আজ বিকেলে(১৮ ই জুন, '২৪) শামসুরদার ,' স্মৃতির শহর' এর টিকা লিখছিলাম। ' শব্রি আম' শব্দটার সঙ্গে এপারের পাঠক পরিচিত নয়।আবার যাঁরা নিজেদের ' বাঙাল' বলতে গর্ববোধ করেন, তাঁদের আজকের প্রজন্ম, ঢাকার এই কথ্য শব্দটার সঙ্গে পরিচিত নন।
শব্দটা প্রথম আমি শুনেছিলাম, মুন্সিগঞ্জের এক বাউলের মুখে।যে বাউলকে বুঝি একমাত্র চিনেছিলেন ' অচিনদা' ।' ঝিনি' ,সে কি সত্যিই চিনেছিল , অনেকটা গোপাল ভাঁড়ের কাহিনীর সেই উৎকলবাসী চেনবার মত, ' শব্রি আম' এই কলকাতার রাস্তাতেও দেখতে পেলে , বিক্রেতাকেও চমকে দিতেন অমন দেশজ নামে ফলটির দাম জানতে চেয়ে।
তখন ই মনেপড়ে গেছিল , মাদারিপুরের হাজারিগুড়কে হরেক রকমের দেশজ নামে ডেকে , 'শ্যামলী' তে , ' আলো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে' র উল্টোদিকের গলির সেই তীর্থে বসে গুণদার মত দাঁড়িওয়ালা , মাদারিপুরের ভূমিপুত্র বলে অহঙ্কার করা কবি, কবির ( শামসুর রাহমান) সামনে আমাকে বলেছিলেন, তোমাদের বুদ্ধদেববাবু( ভট্টাচার্য) কিন্তু কোটালিপাড়ার ভূমিপুত্র।যত ই তিনি উত্তর কলকাতা নিয়ে গর্ব করুন না কেন, ওঁর পূর্বপুরুষের নাড়ী কিন্তু কোটালিপাড়াতেই পোঁতা আছে।
মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় , শামসুরদা তখন বুদ্ধবাবুকে একটা চিঠি লিখছেন।দিয়ে দেবেন আমার হাতে।
আফশোষ হয়, চিঠিটার কোনো জেরক্স রাখি নি।শ্রদ্ধেয় বড়দা( অমিতাভ বসু) চিঠিটা বুদ্ধবাবুকে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
শব্রি আম।সমরেশদার( বসু) ফল বিক্রেতার কাছে শব্রি আমের দাম জিজ্ঞেস।বোকার মত তাকিয়ে আছে ফলওয়ালা।বুঝতে পারছে না, কি বলছে খদ্দেরটি।তখন ই মনে ভিড় জমিয়েছে কবির বাড়ির আড্ডা।কবির চিঠি লেখা। পাশে বসে অনর্গল বকে চলেছেন আর এক দাড়িওয়ালা কবি।জানি না, তখন তিনি ,' আমলা- নামা' লিখেছেন কি না।
অমূল্যভূষণ চক্রবর্তী।নেত্রকোনার মানুষ।অন্নদাশঙ্করের বিশেষ স্নেহের মানুষ।আনন্দ থেকে বেরোনো একটা বই ও তিনি অমূল্যবাবু কে উৎসর্গ করেছিলেন।তাঁর মাধ্যমেই নেত্রকোনায় নাড়িপোতা , দাড়িওয়ালা কবির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
এপার বাংলা বড় একটা চেনেনা এই দেড়েল কবিকে।শামসুরদাকেই বা আজ এপার বাংলায় কজন মনে রেখেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে যখন টিকা লিখছি ' শব্রি আমে' র , একবার ফোন ও করলাম ' শ্যামলী' তে।টিয়াকে।শামসুর রাহমানের প্রতিমা দেবীকে।
কখন যে বদ হাওয়া গায়ে লাগিয়ে, পাখি উড়ে গেছে-- রাডক্লিফের দৌলতে তা জানব কি করে?
