বুধবার ০৮ জানুয়ারী ২০২৫

সম্পূর্ণ খবর

উত্তর সম্পাদকীয় | ইউরোপ এবং সমকালীন বিশ্ব: পর্ব এক

Kaushik Roy | ০৭ জানুয়ারী ২০২৫ ১৪ : ১২Kaushik Roy


সুরজিৎ সি মুখার্জি

 

এই লেখা ইউরোপ নিয়ে চার পর্বের একটি সিরিজের প্রথম অংশ। কিন্তু কেন এই লেখার প্রস্তাবনা? কারণ, একাধিক ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে এখনও ভারতীয় উপমহাদেশের জনমানসে ইউরোপ নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। সেই কারণেই এখানে পাশ্চাত্যের রাজনীতি, অর্থনীতি,সংস্কৃতি এবং সমকালীন বিশ্বে মহাদেশের ভূমিকা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা চমকপ্রদ হবে। এ ছাড়া, ভারতের ইউরোপের প্রতি এই অমোঘ আগ্রহের কারণও এখানে আলোচিত হবে।

 

আমাদের উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন সম্ভবত ভারতের ইউরোপ প্রেমের অন্যতম কারণ। ঐতিহাসিক এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা, অর্থাৎ ভারতবাসীরা খুব কাছ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতায় পূর্ণ এই মহাদেশ এবং তার সংস্কৃতি, বাণিজ্য, শাসনব্যবস্থা, সামরিক কৌশল এমনই নানান দিক সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভারতের সঙ্গে ইউরোপের একাধিক দেশের এই অঙ্গাঙ্গী ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও আমাদের জনগণের একটি বড় অংশের কাছে এই মহাদেশ ও তার মানুষ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান এখনও অস্পষ্ট। আমরা যা জানি, তার বেশিরভাগই প্রাচীন, একইরকম ও অনেকাংশে ভুল উপস্থাপনা, বলা চলে, এক জটিল সমাজ কাঠামোকে অতিরিক্ত সরলীকরণের চেহারায় দেখা।

 

আমাদের কাছে ইউরোপ বলতে দু'রকম ধারণা সামনে আসে। একটি, একটি ভৌগলিক-রাজনৈতিক পরিচয় ও একটি কল্পনা বা ধারণা। আমাদের ধারণা আসলে ইউরোপীয়দের নিজেদের ধারণারই প্রতিচ্ছবি। কারণ, আমরা যেভাবে সেখানকার সাহিত্যকর্ম ও গবেষণাকর্মে ইউরোপকে দেখেছি, সেভাবেই তা আমাদের কাছে এসেছে। এমন উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। তবে আমি মনে করি, ইউরোপ সম্পর্কে আরও বড় একটি জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে উঠেছে তাঁদের দ্বারা, যাঁরা বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির পদানত ছিলেন। আমরা যারা ইউরোপের অধীনে থেকেছি, তারা একধরনের পশ্চিম বা "অক্সিডেন্ট" তৈরি করেছি, যেমন ইউরোপ একসময় "ওরিয়েন্ট" বা পূর্ব সৃষ্টি করেছিল। ধারণাগত ইউরোপ সেই স্থানে অবস্থান করে, যেখানে অক্সিডেন্ট এবং ওরিয়েন্ট একে অপরকে অতিক্রম করে, যা আমাদের কল্পনার একটি চলমান ক্যালিব্রেশন এবং পুনঃক্যালিব্রেশনের ফল।

 

ইউরোপ শব্দটির উৎস বিভিন্ন। এর মধ্যে দু'টি উল্লেখযোগ্য – একটি গ্রিক এবং অন্যটি মেসোপটেমীয়। প্রাচীন গ্রিক পুরাণ এবং ভাষার বিশেষজ্ঞরা বলেন যে এই শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ 'eurys' (অর্থাৎ "প্রশস্ত") এবং 'ops' (অর্থাৎ "মুখ" বা "চোখ") থেকে হয়েছে, যা গ্রিক নাবিকদের জাহাজ থেকে দেখা ইউরোপের প্রশস্ত তটরেখার এক যথাযথ বর্ণনা। অন্যদিকে, মেসোপটেমীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষকরা আকাড্ডিয় শব্দ 'erebu' (অর্থাৎ "সূর্যাস্ত")-এর দিকে নির্দেশ করা হয়। মেসোপটেমিয়া থেকে পশ্চিমে সূর্য যেখানে অস্ত যায়, সেই দিকেই ইউরোপের অবস্থান। মেসোপটেমিয়ার দিক থেকে এশিয়া থেকে সূর্যের উদয় হয় আর সেটি অস্ত যায় ইউরোপের দিকে।

