সুবোধ ঘোষের দৃষ্টিতে ‘অমৃত পথযাত্রী’মহাত্মা গান্ধী

 

এক

“প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে, ম্লান রক্তালোক গঙ্গার ওপারে পশ্চিমাকাশে। বোধি বৃক্ষের চারা বড় হয়েছে। প্রবেশ পথের দু’পাশে কলাবতী ফুল ফুটেছে...হলুদের ওপর রক্তছিটা, তা ছাড়া টকটকে লাল ফুল। উৎকীর্ণ চিত্রাঙ্কনগুলি সুনীল পালের আঁকা, বাংলার ‘মঠ’ পদ্ধতিতে স্মৃতিস্তম্ভ রচিত হয়েছে, কংক্রীটের ব্যবহার। নিকটে আর একটি দেউল। সানাই বাজছে বিয়ে বাড়িতেওপারের অন্ধকারে তারার মত আলোমহাত্মাগান্ধীর (২ অক্টোবর, ১৮৬৯ – ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮) সমাধিস্থল ‘গান্ধীঘাট’ দেখে এসে  ২৯ নভেম্বর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সুবোধ ঘোষ (১৯০৯–১৯৮০) তাঁর ‘দিনলিপি’তে এই কথাগুলি লিখে গেছেনএগুলি নিছক কোন উচ্চারণ নয়। গান্ধীজীর প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ প্রণতি কথাসাহিত্যিকের কলমে সুগভীর অনুভববেদ্য, ইঙ্গিতবহ হয়ে ফুটে উঠেছে ‘বোধি বৃক্ষের চারা’ আর ‘ওপারের অন্ধকারে তারার মত আলো’–গান্ধীজীর মহাজীবনের সঙ্গে লগ্ন শব্দবন্ধগুলি একটি রূপকল্পের সৃষ্টি করেছে

কেমন ছিলেন ব্যক্তিমানুষ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে কবির বিদেশ ভ্রমণের সময় সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকার‘A Liberated Soul’-এ কবি গান্ধীজী সম্পর্কে লিখেছেন– “He is a great man, a great soul. He, today, wields tremendous power over the teeming millions of India…The secret of Gandhiji’s success lies in his dynamic spiritual strength and incessant self-sacrifice… He is sacrifice itself. He coverts no power, no position, no wealth, no name and no fame…His power of sacrifice becomes all the more irresistible because it is wedded to his paramount fearlessness…His is a liberated soul. His simplicity of life is childlike, his adherence to truth is unflinching; his love for mankind is positive and aggressive. He has what is known as the Christ spirit…The soul of the East has found a worthy symbol in Gandhi; for he is most eloquently proving that man is essentially a spiritual, and most positively perishes, both body and soul, in the atmosphere of hatred and gunpowder smoke.”

গান্ধীর বাবা কাবা গান্ধীর কেনা নাটকের বই ‘শ্রমণের পিতৃভক্তি’ পড়ে গান্ধীজী প্রাণের স্পর্শ পান। লণ্ঠনছবিতেও রামায়ণের এই কাহিনি দেখেছিলেন। রাজা হরিশ্চন্দ্রের জীবনী নিয়ে একটা নাটকও তিনি দেখেছিলেন। পরবর্তীকালে গান্ধীজীর জীবনে সত্যের প্রতি আগ্রহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা দেখা গেছে তার প্রেক্ষাপটে রয়েছেন হরিশ্চন্দ্র। শ্রবণকুমার আর হরিশ্চন্দ্রের চরিত্র গান্ধীজীর জীবনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জুগিয়েছে। দাইমা রম্ভার প্রতি অগাধ বিশ্বাসে তাঁর কথামত ছেলেবেলায় রামনাম জপতে শুরু করেছিলেন, পরবর্তী জীবনে এটি হয়ে ওঠে গান্ধীজীর অবলম্বনগান্ধীজী ছোটবেলায় ভূত-প্রেতের ভয় পেতেন। রামনামের বিরাট ভয়ভঞ্জনের শক্তি রয়েছে। রামনামের সত্যিই কোনো শক্তি আছে কিনা সে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, ভয় পেলেই দাইমার কথামতো রামনাম করাটাই জরুরি ছিল ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি নতুন দিল্লিতে প্রার্থনা সভায় যাওয়ার পথে নাথুরাম গডসের গুলিতে তাঁর জীবনাবসান হয়ছেলেবেলায় দাইমা তাঁকে ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাম্নাম করতে বলেছিলেন, বেলাশেষের গানে মৃত্যুর ঠিক আগেও অটল বিশ্বাসে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন–‘হে রাম’। বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও রামের ভক্ত হয়েও তিনি কোনদিনই ধর্মীয় সংকীর্ণতার পরিচয় দেননি। সকল ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্যের প্রতি তিনি আস্থা দেখিয়েছেন।

গান্ধীজীর অহিংসা নীতি ক্ষেত্রবিশেষে পরিস্থিতিগত ও তুলনাত্মক এই বিষয়ে বিশিষ্ট গান্ধীবাদী সমাজতাত্ত্বিক নির্মলকুমার বসু দৃষ্ট আকর্ষণ করেছেন। ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকা সহ অন্যান্য স্থানে গান্ধজী লিখেছিলেন যে, কাপুরুষের মত কিছু মেনে নেওয়ার চেয়ে হিংসাত্মক বিদ্রোহও ভালো। কিন্তু তিনি এও বলতেন, হিংসারও নানা দোষ আছে এবং অহিংসার আচরণ সর্বদাই ভালো বলে মানতে হবে, তারই চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু যদি কেউ অহিংস পন্থায় অন্যায়ের প্রতিকারে অসমর্থ হয়, তবে হিংসার পথ গ্রহণ করলে সে কাপুরুষ হওয়ার থেকে ভাল কাজ করবে। তবে, হিংসার বিরুদ্ধে তাঁর সর্বপ্রধান আপত্তির কারণ হল হিংসার ফল কখনো ভালো হয় না, বরং এর দ্বারা মানুষে মানুষে ভেদ আরও বেড়ে যায়।হিংসার প্রকাশ সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে গান্ধীজীর যেমন একটা উদাসীনতা ছিল, জনতার প্রতি, পৃথিবীর ধূলামাটির প্রতি তেমনই একটি নিবিড় প্রেমের ভাবও বর্তমান ছিল যে দিকটি বিশেষ অনুধাবনযোগ্য।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫-১৬ তারিখে (Congress Bulletin’-এ ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত) কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সামনে গান্ধীজী যেবক্তৃতা দিয়েছিলেন তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলির সমাধানের সন্ধানের ইঙ্গিত রয়েছে।বক্তৃতার আংশিক উদ্ধারযোগ্য– “I was not a little perturbed when the Maulana(মৌলানা আবুল কালাম আজাদ) raised me sky-high. I do not live up in the air. I am of the earth, earthy. I have never seen an aeroplane. I am like you, an ordinary mortal made of common clay…Had that not been the case, we should not have been able to work together these twenty years Ahimsa with me is a creed, the breath of my life. But it is never as a creed that I placed it before India, or for the matter of that before anyone except in casual informal talks. I placed it before the Congress as a political method, to be employed for the solution of political questions. It may be it is a novel method, but it does not on that account lose its political character.”

         

দুই

সুবোধ ঘোষের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে মাত্র দু-জন শ্রেষ্ঠ মানবের প্রকৃতি ছিল– গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ। সুবোধ ঘোষের কৈশোর ও যৌবন ব্রিটিশ পদানত ভারতবর্ষে ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’তেই অতিবাহিত হয়েছে। প্রথম পর্বে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অগ্নিমন্ত্রে তিনি দীক্ষিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গান্ধীবাদই মূলত সুবোধ ঘোষের রাজনৈতিক মতাদর্শের স্থায়ী আসন লাভ করে। গান্ধীজীর জীবনাদর্শ তাকে যে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল তার ছবি “শুনেছি গান্ধীহত্যার দিন বাবা সারাদিন নির্বাক ছিলেন কিন্তু অশ্রুপাত ছিল না।”‘তিলাঞ্জলি’ (১৯৪৪) উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ অনেকটা সুবোধ ঘোষের নিজের আদলে সৃষ্টি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকায় এই উপন্যাস লিখিত।বিপ্লবী আদর্শবাদের সমালোচনার পটভূমিকায় লিখিত ‘শতভিষা’(১৯৪৬) উপন্যাসের পুঁটিমাসীকে লেখকের মুখপাত্র বলা চলে। সুবোধ ঘোষ কমিউনিস্ট বন্ধুদের ঘনিষ্টতা ছেড়ে পরবর্তীকালে ও জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে কংগ্রেসের মতাদর্শে বিশেষত গান্ধীবাদী হয়ে ওঠেন। ইন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট হয়েও কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে। ‘তিলাঞ্জলি’ ও ‘শতভিষা’ লেখকের নিজের রাজনৈতিক ও সাহিত্যদর্শনের তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠার জন্য লিখিত। ‘একটি নমস্কারে’ উপন্যাস ভারতবর্ষের প্রাক্‌ স্বাধীনতা পর্বের অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। ‘তিলাঞ্জলি’-তে কমিউনিস্টদের সার্বিক সমালোচনার যে প্রয়াস ছিল তা এই উপন্যাসে নেই, বরং গান্ধীজীর নেতৃত্বে পরিচালিত অহিংস বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন কীভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কেবল স্বাধীনতা আন্দোলনে নয়, সার্বিক চৈতন্যের বিকাশে উজ্জীবিত করেছিল তারই প্রকাশ এখানে দেখা যায়। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের বিকল্প ধারার প্রস্তাব নিয়ে আগস্ট আন্দোলন যেমন একদিকে প্রকাশক্ষম হয়েছে, অন্যদিকে জাতিভেদ আর অস্পৃশ্যতাকে দূর করার আহ্বান জানিয়ে আত্মশুদ্ধির মধ্যে দিয়ে একটি প্রেমের বোধ সঞ্চারিত হয়েছে। পাশাপাশি প্রবহমান ধারা সংঘাত সৃষ্টি করেনি, বরং অন্যোন্যনির্ভরতায় অগ্রসর হয়েছিল।‘একটি নমস্কারে’ (১৯৪৭) উপন্যাস ‘তিলাঞ্জলি’-এর মতো রাজনৈতিক বক্তব্যসর্বস্ব না হওয়ায় অনেক বেশি শিল্প গুণান্বিত হয়েছে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে অহিংস ও সহিংস দুটি ধারাই প্রবহ্মান ছিল। গান্ধীজী পরিচালিত অহিংস পথটি শ্রেয়তর ছিল বলে সুবোধ ঘোষ মনে করতেন। গান্ধীজীর এই নীতির কার্যকারিতা ও যাথার্থ্য নিরূপণের জন্যেই লেখক ‘একটি নমস্কারে’ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