বিদায় কবি অসীম সাহা--
অসীম সাহা, বাংলাদেশে মানুষটির প্রবল জনপ্রিয়তা আছে। বাংলাদেশের বাঙলিরা গোটা বিশ্বে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, বাংলা ভাষায় কথা বলেন ,বাংলা কবিতা পড়েন ।গল্প পড়েন।উপন্যাস পড়েন ।তাঁদের কাছে অসীম সাহা, বিশেষ রকমের আদরের একটি নাম ।
কিন্তু এপার বাংলা? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বরেন্দ্র মন্ডলের মত দু একজন হাতেগোনা মানুষ জানেন অসীম সাহাকে ।লেখেন তাঁকে নিয়ে ।পড়েন তাঁর কবিতা, গদ্য। আর অসীম সাহা সুন্দরবনকে ঘিরে বরেন্দুর প্রকাশিতব্য বইয়ের জন্য জীবনের প্রায় শেষ পর্বে , অসুস্থ অবস্থাতেও লিখে দেন কবিতা।
১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অসীম সাহার জন্ম। তাঁর পৈতৃক বাড়ি যদিও অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার মাদারীপুরে ছিল, কিন্তু ময়মনসিংহের নেত্রকোনায় তাঁর জন্ম। সেকালের প্রথা মত মামার বাড়িতে জন্মেছিলেন।
কবি অসীম সাহার পিতা ,অখিল বন্ধু সাহা ছিলেন পেশায় একজন অধ্যাপক। অসীমের প্রারম্ভিক পড়াশুনাও মাদারীপুরে।' ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়েন আইয়ুব খান বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। পরবর্তীতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে ।এই রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সেই সময় পিছিয়ে গিয়েছিল ।ফলে ১৯৭৩ সালে অসীম সাহা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
অসীম সাহের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ,'পূর্ব পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায়' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে ।প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়েই বাংলা কবিতার জগৎ বুঝেছিল একটা ভিন্নতা র স্বাদ কবিতা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে আসছে ।অসীম সাহার প্রথম কাব্যগ্রন্থই শামসুর রাহমানকে মুগ্ধ করেছিল। শামসুর রহামানের কবিসত্তার বাইরে সব থেকে বড় ব্যক্তি সত্তা ছিল, নতুন প্রজন্মের কেউ লেখালেখির জগতে আসছে তা তিনি কবিতায় লিখুন, ফিচার ই লিখুন, ছোটগল্পই লিখুন, উপন্যাস ই লিখুন, ছড়াই লিখুন-- নতুন মানুষটির মধ্যে যদি এতোটুকু প্রতিভার সন্ধান কবি পেতে,ন তাহলে তাকে সমাজে পরিচিত করবার ক্ষেত্রে শামসুরের মধ্যে কখনো কোনো রকম কার্পণ্য থাকত না।
শামসুরের সমসাময়িকতার থেকে বয়সে ছোট ,সাহিত্য জগতের বহু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁরা তাঁদের সৃষ্টির প্রথম যুগে কবির কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। অসীম সাহার ক্ষেত্রেও এই কথাটা খুব জোরে সঙ্গে বলতে হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে সমাজ মনস্কতা থেকে শুরু করে নান্দনিক বিষয়ের গভীরতা যেভাবে ছিল, তাতে শামসুর মনে করেছিলেন ,একটা ভিন্ন ধরনের কবিতা চর্চার জন্ম দিচ্ছেন অসীম।
এই কাব্য গ্রন্থে , ' বিরহকাতর এক দগ্ধ বাউলিনী' তে অসীম লিখছেন;
' ছড়িয়ে ছিটিয়ে সে বসে আছে বিরহকাতর
এই পূর্ব- উপকৃলে।
তাকে দেখে মনে হয়, স্বপ্ন- প্রাসাদ থেকে
ভিখারিনী বেশে মীরা এসেছে এখানে।'
ষএই মীরা কে ?এই মীরা, কি অসীম সাহার বনলতা সেন? এই মীরা, কি মিথলজির মীরাবাঈ? স্বপ্ন প্রাসাদ থেকে মীরার ভিখারিনীর বেশ ধরা ,এই ব্যাঞ্জনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কৃষ্ণ কাতর মীরাবাঈ কে।যদি পুরাতত্ত্বের গহীন সমুদ্রে নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত না করে আমরা ভাবতে চেষ্টা করি , এই মীরা, চিরন্তন সেই বাঙালি নারী, মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা তারামন বিবি, এই মীরাই হলেন শামসুরের কবিতার বার্ধক্যের বিজন দেওয়ায় বসে থাকা সেই থুত্থুরে বুড়ি , আমাদের চেতনাস্তর কি বলবে? আমরা ভুল ভাবব, মাহুতটুলির সেই তেলওয়ালা আলী বুড়ি ,যে তেল বিক্রির মাঝেই চিতই পিঠে ভেজে বিক্রি করতো। যার কাছ থেকে সকালে চিতই পিঠে কিনে আনার জন্যে আমাদের ছোট্ট বাচ্চু ,ঘুমের ঘোরেও ছটফট করত। তারপর সেই তেলওয়ালী বুড়ির কাছ থেকে দুহাত ভরে কুল নিয়ে এসে, মনের সুখে খেতো ।শামসুর রহমানের শৈশবের এই চিত্রের সঙ্গে কি জাদু বাস্তবতায় মিলে যায় না অসীম সাহার এই মীরা।
