স্বদেশ সেদেশ

বাংলাদেশ যাওয়ার দু’বছরের মধ্যেই আমাকে আবার ঢাকা যেতে হয়৷ সূত্র ওই থিয়েটারই৷ তখন আমি সুন্দরম নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে অভিনয় করি৷ ঢাকা থেকে সুন্দরম এবার দুটি নাট্যাভিনয়ের বরাত পেল৷ মনোজ মিত্রের অলকানন্দার পুত্রকন্যা এবং ছায়ার প্রাসাদ৷ এত দ্রুত সুন্দরমকে দু’বার আমন্ত্রণের কারণ সম্ভবত ওদেশে নাট্যকার মনোজ মিত্রের  বিপুল জনপ্রিয়তা এবং অধ্যাপক মনোজ মিত্রের একরাশ ছাত্রের বাস৷ এই সব ছাত্র যেহেতু নাটকের সেহেতু বাংলাদেশের কোনও না কোনও নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এঁরা চেয়েছিলেন  প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের নাটক বারবার অভিনীত হোক৷ বাংলাদেশের নাট্যছাত্রদের এই একটা বিষয়কে খুব শ্রদ্ধা করি আমি৷ নাটক  নিয়ে পড়াশুনো শেষ করার পর এঁরা নাট্যচর্চা ভোলেন না৷ কোনও না কোনওভাবে  দেশের চলতে থাকা নাট্য-সংস্কৃতির  সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখেন৷ বিশ শতকের শেষ ও  একবিংশ শতকের গোড়াতেই লক্ষ্য করেছিলাম, সিনেমা বা সিরিয়ালের থেকে নাট্যছাত্ররা গুরুত্ব দেন নাটক করা,  নাটক লেখা  এবং নাটকের বিষয় নিয়ে একটি বই লেখায়৷ কলকাতার ছাত্রদের  নাটকে এই নিষ্ঠা আজও দেখিনি৷ 

 

 

তবে ঢাকায় পৌঁছোবার পর থেকেই দেখলাম সেখানকার ছাত্র ও নাট্যগোষ্ঠীগুলো নাট্যকার মনোজ মিত্রকে কেন্দ্র করেই আলাপ আলোচনাগুলো করতে লাগলেন৷ বলা বাহুল্য, এইসব আলোচনায় আমরাও সমৃদ্ধ হলাম৷ কারণ ততক্ষণে নাট্যকার নিজের দেশে পৌঁছে মন মেলে দিয়েছেন৷ অনর্গল তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হতে লাগল  সাতক্ষীরা জেলায়  তাঁর গ্রাম ধূলিহরে ছোটোবেলার নাটক করার কথা৷ ভাল লাগলেও একটি বিষয় তীরের মতো বিঁধছিল৷ এঁরা কেউই দলের অন্য সদস্যের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না৷ না-কোনওরকম অযত্ন তাঁরা করছিলেন না৷ কেবল গ্রূপ থিয়েটার যে সমষ্টির শ্রম ও মেধার নিট ফল ,এটা তাঁদের আচরণে স্পষ্ট হচ্ছিল না৷ হয়ত মেকআপ রুমে মনোজ মিত্র কোনও সাধারণ কথা বলছেন আর দলের মঞ্চপরিকল্পক দীপক দাস সেটের জন্য কাঠের টুকরো বা পিঁড়ি চাইছেন -এঁরা কিন্তু  সেটের ব্যাপারে তেমন খেয়াল করছেন  না৷ যত সময় ধরে মনোজবাবু কথা বলছেন তত সময় দীপকবাবু কাঠের টুকরোর জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন৷ থিয়েটারে  এই  সেলিব্রিটি ওরিয়েন্টেশন তখনই  ঢাকার থিয়েটারে দেখেছি৷ 

 

 

একমাত্র ব্যতিক্রম বাবলু এবং বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ অভিনেত্রী লাকি ইনাম৷ বাবলুর একটি মুসলিম নামও ছিল -ও দেশের সব মুসলিমের যেমন একটি বাংলা নাম ও একটি মুসলিম নাম থাকে৷ কিন্তু সে নাম তাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন অনুভব করিনি৷ তাঁকে সবার মতো "বাবলু ভাই বাবলু ভাই" বলে হাঁকডাকও করিনি৷ সে তার ভালোবাসায় আজও আমার অন্তরে কেবল বাবলু হয়েই আছে৷

 

 

