গল্প নিয়ে মেলা!

এ যেন অনেকটা সেই তপন সিংহের ছবির মত। আজকের ব্যস্ত জীবনে 'গল্প' ঘিরে মেলা, শীতের রোদ গায়ে মেখে -এ স্বাদ যাঁরা পেয়েছন, তাঁদের তো কথাই নেই। ঘ্রাণে অর্ধ ভোজনের মত এ স্বাদ সবাই প্রাণভরে নেবেন এ আখ্যানে-

 

 

শুরুটা হয়েছিল ঘরোয়া আসরের মত। চন্দননগরের কিছু গল্পকার একসঙ্গে নিজেদের লেখা গল্প নিয়ে আলোচনা করতেন। সেই গল্প আড্ডাই ধীরে ধীরে বদলে গেল গল্পমেলা নামে একটা গল্প সংগঠনে। আশির দশকে একদম শুরুর দিকে  রবিবার করে গল্পপাঠ আর আলোচনার এই সভা চলত। পরে বহু মানুষ আসতে শুরু করায়, ঘরোয়া রবিবারের আড্ডা ছাড়াও মাসের শেষ রবিবার কোনও একটি নির্দিষ্ট বাড়ি বা সভাস্থলে দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি চলত গল্পের এই আসর। গল্পমেলা”  নামটা যাঁর দেওয়া সেই গল্পকার গৌর বৈরাগীর উদ্যোগেই এই সংগঠনের পথ চলা শুরু। তাঁর সঙ্গে সেই সময়ে এক সঙ্গে গল্পমেলাকে গড়ে তুলেছিলেন আশিস ভট্টাচার্য, সৌম্যদেব বসু, অজিত মুখোপাধ্যায়, অমল দাস, শতদ্রু মজুমদার ও আরও অনেক সাহিত্যিক। শুরুর দিকে চন্দননগর, চুঁচুড়া, হুগলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে গল্পমেলা পুরো বাংলার গল্প লেখকদের কাছেই গল্পপাঠ ও আলোচনার অবশ্য গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। 

 

 

 

গল্পমেলায় লেখক গল্প পাঠ করেন, তারপর পঠিত গল্প নিয়ে আলোচনা হয়। অনেকেই বলেন শুনে আলোচনা করা যায় না। পাঠ করলে তবেই আলোচনা সঠিক হয়। এই বিষয়ে মতভেদ থাকলেও, এটাও কিন্ত একটা অনুশীলন। এই সময়ে এটা অবিশ্বাস্য লাগলেও ৪৫ বছর ধরে গল্পমেলার গল্পের আসরে হাজির হয়েছেন বহু গল্পকার ও আলোচক। এই চার দশকে লেখা বাংলা ভাষার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প লেখক প্রকাশ হওয়ার আগেই তাঁর লেখা পাঠ করেছেন গল্পমেলায়, মতামত নিয়েছেন আলোচকদের, পাঠকের। গল্পমেলায় আলোচনা কখনই মুখ দেখে, ওজন দেখে হয় না। একজন সৎ লেখক সব সময়ই চান তাঁর লেখার সঠিক মূল্যায়ন হোক। গল্পমেলা সেই কারণে কিছু মানুষের চক্ষুশূল, আবার বহু লেখকের আবেগ ও ভালোবাসার জায়গা।  

 

 

এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, বাংলার লেখার জগৎ শুরু থেকেই কলকাতামুখী। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রাম থেকে মফস্বল সব লেখককেই একটা সময়ের পর কলকাতায় আসতেই হত বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য। তবে গল্পমেলা যেহেতু কোনও পত্রিকা নয়, আসলে একটা পাঠক লেখকের সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম, চন্দননগরের শিকড় তাকে ছাড়তে হয়নি। 

 

 

