কী পেলাম, কী হারালাম 

মেয়েটা ছাদে দাঁড়িয়েছিল আনমনে। খোলা চুলে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়েছিল দিকশূন্যপুরের দিকে। সোনালী চুলগুলো উত্তুরে হাওয়ার দাপটে উড়ে গিয়েছিল পিছুটানহীনভাবে, কোনও চাওয়া পাওয়া ছিল না সেদিন। রোদ ঝরে ঝরে পড়ছিল। ছায়া আরও সুদীর্ঘ হয়ে আসছিল। মরচে পড়া বাড়িগুলো কয়েক নিমেষের মধ্যে আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল। শ্যাওলা জমা ছাদে মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। খোলা চুলে বাসা বেঁধেছিল উড়ে আসা পাতা! পাতার রঙ সবজে। হাল্কা হলদে আভা। একটা বিশ্রী দিন ভাল হয়ে যাওয়ার মতো ম্যাজিক আছে মেয়েটার মধ্যে। আমি চুপিসারে তাকে দেখি। পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রায়ই দেখি। তার গায়ের জ্যোতি দিনে দিনে আরও উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে। কলিকাতার জলবায়ু তাকে পাল্টে দিচ্ছে দিনে দিনে। আমি রবিবারের জন্য অপেক্ষায় থাকি। প্রতি সপ্তাহের শেষে মেয়েটা কলিকাতার থেকে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে তার জানলায় রাখা গাছের দিকে চেয়ে থাকে অনেক্ষণ। তারপর মহাশূন্যে ছুটে যায় তার দৃষ্টি। একটু অপেক্ষা। একটু নিজেকে উদাসী করে দেওয়ার পরে মেয়েটা ঢুকে যায় ঘরের ভিতরে। একটু একটু করে রোদের আলো নিভে আসে। শ্যাওলা ধরা ছাদে ফিরে আসে বিষণ্ণতা। পৌষের শেষে পুষে রাখা দুঃখগুলো টুক করে বাইরে এসে ফের জানান দিয়ে যায়, কী পেলে আর কী হারালে।
 
যে বছরের শুরু থেকে একটা আলগা বিকেলের রোদ বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে তোমাকে লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। ক্লান্ত সল্টলেক ফেরত বিকেলগুলোয় মনে হতো কী করছি, কেন করছি! একটা জীবন স্রেফ ট্রেনে ঝুলে ঝুলে কলিকাতায় আসছি আর ফিরছি। ফিরছি আবার আসছি। এই শহরেরই কত কোণে কত সব আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কিছুই দেখা হচ্ছে না। জীবনটা একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে হয়ত এটাই জীবন। আবার মনে হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত আশ্চর্যকে তো দেখাই হবে না যদি না এই বৃত্ত ভাঙি।  যদি না একটা গতানুগতিক জীবনকে একটু ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলি, নিয়ম ভাঙাটাই একটা নিয়ম। আসলে জীবনের একটা ফর্মুলা আছে। ঠিক অঙ্কের মতো। সেইভাবেই এগোতে হবে। দুইয়ে দুইয়ে চার করাটাই তো জীবনের আসল লক্ষ্য। তবুও বছরের পাতা ঘুরে যায়, পাতা ঝরে যায় মহীরুহের। শুধুমাত্র মোড়কটা পাল্টে যায়, বাকি জীবনটা একই থাকে। বছর শেষের আনন্দে হঠাৎ করে পুরোনো ব্যথা মুছে ফেলার শত চেষ্টা বৃথা হয়ে যায় নতুন বছর আসতেই। সেই পুরোনো ব্যথা আবার চাগাড় দিয়ে ওঠে। সেই হাহাকার, সেই অনটন, সেই অফিস, তোমার চুলের পুরোনো গন্ধ। একপাশ ফিরে চুপিচুপি রাত কাটিয়ে আবার একটা বিশ্রী দিনের অপেক্ষায় একটা বছর হুশ করে চলে যাওয়া। জীবনের তারিখ বদলায়, জীবন নয়। তারিখের সংখ্যা বদলায়, পরিস্থিতি নয়।
 
একটা গোটা বছর কানের পাশ দিয়ে হুশ করে উড়ে গেল। উবে গেল তোমার গায়ে লাগানো দামি পারফিউমের গন্ধ। তোমার এক বোতল সুগন্ধি যে দাম, সেই রকম দুই তিনটে বোতল সুগন্ধি কিনলেই আমার মাইনের সব টাকা উড়ে যেত। তোমার পায়ে যে জুতোটা শুধুমাত্র হাঁটার জন্য ব্যবহার করতে, আমার বাড়িতে থাকা সব জুতো জোড়ার দামও তোমার জুতোকে হার মানাতে পারবে না। তোমার মধ্যে বরাবরই আভিজাত্য ছিল। আমি ছিলাম ছাপোষা। যে ক্যাফেটেরিয়াকে কেন্দ্র করে আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই ক্যাফেটেররিয়া এখন কাঁচের দরজা দিয়ে ঘেরা। বাতানুকুল যন্ত্র বসেছে। সময় পাল্টেছে তবুও ওই ক্যাফের প্রতি যে টান সেটা আজও অনুভব করি।  আমাদের সময় গিয়েছে চলে শত শত আলোকবর্ষ দূরে, বছর ঘুরেছে তবুও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরার সেই চাওয়া এখনও ফুরিয়ে যায়নি। এখনও ফুরিয়ে যায়নি তোমার ঘামে ভেজা গায়ের গন্ধ। এখনও তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় ওই হলুদ বারান্দায় তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো। চুলগুলো একপাশে দিয়ে আনমনে চেয়ে আছো রাস্তার দিকে। যে পথ দিয়ে আমি প্রায়ই চলে গিয়েছে অভ্যাসের দায়ে। বছর ঘুরেছে তবুও অভ্যাস চলে যায়নি। আসলে প্রতিটা বছরের শুধু রঙ বদলায়, বাকি জীবনটা স্রেফ এক থাকে। নিজেকে ওই রঙের সঙ্গে মেলাতে না পারলে জীবনটা ফ্যাকাশে থেকে যায়। 
 
