মহাজীবন উদ্যান

 

পাতা সরানোর খসখস শব্দ। শুকনো পাতার পর দিয়ে মচমচ করে হাঁটলে যদি পাতাদের ব্যথা হয় তখন যেমন আওয়াজ বেরোয় ঠিক তেমন যন্ত্রণার আখ্যান শুনতে পাচ্ছে শৌনক। গত কয়েকদিন ধরে ‘মহাজীবন উদ্যান’-র এই অংশটায় এসে বসে শৌনক। সকালে আসছে ও। এই সময় পার্কটায় কেউ থাকে না। পরিত্যক্ত জীবনের মত পড়ে থাকে পার্কটা। ওই ছেলেটা এই সময়ে এসে শুকনো পাতা, ঘাস সব পরিষ্কার করে। রোজ এই সময়েইও পার্কটা ঝাঁট দেয়। একগাদা শুকনো পাতা, মরা হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাস এনে জড়ো করে। খানিকটা দূর থেকে ওকে দেখতে পায় শৌনক। উস্কোখুস্কো চুল, গায়ে একটা ছেঁড়া শার্ট। পার্কটা পরিষ্কার করতে করতে ছেলেটা মাঝে মাঝে মুচকি হেসে তাকায় শৌনকের দিকে। শৌনক ভেতরে ভেতরে জ্বলে ওঠে। আসলে খানিকটা রাগ, যন্ত্রণা, ক্ষোভ বুকের মধ্যে পচা মৃতদেহের মত জমিয়েই পার্কে আসে । ছেলেটার ওই তাকানোটা দেখে শৌনকের ইচ্ছে করে ওর গালে একটা থাপ্পড় দিতে। নিজেকে সামলে নেয় । সকালবেলা অফিস যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে এখানে অন্তত দু'ঘণ্টা বসে থাকে। পার্কটা শৌনকের বাড়ি থেকে হাঁটাপথ-এর দূরত্ব। একটু পরেই এই পার্ক থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বেরোবে। ছেলেটা তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা কি শৌনকের মিথ্যেটা ধরতে পারে? ধুর! ধরতে পারলেই বা কি? তবুও ওর শৌনকের দিকে এমন করে তাকানোটা র ভেতরে একটা যন্ত্রণার ছবি এঁকে দেয়। আজকাল শুধু মনের ভেতরেই ছবি আঁকতে পারে শৌনক। অনেক চেষ্টা করেও রং-তুলি, ওর হাত আর ক্যানভাসের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠেনি। কতদিন সাদা পাতায় নিজেকে মেলে ধরে না শৌনক।  ভেতরে জমে থাকা যন্ত্রণার কঠিন পলি। সহজে সরে না। রং তুলি মুখ ফেরায়

 ছেলেটা আজ এক মনে পার্কটা পরিষ্কার করছে। যে বেঞ্চটায় শৌনক এসে বসেছে, আধখাওয়া বিড়ির টুকরো, একটা চায়ের কাপ পড়ে রয়েছে, গা ঘিনঘিন করে। ছেলেটাকে হাতের ইশারায় ডাকে ও।

 -“এদিকে আয় তো একবার”।

 ঝাঁটা হাতে নিয়েই এগিয়ে আসে ছেলেটা। প্রথম সামনে থেকে ছেলেটাকে দেখলো শৌক। এক মাথা চুল, গায়ে-হাতে লেপ্টে থাকা ময়লা। জামাটাও যথারীতি নোংরা। তবে হাসিটা অদ্ভুত উজ্জ্বল। ছেলেটা হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে শৌনকের সামনে।

 

-"এগুলো একটু তুলে নে তো এখান থেকে! বেঞ্চগুলো পরিষ্কার করিস না নাকি?"

