ওটিপি এসে গেছে

-আমি কি চকোরবকোরতিজি-র সঙ্গে কথা বলছি? বাত কর সকতা হ্যায়?
-বলছি।
-আমি দিল্লি কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট থেকে রমেশ যাদব কথা বলছি। আমার এমপ্লয়ি কোড হল বি ২১২৩।
-বলুন স্যার।
-নাইজেরিয়া থেকে আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে। এ সম্পর্কে কি আপনি অবগত আছেন? আপনার কি জানকারি রয়েছে?
স্কুলজীবনে করা ভূগোলের ম্যাপ পয়েন্টিং ছাড়া এই দেশটির সঙ্গে বিন্দুবিসর্গও সম্পর্ক নেই আমার। আর ইদানীং রবিবারের খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রে চলুন বেড়িয়ে আসিতে দেখি দেশটির নাম, জেব্রা জিরাফের ছবি সহ। ব্যাস,আমার নাইজেরিয়া সঙ্গ বলতে এটুকুই।
-না না। আমার এ ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই।

 


-তা হলে সাফ সাফ শুনে রাখুন, ওই পার্সেলে ভরা রয়েছে নারকোটিক্স। রয়েছে আরও কিছু নিষিদ্ধ ড্রাগ। তা আমাদের কাছে রাখা রয়েছে, মুম্বই অফিসে। আপনি ফেঁসে গিয়েছেন। কেন এল আপনার নামে এই পার্সেল? দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ধারণা আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে আপনি জড়িত আছেন। যে কোনও মুহূর্তে আপনি গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। আপনি কি জেলে যেতে চান?
লোন নিয়ে কেনা ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে হাওড়া ব্রিজ দেখা যায় বেশ। মেঘের মতো, ধোঁয়াশাময়। ভোরবেলায় শোনা যায় টিয়াপাখির ডাক। জেলে যাব না।
- অন্য লোকে পাঠাবে পার্সেল আর জেলে যাব আমি?
-পার্সেল যখন আপনার নামে নিতে তো আপনাকে হবেই। আমি আপনাকে সাহায্য, অর্থাৎ মদত করার জন্য এই ফোনটা করছি।
- পার্সেল আমি নিতে যাব কোন দুঃখে? কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।
- কোনও ভুল নেই। আপনাকে নিতেই হবে। কাস্টমস থেকে পার্সেলটা ছাড়াতে আপনাকে বাইশ হাজার টাকা দিতে হবে। মোবাইলে একটা ওটিপি এলো। বলে ফেলুন।
এবার আমি জেগে উঠি। বুঝে যাই, চোরাবালি হাজির। গলার ডেসিবেল বাড়াই।
-ওহে কাস্টমস শুনে নাও! আমি লাইনে অ্যাড করছি আমাদের লোকাল থানার বড়বাবুকে। কাল সন্ধেবেলাতেই একসঙ্গে এগরোল খেলাম। আরও জেনে রাখো, কলটা রেকর্ড হচ্ছে।
যা ভেবেছিলাম, তাই হলো। একটি অশ্লীল শব্দ উড়ে এল ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে। লাইনটা কেটে গেল ঝটিতি। ফোনে আসা ওটিপি বলা হল না।

 