গান্ধীজীর জীবন ও নীতি-দর্শন ভিত্তিক তাঁর রচনা ‘অমৃত পথযাত্রী’ (১৯৫২)এই গ্রন্থে সুবোধ ঘোষ নিজেকে গান্ধীবাদী বলে দাবি করেননি, গান্ধীর সংগ্রাম ও সাধনার প্রতি শ্রদ্ধাবনত– এই কথাটাই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। এই গ্রন্থে গান্ধীজীর সামগ্রিক জীবনের একটি রেখাচিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কীভাবে নিরন্তর আত্ম-অতিক্রমণের মধ্যে দিয়ে ‘মহাত্মা’ হয়ে উঠলেন তার চিত্র খুব যত্ন করে সুবোধ ঘোষ এঁকেছেন। বিলেত বাসকালে বুদ্ধবাণীতে, ভাগবতের শ্লোকে, যিশুখ্রিস্টের সুসমাচারে তিনি ‘মহাসাগরের কল্লোল’ শুনতে পেয়েছিলেন। কেমন হবে আমাদের জীবনচর্যা, সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে গান্ধীজী বুদ্ধবাণীর শরণ নিয়েছেন– পুষ্পের সৌরভ নষ্ট না করে, পুষ্পের রূপকে অবিকৃত রেখে প্রজাপতি যেভাবে মধু আহরণ করে, সেভাবে জীবনের প্রয়োজনের তৃপ্তি সাধনের কথা বলেছেন। গান্ধীজী অবশ্য মূল থেকে সরে গিয়ে নিজের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন, তবে সারকথা বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ত্রিপিটকের ‘সুত্তপিটক’-এর অন্তর্গত ‘ক্ষুদ্দকনিকায়’-এর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ধম্মপদ’-এর ‘পুপ্‌ফবগ্‌গো’র ৪৯ সংখ্যক সূত্রটি উদ্ধারযোগ্য– “যথাপি ভমরো পুপ্‌ফং বণ্ণগন্ধং অহেঠয়ং,/ পলেতি রসমাদায় এবং গামে মুনী চরে।”১০ অর্থাৎ ভ্রমর যেমন যেমন পুষ্পের বর্ণগন্ধ নষ্ট না করে মধু আহরণ করে যায়, ভিক্ষুও সেইভাবে লোকালয়ে বিচরণ করবেন। গান্ধীজী ভিক্ষুদের চর্যাকে ব্যক্তিগত চর্যার অঙ্গীভূত করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ এইক্ষেত্রে বুদ্ধবাণীর প্রতিগ্রহণ তাঁর জীবনসাধনার অন্যতম মার্গ ছিল। এই কথা ভাগবতপুরাণ বা যিশুখ্রিস্টের প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য। সুবোধ ঘোষের লেখায় গান্ধী চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি উদ্ভাসিত হয়েছে।

জীবনের নানাক্ষেত্রে অসফল গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় চাকরি পান। এইসময় গান্ধীর চেতনায় ‘প্রতিবাদ’ ও ‘প্রতিরোধ’– এই দুটি চেতনার জন্ম নেয়। গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে নাতাল ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন, ট্রান্সভালে তিনি নিজ-উদ্ভাবিত সত্যাগ্রহকে প্রয়োগ করেন। ইংলন্ড থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় জাহাজে ভারত স্বাধীনতার নব-সংহিতা হিন্দ স্বরাজ (১৯০৯) গুজরাতি ভাষায় রচনা করেন যা সেইবছরই স্ব-সম্পাদিত ‘ইণ্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ছয় হাজার সত্যাগ্রহীকে নিয়ে ফিনিক্স থেকে ভোকস্রাস্ট মহা অভিযান পরিচালনা করলেন। সত্যাগ্রহের জয়ে ভারতীয়দের মাথাপিছু তিন পাউণ্ড ট্যাক্স আদায় রদ, আর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়বিবাহ পদ্ধতি আইনগত স্বীকৃতি পায়। এখানে বুনিয়াদি শিক্ষার প্রথম পরীক্ষাকেন্দ্র ‘টলস্টয় আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।

সুবোধ ঘোষ দেখিয়েছেন যে ভারত পর্বে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে স্বারাজ ভাবনা ভারতীয়দের মনে চারিয়ে দেবার সুকঠিন ব্রতে গান্ধীজী কীভাবে পদক্ষেপ ফেলেছেন। তিনি ক) আধুনিক সভ্যতাকে অধর্ম ঘোষণা; খ) বিদেশি পণ্য ও কলের পণ্য বর্জন করে স্বদেশি পণ্যের প্রচলন; চরকা ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে স্বদেশি সাধনা এবং স্বরাজ লাভের প্রত্যয় এবং ঘ) সত্যাগ্রহের পথেই স্বাধীনতা ও স্বরাজ লাভ সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ের কর্মপন্থার পথনির্দেশ করেনআহমেদাবাদে সবরমতীর তীরে সত্যাগ্রহের আদর্শে আশ্রম স্থাপন, চম্পারণে চাষীদের বাধ্যতামূলক নীলচাষ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা, খারার চাষীদের অন্যায় ট্যাক্স আদায়ের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করে ট্যাক্স দান বন্ধ করা, গিরমিটিয়া শ্রমিকদের জোর করে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠাবার বিরুদ্ধে পিকেটিং করে এই প্রথার অবসান, আহমেদাবাদে বস্ত্র শ্রমিকদের ধর্মঘট পরিচালনায় সত্যাগ্রহের সাফল্য ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে গান্ধীজী নিজের আদর্শ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যান। ভারতে গান্ধীজীর সেবাব্রতের সূচনাপর্বের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংহত রূপ লেখকের কলমে ফুটে উঠেছে। এই কালপর্বে গান্ধীজীর সেবাব্রতের প্রধান কীর্তি হিসাবে সুবোধ ঘোষ ‘চাষী মজুরের ও অস্পৃশ্যের দুঃখ মৌন সত্তার উদ্বোধন’-কে ব্যক্ত করেছেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবার একটি চিত্র সুবোধ ঘোষের লেখায় ফুটে উঠেছে। গান্ধীজী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সহায়ক হয়ে যুদ্ধের জন্য সৈন্য সংগ্রহ করছেন, খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। এইসব কর্মকাণ্ডের পিছনে লেখক গান্ধীজীর একটা উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেছেন– ভারত শাসনকর্তা বড়োলাট যেন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের শাসনতন্ত্র মঞ্জুর করেন। গান্ধীজীর শাসক-আনুগত্য অবশ্য ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রাওলাট শাসন আইনের বিরুদ্ধে হরতালের ডাকের মধ্যে দিয়ে ভেস্তে যায়। হরতাল হয়, গান্ধীজীর জেল হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল সবরমতীতে একদিকে উপবাসব্রতী গান্ধীজী, অন্যদিকে জেনারেল ডায়ার জালিওয়ানবালা বাগ হত্যাকাণ্ড চালানোর প্রতিবাদে গান্ধীজী ব্রিটিশ সরকারে দেওয়া ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিদেশি বস্ত্র বয়কট আন্দোলন, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে চৌরীচৌরায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে লবন সত্যাগ্রহে দুই মাইল ডাণ্ডি অভিযান, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে গোল্টেবিল বৈঠক, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে র‍্যামসে ম্যাকডোনল্ডের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির বিরুদ্ধতা, ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গান্ধীজীর অনশন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খণ্ডিত ভারতে সম্মতি, স্বাধীনতা লাভ আর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মহাপ্রয়াণের চিত্র সুবোধ ঘোষ সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত করেছেন। গান্ধীজীর চিত্তশুদ্ধির জন্য আঠারো বার অনসন, দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের স্বাধিকার অর্জনের দাবি আদায়, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে আন্দোলন, আটবার কারারুদ্ধ হওয়া, সত্যের প্রতি ন্যায়নিষ্ঠ থাকা ইত্যাদি করমকাণ্ডকে কেবলমাত্র ঘটনাপ্রবাহের দৃষ্টিতে না দেখে দার্শনিক, নৈতিকতার আলোকে বিচার করা জরুরি।

‘অমৃত পথযাত্রী’গ্রন্থেসুবোধ ঘোষ গান্ধীনীতির কতগুলি দিকের উল্লেখ করেছেন– ক) সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি, খ) অস্পৃশ্যতা উচ্ছেদ, গ) মাদক বর্জন, ঘ) চরকা খাদি প্রবর্তন, ঙ) গ্রামশিল্পের উন্নয়ন, চ) গ্রামীণ স্বাস্থ্য সুনিশ্চিতিকরণ, ছ) বুনিয়াদি শিক্ষা, জ) পৌঢ় শিক্ষা, ঝ) নারী সমাজের উন্নয়ন, ঞ) জনস্বাস্থ্য শিক্ষা, ট) নিজভাষা প্রীতি, ঠ) আর্থিক সমতা বিধান, ড) কৃষকের সমতা বিধান, ণ) শ্রমিকের উন্নতি সাধন, ত) রাষ্ট্রভাষা প্রচার, থ) আসিবাসীর সেবা, দ) কুষ্ঠরোগীর সেবা, ন) ছাত্র সমাজের আত্মশিক্ষা। এইদিকগুলি যেমন সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সাধ্যমত সেবামূলক কাজের দিক, অন্যদিকে আবার দুর্বৃত্ত ব্যবসাদারের অর্থকুক্ষিগত করবার উপায়ও।

 

