গুজব

 
' গুজব ' শব্দটার সঙ্গে বাঙালির একটা মিতালি আছে।এই কয়েকমাস হলো, এক সন্ধ্যায়, একটা রাজনৈতিক দলের সদর কার্যালয়ে বসে আছি।হঠাৎ দেখি হন্তদন্ত হয়ে এক যুবক এসে খবর দিলেন, অমর্ত্য সেন মারা গেছেন।
যুবকটি যে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে বসে ছিলাম, সেই দলের সমাজমাধ্যমে কর্মরত ।ফলে তার কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।দলটির অফিসেও একটা বিমর্ষতার চাদর ছড়িয়ে পড়ল। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায়ের পরে এপার বাংলার বাঙালিকে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় অমর্ত্য সেনের মত আর কেউ ই পরিচিতি এনে দিতে পারে নি।ওপার বাংলার নিরিখে বলতে গেলে , অবশ্য ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম করতে হয়।
স্বভাবত ই ফোন করলাম অধ্যাপক সেনের জ্যেষ্ঠা কন্যা অন্তরাকে।তাঁর ফোন ব্যস্ত।ফলে দুশ্চিন্তা বাড়তেই লাগল।ফোন করলেন স্বয়ং অন্তরা।প্রথমেই বললেন; অধ্যাপক সেন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।বুক থেকে যেন একটা ভারি পাথর নেমে গেল।বললাম, তোমার বাবার আয়ু বেড়ে গেল।
ভাবলাম, একটা রাজনৈতিক দলের সমাজমাধ্যমে কর্মরত একজন, কি করে যাচাই না করে , একটা ফেকনিউক কে মান্যতা দিয়ে এভাবে গুজব ছড়াতে পারল? একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘিরে যদি কিছু বলতে হয়, তবে খবর টা যাচাই করতে হয় নাকি? তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেই , সেই ছেলেটির অধ্যাপক সেনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তাহলে তো সে অধ্যাপক সেনের ' প্রতীচী ট্রাস্টে' র কলকাতা আপিসের সঙ্গে কথা বলতে পারত।এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় ঘিরে বলবার সময়ে কি আরো অনেক অনেক বেশি সতর্ক হওয়া দরকার নয়? 
এই ঘটনার প্রায় পুনরাবৃত্তি হতে দেখলাম আমরা কয়েকদিন আগে প্রখ্যাত হিউম্যানিস্ট নোয়াম চমস্কিকে ঘিরে। সমাজ মাধ্যমে তাঁর শারীরিক সুস্থতা ঘিরে এমন ভাবে প্রচার শুরু হয়ে গেল যা গোটা বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে প্রথমাবস্থায় চরম বিমর্ষ করে তুলল।সমাজ মাধ্যমের এই গুজব হোয়াটস অ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপে প্রায় দাবানলের মত ছড়াতে শুরু করে দিলো।অতি উৎসাহীরা চমস্কিকে ঘিরে পোষ্টার তৈরি করে ফেললেন।হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীরা সেই পোষ্টার প্রচারে ,'আগে কে বা প্রাণ , করিবেক দান, তারি লাগি কাড়াকাড়ি' ফেলে দিলেন।
                   যদিও এইসব পোষ্টার থেকে শুরু করে গুজুব ছড়ানো লোকজনেরা একবারের জন্যে কে নোয়াম চমস্কি, কি তাঁর অবদান-- এইসব বিষয় নিয়ে একটা শব্দ ও উচ্চারণ করেন।চমস্কি খায়,  না মাথায় মাখে- তা নিয়ে এই ফেসবুক বিপ্লবী, হোয়াটস অ্যাপ বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র- শিক্ষকদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
সাতের দশক।কেন্দ্রে তখন জনতা পার্টির সরকার সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।তার আগে, জরুরি অবস্থা বিরোধী রাজনীতির জেরে লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে।মোরারজি দেশাই সরকারের উপর জয়প্রকাশের তখন অবিসংবাদী প্রভাব।ক্ষমতার অলিন্দ্যে কোনো ভাবেই না আসা লোকনায়ককে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তখন তুমুল জনপ্রিয়তা।
জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের সময়কাল থেকেই শারীরিক ভাবে বেশ অসুস্থ জয়প্রকাশ।কিডনীর দুরারোগ্য ব্যধি।ডায়ালেসিস চলে। সেই অবস্থাতেও জন্মলগ্ন থেকেই আভ্যন্তরীণ সঙ্কটে দীর্ণ দেশাই সরকারের তিনি কার্যত মুসকিল আসান।
                  টেলিভিশন তখন এসেছে।তবে তা কেবলমাত্র বড়লোকদের বাড়িতেই সীমাবদ্ধ।খবরের জন্যে গোটা ভারতবাসীর একমাত্র সম্বল রেডিও।আকাশবাণী। সেই আকাশবাণী ই ঘোষণা করল লোকনায়ক প্রয়াত।গোটা দেশে শোকের ছায়া। রেডিও তে সব অনুষ্ঠান বাতিল।শোকের আবহে যে ধরণের গান বা যন্ত্রসঙ্গীত হয়, সেসব ই বাজছে।