 

তবে ইউরোপ নামকরণের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যা এসেছে গ্রিক পুরাণ থেকে। বলা হয়, ইউরোপা নামে এক ফিনিশিয়ান রাজকুমারীকে গ্রিক দেবতা জিউস অপহরণ করে ক্রিট দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই কিংবদন্তি অনুযায়ী মহাদেশটির নামকরণ তার নাম অনুসারে হয়েছে। যাই হোক, আমাদের জনমানসের কল্পনায় ইউরোপ কেন্দ্রীভূত মূলত ইউরোপীয়দের ক্ষমতাবলে অর্জিত বিভিন্ন সাফল্যের ভিত্তিতে। সেই তালিকায় মূলত আসে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপন, জনগণকে পেশিবলে দমন করা ও বিশ্বে নিজেদের উপনিবেশকে ছড়িয়ে দেওয়া।

 

প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকায় একটি দেশের উপর উপনিবেশ স্থাপন না করা পর্যন্ত শান্তি পেত না। এই অঞ্চলগুলি আসলে ইউরোপীয় অর্থনীতিকে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি, সামরিক ও শিল্প ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের একটি ধারণা তৈরি করেছে, যা দ্রুত সংস্কৃতি, নৈতিকতা, নীতিশাস্ত্র এবং বিজ্ঞান বিষয়ক বিষয়েও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের কল্পনায় ইউরোপ আসলে এমন একটি অংশ, যা শ্রেষ্ঠ মানবসভ্যতার মাপকাঠি। কিন্তু আখেরে, সেটি অন্য সমস্ত সাংস্কৃতিক,  রাজনৈতিক ও মানব সম্পদকে অস্বীকার করার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেবল ইউরোপকে শ্রেষ্ঠ মানতে শিখিয়েছে, অন্য সবাইকে অস্বীকার করে।

 

যা প্রায়শই অদেখা থেকে যায়, তা হল যে সমস্ত ইউরোপীয় শক্তি দীর্ঘদিন ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে দেনা-পাওনার হিসাব মিটিয়েছে এবং দখলদারির এলাকা বাড়িয়েছে। কথায়-কথায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, মানবিকতার তোয়াক্কা না করে পেশীশক্তির প্রদর্শন করার পাশাপাশি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ইউরোপ। কিন্তু যুদ্ধবাজরা এমন সংস্কৃতি ও সভ্য হয়? ঠিক, এমন প্রশ্নই ইউরোপের চরিত্র আরও জটিল করেছে।  ফলে এর, সাধারণীকরণ এককথায় অসম্ভব।

 

সবশেষে, হয়ত আমাদের ইউরোপকে মনে রাখা উচিত সেই মহান রাজনৈতিক ধারণা এবং কর্মকাণ্ডগুলির জন্য, যা বিপ্লবের সূচনা করেছিল এবং বিশ্বজুড়ে যাদের উপর অত্যাচার এবং শোষণ করা হয়েছে আশা ও মুক্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। সমস্ত ইতিহাস মহৎ অর্জন, উদ্ভাবনী ধারণা, আশা এবং মুক্তির গল্প, তেমনি দারুণ নিষ্ঠুরতা, অহংকার এবং অজ্ঞতার গল্প। ইউরোপ আমার কাছে এর চেয়ে ভিন্ন নয় এবং পরবর্তী লেখাগুলিতে এই বিষয়গুলি অন্বেষণ করব যাতে সমকালীন ইউরোপের একটি সমগ্র চিত্র পাওয়া যায়। একটি আন্তঃসম্পর্কিত বিশ্বে, যেখানে পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা বেশি, ইউরোপ সম্পর্কে জানা মানে নিজেদের সম্পর্কে জানার একটি পথ।

 

সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ সোশ্যাল সায়েন্সের ডিন, উল্লিখিত মতামত ব্যক্তিগত।


#International News#Europe Situation#Post Editorial



বিশেষ খবর

নানান খবর

নানান খবর



সোশ্যাল মিডিয়া



01 25