নতুন বিকেলের নতুন আলো

বাড়িতে তাকে ডাকে আশা  বলে। তার ভালো নাম আশামুকুল চৌধুরি। কিন্তু অবন তাকে ডাকে মুকুল বলে। তার চোখের তারা ফিকে নীল। আঁখিপল্লব কোকিল কালো। চুল এলো করে যখন সে ছাদে পায়চারি করে তখন পাশের বাড়ির মল্লিকা বউদি অবাক হয়ে তার এলো চুলের দিকে তাকিয়ে  থাকে। আশার ঘন চুলে হালকা বাদামি আভা। বিকেলের শ্রান্ত আলোয় তাকে দেখে বিভোর হয়ে যায় বিজন সেনের বউ মল্লিকা।  তারপর বিভোরতা কেটে গেলে মল্লিকা একধরনের জ্বালা অনুভব করে।

 

 

অবন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মুকুলের চোখের  তারা। আঁখিপল্লব এবং  চুল  বাঁধার ধরন। ফরসা  হাতে মেয়েলি ঘড়ি। ঘড়ির  ফিতেতে বাসের টিকিট  গোঁজা।  কখনও  কখনও। নখে রং লাগায় না। পায়ের  নখও তাই। স্বাভাবিক। ঝিনুকবরন। শাড়িটি পরে কেমন সুন্দরভাবে। আঁচলের পরিচ্ছন্নতার ভেতর অবিরত সাঁতার কাটে একঝাঁক হাঁস। সাদা  পালক। হলদে ঠোঁট। হাঁসের পায়ের  পাতা অবিকল  রবারের মতো।

 

 

 

মুকুলের হাসিটি সুন্দর। গাম্ভীর্যও। তার  চপলতা  বালিকার মতো।  কিন্তু   যখন  শান্ত  হয়ে  বসে থাকে এবং অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে  থাকে  ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চুড়োর পরীটার দিকে তখন তাকে অন্যরকম মনে হয়। অবন সবুজ ঘাসে তার  পাশে বসে মুকুলকেই দেখে। তখন  হয়তো আকাশ দিয়ে উড়ে  যাচ্ছে  একটি রুপোলি  এরোপ্লেন। অবন কবিতা  লেখে। মুকুল চমৎকার  গান গায়। অবন স্বপ্ন  দেখে। মুকুলও। তারপর মুখোমুখি  দেখা হলে  কোনও  কোনওদিন পরস্পরের মধ্যে  স্বপ্ন ভাগ করে নেয়। স্বপ্ন  দুজনের  ভিন্ন ভিন্ন। মুকুল বলে, "তুমি  কী স্বপ্ন  দেখেছ আগে আমাকে বলো।" অবন মাথা  নাড়ে, "না। তোমার  স্বপ্নের কথা আগে আমাকে  বলো। তারপর আমারটা বলব।"   মুকুল বলে,  "আগে তুমি  তোমার স্বপ্নের কথা  বলো।" এই নিয়ে  কিছুক্ষণ  পরস্পরের মধ্যে স্বপ্ন  নিয়ে  দড়ি টানাটানি  চলে। অবশেষে  অবনকে হার মানতে হয়। অবন বলে, "আমি  প্রায়ই  স্বপ্নে দেখি রেলগাড়িতে চেপে দূরে কোথায়  যেন চলে যাচ্ছি। অন্ধকার  রেলগাড়ি ছুটে  যাচ্ছে। কোনও  স্টেশনে থামছে না। আমি  রেলগাড়িকে জিজ্ঞেস করি, আমাকে নিয়ে  কোথায়  যাচ্ছ! রেলগাড়ি নিরুত্তর। কেবল অন্ধকারের মধ্যে  ছুটেই চলেছে। তারপর  হঠাৎ  গাড়ি  থেমে যায়। আমার তক্ষুনি ঘুম ভেঙে যায়। দেখি  বিছানায়  বসে কুলকুল করে  ঘামছি।"

 

 

 