তিন

বিদেশি বস্ত্রযন্ত্রের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজের বস্ত্র নিজেই বুনে স্বয়ম্ভর হওয়ার কথা গান্ধীজী বলেছিলেন। তার প্রস্তাবিত এই নিয়ম কালের বিচারেই ব্যর্থ হয়ে যায়। গ্রাম, গ্রামীণ উন্নয়নের অর্থ প্রধানত গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন। এর জন্য যে আন্দোলন জরুরি, সেই পথ গান্ধীজী দেখিয়েছেন। কিন্তু গান্ধী-প্রদর্শিত পথে কৃষক আন্দোলন বেশিদূর এগোয়নি। জমিদারি প্রথার বিলোপ হয়েছে, চাষীর হাতে জমির দেওয়ার শ্লোগানে দেশ মুখরিত হয়েছে, তবুও কৃষক সামাজিক অবহেলার শিকার, আত্মঘাতী। এঁদের জন্য গান্ধী-প্রদর্শিত পথ কি প্রসঙ্গিক? গান্ধীর দেখা গ্রামের চেহারা দ্রুত পরিবর্তমান এটাও স্মরণে রাখা জরুরি। শ্রমিক আন্দোলন শ্রমের মর্যাদার অন্যতম প্রবক্তা গান্ধীজীর সমাজচিন্তায় বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। তবুও অটোমেশন প্রযুক্তির অভাবিত সাফল্যের প্রেক্ষাপটে শ্রমিক সমস্যা গান্ধীজীর প্রদর্শিত পথে কতটা সমাধানযোগ্য এই প্রশ্ন থেকেই যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চরকা’ প্রবন্ধে (‘সবুজপত্র’, ভাদ্র ১৩৩২) স্পষ্টতই বলেছেন, চরকার আন্দোলনে তাঁর মন ‘ভিতর থেকে দোল খায় নি’, কেননা চরকা সম্বন্ধে সকলের মুখ চললেও হাত চলে না। রবীন্দ্রনাথ চরকা সম্পর্কে তীব্র গুরুতর অভিযোগ এনেছেন– “যে আচারপরায়ণ সংস্কারের অন্ধতা থেকে আমাদের দেশে অস্পৃশ্যতারীতির উৎপত্তি, সেই অন্ধতাই আজ রাষ্ট্রিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়ে চরকা-খাদ্দরিক অস্পৃশ্যতা-তত্ত্ব জাগিয়ে তুলছে।”১১চরকার গুরুত্ব নিয়ে কবির মনের সংশয় খুব স্পষ্ট করেই প্রকাশ করেছেন– “স্বরাজসাধনায় একটিমাত্র কাজের হুকুম অতি নির্দিষ্ট, আর তার চার দিকেই নিঃশব্দতা। এই নিঃশব্দতার পটভূমিকার উপরে চরকা কি অত্যন্ত মস্ত হয়ে দেখা দিচ্ছে না? বস্তুত সে কি এতই মস্ত? ভারতবর্ষের তেত্রিশ কোটি লোক স্বভাবস্বাতন্ত্র্যনির্বিচারে এই ঘূর্ণ্যমান চরকার কাছে যে যতটা পারে আপন সময় ও শক্তির নৈবেদ্য সমর্পণ করবে– চরকার কি প্রকৃতই সেই মহিমা আছে?”১২

স্বরাজের বৃহৎ ধারণার রূপায়ণে কবি রবীন্দ্রনাথজীবিকার আন্তরিক ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, গান্ধীজীর প্রস্তাবিত চরকা নীতিকে তিনি সমর্থন করেননি– “...স্বরাজের ভিত বাহ্য সাম্যের উপর নয়, অন্তরের ঐক্যের উপর। জীবিকার ক্ষেত্রে এই আন্তরিক ঐক্যের উপর। জীবিকার ক্ষেত্রে এই আন্তরিক ঐক্যের মস্ত একটা জায়গা আছে। বস্তুত ঐক্যটা বড়ো হতে গলে জায়গাটা মস্ত হওয়াই চাই।”১৩কবি ‘স্বরাজসাধন’ প্রবন্ধে (‘সবুজপত্র’, আশ্বিন, ১৩৩২) চরকার সংকীর্ণ ক্ষেত্রকে দ্বিধাহীনভাবে চিনিয়ে দিয়েছেন–“...স্বরাজিয়া সাধন হচ্ছে সহজিয়া সাধন। একটি বা দুটি সংকীর্ণ পথই তার পথ। সেই পথের অন্তর্গত হয়ে পড়েছে চরকা।”১৪স্বরাজলাভ বলতে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি তাঁর লেখায় ব্যক্ত হয়েছে– “...স্বরাজ হচ্ছে সেই ঐশ্বর্য, অর্থাৎ আপন দেশকে আপনি সৃষ্টি করে তোলবার অধিকার।... যে গ্রামের লোক পরস্পরের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্ন-উপার্জনে আনন্দ-বিধানে সমগ্রভাবে সম্মিলিত হয়েছে সেই গ্রামই সমস্ত ভারতবর্ষের স্বরাজলাভের পথে প্রদীপ জ্বেলেছে। তার পরে একটা দীপের থেকে আর-একটা দীপের শিখা জ্বালানো কঠিন হবে না; স্বরাজ নিজেই নিজেকে অগ্রসর করতে থাকবে, চরকার যান্ত্রিক প্রদক্ষিণপথে নয়, প্রাণের আত্মপ্রবৃত্ত সমগ্রবৃত্তির পথে।”১৫

গান্ধীজীর অর্থাৎ হিন্দ স্বরাজের সাধনা হল স্বয়ম্ভর গ্রামীণ সমাজভিত্তিক সীমিত ভোগে তৃপ্ত নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা-অনুসারী মানব গড়ার সাধনা।১৬ হিন্দ স্বরাজের মডেলে স্বাধীন ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনা রূপায়ণের প্রস্তাব করে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর গান্ধীজী জহরলালকে পত্রে জানান যে তাঁর পরিকল্পনায় রেলওয়ে ও ডাকব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে।১৭ তাঁর মতে, ব্যক্তিমানুষের নিজের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ কাম্য এবং সকলের উৎপাদক শারীরিক শ্রম করা জরুরি। ভারতীয় সভ্যতানিষ্ঠ গান্ধীজীর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি অনীহা যৌবনের সূচনাকাল থেকে ছিল, তা ভারতীয় ধর্মগ্রন্থের চর্চার ফলে বৃদ্ধি পায়। তবে তা তাঁর মনে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ বা পাশ্চাত্য বিদ্বেষের জন্ম দেয়নি। হিন্দ স্বরাজের স্বরাজ ব্যক্তিগত ও জাতীয়, ব্যক্তির স্বরাজ, নাগরিকের আত্মনিয়ন্ত্রণ আর ভারতের স্বরাজ একযোগে চলবার কথা তিনি বলেছেন। ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর ত্রয়োদশ অধ্যায় ‘যথার্থ সভ্যতা কি?’ প্রবন্ধে গান্ধীজী লিখেছেন– “সভ্যতা হল সেই আচরণ-বিধি যা মানুষকে তার কর্তব্যপথের সন্ধান দেয়। কর্তব্য সম্পাদন ও নৈতিকতা পালন পরস্পরের পরিপূরক। নৈতিকতা পালন করতে হলে মন এবং আসক্তিকে জয় করা দরকার। এভাবেই আমরা নিজেদের জানতে পারি।”১৮

বিদেশী শাসনের অবসানের জন্য তার সঙ্গে অসহযোগ যেমন নিশ্চিত পথ, স্বদেশী শোষণকারীদের শৃঙ্খলমোচনের জন্য রক্তপাতবিহীন অহিংস অসহযোগ সহজতম এবং সভ্য পন্থা। বিশিষ্ট গান্ধী-গবেষক শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন– “সমাজ বা ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য তাই “হিন্দ স্বরাজ”-এ ব্যাখ্যাত লোকচেতনা জাগরণের মাধ্যমে জনগণ কর্তৃক নিজেই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্রতী হবার পন্থা গ্রহণের সময় এসে গেছে। জনপ্রতিনিধি, জনসেবক (আমলা) অথবা জনহিতৈষী পেশাদার বিপ্লবীদের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে আত্মশক্তির জাগরণ প্রয়াসের যথার্থ পন্থা হল “হিন্দ স্বরাজ”-এর মর্মবাণী।”১৯ গান্ধীজীর আন্দোলন সম্পর্কে সশ্রদ্ধ টলস্টয় একটি চিঠিতে গান্ধীজীকে লিখেছেন (৮ মে, ১৯১০)– “…I think that the question you treat in it – the passive resistance – is a question of the greatest importance not only for India but for the whole humanity.”২০স্বরাষ্ট্রনীতির জন্য গান্ধীজী ভারতীয় রাজনীতির শীর্ষপুরুষ বলে বন্দিত হন। গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ ও একনিষ্ট দেশপ্রেম আপামর ভারতবাসীকে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। আবার তাঁরই নির্দেশে ও নেতৃত্বে কংগ্রেসে একাধিকবার ভাঙ্গন ধরেছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তার প্রবর্তিত অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পথেও পরিচালিত হয়েছিল। গান্ধীজীর নেতৃত্বে গণ অভ্যুত্থানের আগেও একাধিক মুক্তি আন্দোলন যা অহিংস সত্যাগ্রহের পথে নয়, সশস্ত্র গণআন্দোলনের পথেই পরিচালিত হয়েছিল, যেমন– মাদ্রাজের পলিগার বিদ্রোহ (১৭৯৯), বাংলার বাঁকুড়ার চোয়াড় বিদ্রোহ (১৮১৭), ওড়িষার পাইক অভ্যুত্থান (১৮১৭), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫), মণিপুর বিদ্রোহ (১৮৫৯), পাঞ্জাবের কুকা বিদ্রোহ (১৮৬৫), বাংলারনীল বিদ্রোহের (১৮৬৫) প্রসঙ্গও মনে রাখা জরুরি। এইসকল গণ আন্দোলনই গান্ধীর সর্বভারতীয় আন্দোলনের পটভূমিকা প্রস্তুত করেছিল। 

সুবোধ ঘোষ গান্ধীজীর অর্থনৈতিক ভাবনা প্রসঙ্গে কতগুলি নীতির উল্লেখ করেছেন, যেমন– ক) আধুনিক হাসপাতাল, রেলপথ, আদালত, কারখানা ইত্যাদি সমাজে ধনীর শাসন প্রতিষ্ঠার উপায়; খ) বড়ো বড়ো শহর তৈরি গরীবদের লুন্ঠনের ফাঁদ পাতারই নামান্তর; গ) দেশজাত পণ্যসামগ্রী এবং চরকার ব্যবহারের আবশ্যিকতা, যে পণ্য উৎপাদনের সুবিধা বা যোগ্যতা দেশবাসীর নেই, তা বিদেশি হলেও গ্রহণযোগ্য; ঘ) কুটির শিল্প ব্যক্তির উদ্যোগ ও প্রতিভায় চালিত, কারখানাকেন্দ্রিক শিল্প আলাদা ধরণের; ঙ) হস্তচালিত সেলাইয়ের কল মেশিন নয়, কারণ তা ঘরে ঘরে থাকতে পারে; চ) ইণ্ডাস্ট্রি, ক্যাপিটাল জরুরি হলেও ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিজম, ক্যাপিটালিজম কাঙ্ক্ষিত নয়। গান্ধী অর্থনীতি স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত হলেও তার মৌলিকত্ব ভাববার, নতুন পথের সন্ধানী। ইতিহাস বলে যে অর্থনীতির রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী, কেননা মানুষের চাহিদার ক্রমবর্ধমান। গান্ধীজীও মানবসমাজকে চিরচলিষ্ণু রূপে দেখিয়েছেন। প্রায়োজনিক তাগিদ তাকে সৃষ্টিশীল করে তোলে। শ্রমিক শোষণহীন কারখানা যে অলীক স্বপ্নমাত্র নয়, সমাজতন্ত্র তা করে দেখিয়েছে, কিন্তু প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন যে তাতে গান্ধীঅর্থনীতির সায় নেই।

