শ্যামরায়মঙ্গল- প্রতাপাদিত্যের গুপ্তধন

দশম অধ্যায়

রবিবার লাঞ্চের নিমন্ত্রণে দুপুর বারোটার অনেক আগেই সজল আর চৈতালি চলেএল মনোময়ের ফ্ল্যাটে খাওয়ার দেরি আছে। তাই চা নিয়ে আড্ডায় বসে গেল সকলে। সুজাতা রান্নাঘরে টুকটাক দেখভাল করতে করতে আলোচনায় যোগ দিচ্ছিল মাঝেমধ্যে এসে। স্বাতীর জন্য খেলনা নিয়ে এসেছে চৈতালি। সে সেটি নিয়ে খেলায় মত্তচায়ে চুমুক দিয়ে মনোময় বলল, ‘বলো, এই দুদিন কে কী তথ্য যোগাড় করে উঠলে ?’

‘আমার মনে হয়েছে, তিন মজুমদারকে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছিলেন মানসিংহ’, সজলই শুরু করল।

‘যদিও আমি তোমার কথায় সহমত, তবু তুমি তোমার যুক্তি দাও’, মনোময় বললেন।

‘একমাত্র জয়ানন্দ ছাড়া বাকি দুই মজুমদারই আসলে অতি সামান্য ব্যক্তি ছিলেন। ভবানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্ত, দুজনেই কানুনগো দপ্তরের কর্মচারী। প্রতাপের পরাজয়ের পরেই এই দুই ব্রাহ্মণ সন্তান জমিদার তথা রাজা হয়ে উঠলেন। হলেন সে ভালো কথা, কিন্তু কথা হল এঁদের উপর এমন কৃপা মানসিংহ করলেন কেন ? আরো ভালো করে বললে মানসিংহ মোঘল দরবারে জাহাঙ্গীরকে কনভিন্সড করিয়ে এসব জমিদারীর সনন্দ পাইয়ে দিয়েছিলেন। মানসিংহ বিশেষ উপকৃত না হলে এমন কাজ করবেন কেন ?’

মনোময় মন দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। ভারতচন্দ্র পরিষ্কার জানিয়েছেন যে ভবানন্দ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়া মানসিংহ এবং তাঁর বাহিনীকে সাতদিন খাবার দাবাড়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন’।

‘কেবল তাই নয় স্যার, ভবানন্দ মানসিংহের সঙ্গে সঙ্গে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন যশোরে এবং যুদ্ধের সময় উপস্থিত থেকে নানা মন্ত্রণা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন’।

মনোময় একবার ‘হুম’ বলে ডাইরিটা বের করে বললেন,

‘ভারতচন্দ্র লিখেছেন,

আগে পাছে দুই পাশে দুই সারি লস্কর।

চলিলেন মানসিংহ যশোর নগর।।

মজুন্দারে সঙ্গে নিলা ঘোড়া চড়াইয়া।

কাছে কাছে অশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসিয়া’।।

চৈতালি চুপ করে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সজল একবার ওর মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমার কিন্তু ভবানন্দকে নিয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন রয়েছে’।

‘বল’, উৎসাহ দিলেন মনোময়।

‘ভবানন্দ কাজ করতেন সপ্তগ্রাম সরকারের কানুনগো বিভাগে। মানসিংহ বাংলায় প্রবেশ করলে তিনি নানা উপঢৌকন নিয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মানসিংহ সুবেদার ছিলেন ক’দিন আগে। সুবেদার মানে প্রায় সুলতানের মতন ক্ষমতা। সেই সুবেদার একজন সামান্য কর্মচারীর সাথে দেখা করবেই বা কেন ? মানসিংহ কেবল দেখাই করলেন না, ভবানন্দের গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত গেলেন। এই পুরো ঘটনাটা আশ্চর্যজনক মনে হয় না স্যার, আপনার ?’

