দেবজ্যোতি কর্মকারের চারটি কবিতা
------------------------------------------------------
যজ্ঞবেদি
আমাকে শূন্য করে দিয়ে চলে গেল যে আগুন—
আমি, তার যজ্ঞবেদি ছুঁয়ে ব'সে আছি!
দু'হাতে নিভিয়ে— জ্বলন্ত রাত
তারপর,
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েছি!
শরীরজুড়ে প্রবাহিত বৃষ্টিকণা
একে একে উড়ে গেল পোষা ছয়টি পাখি!
আমাকে শূন্য করে দিয়ে চলে গেছে যে দহন
আমি তার নিস্তব্ধ পথে
খুলে দিলাম সমস্ত বাঁধন!
————--------------
বৈঠা
প্লাবনের মতো রাত্রি নামে দু’চোখে।
এসো,
এই প্রস্তর খণ্ডে—
নির্বাক ছুঁয়ে থাকি দীর্ঘরাত।
কতটা ব্যাকুল হয়েছি—
আশ্রয় হারিয়ে ভেসে যাই কোন সুদূর!
এসো,
স্বরলিপি ছুঁয়ে দ্যাখো—
এখনও কতটা আগুন বেঁচে আছে!
————-------------
কৃষ্ণসুর
আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আস্ত একটা চাঁদ
অথচ, আমরা ভেতরে আঁকছি শূন্যতা!
বাইরে এসে দ্যাখো,
আমাদের অপেক্ষায় সমস্ত আকাশটা
কী ভাবে পায়চারি করছে মেঘের ভেতর!
এই যে, মাটিতে খুঁজছি নিজস্ব দেশ
একদিন সব হারিয়ে যাবে কোথায়!
চলো, অনেকটা দূরে রেখে আসি আক্ষেপ
দু'জনেই জড়িয়ে নিই নির্জন কোনও গান
আরও একটা দিন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে
আমাদের কথাগুলো কৃষ্ণসুর হয়ে উঠুক আবার!
————-----------------
উদযাপন
মনে পড়ে, একদিন খাঁখাঁ রৌদ্রের ভেতর
দু'জনেই, একটু ছায়া খুঁজতে বেরিয়েছি!
তারপর,
গাঢ় সন্ধ্যায় বুকে মুখ গুঁজে গন্ধটুকু নিয়েছি
আমার বুকে মাথা রেখে, চোখে চোখ রেখে
কতবার বলেছ— ‘তুমিই আমার সর্বশেষ ছায়া!’
এক এক দিন
সূর্যটা খাঁখাঁ হয়ে যায়—
দুপুরবেলা মাঠ পেরিয়ে যাই।
কোত্থাও একটু গাছের ছায়া খুঁজে পাই না!
সন্ধে নামে,
বুকের খুব কাছে এসে কেউ
ফিসফিসিয়ে বলে— ‘আজও আমার কোনও ছায়া নেই!’
আমি
আমাদের প্রথম হাতে হাত রাখা দিনে
ফাঁকা মাঠে
একটা একটা করে গাছ লাগিয়ে আসি!
————-----------------------
অর্কপ্রভ ভট্টাচার্যের চারটি কবিতা-
কবিদের উদ্দেশ্যে
দেশের বেকারত্বের জন্য প্রত্যেকটা কবি দায়ী,
প্রতিটি আত্মহত্যার পিছনে অন্তত একজন কবি জড়িত
আমরা জানি, কবিরা আড়াল খোঁজেন ;
হাজার হাজার খুন করেও আড়ালে থেকে যান।
লম্বা লম্বা চুল দাড়ির পিছনে লুকিয়ে রাখেন
অব্যর্থ নাশকতার ছক।
কবিরা আড়াল খোঁজেন ব'লে
পৃথিবীর সমস্ত গোপন সম্পর্কগুলির পিছনে
কোনো না কোনো কবির হাত থাকে।
সমস্ত অপরাধ
একজন কবি সাদা পাতার উপর
কালো কালো অক্ষরে আড়াল করেন ।
এবং ওই প্রতিটি কালো অক্ষর আমরা শ্রদ্ধা করি,
আমরা উত্তরীয় ঝোলাই সাদা পোশাকি কবিদের।
--------------
কে
কে বসে থাকে মাথার পাশে?
কে চলে যায় মাথার ভিতর দিয়ে?
যখন, এক একটা অঙ্গুলি হেলনে বিস্ফোরণ ঘটে,
যখন, পাখা একটু চালালে ব্যয়বহুল বিল সটান ঢুকে পড়ে ঘরে,
যখন, আত্মবিলাপ জাঁকিয়ে বসে স্নায়ুতে,
কে বসে থাকে চেয়ারে, মাথায় পুষ্টিকর বাতাস দিয়ে
শিশুর মতন ঘুম পাড়িয়ে চলে যায়
-----------
ব্যক্তিগত বিপর্যয়
ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?
দাঁড়াবার রাস্তায় ভিড় জমেছে
ধাক্কা খেতে খেতে
ব্যক্তিগত মুখের আড়াল প্রয়োজন।
সমষ্টি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
ছবি গড়ে উঠছে
এখানে ওখানে গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়েছে খবর
ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?
------------
বনধের দিন
বনধের দিন জরুরি সাক্ষাৎ বাতিল
পুলিশ সক্রিয় রাস্তায়
বালকের মন কেমন
বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছে
----------------------------
সজলকুমার টিকাদারের একটি কবিতা
আমার জন্য, দুঃখ
দুঃখের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি;
আকাশ-বাগানে তখন, অজস্র
নক্ষত্রফুল ফুটেছে।
চারিদিকের নিস্তব্ধতা বাড়তে বাড়তে
একসময় এভারেস্ট-এর চূড়া ছোঁয়...
তারপর ঘুম ভাঙলে দেখি
আমাকে সুন্দর ভাবে শুইয়ে দিয়ে
সে কখন পা টিপে টিপে চলে গেছে।
পাশে রাখা, পাশ-বালিশের আরাম;
টেবিলে ঢাকা দেওয়া
জলের গ্লাস!
------------------------------------
তন্ময় মণ্ডলের একটি কবিতা
সব ঠিক হবে একদিন
উদ্বায়ী রঙের প্রলেপ,
মায়ারোদ ঢেউ তোলে আয়নার রঙচঙে জিভে।
সবুজের মোহ যার কেটে গেছে
তার কাছে কী বা দাবী রাখি!
গাছেদের নীরবতা গিলে নেয় বিষন্ন ময়ূরীর ডাক
হাওয়াদের ডানা আছে একথা বোঝানো কঠিন;
অনুভবে সরব, সতেজ।
অন্ধের শহরে শয়ে শয়ে অভিনেতা হেঁটে যায়
ঘিরে ধরে বিষন্ন ময়ূরীর ডাক।
সব ঠিক হবে একদিন।
আদৌ কি তাই?
মাটি নয় ইট তাঁর প্রিয়। অন্ধের শহর।
শেষতম অভিনেতা দাঁতে দাঁত চেপে বলে
সব ঠিক হবে একদিন…
সব ঠিক হবে…