গান্ধীজীর শিক্ষা পরিকল্পনার ভিত্তি বুনিয়াদি শিক্ষা। স্বরাজ সত্যাগ্রহ সত্য প্রতিষ্ঠার সামগ্রিক দিক এর মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হতে পারে। ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করার জন্য দুটি উপায়ের কথা গান্ধীজী ভেবেছিলেন। প্রথমত, সহজ সরল জটিলতামুক্ত, ব্যয়বিহীন সহজলভ্য শিক্ষা। দ্বিতীয়ত, পুঁথি নয়, কর্মকে শিক্ষার উৎস করা, অর্থাৎ কর্মমুখী শিক্ষার ফলে শেখার ঐকান্তিকতায় কর্ম হবে উৎপাদনশীল। সেই উৎপাদন থেকে শিক্ষার অধিকাংশ খরচ উঠে আসবে, বাদবাকি খরচ যোগাবে সমাজ, কারণ সমাজের স্বার্থেই শিক্ষা। কর্মমুখী শিক্ষা আজীবন স্থায়ী এবং যথার্থ বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পূর্ণ মানুষ গড়তে পারে, যা প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয় শিক্ষাও বটে। গান্ধীজীর বুনিয়াদি শিক্ষা প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি। কেবল প্রশাসনিক ঔদাসীন্য নয়, বুনিয়াদি শিক্ষার মত আর পথ নিয়ে শিক্ষাবিদেরা বিভ্রান্ত হওয়ায় তাঁদের থেকে বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১) গান্ধীজী সম্পর্কে সশ্রদ্ধ হলেও তাঁর প্রায় সব আন্দোলনের কর্মপন্থা মেনে নিতে পারেননি, ঠিক তেমনই গান্ধীজীর শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হতে পারেননি, তিনি গান্ধীজী প্রস্তাবিত বুনিয়াদি শিক্ষার অন্যতম সমালোচক ছিলেন। গান্ধীজীর বুনিয়াদি শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজের উপকরণ উৎপন্ন করবে, এই শিক্ষাক্রমে খেলাধূলা অপ্রয়োজনীয়, শিক্ষানীতি বলতে তিনি হস্তসাধিত (ম্যানুয়াল) শিক্ষণের উদ্বোধনের কথা বলেছেন। অন্যদিকে রাবীন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় বা শিক্ষাসত্রে বিদ্যালয়ের ব্যয় শিক্ষার্থীর উপার্জনের অর্থে চলবে না, শিক্ষাসূচিতে ক্রীড়া আবশ্যক, আদর্শ শিক্ষা ধনীদের কুক্ষিগত না করে ভর্তুকির সাহায্যে দরিদ্রের কাছে পৌঁছানো উচিত। সারা দেশে বুনিয়াদি শিক্ষা প্রথমিক শিক্ষার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়লেও তার সীমাবদ্ধতা অচিরেই ধরা পড়ে যায়। এই শিক্ষাপদ্ধতি বাতিলও হয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপদ্ধতির সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা এখনো সচল।

গান্ধীজী সম্পর্কে সুবোধ ঘোষের ‘অমৃত পথযাত্রী’ গ্রন্থের অন্তিম বাক্যের সারবান মন্তব্যটি উদ্ধারযোগ্য– “তাঁর জীবনের এই বহু ও বিচিত্র কর্মাবলির মধ্যে একটিমাত্র বস্তুই প্রতিপাদিত হয়েছে, সে বস্তু হলো অহিংসা।” উন্নততর অহিংস, সত্যসন্ধ এক বিকল্প পথের সন্ধানী মহাত্মা গান্ধী।

         

চার

সুবোধ ঘোষ কিশোর পাঠক পাঠিকাদের উদ্দেশে ‘কেন তিনি মহাত্মা’ (‘আনন্দমেলা’, ১৪ আশ্বিন, ১৩৫২) প্রবন্ধে মানুষ জাতির মনে এক নতুন বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা গান্ধীজীকে ভারতের মাটিতে আবির্ভূত হয়ে এক দুঃখ বেদনায় পীড়িত জাতির মহা অভ্যুত্থানের পথপ্রদর্শক বলেছেনগান্ধীজী পাঠানদের কাছে প্রিয় ‘মালাঙ্গ বাবা’, মিশরীয়দের কাছে ‘অল্‌ হহাত্মা গান্ধী’। দরিদ্র ভারতের এই কৃষকবেশী নেতার প্রতি পৃথিবীবাসীর শ্রদ্ধার কারণ অনুসন্ধান করে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন– “...পৃথিবীবাসী আজ বুঝতে পেরেছে ভারতের গান্ধীজী সমস্ত মানুষ জাতির জন্য এক নতুন সভ্যতার আদর্শ এনেছেন। একমাত্র যারা অত্যাচারের উপাসক এবং অত্যাচারীর ভৃত্য তারা শুধু গান্ধীজীকে বুঝতে পারে না।” সেই কারণে গান্ধীজী ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। গরীব ভারতবর্ষের এই কৃষকবেশী নেতার প্রতি পৃথিবীবাসীর এত শ্রদ্ধার কারণ অনুসন্ধান করে সুবোধ ঘোষ জানিয়েছেন যে গান্ধীজী ‘সমস্ত মানুষ জাতির জন্য এক নতুন সভ্যতার আদর্শ’ এনেছেন। একমাত্র যারা ‘অত্যাচারের উপাসক এবং অত্যাচারীর ভৃত্য’ তারা তাঁকে বুঝতে পারে না বলে লেখকের অভিমত।

কীভাবে ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে নতুন মিথের জন্ম হয় সুবোধ ঘোষ তার অসামান্য চিত্রাঙ্কন করেছেন–“রোমার ধর্মোপনিবেশ ভ্যাটিকানে একটি প্রসিদ্ধ গির্জা আছে– সিস্‌টাইন চ্যাপেল। ইটালীর বনেদী শিল্পীদের আঁকা বহু ছবি এই গির্জায় আছে। মহাত্মা গান্ধী সিস্‌টাইন চ্যাপেল দেখতে গিয়েছিলেন। নানা ছবি দেখতে দেখতে শেষে যীশুখৃষ্টের একটি অতি সুন্দর ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুগ্ধ হয়ে গান্ধীজী ছবি দেখেছিলেন, তাঁর চোখে জল দেখা দিল” জন্ম নিল নতুন মিথ, ইতালিয়রা বলল– ‘নতুন যীশুখৃষ্টের চোখে জল’।

গান্ধীজী সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সকলকে সঙ্গে নিয়ে লড়েছেন। এই লড়াইয়ের নতুন অস্ত্র ‘অহিংসা’। নিষ্ঠুরের নিষ্ঠুরতাকে উপেক্ষা করে তার দরদী হৃদয়ের উন্মোচনের জন্য প্রতীক্ষার মধ্যেই রয়েছে তাঁর অহিংস লড়াইয়ের সার্থকতা। এই লড়াইয়ের আরেকটি পথ তিনি অবলম্বন করেছিলেন– ‘অসহযোগ সাধনা’।গান্ধীজী সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীতপ্রিয় হলেও তাঁর দৃষ্টিতে ‘ভারতবর্ষের ক্ষুধার্তের কাছে খাদ্যই আজকের দিনের কবিতা’। তিনি এই ক্ষুধার্ত ভারতবাসীর অন্ন সংস্থানের জন্য চরকায় বস্ত্র বয়ন শিল্পের কথা বলেছেন। কারণ চরকার উন্নতির সঙ্গে গ্রামের আরও নয়টি শিল্পের উন্নতি হয়। তাঁর কাছে চরকা হল ‘শিল্পের সূর্য’।

গান্ধীজীর আদর্শকে সহজ করে বুঝিয়ে কিশোরদের উদ্দেশে প্রাবন্ধিক আহ্ববান জানিয়েছেন। আদর্শের ভাবসঞ্চার করতে তিনি খেলার আনন্দকে সামনে এনেছেন। তাঁর ভাষাশৈলী ও লিখনকৌশলটিওঅসামান্য– “তক্‌লিতেসুতো কাটা যায়।...কিশোর বন্ধুরা, তোমরাই বল, এই তক্‌লি কি লাট্টুর চেয়ে খারাপ খেল্‌না? মোটেই নয়। তক্‌লি তোমাদের খেল্‌না। আবার এই তক্‌লিই তো একটা আর্ট। তোমার শিল্পীর মত সুন্দর আঙুলে তক্‌লি নাচছে, সাদা সুতো তৈরী হচ্ছে। তুমি খেলার সঙ্গে সঙ্গে একটি শিল্প সৃষ্টি করছো। সেই সঙ্গে একবার ভাব, তুমি তোমার মনুষ্যত্বের জন্য একটি সবচেয়ে শুভ্র সাজ তৈরী করছো– তোমার খদ্দর। এত অল্প বয়সে এর চেয়ে বড় সম্মানের কীর্তি তুমি আর কি করতে পার?” গান্ধীজী মানুষের কাজের একটা ‘আদর্শ’, পরিশ্রমের ‘নতুন বিজ্ঞান’ এনেছেন। গান্ধীজীর মতে, কাজ ও আমোদ একই সঙ্গে লগ্ন থাকবে। পরিশ্রম হবে মৌমাছির মতো, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম, ‘সারাদিন গুঞ্জন’। তাঁর মতে, পণ্য হবে ‘নির্দোষ মধু’র মতো, কৃষক বা মজুরকে বঞ্চিত করে তা যেন উৎপন্ন না হয়। তিনি এও বলেছেন ভারতে ‘মায়াময় কবিতা’ গোজাতির উন্নতি হলে স্বাস্থ্য অর্থনীতি সবদিক থেকেই সমৃদ্ধি আসবে।

দরিদ্র ভারতবাসীকে শিক্ষার ব্যবস্থা স্বরূপ গান্ধীজী ‘বনিয়াদী শিক্ষা’ বা ‘স্বাবলম্বী শিক্ষা’র প্রস্তাব করেছেন, যাতে শিক্ষার্থী জীবিকা অর্জন করার মতো একটা শিক্ষাও লাভ করবে। এরপর অন্ত্যজ ‘হরিজন’দের সেবা, আদিবাসীদের সেবার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। গান্ধীজী মনুষ্যত্বের আলোকে সাহিত্য শিল্পকে বুঝতেন। তাই তাঁর দৃষ্টিতে ম্যক্সিম গোর্কির (১৮৬৮–১৯৩৬)‘The Mother’ (১৯০৬) ‘মা’ আর বাংলার গ্রামে দেখা মহিলা কংগ্রেস কর্মী ‘হাবুর মা’ এক হয়ে যায়।তাই প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষ সার্বিক অর্থেই ‘একটি নতুন জীবন এবং নতুন সভ্যতা’র পথপ্রদর্শক গান্ধীজীকে ‘আমাদের সত্যাগ্রহী জেনারেল’ বলে অভিহিত করেছেন। 

