অশনি ভাদুড়ীর একটি কবিতা
নিঝুমগ্রামে
নিঝুমগ্রামে বৃষ্টি নামে ছপছপিয়ে
পাথুরেপথে কে যেন ভেজে চপচপিয়ে
মাটিরখাঁজে গন্ধ ওঠে সোঁদা সোঁদা
ছুকছুক রেল উড়ে বেড়ায় টুং সোনাদা
ঘাসগালিচায় রডোডেনড্রন ছোপা ছোপা
পাহাড়িচাঁপার গন্ধ গাঁথে আলগা খোঁপা
আরামবাড়ি রাতের পরে কুয়াশা ঢাকা
কালপুরুষের তলোয়ার তাও যায় যে দেখা
লেপচামঠে ঘন্টা বাজে ঢং ঢং ঢং
কুয়াশাকাটে ভোরের আলোয় লালসোনারঙ
চুমুক চায়ে, বেতেরমোড়ায়, আরশে পিঠে
আকাশবাণী, শিবরঞ্জনী, সুরটি মিঠে
চুপড়িপিঠে চার রমণী চা-বাগানে
ধাপে ধাপে পাহাড় ডিঙ্গোয় আপনমনে
হাল্কাহাওয়া গাছের ফাঁকে সরসর বয়
হলুদসোনা গিংকোপাতা বনমাটিময়
গোলাপিআভা অর্কিডের পিছুটানে
বেগুনিরঙা ভীমরুল ঘোরে কী গুঞ্জনে
নিঝুমগ্রামে আধবচ্ছর বৃষ্টি নামে
শহুরেপ্রাণী ঘরপাড়ি দেয় ক্রমে ক্রমে
ঝিঁঝিঁপোকার অবিরত গান ঝিমিয়ে পড়ে
শিশিরফোঁটা শেষবৃষ্টি জড়িয়ে ধরে
নিঝুমগ্রামে হেমন্ত শীত কাঁপিয়ে আসে
বসন্তঋতু মাখোমাখো কার সুবাসে?
------------------------------------------------
ফিরোজ অনীকের তিনটি কবিতা
১. শূন্যতা বনাম দম্ভ
মনের ভেতর জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালবাসা
ঊজাড় করে দিয়ে এখন শূন্য, শুধুই শূন্য!
তুমি উপহাস করছো? আমার ভালোবাসায় সন্দেহ!
আমি তো নেই ।
আমি তো কোনো দিনও ছিলাম না,
আমার বিছানা,বালিশ,লেপ কম্বল —সবটাই সাজানো,ভাড়া করা
সেসব ভাড়া করা দিন কবেই শেষ হয়েছে
দাম্ভিক রাজার মৃত্যুর পর যেমন করে তারা আত্মা ঘুরে বেড়ায় ,তেমনি করে আমিও ছায়ার মতো বেঁচে আছি।
এখন এই শূন্যতার ছায়াবাজি তুমিই বাঁচিয়ে রেখেছো, তোমার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার পুতুল করে
মনে রেখো , মহাশূন্য একদিন এই পৃথিবীর জন্ম দিয়েছিল, লক্ষ লক্ষ তারকা ,গ্রহ ,গ্যালাক্সি এমনকি—
তোমার আমার মূল্যবান প্রানটুকুর জন্মদাতা এই 'শূন্য' —
কাজেই শূন্যতাকে সম্মান করো
অনুভব করো হৃদয় দিয়ে ,
যেমন করে শীতের রাতের শেষে সমস্ত যন্ত্রণাকে উজাড় করে ঘাসের ডগায় হীরকের মতো শিশির জন্ম হয়,
তেমনি করে—
আমার প্রেম তোমাকে ছুঁতে পারেনি,
তাই আমি কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে গেছি,
রয়ে গেছে শুধুই অস্তিত্বের ভানটুকু
ক্ষমতার দম্ভ সবসময় হীনকে ক্ষীন করেই দেখায় ,
কিন্তু ,সেই ক্ষমতাও তো একদিন শুন্যে বিলীন হয়ে যায়
যেমন করে আমি শূন্য হয়ে গেছি,
তবু তুমি ছায়া যুদ্ধ করছো—
এ যুদ্ধ কি আত্ম প্রতারণা নয়?