 আধ-খাওয়া বিড়ি আর এঁটো চায়ের কাপটার দিকে ইঙ্গিত করল শৌনক। ছেলেটা একবার মুখ তুলে তাকালো, ওর চোখে কি বিস্ময়! ওকি শৌনকের থেকে অন্য কিছু আশা করছিল? হয়তো একটু নরম ব্যবহার, সাধারণ, সহজ কথা। এসব ভাবনার মাঝেই ছেলেটা নোংরাগুলো একটা সাদা রঙের বস্তায় ভরা শুরু করে দিয়েছে। ছেলেটার ময়লামাখা হাতে একটা ঠোঙা। খাবার রয়েছে তাতে। প্লাস্টিক উঁকি দিচ্ছে। ও বারবার শৌনকের দিকে তাকাচ্ছে।

 -"কতক্ষণ কাজ করতে হয় তোকে এখানে?"

 প্রশ্নটা করে শৌনক বুঝল বোকার মতই প্রশ্ন করেছে ও। কারণ ছেলেটা প্রতিদিন দশটার সময় বেরিয়ে যায় এখান থেকে। শৌনকও ঠিক ওই সময়ই বেরোয় পার্ক থেকে। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাটা কি তবে একটা ছুতো? নিজের রুক্ষ্ম ব্যবহারে কি খানিক অনুতপ্ত? নাহ! ওসব কিছু হয় না ওর। ঘড়ি দেখে ও। প্রায় পৌনে দশটা বাজে। রুনা অফিস বেরোবে ঠিক আর এক ঘন্টা পর। এই সময়েই বাড়ির দিকে পা বাড়াতে হবে। ইচ্ছে-অনিচ্ছের মাঝের এক নৌকায় দুলতে থাকে শৌনক। একটা যন্ত্র এসে শৌনককে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। প্রায় যন্ত্রের মতই পার্ক থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় ও।

 

 

-“তুমি এমন করে আমায় কাছে ডাকো কেন রুনা?”

 

-“না ডেকে পারি না তো রণ! আর আমি ডাকলেই তোমায় আসতে হবে?”

 

-“কিছু ডাক উপেক্ষা করা যায় না রুনা!”

 

-“তুমিও তো আমায় নিবিড় করে চাও রণ”

 

-“আমাদের চাওয়াগুলো বড় অদ্ভুত তাই না রুনা! নইলে এমন হবে কেন বলতো?”

 

একটা নারী শরীর মিশে যাচ্ছে পুরুষ শরীরে, সেই নারীর প্রতিটা অঙ্গে মায়াবী সুর বাজছে। তবে সেই পুরুষ মাঝে-মাঝেই শিথিল হয়ে পড়ছে। সেই নারী তার উত্তাপে আবার তাকে জারিত করছে। ঝড়-মেঘ মাখানো এই আদরের র্ব চলছে প্রায় আধঘন্টা। দুজনেই বুঝতে পারছে, এই সময়টার রেশ অনেকক্ষণ থাকবে ওদের ভেতর, তবুও ওদের মনে কোথাও যেন কাঁটা বিঁধে রয়েছে। সব শেষে ওরা দুজনে অনেকক্ষণ কাঁদে। চোখের জলে ওরা ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করে সব কলুষ। যাওয়ার সময় সেই পুরুষ নারীটিকে বলে যায় কাল সে না‌ আসার চেষ্টা করবে। সেই নারী তাতেই সম্মতি জানায়। কিন্তু ওরা দুজনই জানে কোন এক অমোঘ বাঁধনে ওরা আবার কাল কাছাকাছি আসবে। ‌ এই আকর্ষণ, এই জড়িয়ে থাকা কিছুতেই এড়াতে পারবে না।

 

রুনা প্রত্যেকদিন এই সময়টায় শৌনককে একবার ফোন করে। যেন একটা দাগ ঝেড়ে ফেলার ছোট্ট চেষ্টা। লাভ কিছু হয় না।

 

রুনা জানতে পার না ওর আর রজয়ের আদরের মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ শব্দবাণ খানিকক্ষণ আগে শৌনককে আঘাতে জর্জরিত করেছে। রুনা ও রজয়ের এই জড়িয়ে থাকা মুহূর্ত নিজের চোখে দেখতে কয়েক দিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকছে শৌনক। ওরা বুঝতেও পারেনি ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে কখন ঢুকে পড়ে শৌক ওদের নিবিড় হওয়া দেখছে। নিশ্চিন্তে আধভেজানো ঘরের দরজায় চোখ মেলেশৌনক ব্যথা শুষে নেয়

 