ফেলে আসা বছরটিকে মনে রাখব বহু নতুন ধরণের কলের জন্মদাতা হিসেবে। নিষিদ্ধ মাদকের প্রাপক কিংবা প্রেরক হিসেবে উঠে এসেছে আমার নাম একাধিকবার। করাচি কিংবা কলম্বোতে আমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নাকি এইমাত্র কেনা হয়েছে তিরিশ লক্ষ টাকার অস্ত্র—ব্যাঙ্ক ‘আধিকারিক’ আমাকে সাবধান করার জন্য ফোন করেছেন। ‘কি করে এমন হল, কার্ড তো আমার কাছে’, শোনার পরে উনি মুচকি হেসে বলেছেন, ‘আজকের দুনিয়ায় কিছুই অসম্ভব নয়। আপনি পিছিয়ে রয়েছেন কয়েক আলোকবর্ষ দূরে।’ তবে তিরিশ লক্ষ টাকা যেন আমার ক্রেডিট কার্ডের বিল মেটানোর সময় পে না করতে হয়, তার জন্য ওই আধিকারিক দাবি করেছিলেন কুড়ি হাজার টাকা। জিম্বাবোয়ের কোনও লটারিতে জিতে গিয়েছি প্রায় তিন কোটি পঁচাত্তর লক্ষ টাকা। টাকাটা আমায় পাঠানোর জন্য মাত্র এক লক্ষ টাকা জমা করতে বলা হয়েছিল ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে। কথা চলাকালীনই ফোনে এসেছিল লিংক। বিদেশি নম্বর দেখে প্রবল উৎসাহে ‘হ্যালো’ বলার পরে এক বয়স্ক সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছেন, ‘জীবনসায়াহ্নে এসে বুঝে গিয়েছি, মিছে এই অর্থ, যশ, অহংকার। এসেছি খালি হাতে। শুন্য হাতে ফেরারও দিনও সমাগতপ্রায়। ভারতীয় মুদ্রায় ২৫ কোটি টাকার কাছাকাছি যা জমাতে পেরেছি, তা আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই বাবা। অনেক গবেষণা করার পরে বলতে পারি, সারা পৃথিবীতে তুমি, একমাত্র তুমিই এর যোগ্য। দেখতো ফোনে একটা ওটিপি গেছে কিনা। এটা বললেই পুরো টাকাটা পাঠিয়ে দেবো।’ ফোনের গলার মধ্যে কেমন যেন মিশে ছিল রোবটগন্ধ। এআই?

 


বার্তা পেয়েছি ফোনে ফোনে! যন্ত্রে আসা সামান্য বার্তা যে বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে তা আমরা শিখছি রোজ। মেসেজের তলায় থাকা একটি সামান্য, আপাতনিরীহ লিংক এক মুহূর্তে অজগরের মতো বড় হাঁ করে গিলে নিতে পারে আমার-আপনার সর্বস্ব। কোন লিংকে মধু আর কোন লিংকে গরল তা আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না। উদয় হয়েছে একটি নতুন শব্দ। ডিজিটাল গ্রেফতারি। ইউ আর আন্ডার ডিজিটাল অ্যারেস্ট। এটা অনেকটা আমাদের গলায় সিসি ক্যামেরার মালা ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো। সম্পূর্ণ অলীক। কিন্তু একইসঙ্গে, ভয়ংকরভাবে বাস্তব। কোনও অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন হুমকি দিয়ে বলবে, ‘আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটির সঙ্গে অপরাধমূলক কাজের লেনদেনের নমুনা পাওয়া গিয়েছে অজস্র। তাই আপনি বন্দি। ডিজিটালি।’ বলা হবে, ‘যতই বন্ধ রাখুন ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল ফোন, ক্যামেরা আপনাকে দেখছে। সমস্ত তথ্য বন্দি আছে আমাদের কাছে। বাড়ি থেকে বেরনো যাবে না। পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে নতুন করে বিপদ বাড়ানো যাবে না। ফোনে কথা বলা মানা। কারও সঙ্গে এই গ্রেফতারি নিয়ে আলোচনাও নৈব নৈব চ।’ এমন ফোন আসে সবার কাছেই। কিন্তু এর বলি হন মূলত নিঃসঙ্গ, একাকী প্রবীণ মানুষরা। ডিজিটালি গ্রেফতার হয়ে ছটফট করেন। পরে পাল্টা ফোন আসে আবার। জিজ্ঞেস করা হয় বন্দিদশা থেকে মুক্তি চান কি না। ছুটি পাওয়ার জন্য গুণতে হয় অর্থ। এর পরিমাণ কয়েক হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। কলকাতার এক প্রৌঢ়া সম্প্রতি মুক্তির গুণাগার হিসাবে খুইয়েছেন ৬৭ লক্ষ টাকা। অধিকাংশ মানুষরা পুলিশের কাছে যাচ্ছেন পুরোপুরি বেকুব বনে যাওযার পরে। জাতীয় সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টালের তথ্য জানান দিচ্ছে, গত বছরে ডিজিটাল গ্রেফতারি নিয়ে যে পরিমাণ অভিযোগ জমা পড়েছে. তার সংখ্যা ১৫ লক্ষ ছাড়িয়েছে। এক পরিচিত সাইবার বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘বাইনারি অপরাধে এত এনক্রিপশনের মোড়ক থাকে যে তা পেরিয়ে অপরাধীর কাছে পৌঁছে যাওয়া দুষ্কর। ফয়সালা করার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না সবসময়। নেটের ফাঁদ পাতা ভুবনে কাঁকুরগাছির সরকারি ব্যাঙ্কের টাকা মুহূর্তে চলে যেতে পারে ঘানায় বসা কোনও কুচক্রীর কাছে। সেই দুষ্কৃতী তা পত্রপাঠ ছড়িয়ে দেবে একাধিক অ্যাকাউন্টে। ব্যাপারটি হাইলি সাসপিশাস এবং ধরা বেশ মুশকিল।’

