রৌদ্রময়ের ছিন্ন শির

আসল কাহিনি ও নকল গল্পের সূত্রপাত

উধাউ ঘুমিয়ে পড়েছিল। ড্রাইভারের কর্কশ চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল। ড্রাইভার ছেলেটি তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। ‘তুমি কী গো? কোথায় যাবে বলছ না, এই এখানে, এই এখানে করে তো চলে এলে, এবার আমি লঞ্চঘাটে পরে আর যাব না, সাফ কথা বলে দিলাম।’

 

 

উধাউ ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল, সে হাই তুলতে তুলতে জানলার বাইরে তাকাল। দু’পাশে অনন্ত সবুজ। তারপর গাছ দিয়ে দিয়ে গাছের পাঁচলি তোলা। হাওয়ায় কাঁচা গন্ধ। তার শুকনো ঠোঁট, যেন জিব বের করে বাতাসে রাখলে সবুজ স্বাদ পাওয়া যাবে।

‘কী হল, কোথায় নামবে?’

উধাউ বলল, ‘এতখানি রাস্তায় এলাম, একটা জায়গার নাম মনে ধরল না, যে নামব। ঠিক আছে, আমি ওপারে যাবে?’

‘কী করে যাবে? আমার গাড়ি জলে চড়তে পারে না?’ ড্রাইভার একটু ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা রসিকতার সুরে কথাটা বলল। এমন জল-মাটি-হাওয়া রস থাকবে না তা তো হয় না।

‘তা বটে। তাহলে আর কোথায় যাবে! আমাকে লঞ্চঘাটেই নামিয়ে দিও।’

‘কোন ঘাটে নামবে বলো? নইলে আমি সোজা বেরিয়ে যাব।’

‘এই যে তুমি বললে, তোমার গাড়ি আর যাবে না। এখন বলছ সোজা বেরিয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা, ফ্যাসাদে পড়েছি তো। সোজা মানে কি নাক বরাবর সোজাই চলে যাব। সোজা গিয়ে আমি গাড়ি রেখে বিষ্টুর হোটেলে উঠব। কাল ভোর আবার পানিহাটী যাব।’

উধাউ বলল, ‘তাহলে আমাকে একটা ভালো দেখে লঞ্চঘাটে নামিয়ে দিও।’

তখন এপাশের জানলার ধার থেকে একটা মেয়ে কথা বলে উঠল, ‘তুমি কোথায় যাবে, জায়গার নাম জানো না।’

উধাউ বলল, ‘আরে কী করে জানব? আমি আগে এদিকে কোনওদিন এসেছি নাকি।’

‘তবে এদিকে এলে কেন?’ মেয়েটা খট করে কথাটা ছুঁড়ে দিল।

‘ট্রেন থেকে দেখলাম স্টেশনের নামটা বেশ সুন্দর। পানিহাটী। মনে ধরে গেল, তাই নেমে পড়লাম। তারপর অনেকেই দেখলাম পটাপটা ট্রেকারে উঠে পড়ছে, আমিও উঠে পড়লাম।’

‘সর্বনাশ!’ ড্রাইভার আঁতকে উঠল। ‘নাম দেখে পছন্দ হতেই এতদূর চলে এলে! কী জিনিস তুমি গুরু!’

‘অ্যাই, ভদ্রভাবে কথা বলো, গুরু টুরু কী!’ মেয়েটা আবার ঝঙ্কার দিল।

‘আরে গুরু বলেছি, গরু টরু বলেছি নাকি! না জেনে, না বুঝে যে এত দূর গাঁটের পয়সা খরচ করে চলে এল সে জিনিস না!’

মেয়েটা সর্তক গলায় উধাউকে বলল, ‘তুমি কি ইউটিউবার? নতুন নতুন জায়গার ছবি তুলে ইউটিউবে লোড করো?’

উধাউ একগলা হেসে বলল, ‘ঠিক ধরেছ তো, তোমার মাথায় খুব বুদ্ধি তো—!’

মেয়েটা হাসল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মুখটা গম্ভীর করে বলল, ‘জানি, ওরা সব এমন কীর্তি করে।’

‘কীর্তি! হ্যাঁ, তা বলতে পারো, আমরা সব কীর্তিমান!’