ঢাকায় অলকানন্দার পুত্রকন্যা বিপুল জয় পেল৷ এ নাটকের ছত্রে ছত্রে উদার মানবতাবাদ৷ সঙ্গে উর্ম্মিমালা বসু (Urmimala Bose ), মনোজ মিত্র এবং সুন্দরমের প্রতি অভিনেতার সমান দুর্দান্ত অভিনয়৷ নাটক সর্ব অর্থে সবার কাছে পৌঁছলো! নাটকের মূলে অলকানন্দার মাতৃত্ব৷ "মা" এর ভাবনা হয়ত মানুষের ধর্মভেদ লোপ করে  বা ধর্মবোধকে পূর্ণ করে দেয়৷ আমি অভিনয় করছিলাম ছায়ার প্রাসাদ নাটকে৷ সেটা ছিল দ্বিতীয় দিন৷ লাকি ইনাম নাটক শেষে মঞ্চে এসে আমার হাত ধরলেন৷ তাঁর চোখে ভর্তি হয়েছিল আপনবোধ৷ আমি থ হয়ে দেখলাম তাঁর কোঁকড়া চুল! বাপ রে! এত কোঁকড়া চুল আমাদের কলকাতার অভিনেত্রীদের নেই –এই জাতীয় কথা বলেছিলাম বোধহয়৷ হাসতে হাসতে অভিনেত্রীসুলভ যাবতীয় গ্ল্যামারের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে লাকি দিদি বললেন -ধুর পাগল! আমি দোকান থেকে চুলটা এমন করে এনেছি! চুলটা খুব বিশ্রী হয়েছিল গো৷ আমার কাছে  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির থেকে আপনতা বোধের গুরুত্ব অনেক বেশি৷ বুঝে পাই না, যে প্রীতিতে অহরহ সম্প্রদায় ঘুরে বেড়ায়, সে প্রীতি যাবে কতদূর!  আমার নিজের কাছে নিজের ধারণারও দেশে প্রথম যাঁর কাছে পরিষ্কার হল তিনি লাকি ইনাম৷

 


পরের দুপুরে  লাকি ইনামের বাড়ি নেমন্তন্ন৷ আগেরদিনই তাঁকে বলে রেখেছিলাম -দিদি আমি আপনাদের রসুন পিঁয়াজের ইলিশ খেতে পারছি না৷ দিদি বললেন -আচ্ছা সর্ষেবাটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে করব৷ মা আমাকে দু’রকমই শিখিয়েছিলেন৷ কিন্ত ব্যাস! আর কিচ্ছু খাবে না? আমি তখন আরও অকপট  - বিফ খাব দিদি৷ মুসলমানদের টিপিক্যাল রান্না তাঁদের রেসিপিতেই খেতে ভাল লাগে৷  তাহলে ...কাবাব -উল্টোদিক থেকে উত্তর এল। বুঝলাম, এ মানুষ কোনওদিন কপট হতে পারবেন না৷

 

 

পরের দিন খেতে বসেছি৷ অবিকল আমাদের মতো করে ইলিশ ভাপা রেঁধেছেন অভিনেত্রী৷ পদ্মা ইলিশের সুগন্ধ ঘরদুয়োর ম ম৷ অচিরেই বিফের কাবাবে আকর্ষণ হারালাম৷ ইলিশে বরাবর মাথাখারাপ হয়ে যায় আমার৷ তার ওপর পদ্মার ইলিশ ...আমার স্বপ্নের ইলিশ৷ ফলে  একটা কাবাবের অর্ধেক খেয়ে কেন জানি আর ইচ্ছেই করল না৷ সর্ষে-বাটা খাওয়ার পর এটা আর খেতে পারছি না দিদি৷ ভীষণ গা গুলোচ্ছে! সবাই তাকাচ্ছেন আমার দিকে৷

 

 

লাকী দিদি বললেন -গা গুলোলে একদম খেও না৷ তোমার অভ্যেস নেই তো৷ জোর করে খেও না কেমন৷ শরীর কিন্তু খারাপ করবে৷ সুন্দরমের বন্ধুরা বললেন -নিজেই খেতে চেয়ে এখন খাচ্ছিস না৷ কী বাজে ব্যাপার হলো বল তো! দিদি তখন রান্নাঘরে৷ পায়েস তুলছেন সবার বাটিতে৷ পিছনে দাঁড়িয়ে আছি বুঝতে পারলেন৷ কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন -

 

 

গা গুলোচ্ছে আর? ভাল পানমসলা আছে৷ খাবে? আমি আস্তে করে বললাম -দিদি আমি খুব সরি। অপরাধবোধ তখন এত বেড়ে গেছে, সরি বলে ছুটে পালিয়ে আসছিলাম। একটা হাত কাঁধে থামল -দাঁড়াও৷ সরি বললে কেন? -আপনি এত কষ্ট করে রাঁধলেন আমার কথায়... লাকি ইনাম কিছু ভাবছিলেন চুপ করে৷ হঠাৎ বললেন -ওহ! তোমার পায়েস দিতে ভুলেছি৷ এই নাও খাও। আমি ভীষণ চেঁচিয়ে মেচিয়ে বললাম- না না দিদি অসম্ভব৷ একফোঁটাও। পায়েস আর ঢুকবে না৷ তিনটে ওই সাইজের ইলিশ৷ এবার বমি হয়ে যাবে কিন্তু! লাকি ইনাম মৃদু  মৃদু হাসছেন আর দুলছেন - কই এবার সরি কই? এবার বলছ না চোদ্দবার সরি। 

 

 

নিমেষে  মুখ আমার  তাঁর বুকে... ভিন ধর্মের মানুষের প্রতি  নিরপেক্ষ থাকার এতবড় শিক্ষা জীবনে খুব কম পেয়েছি৷ বাড়তি "সরি" র কৃত্রিমতা বা নিজেকে মুসলমানের প্রিয়জন করে তোলার এই  অতি চেষ্টা  যিনি  বুঝতে পারেন তিনি তো জাত শিল্পী৷ সে দুপুরে লাকি দিদিকে আপা ডাকা ছাড়লাম৷

  • ময়ূরী মিত্র
  • দ্বিতীয়