 


আশি ছুঁই ছুঁই এক বৃদ্ধ দিনকয়েক আগে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলেন, ‘একটু উদ্ধার করে দেবে বাবা? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ ফোনটা এগিয়ে দিলেন। দেখি, মেলবক্স খোলা। ইমেলটির সারমর্ম হল, আমাদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রক জানতে পেরেছে আপনি ফোনে এমন ভিডিও দেখেন যার বিষয় মূলত শিশুদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া। এই ইমেল পাওয়ার সাতদিনের মধ্যে যদি নিচে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ না করেন তা হলে আপনার বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হবে। নিচে করা সইয়ের পাশের ব্র্যাকেটে লেখা, আইপিএস। যোগাযোগ করার নম্বরে ফোন করলাম। বলল, ‘আপনার নাড়ি নক্ষত্র সব জানে সরকার। ব্যাঙ্ক ডিটেলও। বারো হাজার টাকা দিয়ে মিটমাট করে নিন এখনই। এই গেলো ওটিপি।’

 


খবরের কাগজে, আন্তর্জালে, এসএমএসে এ নিয়ে নিরন্তর প্রচার করা হচ্ছে সরকারি এবং বেসরকারি মাধ্যম থেকে। অজানা, অচেনা লিংকে ক্লিক না করার জন্য, যাকে তাকে ওটিপি না বলার জন্য তারা অনুরোধ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ‘আরবিআই ক্যাহতা হ্যায়’ বলে এ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনের সিরিজ ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। কিন্তু মানুষ সচেতন হচ্ছেন কই? হিমালয়সম অভিযোগের স্তুপ এর পক্ষে সায় দেয় না।  

 


যে ফোন নম্বরগুলো শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের ফোন করার কাজেই ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর গঠনকে একটি নির্দিষ্ট খাঁচায় বেঁধে রাখতে পারলে সাবধান হওয়া যেত অনেকটাই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ নিয়ে কাজ কিছুটা এগোলেও তা নামমাত্র। সাজো সাজো রবে এক্ষেত্রে এগোতে না পারলে আরও বেশি করে প্রবীণ মানুষরা এই বাইনারি যূপকাষ্ঠে বলি হবেন। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গিয়ে অনেকেই হয়রানির শিকার হয়েছেন। সেটাও বন্ধ করা জরুরি। চালু করা প্রয়োজন হটলাইন।

 


পরিশেষে কয়েকটা কথা। যুগের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকাটা বোকামি। ওটিপি মানেই সেটি শেয়ারযোগ্য নয়, তা মাথার মধ্যে গেঁথে ফেললে মুশকিল। এটি অতিসচেতনতা। আমাদের পাড়ারই এক একাকী, সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধ মধ্যরাতে অ্যাপট্যাক্সি বুক করেছিলেন, একটি মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। শুনেছিলাম, অ্যাপগাড়ির অর্ডার তাঁর সেটাই প্রথম। পাঁচ মিনিটে হাজির হয়ে যায় গাড়ি।
আর পরের দশ মিনিটে দুপক্ষের তুমুল বচসায় প্রতিবেশীদের ঘুম ভাঙে। জানতে পেরেছিলাম, গাড়িতে ওঠার পরে অ্যাপট্যাক্সির চালক ওটিপি চেয়েছিলেন। বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘লজ্জা করে না?’
সেই শুরু।
--

  • অম্লানকুসুম চক্রবর্তী