বাঙালির সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে সুফিয়া কামাল এক ঐতিহাসিক নাম। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি বাংলাদেশে কাটালেও, দেশ -ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি জীবনে নতুন আলোর প্রত্যাশার সঙ্গে সুফিয়া কামালের নাম অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। কেবলমাত্র মুসলমান নারীর জাগরণের ক্ষেত্রেই সুফিয়া কামালকে আমরা স্মরণ করব না। হিন্দু -মুসলমান নির্বিশেষে নারীর স্বাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল যে অবদান রেখে গেছেন। তা বাংলা তথা বাঙালির সামাজিক পরিকাঠামোর বিন্যাসকেই অনেকখানি বদলে দিয়েছে।
সুফিয়া কামাল কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন নি। ক্ষমতার অলিন্দে বহু ধরনের প্রলোভন সত্ত্বেও কখনো তিনি কখনো প্রবেশ করেন নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে, তাঁর যে সদা জাগ্রত বিবেক , তা কেবলমাত্র যে বাঙালি নারীর বা বাঙালির জীবন-জীবিকাকে ঘিরে সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয় ।সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে , তাঁর যে লড়াই ,তা বাঙালিকে ,আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বিশেষ সম্মান ,বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
নারীর জীবন জীবিকাকে একটা সুনির্দিষ্ট ধারায় প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে সুফিয়া কামালের যে লড়াই , তা গত বিশ শতকে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে নারীকে একটা বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঠিক তেমন ই নারীর লড়াইয়ের অঙ্গনকে সুফিয়া কামাল যেভাবে প্রসারিত করতে পেরেছেন ,সেই ধারাই কিন্তু তাঁর জীবনাবসানের প্রায় দুই দশক পরেও, নারী মুক্তির প্রশ্নে ,একটা দিক চিহ্নবাহী বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে ।
সুফিয়া কামাল এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁর মধ্যে কখনো ধর্ম, রাজনীতি, মতাদর্শ-- এসব ঘিরে কোনোরকম সংকীর্ণতা বাসা বাঁধতে পারেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম ধারক বাহক সুফিয়া কামাল কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতিও ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল ।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে তিনি মস্কোতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ।সেই সময়ে তিনি পাক- সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সভানেত্রী। সোভিয়েত সফর শেষে যখন তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন, তখন ঢাকার ,সোভিয়েত কনসাল্ট জেনারেলের পক্ষ থেকে ভাইস কন্সাল ভ্লাদিমির কামিনিনিন ঢাকার শাহবাগে সুফিয়া কামালের সম্মানে একটি সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলেন ।
সেই সভায় সুফিয়া কামাল, সোভিয়েত দেশে নারী সমাজের যে অগ্রগতি, তার প্রশংসা করেন বিশেষ করে নারী- পুরুষের সমান অধিকার যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার স্বপ্রশংস উল্লেখ করে ওই সভায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সামাজিক অগ্রগতির দিকগুলি সুফিয়া কামাল তুলে ধরেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সোভিয়েতে মেয়েরা কি ভূমিকা পালন করছে এবং সেই আদল কেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অনুসৃত হবে না -- এই প্রশ্ন সেদিনের সেই সম্বর্ধনা সভায় সুফিয়া কামাল তুলেছিলেন।
আজ যখন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পর পর চার দফায় একটি নির্বাচিত, গণতান্ত্রিক ,ধর্মনিরপেক্ষ সরকার পরিচালিত হচ্ছে তখন বারবার মনে পড়ে যায়, ঢাকার শাহবাগে সোভিয়েত সফর শেষে এসে সুফিয়া কামাল যে সোভিয়েতে নারী সমাজ সম্পর্কে ,বিশেষ করে সেই দেশে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকার কথা জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, সেই সব বিষয়গুলি ।