১৯৮০ থেকে শুরু, এই আসর যখন তুমুল আগ্রহ তৈরি করল গল্প লেখক আর আলোচকদের মধ্যে এক সময় গল্পমেলার সদস্যরা ঠিক করলেন সারাদিন ধরে একটা গল্প উৎসব করার, তার সঙ্গে বাংলা ছোটগল্পের একজন সমসাময়িক লেখককে পুরস্কৃত করবেন। ১৯৯১ সালে প্রথম শুরু হয় গল্পমেলা পুরস্কার। প্রথম বছর পুরস্কার পান স্বপ্নময় চক্রবর্তী। সেই থেকে প্রতি বছর গল্পমেলা বার্ষিক অনুষ্ঠানে ছোটগল্পের জন্য গল্পমেলা পুরস্কার প্রদান করছে। এই পুরস্কার পেয়েছেন কিন্নর রায়, নলিনী বেরা, অভিজিৎ সেন, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, আনসারউদ্দিন, প্রচেত গুপ্ত, অনিতা অগ্নিহোত্রী, দেবর্ষি সারগি, গৌর কারক, জয়ন্ত দে -সহ বহু গল্পকার।

 

 

এর পাশাপাশি শুরু হল অনাদি পুরস্কারনামে আরও একটি পুরস্কারের। নবীন ছোট গল্পকার ছাড়াও, বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা এবং সংগঠনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এই পুরস্কার পেয়েছেন কোরক এবং মুশায়েরা, পরিকথা, গল্পসরণী, অন্য প্রমা, দুর্বাসা এমন অনেক লিটিল ম্যাগাজিন। অব্যয় লিটারারি সোসাইটি, বলরাম বসাক পেয়েছেন  “মুক্ত গল্পসভা”, কানাই কুন্ডু পেয়েছেন গল্পচক্রর জন্য। অনাদি পুরস্কার চব্বিশ বছর ধরে গল্পমেলার পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে। গল্পমেলা আসলে একটা মুক্ত আসর। এখানে সকল সাহিত্য প্রেমী মানুষের অবারিত দ্বার। আর প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে গল্পমেলার বার্ষিক অধিবেশন আর পুরস্কার নিয়ে একটা আগ্রহ থাকে।

 

 

এই বছরের গল্পমেলার বার্ষিক অধিবেশন হয়ে গেল ৮ ডিসেম্বর চন্দননগরের গঙ্গার ধারের ঐতিহাসিক ডুপ্লে প্যালেসের মিউজিয়ামের বারন্দায়। এই ভবনটি চন্দননগরের অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থান। অসাধারণ একটি মঞ্চ সাজিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। এবারের গল্পমেলার বার্ষিক অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল প্রতিবাদ। এই দিনের অনুষ্ঠানে প্রায় ২০০ জন গল্পপ্রেমী মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। উদ্বোধন করেছিলেন সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় ও কিন্নর রায়। উপস্থিত ছিলেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের নবীন প্রবীণ বহু গল্পকার, আলোচক, প্রকাশক এবং গল্পপ্রেমী শ্রোতা।

 

 

এই বছরের গল্পমেলা পুরস্কার পেলেন গল্পকার তপনকর ভট্টাচার্য। প্রায় চার দশক ধরে মূলত লিটল ম্যাগাজিনে লিখছেন তপনকর। এমন শক্তিশালী গদ্যকারের খোঁজ অনেক পাঠকের কাছেই পৌছায় না। গল্পমেলা এই কাজটা করে। তপনকর ভট্টাচার্যের গল্পের বিষয়ে আলোচনা করেন উপল মুখোপাধ্যায়। অনাদি পুরস্কার পেলেন নবাবী পত্রিকা সম্পাদক জ্যোতি প্রকাশ সাহা। তিরিশ বছর ধরে নিয়মিতভাবে প্রকাশ হওয়া ইছাপুর নবাবগঞ্জের এই পত্রিকায় বহু উল্লেখযোগ্য গল্প, প্রবন্ধ, ধারাবাহিক নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। 

 

 

 