 
জীবনানন্দ দাশের কারুবাসনা পড়লে বুঝি, উনি জীবনটাকে স্রেফ জীবনের মতো করে টুকে গিয়েছেন। কোনও বাড়তি ভেজাল নেই। কোনও উপঢৌকন নেই। স্রেফ একটা জীবনরেখা। একটা মোহ, আছন্ন এবং সবুজ ঘেরা জীবন। জীবনে কতকিছু না পেয়েও জীবনটাকে রাজার মতো চালিয়ে গিয়েছেন। শাসন করেছেন এই বাংলার সবুজকে। তোমার বারান্দায় রাখতে হাইড্রেনজিয়া। কানাডার প্রবল শীতে তোমার ঘরে থাকত বাহারিগাছ। তোমার পড়ার টেবিলে রাখতে শৌখিন সম্ভার। তোমার পড়ার টেবিলের পাশে একটা জানালা ছিল, সবুজ পর্দা দিয়ে ঘেরা সেই জানালার বাইরে ছিল গভীর জঙ্গল। কতটা গভীর জানি না, তবে তোমার কথা শুনে মনে হয়েছিল, বড্ড গভীর। তোমার চেয়েও গভীর ছিল সেই জঙ্গলের সবুজ নীরবতা। তুমি রোজ বিকেলে সেখানে হাঁটতে যেতে! অদ্ভুত একটা মায়া ছিল ওই জঙ্গলের প্রতি। তুমি নির্জনতা ভালবাস। ভালবাস সবুজকে। চুপচাপ হেঁটে যাও বহুদূর। একা হয়ে যেতে চাও একা থেকেও! লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এই পৃথিবীর সমস্ত স্বাদটুকু শুষে নাও। এক নিমেষে হয়ে ওঠো সতেজ। ঠিক যেন একটা নতুন উপন্যাসের মতো মনে হয় আমাদের আলাপ, আমাদের কথোপকথন। 
 
 
 
সেদিন দুপুরে মেয়েটা একটা হাত কাটা জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়েছিল ছাদে। অনেকটা পুরুষালী ভঙ্গিতে। মেয়েটার সঙ্গে তিনটে কুকুর। মেয়েটা কুকুর ভালবাসে। কুকুরগুলোও মেয়েটাকে ভালবাসে।  তুমিও কুকর ভালবাসতে। তোমার সারমেয়ের নাম ছিল লুবু। অদ্ভুত দেখতে। সাদা লোমে আবৃত ওর সারা শরীর। মেয়েটাকে আমি চুপিসারে দেখি। জানালার ফাঁক দিয়ে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করি একটা ভাল দিনের। শুধু মনে মনে বলি, আমার হারানোর তো কিছুই নেই। যা আছে সবটাই পাওয়ার। বছর শেষের কিংবা বছরের শুরুতে, সবটাই পাওয়ার জন্য। হারানোর তো কিছু নেই।  আসলে আমরা একজীবনে কারুর হতে পারি না। বিয়ের আগেও নয়, বিয়ের পরেও নয়। প্রেমেও নয়, অপ্রেমেও নয়। আমি চিরকাল আমারই থাকব, যেমন ছিলাম রোদ ভেজা শৈশবের দুপুরে। যখন দুপুরগুলো বড্ড মনোরম ছিল। বেঁচে থাকার তাগিদ থাকত বিকেলের জন্য। আলতো রোদ গায়ে মেখে দৌড় দিতাম বহুদূর। যতদূর যাওয়া যেতে পারে। যত অলিগলি পেরিয়ে যাওয়া যেতে পারে তেপান্তরের মাঠে। মেঠো রোদ, প্রেমিক ধুলো, জোকার সুলভ গিটার বাজানো গান এবং আরও যা যা ছেলেমানুষি আছে সেই সবটুকু এক নিমেষে করে ফেলা যেতে পারে। স্রেফ কিচ্ছু না ভেবে। মনে যা যা পাগলামি আসছে, সেই সবটুকু করে ফেলা যেতে পারে। যেখানে বিচার করার কেউ থাকত না। যেখানে বারণ শোনার কেউ থাকত না। সোনা রোদ আর আমি দুজনেই লোফালুফি খেলতাম। সুখ ভাগ করে আড়াআড়ি শুয়ে থাকতাম মেঘের কোলে। এই রোদের দেশে, আমি যা পেয়েছি আর যা পাইনি সেই সবটুকু নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি। ঝরা পাতার দলের পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। সেই সাইরেন, শ্মশানের গন্ধ, ঘুম ভাঙা মধ্যরাত, না লিখতে পারার যন্ত্রনা এবং তুমি। সেই রোদ, হলুদ বারান্দা, তোমার বাড়ির চেনা পথ, হাইড্রেনজিয়া, বাবার চলে যাওয়া। আমার আদুরে শৈশব ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া। তবুও যা কিছু আছে ভাল, তাই হোক।

  • আদিত্য ঘোষ