বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
AM | | Editor: Arijit Mondal ০৮ জুলাই ২০২৪ ১৪ : ২৮Arijit Mondal
রাজনীতির বাইরে ব্যক্তি জ্যোতি বসু
গৌতম রায়
রাজনীতির বাইরে আসলে ব্যক্তিগত পরিসর বলে জ্যোতি বসুর জীবনে কিছু ছিল না। নিজের ব্যক্তি জীবনকেও তিনি রাজনীতির আঙ্গিকে দেখতে এবং পরিচালিত করতেই সব সময় ভালোবাসতেন। একান্ত পরিবারের মানুষজনেরা বা জয়কৃষ্ণ ঘোষের পরিবার-এসব ক্ষেত্রে কখনও সখনও নিজের ব্যক্তিত্বের যে সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য , রাজনৈতিক আঙ্গিক, সেখান থেকে একটু আধটু বের হতেন জ্যোতি বাবু। তবে একমাত্র তাঁকে আবরণহীন নির্মল বন্ধুত্ব নিয়ে মিশতে দেখা গিয়েছিল বন্ধু স্নেহাংশুকান্ত আচার্যের সঙ্গে।
স্নেহাংশুবাবুকে কখনও তাঁর পোষাকি নাম ধরে জ্যোতিবাবু ডাকতেন না। ডাকতেন, ‘দোদো’ বলে। তবে জ্যোতিবাবুকে কখনও তাঁর একান্ত পারিবারিক পরিমন্ডলের বাইরে, তাঁর ডাকনাম, ‘গণা’ বলে কেউ ডাকতেন না।
দোদোবাবুর সঙ্গে জ্যোতিবাবুর অন্তরঙ্গতার ঝলক দেখার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেছেন, রাজনীতিক জ্যোতিবাবু, আর বন্ধু জ্যোতি বাবু, দু’ জন একেবারে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। অনেকেই বলে থাকেন, জ্যোতিবাবু নাকি কখনও হাসতেন না। জ্যোতিবাবুর অন্তরঙ্গ পরিমণ্ডলে যাঁদের প্রবেশের সুযোগ ঘটেনি, তাঁদের কাছে জ্যোতি বাবু সম্পর্কে এরকম ধারণাটা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু দোদো বাবুর কন্যা অধ্যাপিকা বিজয়া গোস্বামীর স্মৃতিতে এখনও প্রজ্জ্বল হয়ে আছে, তাঁর বাবার সঙ্গে জ্যোতিবাবুর অন্তরঙ্গ আড্ডার নানা বিষয়ে এবং জ্যোতিবাবুর প্রাণ খোলা হাসি।
জ্যোতিবাবুর প্রবল ব্যক্তিত্বকে অনেকে তাঁর উন্নাসিকতা বলে মনে করতেন। কিন্তু যাঁদের জ্যোতিবাবুর কাছে আসার সুযোগ ঘটেছিল, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, বাইরের শক্ত আবরণ ভেদ করে, যদি জ্যোতি বাবুকে স্পর্শ করতে পারা যেত, তাহলে দেখতে পাওয়া যেত এক আদ্যন্ত স্নেহশীল মানুষকে। রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে এমন বহু মানুষ ছিলেন, যাঁদের জ্যোতিবাবু চিরদিন ডাকনামে ডাকতেন। এমন একজন মানুষ হিসেবে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পুত্রের কথা। হীরেন বাবুর পুত্রকে, জ্যোতিবাবু চিরদিন তাঁর ডাকনাম ‘লামা’ বলেই ডেকে এসেছেন।
আজ যখন রাজনৈতিক মতান্তর থেকে মনান্তরের পরিবেশ তৈরি হওয়ার হরবখত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই, তখন বারবার মনে হয়, প্রথম যৌবনের বন্ধু সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সঙ্গে প্রবল মতবিরোধ সত্বেও জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের জায়গাটা কী মাধুর্যময় ছিল।