মনোময় চৈতালির দিকে বললেন, ‘হাত বাড়িয়ে ওই র‍্যাক থেকে ভারতচন্দ্রের ’অন্নদামঙ্গল’-টা আনো তো’।

বইটি হাতে পেয়ে দ্বিতীয় পর্বে খুঁজে বের করলেন,

‘দেখা হেতু দ্রুত হয়ে নানা দ্রব্য ডালি লয়ে

 বর্দ্ধমানে গেলা মজুন্দার।।

... মানসিংহ বাঙ্গালার   যত যত সমাচার

  মজুন্দারে জিজ্ঞাসিয়া জানে’।

  বইটা স্যারের হাত থেকে নিয়ে সজল বের করে দেখাল লেখা রয়েছে,

‘মানসিংহ গেলা মজুন্দারের আলয়।

দেখিলা গোবিন্দদেবে মহানন্দময়’।।

 ‘তুমি ঠিকই বলেছ সজল। মানসিংহের মতন একজন কেউকেটা হঠাতই ভবানন্দের মতন একজন সাধারণ কর্মচারীর বাড়িতে যাবেন কেন ? এমনিতে রাজা প্রজার বাড়িতে যেতেই পারেন। কিন্তু মানসিংহ এখানে বিশেষ যুদ্ধ উপলক্ষ্যে এসেছেন। সঙ্গে অজস্র সৈন্যসামন্ত। আচমকাই ভবানন্দের বাড়িতে কেন যাবেন ? এই জায়গাটিতে রহস্য অবশ্যই রয়েছে’, মনোময় একমত হলেন।

 ‘আরো পয়েন্ট আছে স্যার’।

 ‘কী ?’

 ‘ভবানন্দের মতন একজন সামান্য কর্মচারী মানসিংহের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়া হাজার হাজার সৈন্যের সাতদিনের জন্য ভরণপোষণ করিয়েছিলেন। কেবল সৈন্য নয়, হাতি ও ঘোড়াও। প্রশ্ন হল এতজনের পেছনে খরচ করার অর্থ ভবানন্দ কোথা থেকে পেলেন’ ?

 ‘ঠিক কথা’।

 ‘যতই ভারতচন্দ্র বলুক দেবী অন্নপূর্ণার কৃপায় সব ব্যবস্থা হয়েছে, সেকথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনকি পরে জাহাঙ্গীরও যে বিশ্বাস করেন নি, সেকথা ভারতচন্দ্রই জানিয়েছেন’।

 ‘তুই বলতে কী চাইছিস ?’, এইবারে চৈতালি প্রশ্ন করল সজলকে।

 ‘আমার একটা কথা মনে হয়েছে। বলব ?’

 ‘বল’।

 ‘মানসিংহের আক্রমণের কিছুকাল আগেই সপ্তগ্রাম সরকার প্রতাপ দখল করেছিলেন। এই সরকারের খাজনা প্রতাপ মোঘল দরবারে পেশ করছিলেন না। সেসব ছিল ভবানন্দ আর লক্ষ্মীকান্তের জিম্মায়। মানসিংহ বর্ধমানে আসা মাত্রই ভবানন্দ সেই কারণেই দেখা করেছিলেনউদ্দেশ্য প্রতাপের বিরুদ্ধে মানসিংহকে সাহায্য করা। বিশাল খাজনার হদিশ পেতেই মানসিংহ একেবারে ভবানন্দের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন’।

  সুজাতা লাঞ্চের জন্য তাগাদা দিতে এসেছিলেন। সজলের কথা শুনে বললেন, ‘ভবানন্দের সাথে তুমি লক্ষ্মীকান্তকে জড়িয়ে দিলে দেখছি’।

 ‘বৌদি লক্ষ্মীকান্তের কাজই ছিল রাজস্ব বিভাগে। প্রতাপ যে মোঘল দরবারে খাজনা জমা করছেন না, সেটি নিয়েই লক্ষ্মীকান্তের সাথে প্রতাপের কিছু বিরোধ হয়েছিল। এর ফলেই লক্ষ্মীকান্ত স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়েছিলেন। যশোর থেকে যে খাজনা জমা পড়ছে না সে সংবাদ মানসিংহের কাছে ছিল। তিনি প্রতাপের রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারীকে নিজের বশে আনার জন্যই কাশীতে গিয়ে লক্ষ্মীকান্তের পিতা কামদেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ভবানন্দের কথা মানসিংহ জানতেন না। ভবানন্দ স্বেচ্ছায় মানসিংহের সাথে সাক্ষাৎ করে সহায়তার অঙ্গীকার করেছিলেন’।

  ‘তোমার হাইপোথিসিস বেশ স্ট্রং, মানতেই হবে। এখন চল খেয়ে নেবে। তারপর আমিও শুনব বাকি কথা’, সুজাতা কথা বলেই ডাইনিং টেবিলের দিকে চললেন।

  ভবানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্ত দুজনে যে দোসর ছিলেন তার একটা লিড আমি তোমাকে দিতে পারি, সজল’, খেতে যাওয়ার আগে মনোময় বলে উঠলেন

 তাই ? স্যার, আমি তাহলে ভুল কিছু বলিনি ?’, সজল বেশ খুশি হয়েছে

 হুমম, শোনো’, বলে মনোময় ডাইরি খুললেনবললেন, ‘লালমোহন বিদ্যানিধিরসম্বন্ধনির্ণয়গ্রন্থবলছে,

জীয়াসর্ব শাস্ত্রবিদ পাণ্ডিত্য অসীম

তাদেখি মানসিংহ করে ভক্তি অনুপম

মানসিংহ গুরু পুত্র করে অন্বেষণ

কালীঘাটে দেখা নাম লক্ষ্মী-নারায়ণ।।

আজি হতে তব ইচ্ছা যত লও ভূমি

কুলীনে ধরুক ছাতা অন্নদাতা তুমি।।

ভবানন্দ সহচর কানুন গোভার

ইচ্ছামত তব রাজ্য হবে যে বিস্তার

  আজ ছিল ভাতের নিমন্ত্রণ। ডাল, দু’রকম মাছ আর মাংস। সঙ্গে চাটনি। ঘরোয়া রান্না। সুজাতার রান্না আগেও খেয়েছে সজল। চৈতালি এই প্রথমবার। খেয়ে দেয়ে ‘বৌদি, আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম’ বলে স্বাতীর সাথে কিছুক্ষণ খেলা করে যখন বসার ঘরে এল ততক্ষণে মনোময় গুছিয়ে বসেছেন।

মনোময় বলছিলেন যে লক্ষ্মীকান্ত এবংলক্ষ্মী নারায়ণ একই ব্যক্তিমানসিংহ অন্বেষণ করে লক্ষ্মীকান্তকে খুঁজে বের করেছিলেনএই কাজে সাহায্য করেছিলেন জয়ানন্দ মজুমদারভবানন্দ সহচর কানুনগোভারবাক্যটি ব্যাখ্যা করে বললেন প্রতাপাদিত্যের অধীনে অল্পসময়ের জন্য হলেও ভবানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্ত, একত্রে কানুনগোর দায়িত্ব পালন করেছিলেন

  কাজের দিদির হেল্প নিয়ে বাসনকোসন সিঙ্কে রেখে সুজাতা এসে বসতেই মনোময় চৈতালিকে বললেন, ‘এবার তোমার রিপোর্ট দাও’।

চৈতালি যা বলল তাতে লক্ষ্মীকান্ত সম্পর্কে জানা গেল যে প্রতাপের পরাজয়ের পরে মাগুরা, খাসপুর, কলিকাতা পাইকান, আনোয়ারপুর আমিরাবাদ ইত্যাদি আটটি পরগনার জমিদারী পেলেন। হাভেলিনগর বা হালিশহরে জমিদারবাড়ি গড়ে তুললেন। বসন্তরায়ের পুত্র রাঘব রায়, যিনি কচু রায় নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি পিতার অংশটি পেলেন। তবে তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। সরশুনা অঞ্চল কিছুদিন বাদে লক্ষ্মীকান্তের অধিকারে চলে এসেছিল। নিকটেই বড়িশাতে ১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত দুর্গাপূজা শুরু করলেন।

  লক্ষ্মীকান্তের জ্যেষ্ঠপুত্র রামরায় হালিশহরে থাকলেও দ্বিতীয়পুত্র গৌরীকান্ত নিমতা-বিরাটিতে চলে আসেন। তৃতীয়পুত্র হুগলি এবং অপর এক পুত্র মহাদেব মেদিনীপুরের কিছু অঞ্চলের দেখভাল করতে থাকেন। লক্ষ্মীকান্ত জমিদারী পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেন নি। কিন্তু পুত্রেরা বিভিন্ন অঞ্চলের দেখভাল করতেন। রাজস্ব দুর্গাপূজার সময়ে বরিশার কাছারিবাড়িতে জমা হত। তৃতীয়পুত্র গোপাল রায় উত্তরপাড়াতে ১৬৬০ সালে কাছারিবাড়ি তৈরি করেছিলেন। তবে উত্তরপাড়ায় পাকাপাকিভাবে এলেন লক্ষ্মীকান্তের প্রপৌত্র রত্নেশ্বর রায়। শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায়ের থেকে জমি গ্রহণ করে চলে এলেন এখানে। বালিগ্রামের উত্তরদিকে অবস্থান বলে নাম হল ‘উত্তরপাড়া’।

 ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। শেওড়াফুলির রাজা কোথা থেকে এল’, সুজাতা প্রশ্ন করলেন।

 ‘শেওড়াফুলির রাজারা হলেন বাঁশবেড়িয়ার রাজবংশের অংশ’, চৈতালি বলল।

 ‘অর্থাৎ ...’

