বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
Riya Patra | ১২ এপ্রিল ২০২৪ ১২ : ১৫Riya Patra
এ রাজ্যে তো বটেই। ভিনরাজ্যেও সাড়া ফেলেছে মমতা ব্যানার্জির ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। গ্রামে গঞ্জে কেমন আছেন বাংলার লক্ষ্ণীরা ? ঘুরে দেখলেন, তাঁদের কথা শুনলেন নীলাঞ্জনা সান্যাল।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পান?
হ্যাঁগো দিদি, প্রথম থেকে, হাজার টাকা।
কি করেন টাকাটা দিয়ে?
অনেক কিছু করি গো। দুই ছেলেমেয়ের মাস্টারের খরচ আমি দি। বাকি টাকা সংসারে লাগাই। আমার ঘরের লোক (স্বামী) তো তেমন কিছু করে না। যখন যা কাজ পায় তাই করে। কিছুর ঠিক নেই। আগে ছেলেমেয়ে দুটোর পড়াশোনা, সংসার চালাতে খুব কষ্ট হত। এখন প্রতি মাসে এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পেয়ে খুব উপকারে লেগেছে। কারও কাছে হাত পাততে হয় না, মুখও শুনতে হয় না।
চৈত্রের আগুন ঝরানো দুপুরে নিজের বাড়ির নিকোনো দাওয়ায় দাঁড়িয়ে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে জানতে চাইলে, এই কথাগুলোই বললেন কাকলি পুঁইলে। বলার সময় চোখ–মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছিল আত্মবিশ্বাস। নারীর ক্ষমতায়ন কি একেই বলে? প্রশ্নটা মনে বেশিক্ষণ রাখা গেল না। জবাব মিলল সবিতা রায়, রিঙ্কু সিং, মঞ্জু পুঁইলে, বুলটি মালকি, শ্যামলী পুঁইলেদের কাছে।
সরঙ্গা মোড় থেকে বাঁদিকে একটু গিয়েই চাগ্রাম। জায়গাটার নাম চাগ্রামের দক্ষিণপাড়া মোড়। গ্রামটি পূর্ব বর্ধমান জেলায় হলেও লোকসভা কেন্দ্র বিষ্ণুপুর। বিধানসভা খণ্ডঘোষ। চাগ্রাম থেকে ১০ কিলোমিটারের মতো গেলেই বাঁকুড়া জেলা। তীব্র গরমে মাটি তেতে উঠলেও ভোটের উত্তাপ এখনও ছড়ায়নি দক্ষিণ দামোদরের এই গ্রামগুলোয়। দক্ষিণপাড়া মোড়ের কালী মন্দিরের একদম সামনের বাড়িটাই সবিতা রায়ের। ভোটের তাপ–উত্তাপ টের পাওয়া না গেলেও সবিতার বাড়ির দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী শীতল কৈবর্তর নামের দেওয়াল লিখন। বাড়িতে লাগানো সিপিএমের দলীয় পতাকা দুপুরের গরম হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। আশেপাশের কিছু বাড়িতেও দেখা গেল লাল পতাকা। পতাকা লাল কেন? রহস্য উদ্ঘাটন করলেন স্থানীয় বাসিন্দা অষ্টম রায়। জানালেন, এখানে সিপিএমের ভোটার আছে, তাই। মানে, সিপিএম করেও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পেয়েছেন সবাই? মাথা নেড়ে সায় দিলেন অষ্টম।
তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এত কথার মাঝেই মাঠ থেকে ফিরলেন সবিতা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পান? এক গাল হেসে উত্তর দিলেন হ্যাঁ। খরচ করেন কীভাবে, কোনও কাজে লাগিয়েছেন? হাত ধরে বাড়ির ভেতর টেনে নিয়ে বললেন, ‘উঠোনের সামনের এই ওপরটা আগে খড়ের ছিল। এখন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার জমিয়ে আর কিছু টাকা দিয়ে টিন দিয়েছি। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সঙ্গে কিছু ধার–দেনা করে ২টো ছাগল আর একটা গরু কিনেছি। আস্তে আস্তে শোধ করব। প্রতি মাসে এই টাকাটা ঢুকে খুব উপকার হয়েছে।’ এক বছরও হয়নি হঠাৎ স্বামী মারা গেছেন অলকা সিংয়ের। স্বামী বেঁচে থাকাকালীন যা কাজকর্ম করতেন তাতে কাঁচা বাড়ি পাকা করেছিলেন। ছাগলও ছিল। কিন্তু আচমকা গেল ভাদ্রে স্বামী মারা যাওয়ায় এখন সংসার চালাতে অলকার প্রধান ভরসা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা। জানালেন, বিবাহিত দুই মেয়ে কিছু সাহায্য করে আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভরসাতেই সংসার চলে তাঁর। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পুরো টাকাটাই সংসারের দরকারে খরচ করেন মঞ্জু পুঁইলে। জানালেন, সংসারের টানাটানির সময় এই টাকা কাজে লাগে। নিজের টুকিটাকি হাত খরচাও এই টাকা থেকেই। পুজোর সময় জামা কাপড় কেনা, কাউকে কিছু দিতে মন চাইলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারই ভরসা। শ্যামলী পুঁইলে জানালেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা জমিয়ে একটা খাসি কিনেছেন। একটু বড় হলে বিক্রি করবেন।
মাঠ থেকে তোলা রসুনে উঠোন পুরো বোঝাই হয়ে আছে। সেখানে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন রিঙ্কু সিং। জানালেন ছাগল কিনেছেন। স্বামী চাষবাস করেন। প্রয়োজন পড়লে চাষের কোনও দরকারে কাজে লাগান লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা। কন্যাশ্রী টাকা পেয়েছে মেয়ে। তার কলেজ যাওয়া–আসা, হাত খরচের টাকা তিনি লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা থেকেই দেন বলে জানালেন বুলটি মালিক। আর মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়ের আবদার মেটাতে, নিজের হাতখরচ লাগলে সেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারই ভরসা। প্রথম থেকেই হাজার টাকা পান সন্ধ্যা মালিক। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, টিউশন ফি, জামা কাপড় কেনার কাজেই এই টাকাটা কাজে লাগে বলে জানালেন তিনি। চাগ্রামের পাশের গ্রামই হল সরঙ্গা। সরঙ্গায় বাড়ি শ্রেয়সী মুখার্জির। বিয়ে হয়েছে বর্ধমান শহরে। সদ্য এই প্রকল্পে নাম তুলেছেন। এখনও পর্যন্ত তিনবার পেয়েছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা। প্রথম দু’মাস ৫০০ পেলেও এই মাসে ঢুকেছে হাজার। শ্রেয়সীর বক্তব্য, আপাতদৃষ্টিতে এই টাকার পরিমাণ হয়তো বেশি কিছু নয়, কিন্তু সেটুকুর জন্যও এখন আর স্বামী বলো বা দাদা–ভাই, কারও কাছে হাত পাততে হয় না। কী খরচ করব, কেন করব তার কৈফিয়তও দিতে হয় না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের গুরুত্ব এখানেই। এই টাকা মেয়েদের একান্ত নিজস্ব। মাস গেলে নিজেদের অ্যাকাউন্টে এই টাকা ঢোকার যে নিশ্চয়তা, সেটাই মনোবল অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। ফেরার পথে শ্রেয়সীর বলা কথাগুলোই কানে বারবার বেজে উঠছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প চালু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। লক্ষ্য ছিল বাংলার মেয়েদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলা। হয়তো অনেক পথ চলা এখনও বাকি। কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যে গ্রাম বাংলার মেয়েদের শুধু আর্থিক নয়, মানসিকভাবেও শক্ত করার কাজ শুরু করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।