রবিবার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সম্পূর্ণ খবর

উত্তর সম্পাদকীয় | কে মারছে, কাকে মারছে! গণপিটুনির হিস্টিরিয়ায় গরিব মানুষকে লেলিয়ে দিচ্ছে কারা? পক্ষ নিন পাঠক

AM | | Editor: Arijit Mondal ১৮ জুলাই ২০২৪ ১৭ : ১৭Arijit Mondal


শুভ্রদীপ্ত ভট্টাচার্য

মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে কোনও না কোনও অভিযোগ তুলে, আইন-কানুন নিজের হাতে তুলে,মানুষকে হত্যা করা, সভ্যতার এই ভয়াবহ কলঙ্কজনক ব্যপ্তি আমাদের পশ্চিমবঙ্গকে বিগত কয়েকদিন ধরে যেভাবে আকীর্ণ করছে, তা একইসঙ্গে আতঙ্ক এবং যন্ত্রণার একটা পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সাল থেকে গোটা উত্তর ভারত, পশ্চিম ভারত জুড়ে নানা রকম ধর্মীয় জিগির তুলে, মানুষের দ্বারা মানুষ হত্যার নারকীয় ঘটনাবলী আমরা দেখেছি।

কার বাড়ির ফ্রিজে কিসের মাংস রয়েছে ,এই অভিযোগ তুলে দাদরি শেখ আখলাখকে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনা আমরা দেখেছি। উত্তরপ্রদেশের কৈলানা গ্রাম, ভারতীয় মার্গ সংগীতের দুনিয়ায় বিশেষ স্থান অর্জনকারী একটি জায়গা। সেখানেও আমরা দেখেছি গণপিটুনি, গণধোলাই ধর্মের আবরণে কি নারকীয় বীভৎসতা তৈরি করেছিল।

রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গায় এই নানা অছিলায় ধর্ম এবং সামাজিকতার দোহাই দিয়ে মানুষের দ্বারা মানুষকে খুন করার ঘটনা দেখেই চলেছি আমরা। সেই আটের দশকে দেওরালা গ্রামের রূপ কানোয়ারকে সতী বলে হত্যা করবার ঘটনার একটা নেতিবাচক পরম্পরা চলেই আসছে। এমনকী আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ এইসব জায়গাতেও ধর্মের দোহাই দিয়ে গণপিটুনিতে মানুষকে হত্যা করবার অভিযোগ সেই সময় সামাজিক (বিজেপির একক ক্ষমতায় সরকার পরিচালনার কালে) এবং রাজনৈতিক আবর্তকে দীর্ণ করেছিল।

পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের পরে, শহর কলকাতা থেকে শুরু করে সংলগ্ন এলাকা গুলি এবং মফস্বলের বিভিন্ন শহর, গ্রামে যে ভাবে গণপিটুনিতে মানুষের দ্বারা মানুষের হত্যাকান্ড ঘটছে, তা দেখে আমাদের শিউরে উঠতে হচ্ছে । মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে জিঘাংসা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, অপছন্দের কোনও লোককে, নানা ধরনের অপবাদ দিয়ে, তাকে সামাজিক হেনস্থা করা-- এটা একটা প্রায় সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যাধি যে আজ হঠাৎ করে নতুন ভাবে গজিয়ে উঠেছে, তা মনে করবার কোনও কারণ নেই। এই ব্যাধি ভারতের বুকে তথা বাংলার বুকে দীর্ঘদিন ধরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে। একটা সময় ছিল, এই ধরনের ব্যক্তিগত ক্রোধ মানুষ ব্যবহার করত মামলা মকদ্দমা করে ,অপছন্দের মানুষটিকে সামাজিকভাবে হেনস্থা করবার জন্য । ক্রমে ক্রমে সেই বিষয়টির সঙ্গে সংযুক্ত হতে শুরু করল রাজনীতির নাম করে এক ধরনের ব্যক্তিগত অসূয়ার পরিমন্ডল। শাসন ক্ষমতায় যখন যে রাজনীতিকরা থেকেছেন, সেই পরিমণ্ডলের মানুষেরা , চিরদিনই সামাজিকভাবে কিছু বেশি সুযোগ-সুবিধে আদায় করে নেন। আর এই সুযোগ-সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়গুলি ক্রমশ ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার নিরিখে এসে থেমে যায়।

তাই একজন শাসক সমর্থক, তার যদি পাশের বাড়ির সঙ্গে কোনও বিসংবাদ থাকে , তা সেটা জমিজমা সংক্রান্তই হোক বা অন্য কোনো কারণে, যেমন; নিছক একটা নারকেল গাছ, কি আম গাছকে নিয়েই হোক, তাহলে যে ক্ষমতাবান, সে ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়ে, প্রতিবেশীকে শায়েস্তা করে। এই ট্র্যাডিশন বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে কী ভাবে রয়েছে তা রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র ,বিভূতিভূষণ ,তারাশঙ্কর, মানিক হয়ে সমরেশ বসুর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই । সেদিনের সেই অপরাধী মনস্তত্ত্বের মধ্যে অপরের ক্ষতিকরর মানসিকতা ষোল আনা ছিল। কিন্তু যেটা ছিল না, সেটা হচ্ছে; অপছন্দের লোককে প্রাণে মেরে ফেলবার এই গণহিস্টিরিয়া।

