ্যে চিরকালীনতাকে যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তৃপ্তি মিত্র, ঠিক যেন সেভাবেই সমকালকে ভাবী কালের কষ্টিপাথরে এই 'বিতত বিতংস' উপস্থাপিত করেছিলেন শাঁওলী। এই নাটকটা অন্নদাশঙাকর রায়ের এতটাই ভাল লেগেছিল যে, তিনি তিনবার অ্যাকাদেমিতে নাটকটা দেখেছিলেন।
প্রথমবার এই বিতত বিতংস নাটকটি দেখবার পর অন্নদাশঙ্কর সাজকক্ষের শাঁওলীকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন; বিতত বিতংস শব্দটির অর্থ কি?
অসাধারণ ভাবে তাঁকে বিস্তৃত ফাঁদ বা ছড়ানো ফাঁদ ,বিতর্ক-বিতাংশ শব্দের এই আভিধানিক অর্থের সঙ্গে এই নাটকটি এবং সমকালের যে যোগসূত্র তার ব্যাখ্যা ফুটিয়ে তোলেন শাঁওলী অন্নদাশঙ্করের কাছে ।সেই ব্যাখ্যা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর। সেইবার সাজকক্ষে পঞ্চম বৈদিকের সেই সময়ের প্রায় সকলের সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের গ্রুপ ছবি তুলতে একবারে শিশুর মত মেতে উঠে ছিলেন শাঁওলী।
যখনই এই নাটকটি মঞ্চস্থ হত, অন্নদাশঙ্করকে বললেই উনি দেখবার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। শাঁওলীকে বললেই তিনি কাউন্টারে টিকিট রেখে দিতেন। আর এই টিকিট নেওয়া নিয়ে অন্নদাশঙ্কর আর শাঁওলীর মধ্যে দারুণ মজার একটা ব্যাপার হত। শাঁওলী কিছুতেই তাঁর পিতৃসম অন্নদাশঙ্করের কাছ থেকে টিকিটের দাম নেবেন না। আবার অন্নদাশঙ্কর ও তাঁর কন্যাসম শাঁওলীকে টিকিটের দাম না দিয়ে নাটক দেখবেন না।
অন্নদাশঙ্কর শেষে বলেন; আমি যাব তোমার বাড়িতে। পেটপুরে খেয়ে আসব। কিন্তু টিকিটের দাম তোমাকে নিতেই হবে। কারণ, এভাবে দানছত্র করলে গ্রুপ থিয়েটার টিকে থাকবে না। শেষ পর্যন্ত অন্নদাশঙ্করের যুক্তি মেনে নিতেন শাঁওলী মিত্র। পরবর্তীকালে অগ্নিমন্থ নামে সুপ্রীতির লেখা যে নাটকটি শাঁওলী মিত্র মঞ্চস্থ করেছিলেন, সেটিও বেশ কয়েকবার অন্নদাশঙ্কর দেখেন।
আসলে শাঁওলির অভিনয়ের যে অনবদ্য ধারা, যার মধ্যে ঘরোয়া ভাব এবং আভিজাত্যের এক অদ্ভুত সম্মেলন ছিল, অন্নদাশঙ্কর ছিলেন তার অত্যন্ত অনুরাগী। অন্নদাশঙ্কর বলতেন; মায়ের ভাবধারা তোমার মধ্যে আছে এ কথা ঠিকই। কিন্তু সেই ভাবধারায় তোমার যে নিজস্ব সংযোজন, আজ তোমার মা বেঁচে থাকলে তা দেখতে পেলে অত্যন্ত খুশি হতেন।
এটাই বোধহয় শিল্পী শাঁওলী মিত্র সম্পর্কে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি মূল্যায়ন। বাবা-মায়ের প্রতিচ্ছবি অবলম্বন করেই ধনুকে যেন নতুন করে জ্যা রচনা করেছিলেন শাঁওলী মিত্র।