এক শান্ত সমাহিত কবির বিদায়। যে কবি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে হয়, 'যে অগ্নিতে দীপ্তগীতে'। কবি হেলাল হাফিজ লড়াইয়ের কাতারে চিরকাল জেগে থাকা এক নাম-
বাংলা সাহিত্যে কবিতার মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া এমন ভাগ্য দু-চারজনের হয়েছিল। তার মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের। তারপর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তারপর আসেন সুনীল, শক্তি, শামসুর রাহমানের। আর কবিতা লিখে মানুষের হৃদয়ের তন্তুতে সাড়া জাগানো অনুভূতির বোধ হয় শেষ প্রতিনিধি ছিলেন, সদ্যপ্রয়াত কবি হেলাল হাফিজ। কবিরা সাধারণত ভাবেনই না, তাঁর কবিতা ঘিরে পাঠকের মধ্যে কী অনুরণন ঘটল। লেখার নেশায়, বলার নেশায়, সৃষ্টির নেশায়, তাঁরা লিখে যান। পাঠক চিত্ত বিনোদন -এটা কখনও কোনও সৃষ্টিশীল মানুষের কাজ নয়। এভাবেই কবি সুভাষ থেকে শামসুর হয়ে হেলাল হাফিজেরা, তাঁদের সৃষ্টির দুনিয়াকে প্রসারিত করে গেছেন।
হেলাল হাফিজ কবিতা লিখছেন অনেক কাল ধরে। পাকিস্তান আমলে তাঁর লেখা কবিতাগুলি, তাকে কেবলমাত্র কবিতা না বলে এক একটি লড়াইয়ের ইশতেহার বলা যেতে পারে, আনমনা কবি সেসব লিখে গেছেন লেখার তাগিদে। কিন্তু সেগুলিকে সংকলিত করবার ভাবনা বা প্রয়াস কেন যে লেখার সমকালে হয়নি -এই প্রশ্ন অনেকের জাগতে পারে। এ প্রশ্নের সবথেকে বড় উত্তর হল '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের কালে যখন গোটা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল, সেই সময়কালে লেখা তাঁর কবিতা 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' বা সমচেতন সম্পন্ন অন্যান্য কবিতাগুলো হয়তো অনেকে ছাপতে খানিকটা সংশয়ীই ছিলেন এমন একটা ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। '৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ঘিরে শামসুর রাহমানের ঐতিহাসিক কবিতা 'আসাদের শার্ট' যখন ছাপা হতে পারে, তখন 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' ছাপা হওয়ার ক্ষেত্রে কোথায় বাধা ছিল -তা ঘিরে একটা সংশয়ী ধারণা আমাদের থেকেই যায়।
হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে' সেটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর ১৯৮৬ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের নিরিখে অনেকটাই পরিবর্তিত ছিল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রত্যাশায় লেখা কবিতার সময়কাল আর '৮৬ সালের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হয়েছেন, আজকের প্রেক্ষিতে না হলেও সেদিনও মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান, 'জয় বাংলা' উচ্চারণের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষকে হাঁটতে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যে পরিবেশের জন্য 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' র কালে একাধিক কবিতা হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, সেই প্রেক্ষিত আবার পশ্চাৎগামী হয়েছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের যে মূল নির্যাস 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' তা তখন পরিণত হয়েছে 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে'। সেই 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে' র মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি -এই সমস্ত বিষয়গুলি প্রায় উহ্য থাকছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিত তখন আবর্তিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষককে কেন্দ্র করে। কাদের সিদ্দিকীর মত নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধা তখন বাধ্য হচ্ছেন বাংলাদেশের বাইরে, কার্যত প্রাণের তাগিদে অবস্থান করতে।
এমন একটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে '৬৯ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের চেতনা, যার চরম বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সেই চেতনাকে মুক্ত কন্ঠে সোচ্চারে বলতে পারার মতো সাহস সেটি কিন্তু সেই সময়ের নিরিখে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটা বিষয়। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র উত্তর যুগে যে কবিদের কতগুলি পংক্তি কার্যত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে, যেমন; অন্নদাশঙ্কর রায়ের' তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো, তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো' বা 'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান', শামসুর রাহমানের তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটু পা চালিয়ে ভাই এর, 'লেনিনকে আমরা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম ধর্মতলার ট্রাম গুমটির পাশে' - তেমনভাবেই হেলাল হাফিজের, 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়' - এমন কিংবদন্তি হয়ে ওঠা কবিতার পংক্তি কেবল বাংলা কবিতার দুনিয়ায় কেন, গোটা বিশ্বের কবিতার দুনিয়ায় খুব কম আছে।
