একটি সংক্ষিপ্ত ভূতের গল্প

দুটি যুবক।  দিল্লির জেইনইউ  -এর  ছাত্র।  একজন খুবই জীবন নিয়ে চিন্তিত এবং ভাবুক গোছের, অন্যজন জীবনের সম্পর্কে বেপরোয়া ভাব।  দুজনেই ফতেহপুর সিক্রি যাবে।  আগ্রা থেকে শেষ বাসে চড়ে বসেছে। তাদের স্ত্রীরা আগেই ফতেহপুর সিক্রির Archaeological Survey of India র বাংলোতে চলে গেছে। তারা আগ্রাতে সারাদিন এবং সন্ধ্যেতে কাজের পরে শেষ রাতে চলল ফতেহপুর সিক্রিতে। আজকে পূর্ণিমার রাত।  কিন্তু বাসের দুলুনিতে  সারাদিনের ক্লান্তির পর দুজনের শরীরে নেমে এল তন্দ্রার আবেশ।  দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল।  তাদের গায়ের দামি জামা, হাতের ক্যামেরা এবং ঘড়ি দেখলে বোঝা যায় যে তারা বেশ ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। তাদের সঙ্গে কিছু নগদ টাকাও রয়েছে। আর রয়েছে বহু মূল্যবান এক সুফির সাগরেদের তিনশো বছর আগের নকল করা গ্রন্থ রুমির মাসনাভি -ইয়ে -মা'নাভি।  বইটার বাজার মূল্য প্রায় দশ লাখ টাকা। আর ঐতিহাসিক আর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিসীম। 

 

 

বাসে লোকজন লক্ষ্য করছিল তাদেরকে।  বাসের বাকি লোকজন দেহাতি মানুষ।  তবে আরও তিনজন যুবক রয়েছে। তাদের সুঠাম চেহারা, ভাবলেশহীন মুখ কিন্তু একজনের বলিষ্ঠ হাতে একটা লম্বা কাটা দাগ।  তাদের হাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ।  তারা কিন্তু কথা বলছিল  খাড়ি বলি বুলিতে।  তাদের একজন এই শহুরে সম্ভ্রান্ত যুবকদের দেখে নিল। রাত এগারোটা। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোর সঙ্গে শীতের রাতের কুয়াশার মিশ্রনে এক মায়াবী আলোর সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে।  বাস দাঁড়ালো ফতেহপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজা সামনে।  বাসের কন্ডাকটর এগিয়ে এসে JNU -এ  ছাত্রদের বলল -স্যার জি! বাস অউর নেহি জায়ে গা। আপকা ASI  বাংলা থোড়ি দূর হ্যায়।  লেকিন আপ লোগ জওয়ান আদমি হ্যায়।  জরা তেজ সে জানা।  বিশ মিনিট মে পৌঁছ জায়েঙ্গে।  রাম জি আউর মৌলা সেলিম চিস্তি ভরোসা হ্যায় কুছ নেহি হোগা।   

 

 

তারপরে কন্ডাকটর একটু গলা নাবিয়ে বলল -বাবুজি জলদি কিজিয়ে।  আপ কে পিছে আউর জওয়ান তিন লড়কা হ্যায়, ঊন সে  জরা  হুশিয়ার রহানা। JNU  -র দুই যুবক নেবে কন্ডাক্টরের দেখানো পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু  মুঘল যুগের প্রাসাদের খিলান গম্বুজের বেদনাময় রেখা দেখা যাচ্ছে। শীতে গায়ে একটু কাটা দিয়ে উঠলো তাদের।  চাঁদের  আলো আর ঘন কুয়াশার সংমিশ্রনে  সবই কীরকম রহস্যময় লাগছে।  ছেলে দুটো হাটতে শুরু করে দিল।  দূরে দেখল ওই তিনটি লোক তাদের পিছু করেছে। তারা আর একটু জোরে চলল।  তাদের কাছে তাদের কাছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল  অফ হিস্টরিকাল রিসার্চ -এর টাকা রয়েছে বেশ অনেকটা।  দুপুরে তাদের আগ্রা শহরে ইকমাদউদ্দৌলার স্থাপত্য নিয়ে কিছু কাজ করতে করতে দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া রয়েছে সেই বহুমূল্য সুফী বই।  ASI বাংলোতে কোনওক্রমে পৌঁছলে হয়।  সেখানে ইরা আর বারুনী রয়েছে।  সে যুগে একালের মতো মুঠো ফোন ছিল না। কিন্তু এবার লক্ষ্য করলো তাদের বাসের ওই সঙ্গী তিনজন খুব  দ্রুত তাদের দিকে আসছে। তাদের হাতে দূর থেকে হলেও মনে হচ্ছে ধারালো অস্ত্র আছে।  হয়তো তারা আগ্রা থেকেই তাদের খোঁজ নিয়েছে।  ব্যাঙ্ক থেকে ICHR -এর প্রজেক্টের টাকা তোলার সময়ে তারা এক ধনি কালেক্টরকে তাদের দুষ্প্রাপ্য সে যুগের বইটা বিক্রি করতে রাজি হয়নি।  তার লোক হতে পারে।  ছেলে দুটি তাদের হাঁটার গতি বাড়ালো।  কুয়াশার ঘনত্ব আরও যেন বেড়ে গেছে। তাদের নাকে এসে পড়ল এক অদ্ভুত মিষ্টি সুবাস।  তারা আর কোনওদিকে না তাকিয়ে আরও জোরে দৌড়োতে যাবে সেই সময় নজর পড়ল এক ছায়াময় মূর্তির দিকে।  ছায়াময় মূর্তির মাথায় এক  জীর্ণ পাগড়ি।  গায়ে লম্বা আলখাল্লা।  পুরো মনে হচ্ছে মধ্যযুগ থেকে কেউ যেন চলে এসেছে।  কিন্তু লোকটার মুখে কুয়াশার কুহেলিকার মধ্যে এক নির্মল হাসির আভাস দেখা যাচ্ছে।  