কতকাল তুমি আমার মৃত কঙ্কালের উপর দাঁড়িয়ে তাণ্ডব করবে?
গণজন হাততালি দেবে আর তুমি আস্ফালন করবে?
ভাঙা কলসির বাজনা বেশি হয় , তবে তার ক্ষয় ও লয় কখনোই দীর্ঘ হয় না; দীর্ঘ হলেও ক্ষতি নেই
কতশত বীর যোদ্ধা রাজা মহারাজ কালের স্রোতে মহাকাল হারিয়ে গেছে , তারা এখন শুধুই সংখ্যা
শূন্যও তো একটা সংখ্যা, একটা অংক —সে অংকটা তুমি ভালো করে শিখে নাও , কারণ ঘুটের দিন তো শেষ হয়ে গেছে, এরপর গোবরের পালা —
আত্মপ্রসাদের মিষ্টত্ব থাকতে থাকতেই
পাটিগণিতের অংকটা ভালো করে বুঝে নাও
.......................
২. উনুনের সুখ
পাংসুটে মুখ
উনুনের সুখ
অনন্ত অসুখ
গায়ে মেখে চিরকাল
কেটে যাবে যে কাল
থাক দূরে থাক
আদুরে আলাপ
মিষ্টি সে ডাক
পিছে পড়ে থাক
যত সুর মোহ দূরে যাক
চোখমুখ লাল
গোধূলির কাল
দিন বে সামাল
চলে যায় অবহেলে
অকারণ জ্বলে জ্বলে
তোর মনে মেঘ
কত যে আবেগ
বেড়ে যায় উদ্বেগ
কান্নার বেগ ধেয়ে আসে
উড়ু উড়ু মন কাঁপে হতাশে।।
...............................
৩ . রক্ত করবীর বিলাপ
তুমি যাবে কত দূর?
চলে যেও
দেবো না বাধা
মনে রেখো হৃদয় থেকে দূরে—
মানে আলোকবর্ষ ছাড়িয়ে যাওয়া
নক্ষত্র পতনের মতো নীরব মৃত্যু
চলে যেও সবুজ পেরিয়ে সোনার পাহাড়ে
ভুলে যেও নদীর কলকল শব্দ
রেখো না মনে হৃদস্পন্দনের দিনগুলি
মায়াবী চোখে মওমও শরীরী গন্ধে মাখা অভিকর্ষ
ভুলে যেও —সব আকুতির শেষ বিন্দু
চশমাহীন বৃদ্ধের ঝুলন্ত গালের মতো অসহায়ত্ব
কখনো চিলে নিয়ে যায় না,
নিয়ে যায় তুলতুলে নরম মাংস
এসব আবহমান দিনলিপি—
খরচের খাতায় কেবল জমা হয়
মনে রাখার দায় শুধু
কৃষ্ণচূড়া শিমুল পলাশ রক্তকরবীর
তুমি এসব মনে রেখো না
তুমি যাবে কতদূর?
চলে যেও
পিছু ফিরে চেয়োনা অনন্ত জলরাশির দিকে
---------------------------------------
শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি কবিতা
প্রতিকৃতির ভয়ার্ত চিৎকার
আগুনে ঝলসে ওঠা প্রতিকৃতির ভয়ার্ত চিৎকার
দুয়ারে তুলে দেয় ছিকল
পাহাড়কে বুকে দুমড়ে মুচড়ে শীর্ষ দেশে উঠি
আত্মজের নীরব অভিমানে তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমে
ছাতিম তলায় বসে পাগলা দাশু
কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেয় জীবনের স্রোতে
গল্প ও অর্থহীন হাসি
এক আলোকবর্ষ ধরে চলে নিম গাছের বুকে খনন মূল্যবান খনিজ পদার্থের সন্ধানে
নিরবচ্ছিন্ন গানের তালকাটে সঙ্গতের কারণে
আধখানা চাঁদ কোন নারীর এলো চুলে মুখ ঢাকে
শব্দের মোহজালে নিমেষে জড়িয়ে ফেলি রোজ
জলের গহ্বরে মৃত্যু মিছিল খেলা করতে থাকে
পৌরাণিক নগরের প্রান্তরে!