আসলে সম চিন্তার বিনি সুতোয় বোনা নেই যখন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই আর দলীয় বৃত্তের বাইরে থেকে মানুষের জন্য লড়াইকে একটা সুনির্দিষ্ট কাতারে এনে দাঁড় করানতে পারা যায় তখন শামসুরের কবিতার সাকিনা বিবি সিটির সিঁদুর মুছে যাওয়া হরিদাসী সমরেশ বসুর ধর্ষিতা গল্পের সেই অভাগিনী আনোয়ারা খান আর অসীম সাহার মিরা কোথায় যেন এসে একটা মিলেমিশে যায় সেই মিলেমিশে যাওয়ার মধ্যে থেকেই ক্ষুরিত হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্ঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠ রূপকার শেখ হাসিনার মুখ যে মুখ চিরন্তন বাঙালির রোদ জল-ঝড় মারিকে উপেক্ষা করে টিকে থাকা বাঙালির মুখ।
' পূর্ব পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায়' কাব্য গ্রন্থের ' শানানো ছুরির নিচে' কবিতাতে অসীম সাহা লিখছেন;
" কসাইখানায় একটি অসহায় পশুর ঝুলন্ত লাশ( এটা এক লাইনে হবে)
ঝর্ণার মতো জমাট- বাঁধা;
সে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে
তার দুটি সকরুণ চোখে ভাষাহীন অব্যক্ত
জিজ্ঞাসা,
যেন তার দেহ স্পর্শ করলেই জীবনের স্বাভাবিক( এক লাইনে হবে)
উত্তাপ
টগবগ করে উঠবে; যেন চোখ থেকে ঠিকরে
পড়বে চকিত বিদ্যুৎ।"
এই কবিতার ভেতর দিয়ে ইমেজারির এক আশ্চর্য খেলা খেলেছেন অসীম শামসুর রহমানের কবিতায় যেভাবে ইমেজারি বা প্রতীকের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, অনেকটা যেন সেই ভাবেই প্রতী ক অসীম সাহার কবিতায় অনেক না বলা বিষয়কে বলে দিচ্ছে এই যে' শানানো ছুরির নিচে' কবিতার ভিতর দিয়ে।
পাক হানাদারদের বাংলাদেশের উপর পৈশাচিকতার সেই ঘূর্ণাবর্ত্যের সময়কেই যেন কবি এখানে একটা প্রতীক হিসেবে কসাইখানার মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চাইছেন। বাস্তবিকই সেই সময়ে ,অর্থাৎ ; মুক্তিযুদ্ধের কালে, পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল একটা কসাইখানা। বদ্ধ ভূমি। যেভাবে বাঙালির উপরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী , তার চিত্রকল্প নির্মাণে, এই যে' কসাইখানা ' শব্দটির ব্যবহার কবি অসীম সাহা করেছেন, তার মধ্যে দিয়ে কিন্তু উঠে আসছে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হিংস্রতার ভয়াবহকতাই।
কসাই যেভাবে মাংস কেটে ,সেই মাংসকে ক্রেতার হাতে তুলে দেয় , ঠিক যেন সেভাবেই গোটা বাংলাদেশকে, বাঙালি জাতিকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বদ্ধভূমিতে পরিণত করে ,লোলুপ মাংসের টুকরোতে পরিণত করেছিল। তাই এখানে কবি, পাকিস্তানের সেই বর্বরতা বোঝাতে ব্যবহার করছেন কসাইখানা শব্দটি ।আর গোটা বাঙালি জাতি যেন সেদিন বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর কাছে পশুর ঝুলন্ত লাশ হয়ে উঠেছিল ।সেই লাশের গা দিয়ে ঝরনার মতো ঠান্ডা রক্ত বয়ে যাচ্ছে। সেই রক্ত বইতে বইতে বরফের মতো জমাট বেঁধে যাচ্ছে। আর সেই সুগভীর বর্বরতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব ।
এই চিত্রকল্প এক অসাধারণ মুন্সিয়ানায় আলোচ্য কবিতার মধ্যে অসীম সাহা ফুটিয়ে তুলছেন। কসাইখানায় ঝুলন্ত লাশের চোখ থেকে যেমন এক ভাষাহীন বোধহীন অথচ তীব্র প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হয় ,ঠিক সেভাবেই অসীম সাহা এই কবিতায় অদ্ভুত ইমেজারির মধ্যে দিয়ে, চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন।তিনি তুলে ধরেছেন সময়ের এক যন্ত্রণাকে। একাত্তরের শহিদদের স্মৃতি তর্পণ করলে আমরা এখনো যেন তাঁদের জীবনের স্বাভাবিক উত্তাপ অনুভব করতে পারি। সেই স্বাভাবিক উত্তাপের এক না বলা কান্না উৎসারিত হচ্ছে অসীম সাহার এই কবিতার ভেতর দিয়ে।