রুনা রাত নটার আগে বাড়ি ফেরে না। ওর চাকরির সময়টাই এমন। শৌনকের ফসন্ধ্যে সাতটায়। দুজনের কাছে দুটো চাবি থাকে। প্রত্যেকটা ঘরের দরজার পাশেইবিরাট আকার বাহারি গাছ টবে লাগানোর প্ল্যানটা রুনারই। বুকান বড্ড গাছ ভালবাসত, রুনাও ব্যাঙ্গালোরে পড়তে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওদের তিনটে খুব ওলা ফ্ল্যাটের সব কটা গাছের দায়িত্ব ও সামলেছে বুকানদোকানের পাওয়ার শৌণক জল-সার দেওয়ার চেষ্টা করেনিয়মিতকিন্তু মাঝে মাঝেই ভুলে যায়রুনারও মনে থাকে নাবুকানন, রুনা, শৌনক কতবার এই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকোচুরি খেলেছেআজ শুধু শৌনক লুকোচুরি খেলে

অফিসের কাজের মুহূর্তটুকু বাদ দিলে নিজেকে রং-তুলির ভেতরেই ডুবিয়ে রাখত শৌনক। এমনক ওর অফিসে কেবিনের পাশেও একটা ছোট্ট আঁকার জায়গা রয়েছে। সেদিন একটা তুলি ফেলে গিয়েছিল বাড়িতে, সেটা নিতে হঠাৎ করে বাড়িতে ফেরত আসাই পাল্টে দিয়েছে সবটা

 

কয়েকদিন আগে একটা তুলি বাড়িতে ফেলে গিয়েছিল।অফিস যাওয়ার সময়।‌ রুনা পরে বেরোয়এই সময়ে হয়তো রুনা বাথরুমে থাকবে, বারবার কলিং বেল বাজিয়ে ওকে বিব্রত না করে নিজেই ডুপ্লিকেট চাবিটা দিয়ে ফ্ল্যাট খুলে ঢুকেছিল শৌনকঅর্ধেকবন্ধ ঘরের দরজা থেকে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ শুনে দরজা বরাবর চোখ রেখে শৌনক খানিকক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়েছিলদরজাটা ভেতর থেকে বন্ধরুনার পর আলাদা করে ভালোবাসা বা অধিকারবোধ কোনটাই তেমনভাবে ফলায়নি শৌক। তবে নিজের স্ত্রীকে অন্যের বাহুলগ্ন দেখে শৌনকের ভেতরে একটা পাশুটে রঙের স্রোত বয়ে গিয়েছিল।ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে নিজের ঘর থেকে তুলিটা নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় ঘন কিছু শব্দে শৌনক থমকে দাঁড়ায়। ওদের এই তিন কামরার ফ্ল্যাটটা অনেকদিন ধরে এমন শব্দবিহীন।

ছেলেটা রজয়। রুনার বন্ধু। শৌক অন্তত তাই জানত। এক-আধবার এই ফ্ল্যাটে এসেছে। রুনাকে বুকের ভেতর মিশিয়ে নিয়ে ছেলেটা ওর চোখে-মুখে আদরের লাল দাগ এঁকে দিচ্ছে। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গে ভালোবাসার নীল রং, রুনার বরাবর আকাশ, সমুদ্রের নীল রঙ খুব পছন্দ ছিল। শৌনকের কাছে বারবার আকাশ-নীল রঙের ছবি চাইত। শৌনকের হাত এই নরম নীল রং চেনেনা। ও যতবার রুনার পছন্দের ছবি আঁকতে চেয়েছে সমুদ্রের নীলের বদলে গাঢ়-কালচে নীল রঙ উঠে এসেছে। নীল রঙে ডুবে থাকা রুনাশৌনকের আসার শব্দ টেরপায়নি

 কালচে রঙেরস্রোত নিজের ভেতরেও টের পেয়েছিল শৌক। ক অদ্ভুত টান রোজ রুনা অফিস বেরোনোর এক ঘন্টা আগে শৌক লুকিয়ে-লুকিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যেত। ওদের চোখে ধুলো দিয়ে রুনা আর রণজয়ের আদর মাখামাখি দেখতো। ব্যথা, যন্ত্রণা দেখার চুম্বকের মত আকর্ষণ

