কোষমুক্ত ‘টিনের তরবারি’ – সমকালে ফিরে দেখা এক চিরায়ত উচ্চারণ

কোষবদ্ধ থাকবে তূণ, না কোষমুক্ত? চিরকালীন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদটিও চিরকালীন। সেই চিরকালীন প্রশ্নকে সমকালীনতার অঙ্গনে-

 

 

সমকালকে বিশ্লেষণের প্রয়োজনেই অনেক সময় চিরায়তের আশ্রয় নেওয়া জরুরি। এমনও দেখা যায়, বিশেষ কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কোনও বিশেষ সময়ে একেকটি গান, কবিতা, গল্প বা থিয়েটার নির্মিত হয়, যা কিনা আবারও সময়ের ব্যবধানে কালানুষঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সমকাল সেই সৃষ্টির ধারক ও বাহক হলেও, কালক্রমে তারা চিরায়ত হয়ে ওঠে। এভাবেই ইতিহাসের জন্ম ও পুনরাবৃত্তি হয়। অতিমারী পরবর্তীতে স্বদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি পালটেছে অনেকটাই। সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিকেই বাংলার নাট্য-নির্দেশকেরা একেকজন, সমকালে দাঁড়িয়ে চিরায়ত সৃষ্টির দর্পণে ফেলে দেখতে চেষ্টা করেছেন। তাই তাঁদেরই হাত ধরে মঞ্চে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে টিনের তলোয়ার’, ‘নরক গুলজারঅথবা মারীচ সংবাদ -এর। মঞ্চ-পরিসরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানবতা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের উদযাপন। এর পাশাপাশি বিদেশি ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা দেখেছি কোনও কোনও নাট্যদলের তরফে মেফিস্টোঅথবা দায় আমাদেরও’, সমতুল নাটকের অনুষ্ঠান। নাটক আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে সমসত্ত্বের বিপরীতে বহুত্বেই আমাদের মুক্তি। নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সরব প্রতিরোধেই আমাদের মানবতার অনুশীলন।

 

 

 

প্রযোজনাগুলির আরেকটি বিশেষ দিক লক্ষ্যণীয়। একাধিক এমন প্রযোজনার ক্ষেত্রে একাধিক নাট্যদল একত্রে উদ্যোগী হয়ে  প্রযোজনাটিকে মঞ্চস্থ করেছে। এরফলে একাধিক নামী শিল্পীকেও যেমন একই সঙ্গে মঞ্চে আনা সম্ভব হয়েছে, তেমনই একাধিক দলের প্রচারে অনেক মানুষের কাছে, অধিক গুরুত্ব সহকারে নাটকের বার্তাটি পৌঁছিয়ে দেওয়া গিয়েছে। অন্যদিকে একক উদ্যোগেও অবশ্য এমন প্রযোজনার অভাব নেই। সাম্প্রতিক অতীতে দেখলে চেতনা, তৃতীয় সূত্র ও মুখোমুখি, এমন তিনটি দলের উদ্যোগে মঞ্চস্থ হয় ক্লাউস মানের উপন্যাস অবলম্বনে নাটক মেফিস্টো। নাটকটি একাধিকবারে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এখনও মনে পড়ে নাটক শুরুর আগে, মঞ্চের উপর বিরাট এক সাদা পর্দাতে তীক্ষ্ণ বল্লমে বেঁধানো একটি মোরগের মৃতদেহের তলায় জার্মান যে শব্দদুটি লেখা ছিল তাদের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “কখনও নয়” - নেভার এগেইন! এই নাটকের এর চেয়ে বড় সারমর্ম হয় না। এই তিনটি দলই আবার উদ্যোগী হয়ে মারীচ সংবাদনাটকের পঞ্চাশ বছর উদযাপনে উদ্যোগী হয়। একই সময়ে কলকাতায় থিয়েটার পরিবর্তকের উদ্যোগে অভিনীত হয় নাটক তিতুমির। প্রাচ্য নাট্যদলের প্রযোজনায় অভিনীত হয় দায় আমাদেরওনাটক। কেন এই প্রযোজনাগুলি গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রযোজনাগুলি আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় চ্যাপলিনের সংলাপ, “সো লং এ্যাজ মেন ডাই লিবার্টি ক্যান নেভার পেরিশ!

 

 

 

যুগযুগান্ত ধরে মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষই সরব হয়ে এসেছে। সেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে থেকেছে সাহিত্যকর্মে, সৃষ্টিতে, ইতিহাসের পাতায়। আবার কখনও বা বিস্মৃতির অতলেও তলিয়েছে। নাটক মেফিস্টোঅথবা দায় আমাদেরও’, আমাদের মনে করিয়ে দেয় হিটলারি শাসনের ভয়াবহ সময়। এও মনে করিয়ে দেয়, অনেক মানুষ যেমন সে সময়ে অত্যাচারী, উন্মাদ হিটলারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তার চেয়েও অনেক বড় সংখ্যাতে মানুষ সেই এক সময়ে দাঁড়িয়ে অত্যাচারী, অসংবেদনশীল শাসকগোষ্ঠীকেও নীরবে সমর্থন যুগিয়ে এসেছিলেন। যে সমষ্টিগত নীরবতাই কালানুক্রমে হিটলারকে একনায়কহয়ে উঠতে সহায়তা করে। সমাজসচেতনতা-বোধের বিকাশ প্রত্যেক নাগরিকের ক্ষেত্রে জরুরি। মারীচ সংবাদনাটকে এমনি ভাবেই উঠে আসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেদেশে সাধারণ নাগরিকবর্গকে উগ্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের টোপ দিয়ে রাষ্ট্রের গর্ভে আত্মসাৎ করার চক্রান্ত। যে চক্রান্তের বিরুদ্ধেই সরব হয়ে উঠতে চায় সাংবাদিক ম্যাকি, অথবা অন্য কোনও সময়ে, আদতে সম্পূর্ণ অন্য এক সমান্তরাল কাল-ক্ষেত্রে অবস্থান করা জাদুকর মারীচেরই মতো কেউ। মঞ্চ-আবহে শোনা যায় মেরিবাবার বিশ্বদর্শনের গান। দীর্ঘ এই তালিকাতেই শেষতম সংযোজন, উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার। প্রযোজনায় মুখোমুখি ও তৃতীয় সূত্র। সেই নাটকই সম্প্রতি দেখে এলাম।