নীরাকে নিয়ে সুনীলের কবিতা বা শক্তি 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব' এই সমস্ত কবিতা বাংলা কবিতার পাঠক নন এমন মানুষদেরও মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু সে সব কবিতাগুলির সঙ্গে দেশ, কাল, সময়, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র -এ সমস্ত কিছুর সম্মীলন, সর্বোপরি হানাদারদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ, সেগুলি ভিন্ন ধারায় বাহিত হয়েছে। এখানেই বোধহয় হেলাল হাফিজ হয়ে রয়েছেন প্রেম আর প্রতিবাদের এক সম্মিলিত জনজীবনের উচ্ছ্বাসের সর্বাঙ্গীণ প্রয়াস। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের কালে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে হেলাল হাফিজের সৃষ্টির দুনিয়াটি দ্বারোন্মোচন ঘটেছিল। কবি নিজে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তখনকার ঢাকা, আজকের মত এত ট্রাফিক জীর্ণ নয় আর ঢাকার মানুষদের রিকশায় চড়ে বেড়ানোর একটা বড় রকমের বিলাসিতা সেই সময়ও ছিল। পরবর্তীকালে, নয়ের দশকেও সেই স্বভাবটা ঢাকার অনেক মানুষই ছাড়তে পারেননি।
এইরকম একটি আইয়ুব বিরোধী উত্তল আন্দোলনের দিনে হেলাল হাফিজ একটি রিকশা করে যাচ্ছেন। হঠাৎ রিকশার সামনে একটা নব যৌবন উজ্জীবিত মিছিল এসে পড়ল। রিকশাচালক সেই মিছিলটিকে দেখে জোরে রিক্সার ব্রেক কষলেন। কবির একটু ঝাঁকুনি লাগল। মিছিলটির উপর আক্রমণ করতে পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ একবারে রে রে করে ধেয়ে আসছে উল্টো দিক থেকে। আর মিছিলকারীরাও পুলিশের দিকে লক্ষ্য করে তখন দুর্দার বেগে ইঁট পাটকেল ছুটতে শুরু করেছেন। এই অবস্থায় কবি শুনলেন তাঁর রিকশা চালকটি বলছে; মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনও কোনও সময় মার্ডার করা যায়। রিক্সা চালকের মুখে এই উচ্চারণ শুনে এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থা তৈরি হল হেলাল হাফিজের মধ্যে। তাঁর মনে হল, সত্যিই তো রিকশাচালক একেবারে জীবন্ত সত্য কথা বলেছেন। দেশপ্রেমের জন্য হত্যা, সে হত্যায় তো কোনও অন্যায় নেই। এই ঘটনাই কিন্তু কবিকে কাছে সেই কালজয়ী সৃষ্টি 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' লেখবার প্রধান প্রেরণা হয়ে উঠল।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পর, '৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে 'অগ্নুৎসব' নামে এক অসামান্য কবিতা লিখলেন হেলাল হাফিজ। এই কবিতার ভাব মূর্ছনায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের উত্তাপ এবং মুক্তিযুদ্ধ উত্তর সময়কালের দেশ গঠনের অনবদ্য প্রেম, যে প্রেম মানবীয় প্রেমের ধারাপাতে অঙ্কিত করা যায় না। যে প্রেমের মধ্যে বারবার বেজে ওঠে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে প্রেমের নামে জীবন বাজি রাখার কথা। মানবিক প্রেম যেন সেদিন মানবের কাছে সতীন হয়ে উঠেছিল, দেশপ্রেমিক মানুষদের প্রেমের আখর জন্মভূমিতে।
কবি এখানে লিখছেন; 'রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,/ তোমার দিকে চোখ ছিল না/ জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিল।' এই মূর্ছনা নিয়েই কিন্তু সেদিন বাঙালি পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। লড়াই করেছিল তাদের সহযোগী যেসব বিশ্বাসঘাতক দেশের মধ্যে অবস্থান করে, দেশের স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করতে চায় তাদের প্রতিও। সেই লড়াইয়ের জায়গা থেকেই কিন্তু হেলাল হাফিজ তাঁর গোটা জীবনের কাব্য সাধনাকে পরিচালিত করেছেন। তাই তিনি বলছেন; ‘আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অঙ্কুরিত/অগ্ন্যুৎসবে/তোমাকে চায় শুধুই তোমায়।'
শামসুরের ভাষায়,' তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা, সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর' এ যেন সেই নদী উতাল করা মাতলব মিঞা আর বার্ধক্যের বিজন দেওয়ায় বসে থাকা থুরথুরে বুড়ির এক অপরূপ মেলবন্ধন। যে মেলবন্ধন আমরা খুঁজে পাই, 'ভাঙছো জেলা, ভাঙছো প্রদেশ, জমি জমা ঘর বাড়ি। ধানের আড়ত কাঠের গোলা, কারখানার রেল গাড়ি তার বেলা'' -সেই দ্যোতনার মধ্যে দিয়ে ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে থাকা লেনিন মূর্তির উদ্দেশ্যে কবি সুভাষের সেই উচ্চারিত পংক্তি। এই উচ্চারণের ভেতর দিয়েই মানুষের লড়াইয়ের কাতারে, শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় চিরদিন উচ্চারিত হবে কবি হেলাল হাফিজের নাম।