এই গণপিটুনির সেকাল-কাল, এটাও সমাজতত্ত্বের আলোচনার একটা বিষয় হয়ে উঠছে ক্রমশ। স্বাধীনতার আগে বা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ,কোথাও যে গণপিটুনিতে মানুষ মারা হয়নি, এমনটা নয়। কিন্তু সেদিনের ধারা আর আজকে গণপিটুনির সঙ্গে রাজনীতির নাম করে, ধর্মীয় অসূয়াকে সংযুক্ত করে দেওয়া, রাজনৈতিক বিদ্বেষকে সংযুক্ত করে দেওয়া-- এই দুইয়ের মধ্যে যে চরিত্রগত ফারাক, তাতেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, জাতীয়- আন্তর্জাতিক স্তরে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো যেভাবে গোটা মানব সমাজকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে, তার একটা অবশ্যম্ভভাবী প্রভাব সাধারণ মানুষের উপরে খুব বেশি ভাবে পড়তে শুরু করেছে ।
সার্বিক শিক্ষার অনুগ্রসরতা এমন একটা জায়গায় আজ গোটা ভারত জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে , যার জেরে সাধারণ মানুষ , যার মধ্যে হয়তো কখনো হিংসার বিষয়টি জোরদার ছিল না, সেও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে, নিজের মন, মানসিকতাকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছুতেই নিজের বশে রাখতে পারছে না। অর্থনৈতিক সংকট মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তকে এমন একটা জায়গায় ক্রমশ এনে ফেলছে, যার ফলশ্রুতি হিসেবে মানুষ কিছুতেই নিজের মনুষ্যত্বের ধ্যান ধারণার মধ্যে আটকে থাকতে পারছে না। তার আচার-আচরণ, তার যাপন চিত্র, তার অঙ্গভঙ্গি সবকিছু যেন একটা মনুষ্যেতর হয়ে উঠছে।
ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মানুষের জীবন জৈবিকতার কেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বাঙালির বৈশিষ্ট্যের কিছুটা ফারাক আছে। বাঙালি খুব কোমল হৃদয়ের মানুষ। বাঙালি অহেতুক বিবাদ -বিসংবাদের মধ্যে যায় না। সাংস্কৃতিক রুচিতে বাঙালি কেবলমাত্র গোটা ভারতেই নয় ,দক্ষিণ এশিয়ায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে । রাজনৈতিক এবং ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তবে সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হল বাঙালি। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের বাঙালির যে সার্বিক বৈশিষ্ট্য, সময়ের গতিতে সেই বৈশিষ্ট্য সংস্কৃতিক, সামাজিক আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে এই পারের বাঙালির মধ্যেও অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছে।
 
জলবায়ু কেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য দুপারের বাঙালিকেই একটা কোমল স্বভাবের মধ্যে উপস্থাপিত করতে পেরেছে। এই সবগুলির ভিত্তিতে বলতে হয়, অহেতুক হিংসাকে সমাজ জীবনে প্রয়োগ ঘটাতে , বাঙালি কখনই সেভাবে উৎসাহী ছিল না। বরঞ্চ হিংসা নিরশনে বাঙালির ভূমিকা, জাতীয় আন্দোলনের সময়কালেই হোক বা স্বাধীন ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক টানাপোড়নের মধ্যেই হোক, একটা বিশিষ্ট স্থান অর্জন করতে সম্ভব হয়েছে করেছিল।

সেই বাংলায় সেই বাঙালির মধ্যে যখন আমরা দেখি এই ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে, যে পরিস্থিতিতে ছেলেধরা থেকে শুরু করে, চুরি থেকে শুরু করে, নানা ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, আর সেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ফলশ্রুতি হিসেবে, একজন বা একাধিক মানুষ, অভিযুক্তকে মারধর করছে। এমনকি মেরে ফেলছে। তখন আমাদের শিউরে উঠতে হয়।
 যদিও শিউরে ওঠার আরও অনেকটাই বাকি থাকে। আমরা যখন দেখি, এই গণধোলাই দেখছে একদল মানুষ। নীরবভাবে দেখছে। কোন প্রতিবাদ করছে না। উপভোগ করছে। সেই গণধোলাইয়ের ভিডিও নিজের নিজের মোবাইলে তুলছে। সেটা সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তখন এটাই কেবল মনে হয়, মানব মনস্তত্ত্বের কতখানি অবনমন হলে, মানুষের দ্বারা এই ধরনের একটা পরিস্থিতির বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব হয়।

