বৃহস্পতিবার ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
সম্পূর্ণ খবর
UB | ১৬ জানুয়ারী ২০২৫ ১৩ : ১৫Uddalak Bhattacharya
গৌতম রায়
মহাশ্বেতা দেবী বাঙালি নারীর বিশ শতক কেন্দ্রিক আত্মসমীক্ষার এক আবাসভূমি। বিশ শতকের বাঙালি নারীর মেরুদন্ডকে স্বাধিকারের লক্ষ্যে স্থিত করবার ক্ষেত্রে যে সমস্ত মানুষেরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, মহাশ্বেতা তাঁদের মধ্যে বিশেষ রকম উল্লেখযোগ্য। একাধারে অধ্যাপিকা, লেখিকা। শুধু সমাজসেবী বা সমাজকর্মী পরিচয়ে তাঁর কথা সম্পূর্ণ হয় না। তাঁকে বলতে হয় বিশ শতকের মধ্যভাগের বাঙালি মননের এক বিশিষ্ট সংস্কারক। হাজি মহম্মদ মহসিন, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মীর মোশারফ হোসেন, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুফিয়া কামাল, গৌরী আইয়ব-প্রমুখেরা যে কেন্দ্রীকতার উপর ভিত্তি করে নারীর জন্য এক সম্পূর্ণ আকাশের প্রচেষ্টাতে জীবনপাত করেছিলেন, সেই ধারার এক অগ্রবর্তী সৈনিক ছিলেন মহাশ্বেতা। তাঁর পিতৃকুলের প্রায় সকলেরই মতো দেশভাগ একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তাঁর মনে। ভারেঙ্গা, নতুন ভারেঙ্গা, যমুনা নদী-সহ গোটা পাবনা জেলা, মহাশ্বেতার হৃদয়ের অন্তস্থলে একটা গোপন ভালবাসার মতো চিরদিন থেকে গিয়েছে।
আবার সেই ভালবাসার আঙ্গিক তাঁর 'ছোটকা' ঋত্বিক কুমার ঘটকের মতো কেবলমাত্র একটা সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রিকতায় কখনও আবদ্ধ থাকেনি। প্রথম জীবনের গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের কালে প্রগতিশীল বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ। এই সমস্ত পর্যায়ের বিষয়গুলি লেখিকা তাঁর লেখকসত্তা এবং মননলোকের উদ্বোধনে বিশেষ রকম সাহায্য করেছিল। তাঁর পিতৃদেব মনীষ কুমার ঘটক,যাঁকে তিনি ভালবেসে,'তুতুল ' বলে ডাকতেই বেশি অভ্যস্ত ছিলেন। পিতৃদেবের লেখায় যে একটা সমকালীনতাকে অতিক্রম করে বিকল্পধারার ইঙ্গিত ছিল, যা আমরা পাই, মনীষ ঘটকের 'পটলডাঙ্গার পাঁচালী'-র মধ্যে দিয়ে, সেই ধারাটিতে নিজের লেখক সত্তাকে বিকশিত করবার ক্ষেত্রে মহাশ্বেতা বিশেষ রকমের গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। 'পটলডাঙার পাঁচালী'-এই আখ্যান ছিল কলকাতা মহানগরীর বুকে অপরাধ জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজনদের যাপনচিত্রের এক অনবদ্য কাহিনি। যুবনাশ্বের এই লেখার আগে এই ধরনের বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যে সেভাবে চর্চা হয়নি বলা যেতে পারে।
সেই ধারাটিই আমরা বিশেষভাবে দেখতে পেলাম মহাশ্বেতা দেবীর 'ঝাঁসীর রাণী'-এর মধ্যে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের(১৮৫৭) চরিত্রগুলিকে ঘিরে মহাশ্বেতার এই অনবদ্য আখ্যান রচনার আগে বেশ কিছু লেখা বাংলা ভাষায় হয়েছিল। কিন্তু সেই সমস্ত লেখাই ছিল প্রকৃত ইতিহাসের বাইরে গিয়ে, নানা ধরনের আবেগের সমন্বয়। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের 'বহ্নিবন্যা' ইত্যাদি উপন্যাসের ভেতরে আমরা দেখতে পাই, কাহিনিক্রমের বিস্তারের ক্ষেত্রে সঠিক ইতিহাসের জায়গা থেকে সরে গিয়ে, লেখকেরা এমন কিছু আখ্যানের উপস্থাপন সেখানে ঘটিয়েছেন, যার মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য অপেক্ষা, সংঘাতের পরিবেশ পরিস্থিতি যেন প্রকট হয়ে উঠেছে।