‘পোরবন্দর থেকে রাজঘাট’ প্রবন্ধে (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ১ অক্টোবর, ১৯৫০) সুবোধ ঘোষ গান্ধীজীর ‘পোরবন্দর থেকে রাজঘাট’ পরিক্রমাকে প্রাবন্ধিক ‘এক তীর্থ পথিকের পথ পরিক্রমার ইতিহাস’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি রাজধানী দিল্লির প্রার্থনাভূমিতে মহাত্মার প্রাণ ঘাতকের হাতে চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনাকে প্রাবন্ধিক বলেছেন– “পৃথিবী হারালো তার সভ্যতার দীক্ষাদাতাকে, বিংশ শতাব্দী হারালো তার মহামানবকে, মর্ত্ত্যলোক হারালো এক অমৃতের সন্ধানীকে, ভারত হারালো তার জাতির পিতাকে। বর্ত্তমান যুগের সহস্র সহস্রের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী ছিলেন একক শুদ্ধসাধক পরন্তপ। বহু মিথ্যায় আক্রান্ত বর্তমান শতাব্দীর মধ্যে যে মানুষটির জীবন সত্যের পরীক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র যজ্ঞের মত জাগ্রতছিল, তিরোহিত হল সেই মানুষ। শেষ নিশ্বাসের সঙ্গে রাম নাম ধ্বনিত ক’রে তিনি চলে গেলেন। মানুষের ইতিহাসে অভূতপূর্ব আত্মবলির ঘটনা উপহার দিয়ে সর্বমানবের আত্মীয় সেই মহান প্রাণ পার্থিবজনের গোচরের বাইরে চলে গেলেন।”

যিনি মনেপ্রাণে গান্ধীবিরোধী তাঁরও চিত্তের গভীরে গান্ধীর বাণী দিব্যস্পর্শ দিয়ে গেছে। গান্ধীর এই পরম স্পর্শের প্রভাব বর্তমান শতাব্দীর মানুষের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে চলতেই থাকবে। মানুষের সভ্যতার এক বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা করে তিনি ‘ইতিহাসের এক মহৎ পরিণতির সূত্র’ ধরিয়ে দিয়ে গেছেন। গান্ধীর মত অলোকসামান্য ব্যক্তিত্ব কীভাবে সৃষ্ট হয়েছে তার কারণ সন্ধানে প্রাবন্ধিক বলেছেন– “বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী তার আত্মপ্রকাশের সৃষ্টিকর বেদনা থেকেই গান্ধী-ব্যক্তিত্বকে সৃষ্টি করেছে।” সমাজবিজ্ঞানের এই সত্যদর্শন করেই মানুষজাতির কল্পনা এই বিশ্বাস লাভ করেছে যে ধরণীর বেদনা পুঞ্জীভূত হলে ইতিহাসের বিধাতা দূত পাঠিয়ে থাকেন। প্রাবন্ধিক হিন্দু বা খ্রিস্টিয় পুরাণের বিশ্বাসের প্রেক্ষিতেই গান্ধীর আবির্ভাবের কথা বলেছেন। যুগে যুগে মানুষের ইতিহাসে এইভাবেই ‘চিরকালের রাম’-এর আসা-যাওয়া, মানুষের আত্মার অভ্যুত্থান, ‘নূতনের জন্ম লাগি’ মানুষের চেতনার আত্মনির্মান। এই নিয়মানুসারে বিংশ শতাব্দীর চিত্তশুদ্ধির জন্য ভারতে গান্ধীজীর ‘আবির্ভাব’। মানুষের মন ও চরিত্রের শুদ্ধির কথা গান্ধীজী বলেছেন। তাঁর কাছে ‘রামরাজ্য’ মানবীয় কল্যাণের এক আদর্শ রূপ’। এই অধরা আদর্শ লাভের জন্য মানুষের শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর, কল্যাণ থেকে অধিকতর কল্যাণের পথে নিরন্তর যেতে হবে। সততা ও শ্রেষ্ঠত্বের পন্থায় মানবতন্ত্রের নীতি যতদিন না সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বীকৃত হব্র ততদিন পর্যন্ত প্রকৃত গণতন্ত্র অপূর্ণ হয়েই থাকবে। ভারতের মহাত্মার জীবন-মরণের সদাচারে বিশ্বসভ্যতার ঊর্ধ্বায়ন ঘটেছে যা আশাব্যঞ্জক বলা প্রাবন্ধিক মনে করেছেন।

‘একমুঠো লবন’ প্রবন্ধটি (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ৯ জুন, ১৯৭৪) সমকালীন ভারতের লবণের অস্বাভাবিকতা দুর্মূল্যতার দেশবাসীর জীবনের উদ্বেগের পটভূমিকায় রচিত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল। সুবোধ ঘোষ দেখিয়েছেন যে দরিদ্র ভারত ও তার অর্থনীতির একটি বিশেষ ক্লেশের হেতু ছিল সরকারী ট্যাক্স এবং মনোপলির উতপীড়ক বন্ধনে আবদ্ধ লবণ। ব্রিটিশ নীতির বিরোধিতা করে পরাধীন দেশের মানুষের লবণ তৈরি করার অধিকারের দাবিতেগান্ধীজী ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ সবরমতী আশ্রম থেকে ডাণ্ডি অভিযান করলেন, ঘোষণা করলেন ‘লবণ সত্যাগ্রহ’। সবরমতী থেকে ডাণ্ডির দূরত্ব হাঁটাপথে প্রায় তিনশো পঁচাশি কিলোমিটার। ৬ এপ্রিল প্রত্যুষে গান্ধীজী ডাণ্ডির সমুদ্রতীর থেকে একমুঠো লবণ তুলে নিয়ে লবণ আইন অমান্য করলেন।২১ সুবোধ ঘোষের লিখনীতে অতীত কালের ঘটনা ঘটমান বর্তমানের আবেগে আন্দোলনের উচ্ছ্বাসিত স্বর প্রকাশিত হয়েছে– “গুজরাটের সমুদ্রতটের একটি ক্ষুদ্র ও অখ্যাত গ্রামের প্রান্তস্থানে, যেখানে আরব সাগরের লোনা জলের ঢেউ নিজেরই আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে মাটির উপর লবণের প্রলেপ ছড়িয়ে দেয়, সেখানে দাঁড়িয়ে শীর্ণকায় একটি মানুষ একদিন একমুঠো লবণাক্ত মাটি হাতে তুলে নিলেন, আর সারা ভারতে সংগ্রামের তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে গেল।”  

‘নেহেরু-মনীষার একটি দিক’ (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ৩০ কার্তিক, ১৩৫৯)নেহেরুর আত্মজীবনীতে মহাত্মা গান্ধীর চিন্তারীতি ও অভিমতের অনেক কিছুই তীব্র প্রশ্নের দ্বারা বিচার করেছেন। গান্ধীকে অনেক বিষয়ে দুর্বোধ্য হেঁয়ালি (প্যারাডক্স) বলে মনে হয়েছিল, এমনকি গান্ধীকথিত ‘শুদ্ধ-পন্থা’ তত্ত্বকে প্রথম পর্যায়ে যুক্তি সিদ্ধ তত্ত্ব বলে নেহেরু বিশ্বাস করতে পারেননি, পরবর্তীকালে তিনিই এই তত্ত্বের শ্রেষ্ঠ সমর্থক। গান্ধী-শিষ্যদের মধ্যে একমাত্র নেহেরু গান্ধী-প্রচারিত নীতি অভিমত ও কর্মবিধির সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছেন। নানা সময় চরকা, অহিংস ব্রহ্মচর্য, উপবাস ব্রত ইত্যাদির তাৎপর্য সম্বন্ধে গান্ধী-নীতির বিরুদ্ধে প্রবল সংশয় অকুন্ঠিতভাবে ঘোষণা করেছেন নেহেরুএইসব ক্ষেত্রে নেহেরু বিশুদ্ধ গান্ধীবাদী না হলেও গান্ধী স্বয়ং তাঁকে তাঁর আদর্শের সাধনার ক্ষেত্রে ‘যোগ্যতম প্রতিনিধি’ বলেছেন। সুবোধ ঘোষের মতে ‘মানবপ্রেমই হলো সেই পরশমণি’, গান্ধী-আদর্শের এই দায় শান্তিকামী নেহেরুর উপর ন্যস্ত হয়েছে।

‘মৈত্রীভাবনা’ প্রবন্ধে (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫৩) প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষ গান্ধীজীকে মৈত্রীভাবনার সাধকরূপে চিত্রিত করেছেন। তাঁর মতে, মৈত্রীভাবনার পথে অগ্রসর হয়ে, সমন্বয়ের বিরুদ্ধশক্তিকে নিরোধ করে মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়েছে। স্বজনের প্রতি আর স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বসংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতির ভাব থাকলেই ভাবুকের মনে মৈত্রীভাবনা সুপ্রতিষ্ঠিত হয় না। তাঁর জন্য চাই চিত্তবৃত্তি ও অনুভূতির বৃহৎ প্রসারতা এবং গভীরতা। মৈত্রীভাবনার প্রকৃত ভিত্তি নিছক আচরণগত সহিষ্ণুতার উপর নির্ভরশীল নয়; মনোগত ভাব, অভিলাষ ও অনুভূতি হলো তার ভিত্তি। নিছক সহিষ্ণুতা নয়, চাই অসীম শ্রদ্ধা মহাত্মা গান্ধীকে প্রাবন্ধিক গৌতম বুদ্ধ, যিশুখ্রিস্ট, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ মৈত্রীভাবুক ও উদারতম নীতির বাণীপ্রচারকদের উত্তরসূরী হিসাবে বর্ণনা করেছেন। শত্রুকেও ভালোবাসার নীতিদীক্ষা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে তাঁরা বস্তুত মানুষের আত্মিক উপলব্ধির পরম আদর্শের কথা বলে গেছেন। সেই ভাবনা নিখিল প্রাণের সঙ্গে ভাবুকের মনে এক দিব্য ঐক্যানুভূতিতে সার্থক হয়ে ওঠে, অদ্বৈত ভাবনায় পরিণত হয়। এই প্রবন্ধে আমেরিকান কমিউনিস্ট সাংবাদিক ও লেখকআগনাস স্মেডলির (১৮৯২–১৯৫০) স্মৃতি উৎসবে প্রকাশিত এক গ্রন্থের কবিতায় ছিল–হে যিশুখ্রিস্ট, তুমি এবার সরে পড়। তোমার দিন এতদিনে ফুরিয়েছে। তোমার স্থান আজ অধিকার করেছে মার্ক্স, লেনিন, স্টালিন আর আমি। হে যিশু সরে পড় আর যাবার সময় গান্ধীকে নিয়ে যাও। এই ধরণের মতবাদ ‘নতুন আধিপত্যবাদ’ বিশ্বময় করে তুলবার জন্য বা প্রেরণা জাগানোর জন্য প্রাবন্ধিক তথাকথিত কমিউনিজমকে দায়ি করেছেন।ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ নিয়ে সুবোধ ঘোষ লিখেছেন– “কবির হুমকিতে যীশু ও গান্ধীর পরিণাম কি হবে সে কথা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার দরকার নেই। এ ধরণের মনোবৃত্তি মানুষের ইতিহাসে উৎপীড়নই সৃষ্টি  করতে পারে, কল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে না। প্রকৃত কল্যাণধর্মিতা আধিপত্যবাদের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ খোঁজে না। মৈত্রীভাবনার ভাষাও এরকম হতে পারে না।”