 

 

হঠাৎ কেউ যেন মৃদু সুরে কিন্তু এক অদ্ভুত দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, বেটা তুম লোগো  কো পরিশান নজর আ রহে হায়। ঠিক হো? ওহ বাংলা বাড়ি যাওগে টোডরমল কে কোঠি কে পাশ।  তখন যুবকদের একজন বলল -সাহাব হামারা পিছে তিন গুন্ডা আ রহে হ্যায়।  উনকে লিয়ে থোড়ি পরিশান হু।  

 

 

বৃদ্ধর শীর্ণ আবছা মূর্তি থেকে আবার এক হাসির শব্দ শোনা গেল।  -কোই ডোর নেহি? আল্লা মিয়া কে নাম লো আউর সব ঠিক হো জায়গা। বলে বৃদ্ধ সজোরে চলতে শুরু করলেন তাদের সামনে।  যুবক দুজনও মনে কেমন যেন সাহস পেল।  তারা সজোরে পা চালিয়ে বৃদ্ধের পিছনে হাঁটতে শুরু করলো। চারিদিক নিস্তব্ধ।  কুয়াশা যেন আরও ঘনীভূত হয়ে তাদেরকে আড়াল করেছে।  কোনও কথা তারা আর বলল না।  কেমন  যেন আবিষ্ট তারা। কিছুক্ষণ হাঁটার পর বৃদ্ধ ইঙ্গিত করলেন তাদের -বেটা তুম লোগোকে বাংলা বাড়ি আ গিয়া হায়।  চলে যাও।  ডর কে কোই বাত নেহি। আস্তে আস্তে বৃদ্ধ কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। সুন্দর সুবাস তাদের থেকে দূরে মিলিয়ে গেল। ASI র বাংলোর গেটে দেখা গেল টর্চের আলো। অনেক লোক দাঁড়িয়ে। রাম সিং আর শার্দুল সিং দুই বলিষ্ঠ কেয়ার টেকার ASI র বাংলোর গেট থেকে তাদের দেখে এগিয়ে এল। বলল, তাদের কাছে একটা ফোন এসেছে  যে তাদের শহর থেকে মশহুকের দাগি একই বাসে তাদের পিছু করেছে।  বাসের কন্ডাকটর জি তাদেরকে তার ডিপোতে গিয়ে ফোন করেছে।  তারা সব দল বেঁধে লাঠি বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছে প্রায় রাত পৌনে বারোটা হয়ে গেছে দেখে।  তখন ছেলে দুটি বলল, আরে অত চিন্তার কিছু নেই এক বৃদ্ধ মুসলমান  আমাদেরকে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।  লম্বা দাড়িওলা পাগড়ি পড়া। গায়ে আতরের গন্ধ, মুখে মিষ্টি হাসি।  ASI গেস্ট হাউসের লোকগুলি বলল- আপনারা ভিতরে চলুন দ্রুত।  দরজা লাগিয়ে তারা বলল, আপনাদের বড় মিয়া খুদই পৌঁছে দিয়েছেন বাবুজি।  রাম ভরসা আপনাদের নসিব খুবই ভাল।  আপনাদের সঙ্গে কি কোরান শরীফ বা কোনও ধর্মগ্রন্থ আছে। অরে সেইটা চুরি  করতেই লোকগুলো আমাদের পিছু নিয়েছিল। কিন্তু বড় মিয়া কে  ভাই

-সে কি এতো পড়া লিখা আদমি আপনারা? আর আপনারা মালুম করতে পারছেন না।  

-না  সে কে?

-মৌলা সেলিম চিস্তি।  

যুবক দুজন অবাক বিস্ময়ে রুমির বইটা খুলে দেখল এক টুকরো সুগন্ধি গোলাপের পাপড়ি কে যেন বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

 

  • শুভ বসু
img
আগের পাতা
স্বদেশ সেদেশ