-----------------------------------------------------------------
আত্মসমর্পণ
নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ শেষে উথাল পাথাল
ঢেউ স্তিমিত হয়ে ওঠে
গাছের কোটরে বিচ্ছুরিত আলোয় অলৌকিক
সৌন্দর্যায়ন
নিঃস্বতার অন্ধকারে ভেসে যায় প্রাগৈতিহাসিক
স্তব স্তুতি গভীর অরণ্যে
নির্নিয়মান দুঃখ এলোমেলো বাতাসে ওড়ে
কোন কিছু বোঝার আগে নৌকা ডুবে যায়
নদীর দোয়ায়
দু’চোখে ভোর নেমে আসে পাখির ঝাপটে
গরুর খুরের শব্দে হাহাকার
আমি খরোষ্ঠী লিপি উদ্ধার করতে থাকি
কোন পাহাড়ের গুহায়, প্রখর রোদ্দুরে ফাটা
রোয়ানো ধানের জমিতে
মুখের খাঁজে খাঁজে পাহাড়ি রাস্তা জুড়ে
শাল, সেগুন, মেহগনির সারি
উপত্যকা ই যেন লাস্যময়ী কোনও নারী
------------------------------------------------------------
অন্য গ্রহের খোঁজে
গল্পের ভেতর চড়ুই পাখির আনাগোনা
পশ্চিমি বাতাস নিয়ে গ্যাছে চন্দন কাঠের বোতাম, মাটির ভাঁড়, ধূতি এবং ফতুয়া
তবু নীল মেঘে কোন নারীর চোখ ভাসে
অন্ধকারের মধ্যে বুকে জ্বলে ওঠে আলো
গাছের ভেতর পিতৃপুরুষেরা চোখ ঠিকরে পড়ে
উষ্ণ চুম্বনে মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে
এ ভাবেই নিজের ভেতর নিজেকে পুড়িয়ে ফেলি
মদে রুটি চুবিয়ে খেতে খেতে অনায়াসে খিস্তি
হিন্দি গানের দু একটি কলি বাতাস কাঁপিয়ে দেয়
যেভাবে বুড়ি মাসি পয়সার জন্য কড়া নাড়ে
যেভাবে বন্ধু বদলে গিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে
যেভাবে মানুষ মানুষের কষ্ট বোঝেনা কোন দিন
আমি ও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিই
কোন অন্য গ্রহের খোঁজে অন্য সৌর মন্ডলে
----------------------------------------------------------
সেই মানুষটি
দিক বিদিক জ্ঞান শূন্য অন্ধকারে
দৌড়ে চলেছে
সেই মানুষ টিকে দাঁড় করিয়ে দুটো কথা
বলতে চেয়েছি
কোন কথা না বলে ইশারায়
কখনো বৃষ্টির মধ্যে রোদ্দুর
কখনো ভোরের মধ্যে সকাল
কখনো হাসির মধ্যে অশ্রু
ওহে দাঁড়াও, দুটো কথা বলব
কোন কথা না শুনে আরো দ্রুত গতিতে
দৌড়ে চলেছে
সেই মানুষ টির মুখ অন্ধকারে
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে
কখনো চোখ পাল্টে যাচ্ছে
কখনো ঠোঁটের কোনে হিংস্রতা
কখনো নির্লিপ্ত চিবুক
সেই একই ভাবে দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য
অন্ধকারে দৌড়ে চলেছে