সুবোধ ঘোষ ‘সমাজবাদের পথে’ প্রবন্ধে (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ১২ এপ্রিল, ১৯৫৬) আধুনিক ভারতে মানুষের সমমর্যাদার আদর্শ উদ্বোধনে একটি অবিচ্ছিন্ন চিন্তা ও প্রয়াসের পরম্পরা রূপে রামমোহন, বিবেকানন্দ, গান্ধী ও নেহেরুর উল্লেখ করেছেন। ‘কংগ্রেস ও আদিবাসী’ (‘দেশ’, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৪৭) প্রবন্ধে সুবোধ ঘোষ বলেছেন যেদেশসেবকের জন্য মহাত্মা গান্ধী যে ১৮ দফা গঠনমূলক কর্মবিধি প্রণয়ন করেছেন, যা দেশ ও জাতিকে ‘শান্তিপূর্ণ বিপ্লব’-এ দীক্ষা দেবার ব্যাপার, যা সত্যিকারের স্বরাজের ভিত্তি এবং জনসাধারণকে দেশ ও জাতির পরিচালক রূপে পরিণত করার উদ্যোগ। এই গঠনমূলক কাজে অতি অল্পসংখ্যক কংগ্রেসী ও কংগ্রেসানুরাগী ব্যক্তি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৮ দফা গঠনমূলক কর্মবিধির ১৬ নম্বরের নির্দেশ হল আদিবাসী সেবা। এই প্রসঙ্গে গান্ধীজীর বক্তব্যকে প্রাবন্ধিক উদ্ধার করেছেন, তার থেকে খানিকটা আমরা উদ্ধার করছি– “আমাদের দেশ এত বৃহৎ এবং এত বিভিন্ন সমাজ ও গোষ্ঠী আছে যে, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্ষম লোকের পক্ষেও ভারতের সকল মানুষের ও তাদের অবস্থা সম্পর্কে সব কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় জানা সম্ভব নয়যখন কেউ এই ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারে, তখন সে এটাও বুঝতে পারে যে, আমাদের পক্ষে এক জাতীয়তার দাবী সার্থক করা কত কঠিন, যদি না দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি বা সমাজের চেতনায় সর্বসাধারণের বা সর্বসমাজের সঙ্গে একাত্মবোধ সজীব হয়ে ওঠে।” গান্ধীর এই বক্তব্যটি উদ্ধারের মধ্যে একদিকে যেমন গান্ধীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়, অন্যদিকে সুবোধ ঘোষের গান্ধীচর্চার গভীরতাও টের পাওয়া যায়।

গান্ধীজী খাদিপ্রচার, অস্পৃশ্যতা নিবারণ, মাদক বর্জন প্রভৃতি গঠনমূলক কর্মবিধির তুলনায় আদিবাসী সেবা কম গুরুত্ব দেননি, তবুও দেশের গঠনমূলক কর্মীরা এই বিষয়ে গুরুত্ব দেননি। আদিবাসী সম্পর্কে গান্ধীজী ও কংগ্রেসের আগ্রহের বহু আগেখ্রিস্টান মিশনারীরা আদিবাসীদের সেবামূলক কাজ সূচিত করেছিল। কিন্তু খ্রিস্টান পাদরি সমাজ পরিচালিত ও গান্ধী করিকল্পিত সেবামূলক কাজের মৌলিক ফারাক রয়েছে। খ্রিস্টানদের আদিবাসী সেবার পিছনে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ সুবোধ ঘোষের ‘চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ’ গল্পটির কথা বলা যায়। গান্ধী পরিকল্পিত আদিবাসী সেবার পিছনে জাতিগঠনের প্রেরণা ক্রিয়াশীল বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন।

‘পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কুটিরশিল্প’ (‘দেশ’, ১৩ বৈশাখ, ১৩৫৯) প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষ গান্ধীবাদী শ্রীমননারায়ণ আগরওয়ালার গ্রন্থ (গান্ধীজী গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন) এবং ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিল থেকে দেখিয়েছেন যে গান্ধী পরিকল্পনায় কুটীর শিল্পের জন্য অনেক বেশি টাকা বরাদ্দ করা হলেও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কুটীর শিল্পে টাকা বিনিয়োগ হয়েছে অত্যল্প। ভারতের গ্রামজীবনের উন্নয়নের দাবি এক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে। শ্রীমননারায়ণের গ্রন্থটির নাম প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেন নি, গ্রন্থটির নাম ‘Gandhian constitution for free India’ (১৯৪৬)।কুটির শিল্পের প্রতি এই অবজ্ঞা প্রাবন্ধিকের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। তিনি তুলনামূলক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, গান্ধী পরিকল্পনায় কৃষি ২৭.৮, বৃহৎ শিল্প ২৮.৭, কুটিরশিল্পে ১০.০ আর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি ৪৩.০, বৃহৎ শিল্প ৫.৩, কুটির শিল্পে ১.০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে।ইণ্ডাস্ট্রির পত্তন ও প্রসার সম্পর্কে গান্ধীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষ দেখিয়েছেন যে গান্ধীজী ইণ্ডাস্টি চাইলেও ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিজম্‌ চাইতেন না। ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিজম্‌ যেসব অসামাজিক, বেকার বৃদ্ধিসূচক, বৈষম্যমূলক এবং পুঁজিবাদ পরিতোষক কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা বোঝায়, সেই অনর্থগুলিকে বর্জন করে যন্ত্রশিল্পের পত্তন ও প্রসার চেয়েছিলেন। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষিকে শ্রীমননারায়ণ আগরওয়ালার পরিকল্পনার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি মর্যাদা দান করা হয়েছে। সুবোধ ঘোষ তাই প্রশ্ন তুলেছেন– “শ্রীমননারায়ণ আগরওয়ালার ‘গান্ধী-পরিকল্পনা’কেই যদি গান্ধীসমর্থিত পরিকল্পনা বলে ধরে নিই, তবে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে গান্ধী-নীতিসম্মত বলে মনে করতে আপত্তি করবার কোন যুক্তি আছে কি? কুটিরশিল্পের উন্নয়নের প্রয়োজন স্বীকার্য হলেও কৃষিকে প্রাধান মর্যাদা দিয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কার্যত কুটিরশিল্পেরই স্বাভাবিক অর্থনৈতিক বনিয়াদটুকু বাস্তবসম্মতভাবেই রচনা করতে বেশি সাহায্য করবে বলে প্রাবন্ধিক মত প্রকাশ করেছেন। গান্ধীজীর মতবাদ যে কোনো স্থানু মতবাদ নয়, বরং জঙ্গমতা তার একটা বিশেষ দিক প্রবন্ধের সমাপ্তিতে প্রাবন্ধিকের ভাবনায় তা প্রস্ফুটিত হয়েছে– “শ্রীমননারায়ণ আগরওয়ালার গান্ধী-পরিজকল্পনায় কৃষির জন্য কম অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ইণ্ডাস্ট্রির জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে– এটা যদি গান্ধীপন্থীদের কাছে কোন ত্রুটি বলে না মনে হয়, তবে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কুটীরশিল্পের জন্য কম অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারটিকেও ভয়ংকর কোন ত্রুটি বলে মনে করা সঙ্গত হবে না। গান্ধীজী বেঁচে থাকলে এই দুই পরিকল্পনার কোন্‌টিকে তিনি বেশি সঙ্গত বলে মনে করতেন, সেটা কেউ জোর করে বলতে পারেন না।”

 

পাঁচ

মহাত্মা গান্ধী তাঁর চারিত্রিক মহিমার জন্য ভারতীয় কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। গান্ধীজীর চরিত্র, তাঁর আদর্শ ও আন্দোলন বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ গুরুত্বময়। বিশেষ করে গান্ধীজীর তিনজন ভক্ত অনুরাগী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮–১৯৭১), সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬–১৯৬৫) ও সুবোধ ঘোষের কথাসাহিত্যে তাঁর উপস্থিতি অত্যুজ্জ্বল।

‘একটি নমস্কারে’উপন্যাসেশিশুভবনের অধ্যক্ষা সোমা একটা চাকরির বাঁধন স্বীকার করলেও তাঁর মনের গোপন ইচ্ছা বাঁধন অতিক্রম করতে চায়, তার প্রকাশ দেখা যায় টুকরো টুকরো কাজে। যেমন– তিনি নিজের হাতে আঁকা গান্ধীজীর ছবিকে প্রতি সপ্তাহে একটা ফুলের মালা দিয়ে সাজানগান্ধীজী এই উপন্যাসের চরিত্র নন, অথচ উপন্যাস জুড়ে তাঁর অলক্ষ্য উপস্থিতি। কাঞ্চীপুরের গ্রামগুলির চেহারা পরিবর্তনে তাঁর অবদান লক্ষনীয়। উপন্যাসের বর্ণনা– “একটা শিশুভবন, একটা বাণীপীঠ, একটা চরকা প্রচারের আশ্রম, কাঞ্চীপুরের সেবাকেন্দ্র চারদিকের পনরটা গ্রামের অবসন্ন সত্তাকে যেন সকল দীনতা ও গ্লানির রোগ থেকে উদ্ধার করে বাঁচিয়ে রেখেছে।”গান্ধীবাদী নয়নের ঘরের দেওয়ালে মহাত্মা গান্ধী আর বিবেকানন্দের ছবি টাঙানো থাকে। তাঁর টাকা মানুষের সেবার কাজে উৎসর্গীকৃত। তার এই সাফল্যের ছবির বর্ণনা– “কাঞ্চীপুরের তাড়ির দোকান উঠে গিয়েছে, মিঞাবাজারে পঞ্চাশটা তাঁত আবার জেগে উঠেছে, নরসিংহতলার হাটে যারা ভিক্ষে করতো, তারা ভিক্ষে ছেড়ে দিয়ে চরকা ধরেছে। ঠাকুরপুরের চাষীরা নিজেরা দল বেঁধে খেটেখুটে একটা বাঁধ বেঁধেছে, যার ফলে তিন হাজার বিঘা জমির ধান মরাকালিন্দীর প্লাবন থেকে এবার বাঁচতে পারবে।...নাই বা হলো স্বাধীনতা, এতগুলি মানুষের সেবায় তার টাকাগুলো যে সার্থক হচ্ছে, এটাই বা কি তার কম আনন্দের বিষয়?”