 ‘অর্থাৎ জয়ানন্দ মজুমদারের বংশধর। আর জয়ানন্দ হলেন তিন মজুমদারের একজন, যিনি প্রতাপের বিরুদ্ধে মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন’, এবারে উত্তর দিলেন মনোময়।

 ‘বাব্বা, মজুমদারে একেবারে ছড়াছড়ি দেখছি’, সুজাতা মুখ বেঁকালেন।

‘ইকিড় মিকিড় চাম চিকির

চামে কাটা মজুমদার...।

 এই মজুমদারদের নিয়েই ছড়ার জন্ম সেই সময়ে’।

  ‘তিন মজুমদারের মধ্যে সদ্ভাব ছিল। রত্নেশ্বর ব্যারাকপুর অঞ্চলের জমির বিনিময়ে উত্তরপাড়া-কোতরং অঞ্চল পেলেন। উত্তরপাড়ায় তৈরি করলেন ‘সাবর্ণ ভিলা’, যার একটা পুরানো ছবি আমি যোগাড় করেছি। দেখুন’।


  সকলে চৈতালির মোবাইলে উপর ঝুঁকে পড়লেন ছবিটি দেখতে। মনোময় সাবাসি জানিয়ে বললেন, ‘অল্প সময়ে ভালো একটা কাজ করে ফেলেছ চৈতালি। গ্রেট। ছবিটা অনেক পুরানো এবং অস্পষ্ট। তবুও একটা আইডিয়া পাওয়া যাচ্ছে’।

 ‘এই সাবর্ণ ভিলার একদিকে ছিল শ্যামরায়ের মন্দির, অন্যদিকে পঞ্চমুণ্ডের আসন’, চৈতালিবলল

 ‘শ্যামরায়ের মন্দির ! বল কী ! এই তাহলে শ্যামরায়মঙ্গলের উৎস ! দেখা যাবে সেই মন্দিরটি ?’, মনোময়ের উচ্ছ্বাস বোঝা গেল গলার স্বরে।

 ‘সরি স্যার। সাবর্ণভিলা ভাঙ্গা হয়ে ‘মেনকা অ্যাপার্টমেন্ট’ হয়ে গিয়েছে কয়েকবছর হল’।

***

‘রিপোর্ট কী প্রিয়ব্রত ?’

 ‘স্যার, আপনার অনুমান সঠিক। এই টিমটা অনেকগুলো অ্যান্টি-সোশাল একটিভিটির সাথে যুক্ত আছে। আর্মস ট্রাফিকিং, ড্রাগস ট্রাফিকিং ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব বিভিন্ন জনের উপরে আছে’।

 ‘এভিডেন্স কী পেয়েছ ?’

 ‘স্যার, খুচরো পেডলার দু’একটা ধরা পড়েছে। তবে তাদের থেকে র‍্যাকেটের টপ লোকেদের নাম পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওরা সেসব জানেও না। রেড করলে কয়েকদিন বন্ধ থাকার পরে আবার অন্য পেডলার চলে আসছে’।

 ‘তোমাকে যে কয়েকজনের উপরে নজর রাখতে বলেছিলাম, তার রেজাল্ট কী হল ?’

 ‘স্যার, অবজার্ভ করা হচ্ছে ওদের। ওদের হাত অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। কিছু পাওয়ারফুল লোক জড়িয়ে যেতে পারে’।

 ‘তুমি আপাতত কেবল নজর রাখবে আর আমাকে রিপোর্ট করবে। কোনো একশন নেবে না, আমার পারমিশন ছাড়া’।