সারাদিনের অনুষ্ঠানে ছিল বিষয় ভিত্তিক তিনটি আলোচনা। আমার প্রতিবাদের ভাষা”    “আখ্যানে লেখকের প্রতিবাদী দায়বদ্ধতাশীর্ষক দুটি আলোচনায় ছিলেন অহনা বিশ্বাস, প্রতিভা সরকার, শ্যামলী আচার্য,কাবেরী চক্রবর্তী, টুপুর ঘোষ। অন্য পর্বে ছিলেন কিন্নর রায়, চিরঞ্জয় চক্রবর্তী, শম্পা চৌধুরী। সঞ্চালনায় ছিলেন পূর্বা দাস, সোনালী জানা। গল্পচর্চা সংগঠনের অতীত ও ভবিষ্যৎশীর্ষক অন্য একটি আলোচনায় এই সময়ের বাংলার সাতটি বিভিন্ন অঞ্চলের গল্পচর্চা সংগঠন ও পত্রিকা প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। আলোচনায় ছিলেন অনুপম মুখোপাধ্যায়, গৌতম অধিকারী, ভবানী ঘটক, তপন রায়চৌধুরী, অরিন্দম গোস্বামী, সায়ন্তনী নাগ, অমিতাভ দাস। সঞ্চালনায় ছিলেন অয়ন ভট্টাচার্য। ছবি থেকে গল্প লেখার রেখায় লেখায়”  নামে একটি অভিনব অণুগল্প প্রতিযোগিতা এই দিন সকাল থেকে হয়। প্রায় চল্লিশজন গল্পকারের লেখা তিনশো শব্দের অণুগল্প থেকে তিনজনকে দিনের শেষে পুরস্কৃত করা হয়। বিচারকদের মধ্যে ছিলেন সুকুমার রুজ, দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়, শতদ্রু মজুমদার, সায়ন্তনী নাগ। গল্পমেলার পক্ষ থেকে সুদেব বসু পুরো প্রতিযোগিতা পরিচালনা করেন। 

 

 

 

গল্পের প্রতিবাদ, প্রতিবাদের গল্প বিষয়ক পাঁচটি প্রবন্ধ আর দশটি গল্প নিয়ে গল্পমেলা বার্ষিক সংকলন ২০২৪ প্রকাশ হয়। পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন শীর্ষেন্দু দত্ত। গল্পকার গৌর বৈরাগীর নতুন গল্পের বই এক চিলতে রোদ্দুরএই দিনই প্রকাশিত হয়। বাংলা তথা বিশ্বে এই প্রথম কোনও বই প্রকাশ হল যেখানে বইয়ের কোনও দাম নেই। উল্টে যে পাঠক কিনবেন তাঁকে লেখক কুড়ি টাকা পাঠ মূল্য দিলেন। গৌর বৈরাগীর মত সাহিত্যিক, এমন অভিনব ব্যাপার কেন করলেন সেই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক থাকতে পারে। তবে বই সব নিমেষে শেষ হয়ে যায়। লেখক চান  তাঁর বই পাঠক পড়ুক, এবং প্রতিক্রিয়া জানান। এটা তাঁরই একটা প্রচেষ্টা। গৌর বৈরাগীর গল্প নিয়ে পাঠক মহলে সব সময়েই একটা আগ্রহ থাকে। এই বইটা নিয়ে এখনও অনেক মানুষ আগ্রহ জানাচ্ছেন। 

 

 

 

গলমেলার অনুষ্ঠান স্থলে বই-পত্রিকার মেলাও বসে। আসেন বিভিন্ন প্রকাশক আর লিটল ম্যাগাজিন। চন্দননগরের নিজস্ব একটা শিল্প সংস্কৃতির ঐতিহ্য আছে, তার মধ্যে গল্পমেলা অনেকদিন আগেই স্থান করে নিয়েছে। যিনি গল্প লেখেন, গল্প পড়তে ভালবাসেন, গল্প নিয়ে চর্চা করেন তাঁকে আসতেই হবে গল্পমেলায়। এই সময়ে যখন জেলায় বই মেলা করেও বাংলা বইয়ের পাঠকের সংখ্যা বাড়ছেই না। নতুন প্রজন্ম প্রায় সম্পূর্ণ মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে বাংলা ভাষা থেকে। সেই সময়ে এমন এক সংগঠন শুধু মাত্র বাংলা ছোটগল্পের স্বার্থে এত বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে এটা সত্যিই খুব বড় কথা।

  • অয়ন ভট্টাচার্য
img
আগের পাতা
কবিতাগুচ্ছ