হিংসার সঙ্গে রাজনীতি এবং দারিদ্র্যের একটা সম্পর্ক আছে। রাজনীতিকে যারা বিকৃতভাবে প্রয়োগ করতে চান, তাদের কাছে হিংসা হল একটা বড় অস্ত্র । আর এই অস্ত্র প্রয়োগ করতে তারা ব্যবহার করেন সেই সমস্ত মানুষকে , যারা দু'বেলা দু'মুঠো পেটে দিতে, নিজেদের বুদ্ধি- বিবেককে বাধ্য হন কুলুঙ্গিতেতে তুলে রাখতে । কোনও মানুষ জন্ম থেকে হিংস্র হয় না। জিন বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলবেন, মানুষের মধ্যে যে অংশের ভিতরে হিংস্র প্রবণতা অত্যাধিক, এ দের মধ্যে পূর্বপুরুষের হিংস্রতার একটা জিনগত ধারাবাহিকতা থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়, রাজনীতির বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা, তা সেটা রাষ্ট্র ক্ষমতায় হোক, আঞ্চলিক ক্ষমতায় হোক, পাড়াগত ক্ষমতাই হোক, কোনও দলীয় বৃত্তের মধ্যেই হোক, ক্লাবগত ক্ষেত্রেই হোক --মানুষের দারিদ্র্যকে ব্যবহার করে হিংসাকে সমাজের বুকে প্রয়োগের জন্য ।
একজন গরিব মানুষকে খুব সহজেই তাতিয়ে দেওয়া যায় ,আরেকটি লোকের প্রতি হিংস্র হয়ে উঠবার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায়, যে মানুষটিকে তাতিয়ে দেওয়া হল অপর একজনের প্রতি হিংস্র আচরণ করবার লক্ষ্যে, সেই দু'জন মানুষের মধ্যে কিন্তু শ্রেণিগত অবস্থান অভিন্ন থাকে। তবুও শ্রেণির সচেতনতার অভাব থেকেই একদল মানুষের মুখোশ পড়া বন্যপশু, গরীব মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে হিংসাকে ফলপ্রসূ করে তোলার লক্ষ্যে ।

পশ্চিমবঙ্গে এই যে একের পর এক গণধোলাই, গণপিটুনি ইত্যাদি ঘটনাগুলি ঘটছে তার মধ্যে যেমন রাজনীতির প্রভাব আছে, ঠিক তেমনিই রয়েছে ভয়াবহ দারিদ্র। বেকারি। কর্মসংস্থানের অভাবের বিষয়গুলিও এগুলিকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতার মিশেল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নাগরিক সমাজের সমবেত হিংসাকে প্রতিবাদের যে বিষয়টিকে এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে বা একটু কটাক্ষ করা হয়েছে, এক্ষেত্রে একটা কথা খুব জোরে সঙ্গে বলতে হয়; সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে শাসকবিরোধী শক্তি, যখন প্রতিবাদের সামিল হয়, তখন তাদের উপরে রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্র প্রয়োগ করবার প্রবণতা এই মুহূর্তে তীব্র হয়ে উঠছে ।

এটা কাউকে কোনও রাজনৈতিক সুযোগ এনে দিতে পারে। কিন্তু এই প্রবণতা আগামী দিনে যে কোনও শাসকের পক্ষেই মারাত্মক হতে বাধ্য। অ্যালেন অক্টোভিয়ান হিউম সেই সময়ে (১৮৮৫) ভারতবাসীর মধ্যে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রবণতা দেখেছিলেন, সেই প্রবণতাকে তার মনে হয়েছিল, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম অর্থাৎ; ১৮৫৭ সময়কালের মতো একটা উপক্রম। তাই তিনি কংগ্রেসের পালক পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রভুদের পরামর্শে ।

শাসক যদি বিরোধী প্রতিবাদের পরিসরটুকু বরদাস্ত করতে না পারে, তাহলে সেটা আগামী দিনে কখনই সেফটি ভাল্বের মতো শাসককে কোনওরকম সুবিধে দেবে না। তার পাশাপাশি এই ভাবে মানুষ, আইনকে যে হাতে তুলে নিচ্ছে, আর ক্রমশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেই গোটা পরিক্রমার মধ্যে একটা শাসক সংযোগের বিষয় উঠে আসছে, গোটা ব্যাপারটা যদি এখনই দৃঢ় হাতে মোকাবিলা করতে না পারা যায়, তাহলে আগামী দিনে এটা শুধুমাত্র রাজনীতিকদের জন্য নয় , গোটা সমাজ ব্যবস্থার পক্ষেই একটা বড় রকমের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।


#postedit#aajkaalonline#aajkaal



বিশেষ খবর

নানান খবর

সংগ্রহ করুন... #aajkaalonline #pujovibes #durgapuja #DurgaPuja2024

নানান খবর



রবিবার অনলাইন

সোশ্যাল মিডিয়া



07 24