 

 

ড্রাইভার ক্যাঁচ করে গাড়িটা রাস্তার এক ধারে ব্রেক করল। তারপর দু’হাত কানে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গীতে বলল, ‘সরি ভাই। কিছু মনে করো না। আমি বুঝিনি, তুমি বলবে তো আমি ইউটিউবার-চ্যানেলের লোক। তাহলে কি তোমাকে এমন গোরু খেদানো খেদাতাম? বরং দেখিয়ে আনতাম— কত ভাল ভাল স্থান— হেব্বি হেব্বি সব জায়গা। কত রকম খাবার—’

মেয়েটা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘গোরু খেদানো করা এইসব ট্রেকারওয়ালাদের রোজকার অভ্যাস। এরা জামাই আদর করে ডাকবে হুমম! তারপর গোরু-ছাগলের মতো ঠেসে ঠেসে মানুষগুলোকে গাড়িতে ঢোকাবে, তারপর ইচ্ছেমতো চালাবে। খানাখন্দ মানবে না। একজন নামলে দাঁড়িয়ে থাকবে প্যাসেঞ্জারের জন্য। এখন ইউটিউবারের চ্যানেল দেখে কেমন গিরগিটির মতো রং বদলাচ্ছে। ভাল ভাল স্থান, হেব্বি হেব্বি জায়গা, কত রকম খাবার—কচু পোড়া!’

ড্রাইভার গুটকা ভরা থুতু রাস্তার ধারে ফেলে, জিব বের করল, তারপর এক গাল হেসে বলল, ‘বোন নিজের বাড়ির, নিজের ফ্যামেলি, নিজের জায়গার বদনাম করতে আছে!’ তারপর নিচু গলায় বলল, ‘এইসব ইউটিউবাররা, চ্যানেলের লোকজনরা গম পেলে এমন ভাঙা ভাঙে দেবে, শুধু আটা নয়, ময়দা নয়, রুটি লুচি হয়ে বেরিয়ে যাবে, জানত। তাই বলি বোন বদনাম করো না। মিষ্টি সোনা আমার!’  

‘হুমম! করলে তো সব ফাঁস হয়ে যাবে।’ মেয়েটা তাচ্ছিলের আওয়াজ দিল। একরাশ আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘কী নাম তোমার চ্যানেলের?’

 

 

উধাউ হালকা হাসল, বলল, ‘এখন কী করে বলি! আমি ক্রিয়েটিভ করি। এক একটা লোকেশন খুঁজে বের করি। গুণাগুণ নোট করি, তারপর চ্যানেলে চ্যানেলে সাবজেক্ট বিক্রি করি।’

‘সাবজেক্ট মানে?’ ড্রাইভার ছেলেটা বলল।

‘সাবজেক্ট মানে নতুন নতুন জায়গা। সেই সব জায়গার স্থান মাহাত্ম্য।’

মেয়েটা বলল, ‘তাহলে তোমার চ্যানেল—?’

‘আমার চ্যানেল একটা নয়, অগুন্তি, অফুরান। সবই আমার চ্যানেল। তাই আমি নির্দিষ্টভাবে কারও নাম করব না।’ উধাউ চোখ বন্ধ করে বলল।

‘ঠিক ঠিক, একটা চ্যানেলের নাম করলে, অন্য চ্যানেল রাগ করবে। বুঝেছি।’ ড্রাইভার বেশ বিজ্ঞ গলায় সায় দিল। বলল, ‘একেই বলে প্রফেশনাল। সবার কাছে সমান। কেউ আপন, কেউ পর নয়। আমি ভাই তেমন করি। সবাই প্যাসেঞ্জার। কেউ আপন, কেউ পর নয়।’

মেয়েটা এবার চিৎকার করে উঠল, ‘তোমরাও মনে রাখবে, প্যাসেঞ্জাররা মানুষ। সবাই সমান? তোমার ঘরের লোকের মতোই তারা মানুষ, তাদের স্বস্তিতে নিয়ে যেতে হয়। তারা ভাড়া দিয়ে যায়।’

‘কেন আমি কি খারাপ নিয়ে যাচ্ছি, ও ভাই তুমি বলো?’ ড্রাইভার ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখে বলল।

‘এখন ঠিক আছে, কিন্তু আগে? স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারপর কী করছিলে? গাড়িতে জায়গা নেই, তবু লোক ডাকছিলে না?’