 

 

ৌনক সবেমাত্র তুলিটা হলুদ রঙে ডুবিয়ে একটা পালক আঁকার চেষ্টা করছে। সোনালী হলুদ রঙের নরম, ভারহীন পালক। অনেকদিন পর। আজকাল বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আঁকাসরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়েছে শৌনক। কয়েকদিন আগেও অফিসর নাম করে অনেকটা আগে বেরিয়ে প্রথমে খানিকক্ষণ পার্কে বসে তারপর কয়েকটা যান্ত্রিক পদক্ষেপ ফেলে নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যেত, ব্যথা, যন্ত্রণা শুষে নিয়ে আবার পার্কে এসে বসে থাকতো খানিকক্ষণ। তারপর অফিস। এই শৃঙ্খলা-ভরা অন্ধকারগুলোকে চেটেপুটে খেয়েছে শৌনক। একদিন প্রায় ধরা পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেছে ও। আবাসনের চন্দনদা রুনার সামনে জিজ্ঞেস করেছিল "এই যে শিল্পী মশাই নিজের বাড়িতে অমন লুকিয়ে লুকিয়ে ঢোকেন কেন সকালবেলা?" গম্ভীর মুখে কোন উত্তর না দিয়ে আবাসনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছিল সেদিন শৌনক। রুনার চোখমুখের পরিবর্তন দেখার চেষ্টা করেনি।

 

তার কয়েকদিন পর থেকেই আঁকার সরঞ্জামের ব্যাগটা নিয়ে পার্কে আসে শৌনক। কয়েকদিন সাদা ক্যানভাসে শুধু শূন্যতা এঁকেছে। আজ প্রথমবার রং-এর ব্যবহার করছে। একটা হ্যাচকা টানে তুলিটা হাত থেকে পড়ে গেল। পিছন দিকে ফিরে দেখে সেই পার্ক পরিষ্কার করতে আসা ছেলেটা। চোখ দুটো ছলছল, অদ্ভুত দেখাচ্ছে। শৌনক সবে একটা সবুজ মাঠের ভেতর হলুদ পালকআঁকার চেষ্টা করছিল, ও দেখল তুলি থেকে হলুদ রং ছিটকে পার্কের ঘাসবিহীন জায়গাটায় ধুলোর সঙ্গে মাখামাখি হয়েছে।

 

-“একটু ওষুধ দিবেন? আমার মায়ের খুব জ্বর”।

 

হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলেটা বলল।

 

-“আমার কাছে কোন ওষুধ তো নেই, ডাক্তারের কাছে যাবি?”

 

ৌনকের অবাক হয়ে বলা কথাগুলো শুনে ছেলেটা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল

 

-“আপনিই তো রোজ মন খারাপ করে পার্কে এসে বসে থাকেন, সেদিন আমায় ময়লা ফেলতে বলেছিলেন। এই পার্কে বেশি লোক আসে না। মহাজীবন উদ্যানে রোজ সকাল  'টায় আপনি আসেন, আমি দেখি। আমার মায়ের খুব কষ্ট, আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এলুম, করবেন সাহায্য?”

 

শৌক অবাক হয়ে কথা শুনছিল, ছেলেটার চোখে-মুখে অন্ধকার মেশানো হলুদ রং। একটা ২০০ টাকার নোট ছেলেটার হাতে গুঁজে দেয় ও।

 

-“এই পার্ক থেকে বাঁদিকে বেরোলেই যে রাস্তাটা আছে ওর ওপারে দেখবি একটা ওষুধের দোকান, জ্বরের ওষুধ কিনে নিয়ে যা তাড়াতাড়ি”।

 

ছেলেটা যখন দৌড়ে পার্কটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, শৌনকের তুলির হলুদ রংটা ধুলোর সঙ্গে মিশে গেছে।

                 

 