সিদ্ধার্থবাবু তাঁর জীবন সায়াহ্নে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে নিজের অন্তরঙ্গতার কিছু কিছু কথা বিভিন্ন ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। কিন্তু নিজের কথা, রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে বলা ঘিরে জ্যোতি বাবু ছিলেন ভীষণ রকমের আত্মসংযত। নিজের কোনও রকম ব্যক্তিগত আবেগকে তিনি কখনওই সামাজিক পরিমণ্ডলে জানতে দিতে চাইতেনই না, এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলেও জানতে দিতে চাইতেন না।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, পত্নী কমল বসু প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছে ইন্দিরা ভবনে। সামনের বাঁধানো চত্বরটিতে মরদেহ শায়িত। খুব ঘনিষ্ঠ মানুষজন আশেপাশে রয়েছেন। জ্যোতিবাবু অন্দরমহল থেকে বাইরে এলেন। সিঁড়ির উপরে, পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে দেখলেন বহুকালের একান্ত আপনজনকে, শুয়ে রয়েছেন নিস্পন্দ। জ্যোতি বাবুকে দেখে বুঝতে পারা যাচ্ছে, তাঁর মনের ভিতরে কী হচ্ছে। কিন্তু বাইরে তিনি অচঞ্চল। কাউকে বুঝতে দিতে চাইছেন না তাঁর হৃদয়ের গোপন ক্ষরণকে।
কখনও আনন্দেও তাঁর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত কোনও বহিঃপ্রকাশ ছিল না। আবার বিষন্নতাতেও নিজেকে একেবারে বিলীন করে দিয়ে, নিজের পরিচিত সত্তার বাইরে কখনও গিয়ে, কোনও কোটরে তিনি আশ্রয় নিতেন না। তাঁর ব্যক্তি জীবনের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য, জ্যোতিবাবুর মধ্যে কিন্তু কখনও দ্বৈত সত্তা কাজ করত না। তিনি সামনে যা বলতেন, লোকচক্ষুর আড়ালে এমনকি একান্ত নিজের কাছেও সেই জায়গা থেকে কখনও সরে আসতেন না ।
একবার একটি বৈদ্যুতিন মাধ্যম তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে। তাঁরা চলে যাওয়ার অল্প কিছু পরেই তাঁর ঘরে গিয়েছেন এই নিবন্ধকার। একটু বিরক্তির সঙ্গেই জ্যোতি বাবু বললেন, ‘সারাদিন কী খাই, কী পড়ি, কী খেতে ভালবাসি-এইসব নিয়ে যত সব প্রশ্ন। যত্ত সব নন-পলিটিক্যাল ব্যাপার।‘
আসলে জ্যোতি বাবু রাজনীতির বাইরে কখনও কোনও কিছু জানতেন না। বুঝতেন না। ভাবতেও চাইতেন না। তাই ব্যক্তি জীবনে কী খেতে ভালোবাসেন, কিভাবে অবসর কাটান, এসব প্রশ্ন সাংবাদিকেরা করলে একটু নয়, বেশ বিরক্তই হতেন।