মহাশ্বেতা দেবীর ঝাঁসীর রাণী উপন্যাস এক্ষেত্রে এক বিরল ব্যতিক্রম। মহাশ্বেতা, এই উপন্যাসে কখনই প্রকৃত ইতিহাস থেকে সরে আসেননি। কাহিনির উপাদান হিসেবে তিনি ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের অনেক বইপত্র ব্যবহার করেছেন। দলিল দস্তাবেজ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ইউরোপীয় ঐতিহাসিকেরা যেভাবে রানি লক্ষ্মী বাইয়ের স্বদেশপ্রেমকে খাটো করে দেখাবার অগ্রধিকার দিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লিপ্ত থেকে ছিলেন, সেই জায়গাটাকে অতিক্রম করে, প্রকৃত ইতিহাসকে উপন্যাসের একটা পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে তুলে এনেছিলেন মহাশ্বেতা। তাঁর প্রথম এই উপন্যাসটি থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, নিছক সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি কলম ধরেননি। সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে সমাজ সচেতনতা এবং জনজাগরণের কাজটিকে একটা অতি প্রয়োজনীয় মানবিক দায়িত্ব বলে যে মহাশ্বেতা উপলব্ধি করেছিলেন, সেটা তাঁর এই প্রথম উপন্যাসই প্রমাণ রাখে।
মহাশ্বেতা দেবী যেভাবে কথাসাহিত্য সৃষ্টির সঙ্গে প্রায় পাল্লা দিয়ে সমাজের নিপীড়িত, অবহেলিত অংশের মানুষদের জন্য সার্বিকভাবে নিজেকে ব্রতী করেছিলেন, এমন দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রায় নেইই বলে যেতে পারে। একাধারে সাহিত্য সৃষ্টি অপরদিকে সমাজসেবা এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য বিশেষভাবে নিজেকে ব্রতী রাখা, মহাশ্বেতার এই ত্রিভৃত ধারার সঙ্গে বাংলা কথাসাহিত্যে তুলনা চলে হাতেগোনা একজন দু'জন ব্যক্তিত্বের। যাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য না হলেন বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, গৌরী আইয়ুবেরা। তবে একইসঙ্গে সমাজসেবার সঙ্গে প্রায় পাল্লা দিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করা, এমন দৃষ্টান্ত বোধহয় মহাশ্বেতা ছাড়া আর কারওর নেই।
পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত রাজনয়াগড় অঞ্চলে গিয়ে মহাশ্বেতা দেবী যে ভাবে তাঁর জীবনের শেষ পর্বে একটা সুদীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছিলেন, তা গোটা বাঙালি সমাজের কাছে একটা বিশেষ রকমের গর্বের বিষয়। শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতজনেরা সে ভাবে কোনওদিনই খুব একটা পরিচিত ছিলেন না এই অংশের মানুষদের যাপনচিত্রের সঙ্গে। এঁদের জীবন ছিল দুর্বিসহ ক্লেশে ভরা। প্রথাগত শিক্ষার কোনও আলো তো এই খেড়িয়া শবরদের মধ্যে ছিলই না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে যতদিন না পর্যন্ত মহাশ্বেতা দেবী তাঁদের নিয়ে কাজকর্ম শুরু করেন, এই খেড়িয়া শহরদের অপরাধপ্রবণ হিসেবেই চিহ্নিত করা প্রশাসনের একটা চলতি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে এই খেড়িয়া শবরদের অর্থনীতির মূলধারায় আনার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে, তাঁদের হাতে কলমে কাজ শিখিয়ে, তাঁদের তৈরি নানা ধরনের জিনিসপত্র কার্যত নিজের হাতে ফেরি করেন মহাশ্বেতা দেবী।
স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে রেণুকা রায়,সাধনা ভট্টাচার্য, অশোকা গুপ্তা , লাবণ্যপ্রভা দাশগুপ্ত, জুলেখা রুখসানা, ফুলরেণু গুহর -মতো বহু মানুষ আন্তরিকভাবে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কিন্তু মহাশ্বেতা দেবীর কাজের জায়গাটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রশাসনিক স্তরে একটা বড় অংশের লোক কোনওদিন, বিনা অপরাধে যে সমস্ত মানুষ জেলের নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে, তাঁদের নিয়ে সেভাবে