 

 

 

নির্দেশনা সুমন মুখোপাধ্যায়। অভিনয়ে দেবশঙ্কর হালদার, শঙ্কর চক্রবর্তী, পৌলমী বসু প্রমুখ। অভিনয়, মঞ্চ, সঙ্গীত অথবা অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাদা করে কোনও বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন দেখছি না। বরং নাটকটি দেখতে বসে বারেবারেই মনে হচ্ছিল, আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও এ নাটক কতখানি প্রাসঙ্গিক। বাকস্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রণ, মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ এবং তারই পাশাপাশি অর্থের জোরে, বাহুর জোরে সমস্ত অপছন্দের মতাদর্শকেই রুদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা, সমকাল থেকে চিরায়ত সময়, তাতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চোখে চোখ রেখে বাবু বীরকৃষ্ণ দাঁয়ের ভূমিকায় শঙ্কর চক্রবর্তী ও দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নির্দেশক বেণী চ্যাটার্জির ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার অভিনয় করেন। উৎপল দত্তের অভিনয় মুখোমুখি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সৌভাগ্য হয়ে থাকলেও সকল বিষয়ে অকারণ তুলনা টানার বিষয়টিতে আমার যারপরনাই আপত্তি রয়েছে। দেবশঙ্কর হালদার তাঁর নিখুঁত সময়জ্ঞান ও স্বকীয়তায় যেভাবে বেণীর চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার রেশ অনেকদিন মনে থেকে যাবে। আলাদা করে বরং বলব, ময়না ওরফে শঙ্করীর চরিত্রে আনন্দরূপা চক্রবর্তী ও বাবু প্রিয়নাথ মল্লিকের চরিত্রে রাজু বেরার নাম। এঁরা প্রত্যেকেই নিজ দক্ষতায় নাটকের সমগ্র রূপটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আঙুরবালার চরিত্রে পৌলমী বসু যথাযথ। নাটকের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল গান। তদুপরি নাটক চলাকালীন মঞ্চে সরাসরি সঙ্গীত প্রয়োগের ভাবনা।

 

 

 

প্রযোজনার প্রয়োজনেই এই নাটকে টিনের তলোয়ারএর নিজস্ব গানগুলি ছাড়াও ব্যবহৃত হয়েছে মেরিবাবার গান’, ‘সমুদ্র-কল্লোলের গান’, অথবা নরক গুলজারের কথা কোয়ো না কেউ শব্দ কোরো নার সেই অমোঘ সঙ্গীতময় উচ্চারণ। যুগে যুগে যে সকল নাটক-গান-সংলাপের মাধ্যমে বাংলা থিয়েটার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি সরব হয়েছে, সেগুলিরই উদ্দেশ্যে নতুন এই টিনের তলোয়ারনাটক যেন এক সরাসরি সম্মাননায় পরিণত হয়েছে। ঠিক যেমন ভাবে মেফিস্টোর শেষ দৃশ্যে আমরা বেলা চাওএর গান শুনতে পেয়েছিলাম, একই ভাবে এখানে আমরা শুনেছি নাটকের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশে তিতুমিরএর বঙ্গলক্ষ্মীর গানের পাশাপাশিই মেরিবাবার গান। সুরে-বেসুরে আমরা গলা মিলিয়েছি জরুরি অবস্থাকে মনে পড়ানো, ‘গোলযোগ সইতে পারেন নার সংলাপেই।

 

 

 

উপরে উল্লেখ করে আসা মেফিস্টোতিতুমিরনাটকের প্রযোজনা আপাতত বন্ধ থাকলেও বাকি সবকটি প্রযোজনাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অভিনীত হয়। এর পাশাপাশিই, যাদবপুর রম্যাণীর ব্যবস্থাপনায় অভিনীত হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে, অরুণ মুখোপাধ্যায়-কৃত নাট্যরূপ-নির্ভর প্রযোজনা হারানের নাতজামাই। মনোজ মিত্রের প্রয়াণের পর সুন্দরমের তরফে ঘোষিত হয়েছে তাঁদেরও পরবর্তী প্রযোজনার নাম। বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় তাঁরা ডিসেম্বরেই মঞ্চে ফিরিয়ে আনছেন নরক গুলজারনাটক। চিরায়ত সৃষ্টির সঙ্গে এভাবেই সমকালের উচ্চারণ অনুরণিত হয়। প্রতিধ্বনিতে শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।

 

 

চ্যাপলিন যা একটু অন্যভাবে বলেছিলেন, যতদিন এই পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের নিমিত্তে শাহাদতকামী মানুষ থাকবে, ততদিন এই পৃথিবীতে মুক্তির আহ্বান স্তব্ধ হতে পারবে না। 

  • অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
img
আগের পাতা
বিলম্বিতে সম