কবির প্রত্যাশা ,শহিদরা আগামীর প্রত্যাশায় কিছুতেই নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে থাকবেন না ।এই যে কসাইখানা লাশ থেকে তাঁদের চোখ এবং সেই চোখ থেকে ঠিকড়ে পড়া বিদ্যুতের প্রত্যাশা --এর ভেতর দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সার্বজনীন বার্তাটা যেভাবে অসীম সাহা তুলে ধরেছেন ,তা যেন শামসুর পরবর্তী সময়ের কবিদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি পরম মমতার চিহ্ন।
ছন্দ ঘিরে অসীম সাহার একটা ভালো লাগা ছিল ।ছন্দহীন কবিতা বোধহয় তাঁর পছন্দের ছিল না ।যেমন ছিল না ছন্দহীন জীবন ।সেই কারণে তাঁর জীবনের প্রায় শেষ পর্বের কাব্যগ্রন্থ 'পুনরুদ্ধার', তার মধ্যে আমরা দেখতে পাই, ছন্দঘিরে কেবল পরীক্ষা নিরীক্ষাই নয়। সেখানে অসীম সাহা ছন্দের সমস্ত ধরনের প্রকরণকে এই কাব্যগ্রন্থে যেন একটা নতুন রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অসীম সাহা ছন্দের গতিকে নিয়ে এসেছিলেন, একটা দুরন্ত, দুস্তর হাওয়ার তীব্রতার মত করে ।কেউ কেউ অনুমান করেন, বাংলা কবিতায় ,দুই বাংলা মিলিয়েই ছয়ের দশকে যাঁরা কাব্য চর্চা করতে শুরু করেন, তাঁদের মধ্যে ছন্দের শুদ্ধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অসীম সাহার একটা নিজস্ব সাফল্য এবং বৈশিষ্ট্য ছিল।
অসীম সাহা যে সমস্ত ছড়া লিখেছেন , এমনকি গান লিখেছেন , সেসবের মধ্যেও আমরা ছন্দের এই সুন্দর ব্যবহার পেয়েছি ।এই প্রসঙ্গে আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে , মাসুদ পথিকের ,'নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ' বলে একটি ফিল্মের জন্য তিনি গান লিখেছিলেন। ফিল্মটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। গানটিতে সুর ও নিজে অসীম সাহা দিয়েছিলেন।গানটি ছিল;' কৃষ্ণ দরশনে রাধা কদম তলে যায়।' গানটি গেয়েছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী প্রিয়াংকা গোপ।
অনেকেরই হয়তো জানা আছে, আবার অনেকের হয়তো জানাও নেই ,অসীম সাহা কিন্তু রীতিমতো ধ্রুপদী সংগীত জানতেন। বাংলায় ধ্রুপদী সংগীত জানা কবি, রবীন্দ্র যুগের পরে খুব একটা আছেন কিনা জানা নেই। সে ক্ষেত্রে দুই বাংলা মিলিয়েই কবি অসীম সাহা ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। ছয়ের দশকের বাংলা কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ, শামসুল ইসলাম, মহম্মদ নুরুল হুদা, জাহিদুল হক ইত্যাদি কবিরা ফিল্মের জন্য গান লিখেছেন ।যেমন এখন এপার বাংলায় লেখেন কবি শ্রীজাত। কিন্তু ছয়ের দশকের কবিদের মধ্যে সম্ভবত অসীম সাহা ই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তিত্ব ,যিনি নিজের গানে নিজে সুর দিয়েছেন।
শামসুর রহমানের মতই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ছিল অসীম সাহার গভীর নৈকট্য ।সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা এবং অবদান বাঙালি জাতি চিরকাল মনে রাখবে। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী গণ আন্দোলনে একেবারে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহপাঠী। তা বলে কখনোই কোনো ব্যক্তি প্রয়োজনে শেখ হাসিনার দ্বারস্থ তিনি হননি। যদিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহপাঠী অসীম সাহার পারিবারিক আর্থিক সংকটের কথা জানবার পর ,সেই সমস্যার নিরসনে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে ব্যক্তিগত স্তরে প্রত্যাশী হয়েছিলেন।