ভাবনা চিন্তা করেনি। রাজনৈতিক স্তরেও এটা যেমন হয়নি,সামাজিক স্তরেও সেটা হয়নি। অথচ কোনও ধরনের অপরাধমূলক কাজ না করে একটা বড় অংশের মানুষ তাঁদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির জন্য বা মানসিক অসুস্থতার কারণে দিনের পর দিন কারাগারের অন্ধকারে থেকে গিয়েছেন। আইনের ভাষায় এঁদেরকে বলা হতো,'নন ক্রিমিনাল লুনাটিক'। এই 'এনসিএল '-পর্যায়ের মানুষদের, বিশেষ করে মেয়েদের, জেল থেকে মুক্ত করা এবং তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য মহাশ্বেতা দেবীর আগে এপার বাংলায় কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা কোনও সামাজিক ব্যক্তিত্ব এতটুকু উদ্যোগ গ্রহণ করেনি । এনসিএল মেয়েদের অন্ধকারের আবর্ত থেকে দিনের খোলা হওয়ার সামনে উপস্থাপিত করবার কৃতিত্বের প্রথম এবং প্রধান অধিকারী হলেন মহাশ্বেতা দেবী।
শাসকের চোখ রাঙানিকে কোনদিনও ভয় পাননি মহাশ্বেতা দেবী। ন্যায়ের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোসহীন। অন্যায়ের সঙ্গে কোনওদিন কোনও রকম বন্দোবস্তি, এটা ছিল তাঁর চরিত্র বিরোধী। তাই সেকালের শাসক শিবিরেরও বহু মানুষ, যাঁরা নানা রকম ভাবে ন্যায় পাওয়ার জায়গা থেকে বঞ্চিত, তাঁরাও অকপটে মহাশ্বেতা দেবীর কাছে নিজেদের যন্ত্রণা জানাতেন। সেকালের শাসকদের সঙ্গে সেসব নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী, রীতিমতো যুদ্ধং দেহি মানসিকতায়, অথচ যুক্তিনিষ্ঠভাবে লড়াইয়ে ব্রতী হতেন। বাম আমলের শেষের দিকে জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য অনৈতিকভাবে জমি-অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে তৎকালীন শাসকের চোখরাঙানির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে তিনি আগাগোড়া সরব ছিলেন। প্রথম সারিতে থেকে সরকারের একাধিক গা-জোয়ারির বিরোধিতা করে কার্যত বিরুদ্ধতার স্বর তৈরি করেছিলেন। নব প্রজন্মের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতেন পশ্চিমবঙ্গে উত্তাল গণআন্দোলনের মুহূর্তে।
তার অভিজ্ঞতা মহাশ্বেতাকে তাঁর সৃষ্টির কাজে অনেক ঋদ্ধ করেছিল। ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকে সাতের দশকের মধ্যবর্তী সময়কাল পর্যন্ত যে বামপন্থী রাজনৈতিক ধারা প্রবাহ এবং নানা ধরনের সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত, তার সঙ্গে মহাশ্বেতা অনেকাংশে সংযুক্ত ছিলেন। তাঁর একটা বড় অংশের লেখালেখির মধ্যে এই সময়ের প্রেক্ষিত নানা আঙ্গিকে উঠে এসেছে। সেই আঙ্গিককে কেবলমাত্র কাগজ-কলম-নিউজপ্রিন্টে প্রকাশ করে নিজের দায়িত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে বলে মহাশ্বেতা দেবী কখনও মনে করতেন না। অত্যাচারিত মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায়,সুবিচার পায়, তার জন্য তিনি লড়াইয়ের শেষ স্তর পর্যন্ত যেতেন। সেই কারণেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তিনি সেই বয়সেও হেঁটেছেন মিছিলেন। বারংবার বার্তা দিয়েছেন লড়াইয়ের। রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির ক্ষেত্রেও তৎকালীন বাম সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে তিনি স্বর চড়িয়েছেন বারংবার। এই লড়াইয়ের মানসিকতাই ছিল তাঁর সব থেকে বড় মানবিক বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের ভেতর দিয়েই একাধারে লেখিকা,আরেকদিকে সমাজ সংস্কারক হিসেবে মহাশ্বেতা দেবী নিজের কাজের মধ্যেই নিজেকে অমর করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন জীবিত অবস্থাতেই।