ঝড়ের পরের থমথমে আকাশের মতো লাগছে রুনার মুখ। চোখের দুই প্রান্তে কাজলের অভাব বোধ হচ্ছে না। ওর চোখ দুটো দেখে শৌনকের মায়া হচ্ছে। শৌনকের হঠাৎ মনে হচ্ছে রনা যেন সেই কিশোরীবেলার ওর কাছের বন্ধু, যে কল পাড়তে গিয়ে বা অন্যের বাগানে আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। একটা যন্ত্রণামাখানো অন্ধকার আস্ফালন শৌনককে সিঁড়ির মতো পেঁচিয়ে ধরেছিল, আজ মনে হচ্ছে সেসব বরফের সিঁড়ি।

 

-“আমি চলে যাব এই বাড়ি থেকে, তোমার বাড়িতে থাকার অধিকার আমার নেই”।

 

রুনা নয়, যেন ওর গলা নকল করে কোন যন্ত্র-মানব কথা বলছে।

 

-“তার কোন দরকার নেই রুনা, খুব তাড়াতাড়ি আমার ট্রান্সফার অর্ডার আসছে, ততদিন আমি আমার আঁকার ঘরেই থাকবো, তোমার সংকোচ বা অস্বস্তির কোন কারণ নেই”।

 ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দেয় শৌক।

 

-“তুমি এতদিন ধরে সব জেনেও কিছু বলোনি কেন...! আমি তোমায় নিজের মতো করে কখনও পাইনি! কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছিলাম!”

শৌনকের কলারটা খামচে ধরে চিৎকার করে রুনা। ও যে ভেঙে গুঁড়িয়ে পার্কের ঘাসবিহীন জায়গাটায় পড়ে থাকা ধুলোর মতো হয়ে যেতে চাইছে শৌনক বুঝতে পারে।

 

ও রুনাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

 

-“আমি অনেকদিন আগেই জানতাম, একটা আঁকারতুলি বাড়িতে নিতে এসে প্রথম সাক্ষী হয়েছিলাম সবটার...”।

 

-“তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ ওই সময়টায় আসতে? আজ সকালেওইদিকের ফ্ল্যাটের দাসবাবু যদি আমায় না বলত, আর আমি যদি তোমায় জোর না করতাম এভাবেই সবটা চলত! তুমি কেমন মানুষ? যন্ত্রণায় আমার মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে! তুমি কি মহান সাজতে চেয়েছিলে?”

 

রুনা ধপ করে সোফায় বসে পড়ে।

 

-“আমি গাঢ় নীল রঙের ব্যথার মানুষ রুনা। আমি কোনদিন কিছু হতে চাইনি, পারব না হতে। আমি এখন শুধু আঁকাটা ভালোবেসে করতে চাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিস যেতে হবে আমায়”।

 

রুনার দুই হাত দিয়ে ঢাকা মুখের আড়ালের ঝড় দেখতে দেখতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শৌনক।

 

-“এইতো আজ তুমি এসেছ, মা এখন ভালো আছে, সেদিনের টাকাটা তোমায় ফেরত দেবো বল কত খুঁজেছিলাম ”।

 

সাদা ক্যানভাসটা ক্লিপ দিয়ে আটকাচ্ছিল শৌনক, সবুজ-হলুদ, আরেকটা হালকা আকাশ রং বের করেছে ব্যাগ থেকে। ছেলেটার কথায় তেমন পাত্তা না দিয়ে ওর দিকে একবার মুচকি হেসে আবার কাজে মন দিয়ে শৌনক।

 

-“আজ নতুন কিছু আঁকবে? তুমি টাকাটা নেবে না দাদা?”

 

ছেলেটার প্রশ্নে আবার ওর দিকে তাকায় শৌনক।

 

-“এটা নিয়ে যা, মাকে কিছু খাবার কিনে দিস। মায়ের কাছে কটা দিন ভালো করে থাক”।

 

শৌনকের মন শুধু আঁকার দিকে। হলুদ পালকটা মাটিতে পড়ে রয়েছে। ওর আশেপাশের সবুজ রং দিয়ে ঘাস আঁকছে শৌনক। এই প্রথমবার আকাশ রং-এর একটা মেঘ-নীল আকাশ এঁকে দেওয়ার চেষ্টা করে শৌনক। চলে যাওয়ার আগে রুনাকে এটা উপহার হিসেবে দিয়ে যাবে ও।

 

  • পায়েল চট্টোপাধ্যায়