তবু তার মধ্যেও তো যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন , তাঁরা জানবার সুযোগ পেয়েছেন ‘মানুষ’ জ্যোতি বাবুকে। জ্যোতি বাবু আপাদমস্তক সাহেবীয়ানাতে অভ্যস্ত থাকলেও ছিলেন পরিপূর্ণ বাঙালি। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে একদম টিপিকাল বাঙালি খাবারের প্রতি, বিশেষ করে মাছের প্রতি তাঁর ছিল একটা বড় রকমের আকর্ষণ। শীতকালে যখন ভালো ট্যাংরা মাছ উঠত, এই নিবন্ধকারের অভ্যাস ছিল, নৈহাটি বাজারের মাছ বিক্রেতা সুকুমারদার কাছ থেকে সেই মাছ নিয়ে, কাটিয়ে-কুটিয়ে, কখনও রান্না করা, কখনও কাঁচা মাছ, ইন্দিরা ভবনে পৌঁছে দেওয়া। আর এই মাছের পরিমাণ নিয়ে নিবন্ধকারের সঙ্গে খুনসুটি তৈরি হয়ে যেত জয়কৃষ্ণ ঘোষের। জয়দা বলতেন, ‘আপনি একদম বেছে বেছে দুটো মাছ আনবেন। বেশি মাছ আনলেই সাহেব খেতে চাইবেন, আর খেয়ে পেটের সমস্যায় পড়বেন।‘ জয়দা যাই বলুন, জ্যোতি বাবুকে তো আর বেছে বেছে মাত্র দুটি মাছ পাঠানো যায় না। তাই মাছ পাঠালেই জয়দার কাছ থেকে বকুনি খাওয়া এই নিবন্ধকারের ছিল অবধারিত।
জ্যোতি বাবু ভোজন রসিক ছিলেন। একেবারে আম বাঙালির ঘরের শুক্তো, ছেঁচকি, চচ্চড়ি, নানা প্রকারের ঘন্ট-এগুলির প্রতি ছিল তাঁর বেশ স্বভাবসুলভ একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল। মাছ-মাংসের মধ্যে, মাছের প্রতি ছিল তাঁর বেশি রকমের দুর্বলতা। তবে জ্যোতি বাবু ভোজন রসিক ছিলেন বলে যে খাওয়া-দাওয়ার পরিমাণের ক্ষেত্রে সংযমী ছিলেন না, তা কিন্তু নয় । তাঁকে খুব বেশি পরিমাণ খাবার কেউ কখনও খেতে দেখেননি।
ভাত হোক কিংবা রুটি, অত্যন্ত পরিমাণ মতো খেতেন। সঙ্গে যেসব ডাল, তরকারি ইত্যাদি থাকত, সেগুলিও চামচ দিয়ে একটু-আধটু নিয়ে খাওয়া ছিল তাঁর অভ্যাস। কোনও একটা খাবার ভালো লেগেছে বলেই-সেটা অনেকটা পরিমাণ খেয়ে নিলেন, এটা কিন্তু জ্যোতিবাবুর চরিত্রে ছিল না। তবে কোনও কিছু খাওয়া ঘিরেই জ্যোতিবাবুর মধ্যে কখনও আপত্তিও ছিল না। মশলাদার খাবার যেমন পছন্দ করতেন (পক্ষপাতিত্ব ও ছিল) তেমনই খুব অল্প মশলা দেওয়া খাবারও যদি তাঁর সামনে ধরে দেওয়া হতো, তাঁর মধ্যে কোনওরকম ভাবান্তর দেখা যেত না।
ভাল রান্না খেয়ে পরিতৃপ্ত যেমন হতেন, আবার যদি কখনও কোনও কারণে রান্না পছন্দমত না হতো, সেক্ষেত্রেও কিন্তু কোনও রকম প্রতিক্রিয়া জানানো-এটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।
পোশাকের ব্যাপারেও জ্যোতিবাবু ছিলেন একেবারেই ভাবলেশহীন। তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রায় গোটা সময়টা জুড়ে তাঁর বাইরের পোশাকের হিসেব-নিকেশ এবং তত্ত্বাবধান করে গেছেন জয়কৃষ্ণ ঘোষ। এমনও ঘটনা ঘটেছে, বিদেশে যাবেন জ্যোতি বাবু, সেখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি দেখে স্যুট পরবেন। গলাবন্ধ কোটটাকে প্রায় দলামচড়া করে সুটকেসে পুরে নিয়ে গেছেন। বিলেতের মাটিতে জয়দাকেই ছুটোছুটি করতে হয়েছে তাঁর সাহেবের কোট ইস্ত্রি করবার জন্য ।