সম্পূর্ণভাবে কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি পাতানোর যে ঘরানা টি শামসুর রাহমানেরা তৈরি করেছিলেন ,সেই ঘরানার এক অক্লান্ত পথিক ছিলেন অসীম সাহা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহপাঠী বলে, আমলাতন্ত্র কিভাবে প্রশাসনকে ঘিরে ফেলছে একথা কবিতার ভাষায় বলতে কিন্তু অসীম সাহা কখনো দ্বিধা করেননি ।আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কিভাবে পুনঃ স্থাপিত করবার লক্ষে জীবনপাত করছেন তাঁর সহপাঠী হাসিনা , সে কথা বলবার ক্ষেত্রেও কিন্তু কোনো রাখ ঢাক , গুর গুর কখনো অসীম সাহা করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে, কেবল বাঙালির জীবনে প্রতিষ্ঠিত করাই নয়। সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিভাবে প্রতিফলিত করতে পারা যায়, সেই লক্ষ্যে অসীম সাহা তাঁর গোটা জীবনের সাহিত্যকর্ম কে পরিচালিত করেছেন। সচেষ্ট থেকেছেন সেই লক্ষ্যে।
কেবল বাংলাদেশের বাঙালি নয় ,ভারত সহ গোটা বিশ্বে যে মানুষরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে মূল সুর ,ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ,তাকে গেঁথে দিতে ছিল অসীম সাহার আন্তরিক প্রেষ্টা। বাংলাদেশের বাঙালি আর ভারতের বাঙালি কে কখনো ভিন্ন পংক্তিতে বসিয়ে বিচার করা ,এটা তাঁর পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল না। তাঁর পূর্বসূরী সুফিয়া কামাল ,শামসুর রাহমান ,কবীর চৌধুরী,কালিম শরাফিদের মত মানুষদের তিনি ছিলেন স্বার্থক উত্তরাধিকারী ।
এই ক্ষেত্রে স্বভাবতই আল মাহমুদ, বদরুদ্দিন উমরের চিন্তা ধারার সঙ্গে ,অসীম সাহার ছিল একটা ফারাক। তিনি খুব স্পষ্টভাবেই বলতেন, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না , তারা বাংলাদেশকেই বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশকেই স্বীকার করে না।
এই যে স্পষ্টবাদী কথা বলা, এজন্য তাঁর শত্রুর অভাব ছিল না ।বিশেষ করে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি, বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা অধিষ্ঠিত ছিল, সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার থাকার জন্য অনেক ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে জীবন জীবিকা নির্ধারিত করতে হয়েছিল কবি কে। কিন্তু তাই বলে কখনো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শক্তির কাছে এতটুকু আত্মসমর্পণ তৈরি তিনি করেন নি ।কোন অবস্থাতেই ব্যক্তিজীবনের কোনো চাওয়া পাওয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষই হোক বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ধারণাই লালিত পালিত পাক সহযোগীদের কাছেই হোক, হাত পাতেন নিয়ে অসীম সাহা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এভাবে অন্তরে ধারণ করে , সেই বোধ কে নিজের যাপনচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, সৃষ্টির ক্যানভাস কে ফুটিয়ে তোলা-- এমন মানুষ বাংলাদেশে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অসীম সাহার প্রয়াণ সেই শূন্যতাকে আরো খানিকটা স্পষ্ট করে দিল।
মুক্তিযোদ্ধারা যে কখনো ব্যক্তি চাওয়া পাওয়া নিরিখে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেননি-- এই বোধকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমৃত্যু অসীম সাহা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করবার ক্ষেত্রে, কেবল কবিতা দিয়ে নয় ।গদ্য দিয়ে নয়।মন মানসিকতা দিয়েও কবি অসীম সাহা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গেছেন।
তাঁর সেই ভূমিকার মধ্যে দিয়ে আগামী বাংলাদেশ নতুন করে স্বপ্ন দেখবে। নতুন করে ভাববে ।উন্নত প্রযুক্তির মধ্যে দিয়ে আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যেমন কৃষি, শিল্প সমস্ত কিছুতেই একটা উল্লেখযোগ্য স্থানে তাঁদের পৌঁছুতে হবে ।ঠিক তেমনিই সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গন কেও সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত রেখে ,কিভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় বৈজয়ন্তীকে আরো উর্ধ্বে তুলে ধরে রাখা যায়, ' বিশ্বমানব হবি যদি ,শাশ্বত বাঙালি হ' -- ব্রতচারী স্রষ্টা স্যার গুরুসদয় দত্তের এই আপ্ত বাক্যকে বাঙালি তাঁদের প্রাণের কথায় পরিণত করবে সেই ছিল অসীম সাহার একমাত্র লক্ষ্য।