গোটা সোভিয়েত জুড়ে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের যে তৎপরতা সেটা মুগ্ধ করেছিল সুফিয়া কামালকে। সে বিষয়টিও তিনি ওই সম্বর্ধনা সভায় বারবার বলেছিলেন ।সেই সঙ্গে বলেছিলেন , সামাজিক জীবনে, বিজ্ঞানী এবং কবি সাহিত্যিকদের কি অসাধারণ মর্যাদা সোভিয়েট সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। তখনকার পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানতে পারে যাচ্ছে, সেই সভায় সুফিয়া কামাল আরো বলেছিলেন ,সোভিয়েত দেশে যে কোনো একটি বই প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে যায়।
সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে সোভিয়েতপন্থী এবং চীনপন্থী এই দুই শিবিরের অবস্থান ছিল। সুফিয়া কামালের অবস্থান কে সোভিয়েতপন্থী অবস্থান বলে ধরে নিয়েছিল চীনপন্থীরা।তাই তারা অবশ্যই খুশি হতো না সুফিয়ার প্রতি।কিন্তু কোনো পক্ষ অবলম্বন করে দলীয় রাজনীতির শিবির ভুক্ত হওয়া ছিল সুফিয়ার চরিত্র বিরুদ্ধ।আর কে খুশি হলো ,আর কে খুশি হলো না --তার উপরে নির্ভর করে সুফিয়া কামাল কখনো নিজের বিবেকের সঙ্গে ছলনা করেননি। নিজের বিবেকের ডাকে তিনি যা মনে করেছেন সত্যি, সেই সত্যিকেই অকপটে মানুষের সামনে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে সুফিয়া কামালের মধ্যে কোন দ্বিধা ছিল না সংকট ছিল না ।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনের হলে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বাধীন পাক - সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির উদ্যোগে লেনিনের জন্মদিন পালন করা হয়েছিল ।এই অনুষ্ঠানে সুফিয়া কামাল নিজে সভাপতিত্ব করেছিলেন। সভাপতির বক্তৃতায় তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন ; লেনিনের দেশে তিনি এমন এক আদর্শ কালজয়ী শক্তির সন্ধান পেয়েছেন ,যে আদর্শকে গ্রহণ করলে বাংলাদেশের তরুন প্রজন্ম একটি স্বপ্ন রাজ্য গড়ে তুলতে পারবে।
সোভিয়েত নর নারীদের মধ্যে একটা আনন্দ বিহ্বল অকৃত্রিম আন্তরিকতা যে তাকে সব থেকে বেশি মুগ্ধ করেছিল ,সে কথা তিনি সেদিন প্রকাশ্যে বলতে দ্বিধা করেননি। সোভিয়েতে নারীদের মধ্যে কোনো ধরনের আলস্য তিনি দেখতে পাননি ।এই কথাটা কিন্তু লেনিনের জন্মবার্ষিকীর সেই সভায় সুফিয়া কামাল বারবার উল্লেখ করেছিলেন।
শীতকাল ।প্রচন্ড তুষারপাত ঘটছে। পুরুষদের সঙ্গেই হাতে হাত লাগিয়ে মেয়েরা কিন্তু সমস্ত ধরনের সামাজিক কাজ কর্মের মধ্যে নিজেদের যুক্ত রেখেছে। শীত বলে, বরফ পড়ছে বলে, বাড়িতে ঘরকুনো হয়ে তাঁরা বসে নেই ।কাজের মধ্যেই যে মেয়েরা সোভিয়েট দেশে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে-- এই কথাটি ওই সভায় সুফিয়া কামাল বলেছিলেন। সেখানে মেয়েরা কারখানা, খামার, ট্রেন ,সমবায় সমিতি চালায় ।এমনকি তাঁদেরই একজন ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা মহাকাশে গিয়েছেন ।
সোভিয়েতের এ বিস্ময়কর উন্নতির মূল হিসেবে সুফিয়া কামালের কাছে মনে হয়েছিল ,সে দেশের মানুষের অর্ধেক অংশ নারী সমাজ ।আর সেই নারী সমাজ আমাদের মত পঙ্গু হয়ে পড়ে নেই। ওই সভায় সুফিয়া কামাল অত্যন্ত জোড়ের সঙ্গে বলেছিলেন, সোভিয়েত নারীর সামাজিক অগ্রগতি দেখে আমার মনে হয়েছে যেন বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন সেখানে বাস্তবায়িত হয়েছে ।
শিশুদের স্বাস্থ্যের প্রতি সোভিয়েতের নারী সমাজের নজরদারি , বিশেষ করে সেখানকার প্রশাসনের যে শিশুদের প্রতি যত্নশীল মানসিকতা, তার কথাও কিন্তু এই সভায় সুফিয়া কামাল অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছিলেন ।তিনি বলেছিলেন; সে দেশের শিশুদের দেখে আমার বারবার আমার দেশের হতভাগা শিশুদের কথা খুব মনে পড়ছে। পাখির কুলকূজনের মত কিন্ডারগার্টেনে, শিশুদের শিক্ষার ভির নিয়েছে সরকার। প্রাইমারি স্কুলের ছেলেমেয়েরা স্কুলে এই মনের সুখে গান গায় ।নাচে ।পাঠভ্যাস করে। পায়োনিয়ার প্যালেস থেকে যখন রাষ্ট্রপ্রদত্ত অভিন্ন পোশাক পরে ছেলেমেয়েরা দলে দলে বের হয় তখন মনে হয় যেন একটি ফুলের বাগান ভেঙ্গে পড়েছে- এসব ছিল সেদিনের সভায় সুফিয়া কামালের অভিমত।