 ‘রাইট স্যার’।

 ‘নাও ইউ ক্যান লিভ’।

 ‘ইয়েস স্যার’, বলে ডেপুটি কমিশনারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে প্রিয়ব্রত ভাবছিল অন্যকথাতাঁরএই স্যারটিকেঠিক চিনে উঠতে পারেনা সেএতো এতো পলিটিক্যাল প্রেসার কি করে যে তিনি সামলান কে জানেসব পলিটিক্যাল পার্টির লোকজন ক্রাইমের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে কেস হ্যান্ডেল করাই মুশকিল হয়ে পড়েছেমাঝে মধ্যেই তদন্তের মাঝপথে উপরমহল থেকে ফোন আসেচ্যাটার্জি স্যার দুপাপিছিয়ে যান, আবার একপা এগোনসুযোগের অপেক্ষায় থাকেনকখনও একপা পিছিয়ে এগোন দুপাএ এক ট্যাগ অব ওয়ারের খেলা চলে সর্বক্ষণটাকা ওড়ে সর্বত্রকোটি কোটি টাকার খেলাএর মাঝেই অর্জুনের মতন পাখির চোখের দিকে নজর রেখে চলেন ডেপুটি স্যারবর্তমানে যে কেসটি কে নিয়ে পড়েছেন তার লেজ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছেচ্যাটার্জি স্যারের মাথায় কী আছে প্রিয়ব্রত জানেনাতবে অর্ডার ক্যারি করে চলেছে বিনা প্রশ্নেদেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়

***

  সেদিন মনোময়ের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ে ঠিক করা হল পরেরদিন বিকেলে উত্তরপাড়ায় তিনজনে মিলে যাবে সাবর্ণ ভিলার এলাকাটি দেখতে। চৈতালি যখন জানাল যে সাবর্ণভিলা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে কয়েকবছর আগেই তখন কিছু একটা ভাবনা থেকে মনোময় রত্নদীপকে ফোন করেছিলেন। আগে একবার এ নিয়ে কথা হলেও আবার প্রশ্ন করে কনফার্ম করেছিলেন হুগলির যে বাড়িটি থেকে ‘শ্যামরায়মঙ্গল’ পাওয়া গিয়েছে সেটি রয়েছে উত্তরপাড়ায়। রত্নদীপ ‘হ্যাঁ’ বলায় মনোময় ‘সাবর্ণভিলা’-র কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে রত্নদীপ নাম শুনেছে সেই ভিলার, তবে সেটি বর্তমানে আর নেই। মনোময়ের স্বাভাবিকভাবেই পরের প্রশ্ন ছিল তাহলে পুঁথিটি কোথায় পাওয়া গিয়েছে ? রত্ন যা জানাল তা হল সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশধরেরা ঐ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরানো সাবর্ণভিলার আশেপাশেই। এমনই একটি পুরানো বাড়ি থেকে পুঁথিটি পাওয়া গিয়েছে। এরপরেই রত্নদীপের থেকে লোকেশন জেনে নিয়ে মনোময় ঠিক করলেন যে পরের দিন বিকেলের দিকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড়িয়ে যাবেন উত্তরপাড়ায়। চৈতালির অফিস ঐ সাবডিভিশনেই। ফলে ওর অসুবিধা নেই। আর সজল চেষ্টা করবে হাওড়া থেকে চলে আসার।

 প্রোগ্রাম মোটামুটি ঠিক হওয়ার পরে মনোময় সজলকে বললেন ‘কালীক্ষেত্র কলিকাতা’ থেকে লক্ষ্মীকান্তের বংশধরদের একটি তালিকা তৈরি করে নিতে বাড়ি ফিরে। বিকেল হয়ে এসেছিল। সজল আর চৈতালি একপ্রস্থ চা খেয়ে বের হয়ে এল মনোময়ের ফ্ল্যাট থেকে।

 চৈতালিরা ফ্ল্যাট থেকে বের হতেই ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে সুজাতা অস্ফুটে বলে উঠল, ‘মেয়েটা কিন্তু চমৎকার। ওর সাথে সজলকে কিন্তু মানাবে বেশ’।

 মনোময় সামান্য চমকেছিলেন। হেসে বললেন, ‘তুমি পারোও বটে, উফ্‌’।

‘ওসব মেয়েদের মন তুমি বুঝবে না, যত্তসব আনরোমান্টিক’, ঝাঁঝিয়ে উঠল সুজাতা কিছুটা।

এর উত্তরে মনোময়ের যেটা করতে ইচ্ছে করছিল সেটা মেঝেতে খেলতে থাকা মেয়ের দিকে চোখ পড়ে যাওয়ায় আর করে উঠতে পারলেন না।

 

  • রজত পাল
  • চামে কাটা মজুমদার