জয়দা প্রকাশ্যে সবসময় ‘জ্যোতি বাবু’ বললেও, তাঁকে অন্তরঙ্গ মহলে বেশিরভাগ সময়ই ‘সাহেব’ বলতেন। জ্যোতিবাবুর জীবনের একদম অন্তিম পর্ব, যখন তিনি প্রায় শয্যা নিয়েছেন, সেইসময়কালেও তাঁর মস্তিষ্ক অত্যন্ত সচল। তাই কারও সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ভীষণ রকমের আপত্তি ছিল জ্যোতিবাবুর।
হাসপাতালে যে ফাউলার বেড ব্যবহার করা হয়, সেই রকম বিছানাতেই থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল শেষকালে, বাড়িতে সেই বিছানা থেকে একদম সন্তানের মতো কর্তব্যে, প্রতিদিন পিতৃপ্রতিম জ্যোতি বাবুকে, পাঁজাকোল করে নিয়ে গিয়ে কমোডে বসিয়েছেন জয়কৃষ্ণ। তাঁকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, পোশাক বদলে আবার বেডে শুইয়ে দিয়েছেন।
কী পরম মমতায় জ্যোতি বাবুকে শেষ জীবনে জয়কৃষ্ণ বাবু সেবা শুশ্রূষা করেছিলেন , সেই প্রসঙ্গটি প্রায় অলিখিতই থেকে গেছে। কিন্তু আমাদের মত সামান্য দু-একজন মানুষের জয়কৃষ্ণ বাবুর সেই সেবা দেখার সুযোগ ঘটেছিল। অমন সেবা খুব কম সন্তানই তার বাবা-মাকে নিজের হাতে করে থাকেন, একথা জয়কৃষ্ণ বাবু সম্বন্ধে খুব জোর গলায় বলতে পারা যায়।
কোনওদিন তাঁর শয়নকক্ষে কোনওরকম সেবককে থাকবার অনুমতি দিতে জ্যোতিবাবুর ছিল প্রবল আপত্তি। শেষদিকে বেশ কয়েকবার রাতে ঘুমের ঘোরে বাথরুমে যেতে গিয়ে পরিধেয় লুঙ্গিতে পা আটকে শয়ন কক্ষে জ্যোতিবাবু পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরা, ব্যক্তিগত পরিসরের বহু মানুষ বারবার তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, রাতে শোবার ঘরে অন্তত একজন মেইল এটেনডেন্টকে থাকবার অনুমতি দিন জ্যোতি বাবু ।
কেউই জ্যোতিবাবুকে এই অনুরোধে রাজি করাতে পারেননি। ব্যতিক্রম জয়কৃষ্ণ ঘোষ। জ্যোতিবাবু তাঁর জয়ের এই অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। জয়বাবুর তত্ত্বাবধানে শেষ পর্যন্ত জ্যোতিবাবুর শয়নকক্ষে একজন মেইল এটেনডেন্ট থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।
এখানেও কিন্তু ব্যক্তি জ্যোতিবাবুর অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। নিজের ব্যক্তি প্রয়োজনে তিনি কখনও কাউকে বিরক্ত করা পছন্দ করতেন না। তাই মেইল এটেনডেন্ট তাঁর ঘরে থাকার পরেও, অনেক সময় দেখা গেছে, তিনি মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজনে, ঘুমন্ত মেইল এটেনডেন্টকে ডাকতেন না তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে বলে।
বিষয়টা জানার পর সেই জয়কৃষ্ণ ঘোষই আটেন্ডেন্টের প্রতি কড়া নিয়ম করেছিলেন, কোনও অবস্থাতেই সে রাতে জ্যোতিবাবুর ঘরে ঘুমোতে পারবেনা। তাকে জেগে থাকতে হবে। ওই একবারই দেখেছিলাম জ্যোতি বাবুকে, তাঁর জয়ের উপরে বিরক্ত হতে। কিন্তু জয়কৃষ্ণের সিদ্ধান্তকে শেষ পর্যন্ত তিনি মেনে নিয়েছিলেন এমনটাই ছিল জয়কৃষ্ণের প্রতি তাঁর সন্তানবৎ স্নেহ।