বাঙালি নারীর আর্থ-সামাজিক -সাংস্কৃতিক উন্নতির লক্ষ্যে সোভিয়েত মডেলের কথা এইভাবে জোড়ের সঙ্গে বলার কারণে আইয়ুব খানের প্রশাসনের চক্ষুশূল হতে হয় সুফিয়া কামালকে। সমস্ত রকম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে প্রচার চালায়, সুফিয়া কামাল কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন। সেই কারণেই তিনি ঢাকার বুকে লেনিনের জন্মদিন পালন করছেন। সেই কারণেই তিনি পাকিস্তানের মেয়েদের উন্নতির কথা না বলে, কেবলমাত্র সোভিয়ের দেশের মেয়েদের উন্নতি কে ঘিরে নানা ধরনের কথা বলছেন।
সুফিয়া কামাল সোভিয়েত দেশে মেয়েদের উন্নতির যে সমস্ত স্মৃতিচারণ ঢাকায় এসে করেছিলেন ,সেগুলিকে অসত্য প্রমাণ করবার জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন ফৌজি শাসকেরা খুবই উঠে পড়ে লেগেছিল। তাদের মধ্যে একটা ভয় খুব তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, সুফিয়া কামালের যে সর্বজনমান্যতা আছে, তার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তানের ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের যে সামাজিক প্রচলন ,তার থেকে মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নেবে। বিশেষ করে মেয়েরা মুখ ঘুরিয়ে নেবে ।সুফিয়া কামালের প্রভাবে গোটা পাকিস্তানের নারী সমাজ ,সোভিয়েতের প্রতি বিশেষ রকমের আকৃষ্ট হয়ে পড়বে ।অর্থাৎ ; তাদের আকর্ষণ বাড়বে কমিউনিজিমের উপর ।
এই ভয়টাই পাকিস্তানের ফৌজি শাসকেরা সুফিয়া কামালকে ঘিরে সব থেকে বেশি অনুভব করেছিল। সেই কারণেই আইয়ুব খানের শাসনের নামে যে ত্রাসের রাজত্ব , সেখানে নানাভাবে সামাজিক হেনস্থা করবার চেষ্টা করা হয় সুফিয়া কামালকে। একইসঙ্গে তাঁকে প্রভাবিত করবার বহু ধরনের প্রচেষ্টা চলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন বা পরবর্তীকালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রশাসন কেউ ই কোনো অবস্থাতেই, তাঁকে প্রভাবিত করতে না পেরে, নিজেদের বামপন্থী বলে পরিচয় দেওয়া যে সমস্ত লোকেরা, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের চীনপন্থী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদারিত্বকে সমর্থন করে চলেছে, সমস্ত রকমের শোষণকে সমর্থন করে চলেছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালি হত্যাকে কে সমর্থন করে চলেছে, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ধরনের চেতনাকে অস্বীকার করবার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে-- তারাও সচেষ্ট হয়েছিল সুফিয়া কামাল সম্বন্ধে নানা ধরনের বিষোদগার করতে।
এ কথা আজকে খুব জোরের সঙ্গেই বলতে পারা যায় যে, সেদিনের চীনপন্থীরা, পশ্চিম পাকিস্তানের ফৌজি শাসকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে সুফিয়া কামাল সম্পর্কে নানা ধরনের অসত্য ,অর্ধসত্য বিভ্রান্তিমূলক খবরাখবর ছড়াতে শুরু করেছিলেন ।এই চিনপন্থীরা কিন্তু একটি বারের জন্য ও পাক হানাদার বাহিনীর হানাদারিত্ব নিয়ে একটা কথা বলে নি।লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিধন নিয়ে একটা কথাও বলে নি।একবারের জন্যও পাক হানাদার বাহিনীর যে ভয়াবহ অত্যাচার বাংলাদেশের নারীদের প্রতি ,সে সম্পর্কে একটা শব্দ উচ্চারণ করে নি।
মুক্তিযুদ্ধের কালে সুফিয়া কামালের প্রাণনাশের বহু চেষ্টা হয়েছে ।সেই চেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ।তাদের সহযোগিতা করেছে আলবাদার ,আল শামস, শান্তিবাহিনী সহ সমস্ত ধরনের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি। সমস্ত ধরনের চিনপন্থী রাজনীতিকেরা, পশ্চিম পাকিস্তানের সেই চেষ্টা থেকে নিজেদের কখনো দূরে রাখেনি ।
এইরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ,ধর্মনিরপেক্ষতা , সর্বোপরি সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে, জীবন জীবিকার লড়াইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করবার এক অদ্ভুত ধৈর্য নিয়ে সুফিয়া কামাল নিজের জীবনকে, নিজের যাপন কে পরিচালিত করেছিলেন।