‘সবাইকে নিয়ে যেতে হবে তো? কাউকে অবচ্ছেদ্দা করে তো আর ফেলে রেখে যেতে পারি না। বদনাম হয়ে যাবে।’ ড্রাইভার বিগলিত গলায় বলল।

‘বলব, তোমাদের সব কথা। তোমরা মনদুয়ারির লোকদের নিতে চাও না, বলব?’

‘আঃ আবার নিজের দেশের লোকের বদনাম করছে।’ ড্রাইভার চাপা গলায় কথা চেপে দিল।

মেয়েটা বলল, ‘সেই তোমাদের নামে আর কত বলব? কয়লার কালি কি ধুলে যাবে। তার থেকে অন্য কথা বলাই ভালো।’ মেয়েটা একটু ছড়িয়ে বসে, বলে, ‘আমার নাম অপ্সরা।’

 

 

ড্রাইভার বলল, ‘কী?’

‘আরে কাকা তুমি মন দিয়ে গাড়ি চালাও তো— এদিকে কান দাও কেন?’ মেয়েটা ধমক দিল।

‘অপ্সরা! অপ্সরারা স্বর্গে থাকে! ওই জঙ্গলে কোনও অপ্সরা যে থাকে সেটা প্রথম জানলাম।’ ড্রাইভার বলল।

‘জানতে না— জেনে গেল।’ মেয়েটা গলা তুলে বলল।

‘অপ্সরারা সুন্দরী হয়, তবে তোমাকে দেখিনি ঠিক করে—।’ ড্রাইভার ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল।

‘দেখবে কী করে? তুমি তো অন্ধ কানাই!’

উধাউ বলল, ‘না না, কে বলল, তুমি তো বেশ সুন্দর। আর সুন্দর কি শুধু দেখতে হয়!’

মেয়েটা বলল, ‘দেখলে তো কে ঘরের মানুষদের নিন্দা করে। আর শোনো আমি কিন্তু মনদুয়ারির মঞ্জিলবাড়ির ছোট তরফের মেয়ে। একটা বাজে কথা বললে, দাদাদের খবর দেব। ওরা ছাড়বে না। নদী পেরিয়ে এসে তোমার ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব।’

‘মঞ্জিলবাড়ি! অ! নামে তালপুকুর ঘটি ডোবে না। ওরা নদী পেরিয়ে বারদুয়ারিতে এসে হাঙ্গামা করবে— মাথামোটার দল। খালি মারধর জানে!’

উধাউ বলল, ‘মনদুয়ারি-বারদুয়ারি কী?’

‘এই নদীর এপার হল বারদুয়ারি।’ ড্রাইভার বলল। ‘যেদিকে খুশি চলে যাওয়া যায়— বারোটা পথ আছে—।’

‘আর ওপার হল মনদুয়ারি। মনের দুয়ার খুলে আপন করে।’ অপ্সরা বলল।

‘বারদুয়ারি— গুড লোকেশন! কী নেই! হাট­-বাজার, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, খানা-পিনা, সব, সব মিলবে।’ ড্রাইভার বলল।

‘লটারি, গুটকা, মদের ভাঁটি, জুয়ার আড্ডা, চোর চিটিংবাজ, রাজনীতি ধান্দাবাজ— সব সব মিলবে।’ অপ্সরা বলল।

‘এটা গঞ্জ, এখানে লঞ্চঘাট, এখান থেকে স্টেশান, এখান গাড়ি পাবে— হাসপাতাল, থানা—।’ ড্রাইভার বলল।

‘সব আছে শুধু মানুষ নেই।’ অপ্সরা চাপা গলায় বলল, ‘সব অমানুষ!’

‘মনদুয়ারি জঙ্গল। মানুষগুলো জঙ্গলি!’

‘মনদুয়ারি অনেক অনেক সুন্দর। মানুষগুলো মানুষের মতো। ওদিকে এমন বজ্জাত ট্রেকার ড্রাইভারের দল নেই।

‘ওদিকে সব রিকশা আর ভ্যান— খালি প্যাঁ পোঁ শুনবে।’ ড্রাইভার বলল।

‘ওরা গায়ের ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে মানুষ মারে না।’

‘গাড়ি চললে ও একটু আধটু অমন হয়।’ ড্রাইভার বেশ তেরিয়া গলায় জবাব দিল।

  • জয়ন্ত দে
  • প্রথম
img
আগের পাতা
প্রজাপতি