কাব্যতীর্থের মনোভাবের মধ্যে দিয়ে একটি পৌরাণিক প্রতীকী চিত্র উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে– “এই তো মহালগ্ন, পুঞ্জ পুঞ্জ কলুষের ভার মানুষের সত্যকে প্রায় চূর্ণ করে আনছে। এই সময়েই তো নীলকণ্ঠ জাগেন আর বিষপান করেন। যুগে যুগে এই লগ্নেই তো রুদ্রের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। এক যুগের আবর্জনাকে একদিনে পুড়িয়ে দেবার, এক শতাব্দীর পাপের পাহাড়কে একদিনে গুঁড়ো করে দেবার আহ্বান।” নীলকণ্ঠ যে গান্ধীজী স্বয়ং তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। ‘হরিজন’ পত্রিকায় গান্ধীজীর আহ্ববানের কথাকংগ্রেস মণ্ডলীর প্রেসিডেন্ট প্রবীর কাব্যতীর্থকে পড়ে শোনান– “...হিন্দুস্থানমে ভয়ংকর জ্বালামুখী ফুটেগী! তুম লোগ উসকে সাক্ষী রহনা, ঔর জব বহ সমীপ আ জায় তো উসমেঁ কুদ পড়না...।” কাব্যতীর্থের মনোভাব গান্ধীজীর আহ্বানের ফলে স্পষ্ট রূপ লাভ করে, আগস্ট আন্দোলন অর্থাৎ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকা প্রস্তুত করে দেয়– “সত্যিই যে রুদ্রের আহ্বান, নিপীড়িত ভারতের লক্ষ লক্ষ প্রাণকে এক বিরাট মরণ আহবে আত্মাহুতি দেবার জন্য আহ্বান। আসমুদ্র হিমাচল ভাততের রণগুরুরূপে আবার এক কৌপীনবস্তু মহাক্ষত্র সেই বিরাট তর্জনী তুলে ইঙ্গিত করেছেন।” গান্ধীবাদী নয়ন চৌধুরীর ছাপানো পুস্তিকার মুখবন্ধে শুদ্ধ অহিংসা, অনুচ্ছেদে তিতিক্ষা এবং উপসংহারে আত্মত্যাগের কথা এবং প্রত্যেক গ্রামবাসীকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্জলা উপবাস করে সংগ্রামের উদ্বোধনের পরিকল্পনা তাঁরা করেন।   

আগস্ট আন্দোলন সূচিত হওয়ার পরেকাব্যতীর্থ বাণীপীঠের প্রাঙ্গণে ত্রিবর্ণ পতাকার তলায় প্রার্থনা করেন। এই প্রার্থনামন্ত্র সমকালীনতায় কেবল আবদ্ধ নয়, তা অতীত ভারতের গৌরবস্পর্শী আর ভবিষ্যৎ ভারতে সম্প্রসারিত ভাবনা। সেই প্রার্থনার আংশিক উদ্ধৃতি উদ্ধারযোগ্য– “–হে জ্বালামুখী, তোমার শুদ্ধ পাবকের লক্ষ শিখা দিয়ে পরাধীন ভারতের জীবন হতে এই সুদীর্ঘ কালরাত্রির পুঞ্জীভূত তমিস্রা দগ্ধ কর; দূরীভূত কর।...হে আমার দেশের ইতিহাস, তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা। আমার চেতনার নেপথ্যে যারা নিঃশব্দ হয়ে আছ, হে লক্ষ সাধকের স্মৃতিময় সত্তা, সাড়া দাও, সাড়া দাও।...হে আমার সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ, সরস্বতী তীর হতে তোমার হোমাগ্নি ধূমের পুঞ্জ পুঞ্জ পূত সৌরভ আজ আমাদের প্রতি গৃহে প্রেরণ কর।...হে মৌনী কপিলাবস্তু, তোমার সিদ্ধার্থের বাণী আবার নতুন করে শোনাও। জোগো সারনাথ, জাগো মৃগদাব, জাগো ঊরুবিল্ব, তোমার শীলাচারের পুণ্যে আবার ভারতের গৃহে গৃহে নতুন প্রদীপ জ্বাল। ভারতের প্রতি কুটীর স্বাধীন ভারতের নব সঙ্ঘারামে পরিণত হউক।...জাগ্রত হও পাটলিপুত্রের পাষাণ...হে ধর্মাশোক, ভারত ভূমিতে আবার শান্তির সাম্রাজ্য সম্ভব কর।...আহ্বান করি তোমাকে, ক্ষাত্রশক্তিসেবিতা হে আমার সুদূরাতীতা দুর্জয়া ভারতভূমি!...জাগো ভারতের শস্য ও বনস্পতি, স্বাধীন ভারতের বলিষ্ঠ কৃষকের মমতাময় স্পর্শে আবার অন্নময় হও। ভারতের ভাস্কর, স্বাধীন ভারতের হৃদয়কে নতুন করে প্রতিমায়িত কর। দাও প্রেম, দাও পুণ্য, দাও শক্তি, হে মহাপ্রাণ আমাদের যাত্রা সফল কর।”

সংবাদ অনুযায়ী মেদিনীপুরের এক গ্রামে জনতার উপর ব্রিটিশ পুলিশ ও সৈনিকের গুলিবর্ষণের ফলে অনেকের সঙ্গে পল্লীর এক কাব্যতীর্থ মরেছেন। কিন্তু তাঁর হৃদয়ের স্বপ্ন আর প্রার্থনা যেন এই ভারতের আকাশ-বাতাসে ‘হোমবহ্নির সুরভিত জ্বালার মত, সঙ্গীতময় মন্ত্রের মত’ এখনো ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। সেই প্রার্থনার ভাষা ও ধ্বনি ঘটনাস্থল অতিক্রমী, তাকে গুলি করে হত্যা করা যায় না।ইংরেজশাসিত ভারতে ঔপনিবেশিকতা আর প্রাচ্যচর্চার বিকাশ সমান্তরাল ভাবে প্রবাহিত হয়েছিল। ‘কালাগুরু’ গল্পে আমরা পাইভারততাত্ত্বিক টেনব্রুক সাহেবকে। এই সাহেবের প্রাচ্য প্রেমের আপাত মুখোসের পিছনে আসল মুখের ভয়ঙ্কর স্বরূপ এই গল্পে উদ্ঘাটিত হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে লেখা মহাবিদ্রোহের ইতিহাসকে বদলে প্রত্ন-পৌরাণিক যুগে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে চোখের সামনে ‘কদর্য একটা কুহক যেন ছোট ছায়ামূর্তি’র রূপ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিপথ জুড়ে নেমে আসতে থাকেএই মূর্তিকে সনাক্ত করা যায়– ‘গান্ধী গান্ধী গান্ধী’গান্ধী‘অশান্ত অবাধ্য দুষ্টু ফকীর’কোথাও কি ব্রহ্মদত্তের আশ্রম আর শবরমতীর আশ্রম সমাপতিত হয়ে যায়?২২ টেনব্রুকের বিনিদ্র রাতে ছাত্রদের শোভাযাত্রার দুঃস্বপ্ন হানা দিয়ে যায়। ফিরে ফিরে আসে– “একটা নিষ্ঠুর নৈরাশ্য চিন্তার শিরায় শিরায় শিউরে উঠতে লাগলো– না, ওরা মানবে না। আবার ওরা আসবে। আজই রাত্রিশেষে– একটা প্রেতের দল, বায়ুভূত নিরালম্ব ছোট ছোট মসীমূর্তি– শয়তানী আনন্দে অপমৃত্যুর কোরাস গাইতে গাইতে আবার আসবে– দল বেঁধে– কাতারে কাতারে।” আর তখনই “রাজগীরের ধূপদানের বুকটা তখন প্রবলভাবে পুড়ে চলেছে। কুণ্ডলী কুণ্ডলী ধোঁয়া জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে অবলীল স্বাচ্ছন্দ্যে বাইরে উড়ে যাচ্ছে।” কালাগুরুর নিজেকে পুড়িয়ে সৌরভ দানের সঙ্গে দেশপ্রেমিকের আত্মদানের একটা যোগসূত্র রয়েছে। গল্পের অন্তিম পরিণতিতে টেনব্রুকের হিংস্র শাসক-শোষক মূর্তি বেরিয়ে আসে, আর কালাগুরুর আত্ম-দহন আর বলাইয়ের আত্মদান সমার্থক হয়ে ওঠে। দেশপ্রেমে নিঃশেষে প্রাণ দান করলে যে তার ক্ষয় নেই, ধূপের সৌরভের রূপকল্প সুবোধ ঘোষের ‘৩রা মার্চ’ প্রবন্ধে গান্ধীজী সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়েছে– “ভারতের গান্ধী! তুমি মৃত্যুকে অতিক্রম করেছ, তুমি ধূপ নহ, তুমি সৌরভ।” কালাগুরু ও ধূপের সৌরভ যে ব্যঞ্জনায় এক ও অভিন্ন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে কী!