                     হঠাৎ ই রেডিও তে ঘোষণা।না, জয়প্রকাশ লোকান্তরিত হন নি।সারা দেশ উদ্বেল হয়ে উঠল আনন্দে।
আসলে পাটনার কদমকুয়ার বাড়িতে অসুস্থ জয়প্রকাশের হৃদস্পন্দন হঠাৎ থেমে গেছিল।সেখানে থাকা ডাক্তারদের কর্ম তৎপরতায়, চেস্ট মেসেজের পর ধীরে ধীরে হৃৎস্পন্দন ফিরে আসে লোকনায়কের।
একজন মুমুর্ষ রোগীর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চেস্ট মেসেজ দেওয়া চিকিৎসা বিদ্যার একটা অংশ।কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ভাবে চেস্ট মেসেজ দিলে রোগী ফিরে আসেন।পশ্চিমবঙ্গে সেই সময়ের মন্ত্রী নন্দগোপাল ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে এস এস কে এম হাসপাতালে এমনটা হয়েছিল।' আজকাল' এ সেইখবর বিস্তারিত ভাবে প্রকাশিত ও হয়েছিল।
কিন্তু জয়প্রকাশ নারায়ণের ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যে মানুষটার হৃৎস্পন্দন চেস্ট মেসেজের পর ফিরে এলো, সেই মানুষটিকে ঘিরে সরকারী প্রচার মাধ্যম অতি তৎপর হয়ে কি করে অমন খবর পরিবেশন করল? সরকারী প্রচার মাধ্যমের একটা দায়িত্ববোধ থাকবে না?
এই প্রশ্নটাই আবার ওঠে সমাজমাধ্যমে অমর্ত্য সেন বা নোয়াম চমস্কি কে ঘিরে উঠে আসা আসা গুজব থেকে। সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকদের যে ভূমিকা এবং গুরুত্ব , আজ সমাজমাধ্যমে কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে , সাংবাদিকদের সেই ভূমিকার সঙ্গে পাঙ্গা দিতে চায়।
কিন্তু মজার কথা হল, পেশাদার সাংবাদিকের যে দায়িত্ববোধ আছে, সমাজমাধ্যমে অতি উৎসাহী এই পোস্টদাতাদের মধ্যে সেই দায়িত্বের ন্যুনতম প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না।পেশাদার সাংবাদিকেরা জানেন, তাঁদের অতি সামান্য একটা ভুলের ও প্রভাব সমাজ জীবনে কী হতে পারে।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া একটা বড় অংশের মানুষ , সেই দায়িত্ববোধের ধারপাশ দিয়ে হাঁটেন না।
বিজেপি তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে আই টি সেল পরিচালনা করে। এই আই টি সেলের প্রধান কাজ ই হলো গুজব ছড়ানো।টাকার জোরে অত্যন্ত সঙ্গবদ্ধ ভাবে, প্রযুক্তি সবধরণের আধুনিকতাকে আশ্রয় করে তারা সেটা করে।
রাজনীতি এখন আর সোজা পথে সব সময়ে চলে না।প্রযুক্তি হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে রাজনীতির অন্যতম প্রধান অবলম্বন।হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ।পিছিয়ে পড়ছে মানুষ।
রাজনীতির মানুষজনের সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকটা এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে যে জায়গাতে এসেছে, সেই স্রোতে সাধারণ মানুষ যদি গা ভাসায়,সমাজের বুকে তা ধীরে ধীরে একটা গভীর ক্ষত তৈরি করবে। 
বিভূতিভূষণের গল্পের কুমড়োকাটা বটঠাকুরের মত সাধারণ নাগরিক যদি সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে উন্নাসিক হয়ে অমর্ত্য সেন থেকে নোয়াম চমস্কির শারীরিক বিষয় ঘিরে গুজব ছড়ান, সেই গুজুবে যদি গণহিস্টিরিয়া তৈরি হয়-- এর থেকে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না।
আর একটা কথা, এই লেখা তৈরি পর্যন্ত যিনি বিজেপি নেতা( সকালে বিকেলে উনি দল বদল করেন কি না!) অর্জুন সিং, তিনি অমর্ত্য সেনকে ঘিরে গুজব রটার পরের দিন , ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন; খুব খারাপ লোক।মরলো না কেন? 
মানুষের ভোটে পরাজিত অর্জুন।তার মত মানসিকতার লোককে এখন সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করবার সময় এসেছে।অর্জুনের মত রাজনীতিকে করেকর্মে খেতে আসা লোকজন ই গণেশের দুধ খাওয়া থেকে অমর্ত্য সেন, চমস্কিদের মত প্রণম্য মানুষদের ঘিরে গুজব ছড়ানোর অন্যতম প্রধান উৎস।

  • সম্পাদকীয়