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার পটভূমিকায় ‘মাটির দীক্ষা’ গল্পটির সূচনা হয়েছে।ভয়ানক এক দাঙ্গায় নোয়াখালির পল্লীর শান্তি বিপর্যস্ত। হিন্দু নরনারীর জীবন বিপর্যস্ত, অপমানিত। সেই ভয়াবহ হিংস্র সময়ে গান্ধীজীরই শুধু প্রতীক্ষা–“সবই অনিশ্চয়ের মধ্যে। দূরান্তরে ঐ অন্ধকারাবৃত ক্ষেত মাঠ ও তরুবীথিকার জগতে আজ মানুষের মানমর্যাদা ও জীবন অনিশ্চিয়ের মধ্যে। ঐ অন্ধকারের বুকে হিংসার গরল পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। নীলকণ্ঠ কোথায়? কিন্তু সংসারের তিনি কি মানুষের ইতিহাস থেকে বিদায় নিয়ে সরে গেছেন? এই রকম সংশয়েই তখন মনের ভেতর যেন তোলপাড় করছিল এবং ভারত জীবনের শঙ্কাহরণ নায়ক মহাত্মা গান্ধী তখনো নোয়াখালি এসে পৌঁছননি। তবু সংবাদ শুনেছি, কলকাতা থেকে তিনি যাত্রা শুরু করেছেন। তিনি আসছেন, সেই সময়।” ‘একটি নমস্কারে’ উপন্যাসে নীলকণ্ঠের রূপকল্প গান্ধীজীর উদ্দেশেই ব্যবহৃত হয়েছেদাঙ্গা বিপর্যস্ত হিন্দু পরিবারের নরেশ ও অমিতার একটি শিশু নিয়ে নিরাপদ বাসস্থানের সন্ধানের মধ্যে দিয়ে গল্পটির প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে খণ্ডিত দেশে এপার বাংলায় বেনিয়াপুকুরের এক বাড়ির সিঁড়িকোঠার ক্ষুদ্র পরিসরে অন্ধকারময় স্যাঁতসেঁতে বাসায় তাদের সঙ্গে বহুদিন পরে কথকের দেখা হয়েছে। দুঃখ ও অভাব।শ্রীহীনবাসার চিত্রটি এরকম– “ঘরে কোন দেব-দেবী বা মহাপুরুষের ছবি নেই, কোন বই নেই... অভাব আর অপচয়, কোথাও শূন্যতা কোথাও অতিরিক্ততা, সব মিলিয়ে কোথায় যেন ছন্দ নষ্ট করে দিয়েছে, যার জন্যে বড়ই শ্রীহীন মনে হচ্ছিল এই দম্পতির সিঁড়িকোঠার সংসার। হয় পৃথিবী এদের সঙ্গে ছন্দ রাখতে পারছে না, নয় এরাই পৃথিবীর সঙ্গে ছন্দ রেখে চলতে পারছে না। কোথায় যেন ভুল রয়ে গেছে।”

অনেক দিন পরে কথকের সঙ্গে নরেশদের আবার দেখা হয়েছে। বেনিয়াপুকুরে নয়, ধুলো-ধোঁয়া আর কলকাতায় দিনের আলোয় নয়; রাজীবপুরে এক পৌষের প্রভাতে। সমৃদ্ধির পৌষলক্ষ্মীর সময়কার নরেশদের বাড়ির বর্ণনায় এবার সারল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লক্ষ্মীশ্রী, আদর্শ, রুচি। বর্ণনাটি আশ্চর্য সুন্দর–“মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি, বড় আঙিনা, লতার বেড়া। কুমড়োর মাচানও আছে। কয়েকটা নতুন পেঁপেগাছ। খুঁটোর সঙ্গে দড়ি বাঁধা একটা কালো গরু... আঙিনায় তুলসীগাছ আছে। ঘরের দেয়ালে কুলুঙ্গিতে একটি লক্ষ্মীর সরা ও ছবি রয়েছে। দেয়ালে মহাত্মা গান্ধী ও স্বামী বিবেকানন্দের ছবি আছে। দাওয়ায় মাদুরের ওপরে কয়েকটা বইও পড়ে আছে দেখলাম– গীতা, রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য আর চণ্ডীদাসের গান।” নরেশ আর অমিতার জীবন ‘একটা বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস’ পার হয়ে এইখানে উদার করুণার স্পর্শে ‘মাটির দীক্ষা’ লাভ করে নিজেদের ভাগ্য গড়বে। ওদের চোখে মুখে বেনিয়াপুকুরের সিঁড়িকোঠার বিশ্রী দুঃখের ছাপ নেই, তাই এখানে তাদের এত সুন্দর ও সুশ্রী দেখাচ্ছে। কথকের মনে হল, “এইরকমই এক মানবদম্পতি বোধহয় মানুষের প্রথম সংসার রচনা করেছিল, এবং এইরকমই একটি মাটির আঙিনা ছিল সেই সংসারে।”

         

ছয়

রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর আন্দোলনের পন্থা সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহমত হননি। গান্ধীজীর মহত্ত্ব সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দিগ্ধ হলেও তাঁর কর্মপন্থা সম্পর্কে কবির দ্বিধা ছিল, তাঁর ‘শক্তি’ ভারতবাসীর চিন্তন, সংকল্প ও ত্যাগের পথে উদ্বুদ্ধ করুক এটাই ছিল কবির প্রার্থনা– “মহাত্মাজির সঙ্গে কোনো বিষয়ে আমার মতের বা কার্যপ্রণালীর ভিন্নতা আমার পক্ষে অত্যন্ত অরুচিকর। বড়ো করে দেখলে তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু তবু সব সময়ে মন মানে নাকেননা যাঁকে প্রীতি করি, ভক্তি করি, তাঁর সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার মতো আনন্দ আর কী হতে পারে? তাঁর মহৎ চরিত্র আমার কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয়। ভারতের ভাগ্যবিধাতা তাঁর হাত দিয়ে একটি দীপ্যমান দুর্জয় দিব্য শক্তি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই শক্তি ভারতবাসীকে অভিভূত না করুক; তাকে নিজের মন দিয়ে চিন্তা করতে, সংকল্প করতে, ত্যাগ করতে শিক্ষা দিক– এই আমার কামনা।”২৩গান্ধজী ও নেহেরুর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাসম্পন্ন হওয়ায় তাঁদের কোন সীমাবদ্ধতা সুবোধ ঘোষের লেখাতে প্রায় প্রকাশ পায় নি বলা চলে। এটা তাঁর চিন্তনের একটি মারাত্মক সীমাবদ্ধতা। গান্ধী-নেহেরু সম্পর্কে তাঁর বিচারবুদ্ধি যে প্রায় অন্ধত্বের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছিল তার পরোক্ষ প্রমাণ তাঁদের বিপরীত পন্থার দেশনায়ক একটিবারের জন্যও সুবোধ ঘোষের চিন্তনে স্থান পায় নি। এই একদেশদর্শিতা সমর্থনযোগ্য নয়।

‘Gandhi the Man’ প্রবন্ধে (‘The Sunday Statesman, 13 February 1938) রবীন্দ্রনাথ অনাগত কালে গান্ধীজী ব্যর্থতা সত্ত্বেও যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সে সম্পর্কে যা বলেছিলেন তার মধ্যে ঋষিকল্প কবির সত্যদৃষ্টির পরিচয় বিধৃত হয়ে রয়েছে– “Perhaps he will not succeed. Perhaps he will fail as the Buddha failed and as Christ failed to wean men from their iniquities, but he will always be remembered as one who made his life a lesson for all ages to come.”২৪

 

 

উৎস নির্দেশ:

১। ঘোষ, উত্তম (২০০১)। ‘বড় বিস্ময় লাগে’ কলকাতা: নাথ পাবলিশিং। পৃ. ৮২

২। Tagore, Rabindranath (1963). Sen, Pulinbiharai (Compiled by).‘A Liberated Soul’.Mahatma Gandhi. Calcutta: Visva-Bharati. p. 61-63.

৩। ঘোষাল, সুভাষ (১৯৯৫)। ‘গান্ধী’কলকাতা: প্যাপিরাস। পৃ. ১১-১৩, ৬২

৪। বসু, নির্মলকুমার (১৩৫৬)। ‘গান্ধীচরিত’কলকাতা: রঞ্জন পাব্‌লিশিং হাউস। পৃ. ২৮

৫। পূর্বোক্তপৃ. ৩২

পূর্বোক্ত।পৃ. ৩৩

৭। ঘোষ, উত্তম (২০০১)। ‘বড় বিস্ময় লাগে’ কলকাতা: নাথ পাবলিশিং। পৃ. ৬৯

৮। পূর্বোক্তপৃ. ৬০

৯। পূর্বোক্তপৃ. ৭৪

১০। মহাস্থবির, ধর্মাধার (১৯৫৪)। পুপ্‌ফবগ্‌গো। ‘ধম্মপদ’কলকাতা: বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা। পৃ. ২০

১১। ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ (১৪১৬)। ‘চরকা’। ‘কালান্তর’কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ।পৃ. ২৬৬

১২। পূর্বোক্তপৃ. ২৫৮

১৩। পূর্বোক্তপৃ. ২৫৯

১৪। ‘স্বরাজসাধন’। পূর্বোক্তপৃ. ২৬৯

১৫। পূর্বোক্তপৃ. ২৭৯-৮০

১৬। গান্ধী, মোহনদাস করমচাঁদ (১৪১৩)। সান্যাল, শিশির (অনূদিত)। বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেশকুমার‘ভূমিকা’‘হিন্দ স্বরাজ’কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ প্রাইভেট লিমিটেড। পৃ. ৪

১৭। পূর্বোক্তপৃ. ৬

১৮। গান্ধী, মোহনদাস করমচাঁদ (১৪১৩)। পূর্বোক্তপৃ. ৪৬

১৯। গান্ধী, মোহনদাস করমচাঁদ (১৪১৩)। ‘ভূমিকা’। পূর্বোক্তপৃ. ১২

২০। Gandhi, M. K. (2004).Parel, Anthony J. (Edited).‘Supplementary writings’.Hind Swaraj and Other Writings. Cambridge: Cambridge University Press. p. 139

২১। ঘোষাল, সুভাষ (১৯৯৫)। ‘গান্ধী’কলকাতা: প্যাপিরাস। পৃ. ৫২-৫৩

২২। পুরকাইত, উত্তম (২০১১)। মুখোপাধ্যায়, ঋতঙ্কর। ‘ঔপনিবেশিকতা ও ভারতীয়ত্বের সন্ধান: সুবোধ ঘোষের ‘কালাগুরু’। ‘সুবোধ ঘোষ অযান্ত্রিক শিল্পী’হাওড়া: উজাগর। পৃ. ১২৪

২৩।ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ (১৪১৬)। ‘চরকা’। ‘কালান্তর’কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ। পৃ.২৬৬-২৬৭

২৪। Tagore, Rabindranath (1963). Sen, Pulinbiharai (Compiled by).‘Gandhi the Man.Mahatma Gandhi. Calcutta: Visva-Bharati. p. 16-17

 

সুবোধ ঘোষের উদ্ধৃতি দেওয়ার জন্য নিম্নলখিত গ্রন্থগুলি ব্যবহার করা হয়েছে– 

১। ঘোষ, উত্তম ও নাথ, সমীরকুমার (সম্পাদিত) (১৯৯৯)। ‘সুবোধ ঘোষ রচনা সমগ্র’ ২কলকাতা: নাথ পাবলিশিং।

২। ঘোষ, উত্তম ও নাথ, সমীরকুমার (সম্পাদিত) (১৯৯৯)। ‘সুবোধ ঘোষ রচনা সমগ্র’ ৮কলকাতা: নাথ পাবলিশিং।

৩। ঘোষ, সুবোধ (২০০০)। বসু, নিতাই (সম্পাদিত)। ‘সুবোধ ঘোষ: প্রবন্ধাবলী’কলকাতা: সাহিত্যলোক।

৪। ঘোষ, সুবোধ (২০০৫)। ‘গল্প সমগ্র ২’কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

৫। ঘোষ, সুবোধ (২০০৫)। ‘গল্প সমগ্র ৩’কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

  • সুমিত বড়ুয়া