মুকুল বলে, "আমার  স্বপ্ন  অন্যরকম। নদীর ধারে একটি বাড়ি। পাকা বাড়ি  নয়। কাঁচা  বাড়ি।উঠোনে জবা ফুলের গাছ। তার  পাশে পেঁপে গাছ। গাছের  গুঁড়িতে সারি সারি পিঁপড়ে। একতলা  বাড়ি। উনুনে আঁচ দিয়ে  তোমার  জন্যে  অপেক্ষা করছি। তুমি এলে আমি  রান্না  শুরু   করব। নদীর ধারে বাজার। সেখানে  তুমি বাজার করতে গেছ। "দুজনে  স্বপ্ন  বিনিময়  করে হাসতে থাকে। এইভাবে  দিন যায়। অবন কবিতা  লেখে। সরকারি  অফিসে  কেরানিগিরি করে। তার  একটা  দুটো কবিতা  ছাপা হয়। বেশিরভাগ  কবিতা  সম্পাদকের অমনোনীত ফাইলে জমা  হয়। মুকুল কোনও  কোনওদিন ভোরবেলায়  হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতে বসে। পাশের বাড়ির  বিজন সেন তার বউকে বলে, " আশা  চমৎকার গান গায়। "স্বামীর কথা শুনে মল্লিকা হিংসেতে জ্বলেপুড়ে  মরে। দুবছর  হল পাশকোর্সে বি.এ. পাশ করে আশামুকুলের আর  পড়া হয়নি। ঝুম্পাদির টেলারিং শপে পাঁচদিন যায়। আর গুনগুন করে  গান গাইতে  গাইতে  মেয়েলি পোশাক  তৈরি  করে। ঝুম্পাদি বড্ড খিটখিটে মহিলা।

 

   

 

অবন বলল, "চলো, এমন  একটা  জায়গায়  যাই যেখানে  নদী  আছে আর তোমার  স্বপ্নে দেখা  সেই বাড়ি আছে। যে বাড়িতে  জবা ফুলের  গাছের  পাশে পেঁপে গাছ এবং  পিঁপড়ের শ্রেণি।" অবনের মুখের কথা  কেড়ে নিয়ে  মুকুল বলল, "নদীর ধারে বাজার থাকা  চাই। তুমি  সেই বাজার থেকে বাজার করে আনবে।  জমিয়ে শীত  আসছে। ফুলকপি, পেঁয়াজকলি চাই। আর চাই  ট্যাংরা মাছ।" অবন বলল, "নিশ্চয়ই। ট্যাংরা মাছ আমার  খুব প্রিয়।" দুজনে কথা বলছিল একটি  রেস্তোরাঁয়  বসে। শ্যামবাজারে একটি  গলির ভেতরে  এটি। রেস্তোরাঁর নাম নিরিবিলি। কলকাতা থেকে  এইরকম  ছোট  ছোট  রেস্তোরাঁ ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে  যাচ্ছে। সেখানে গজিয়ে  উঠছে সাইবার কাফে কিংবা  জামা-কাপড়ের দোকান অথবা লন্ড্রি।"

 

 

 

নিরিবিলি  যেন  ওদের  হাতে  স্বর্গ এনে দিল। প্রায়ই ওরা এখানে  আসে। মাসের  প্রথম  দিক হলে অবন চিকেন কাটলেটের অর্ডার দেয়। মালিক  গোবিন্দবাবু ক্যাশ কাউন্টার থেকে  হাঁক পেড়ে বলেন, "কীরে কেষ্ট এত দেরি হচ্ছে  কেন! দুনম্বর টেবিলে  ফাউল কাটলেট দিচ্ছিস না কেন! "কেষ্ট ছুটতে  ছুটতে  কাটলেট নিয়ে  আসে। কাটলেট খেতে খেতে মুকুল অবনকে জিজ্ঞেস  করে, "চিকেন  কাটলেটকে আবার  ফাউল কাটলেটও বলে! "অবন বলে, "তা বলে। লক্ষ করে দেখবে বয়স্ক মানুষেরাই বেশি বলেন। আমার  দাদু চিকেন  কাটলেটকে ফাউল কাটলেট বলতেন।" আজ মাসের  প্রথম  সপ্তাহ। নিরিবিলি -তে ঢুকে  মুকুল বলেছিল, "আজ আমি ফাউল কাটলেট খাওয়াব।" মুকুল এখন  চিকেন  কাটলেটের বদলে ফাউল কাটলেট বলে। অবন অবাক, "তার  মানে!" মুকুল বলল, 'গতকাল  ঝুম্পাদি আমাকে  মাইনে দিয়েছে। গুনে গুনে একহাজার টাকা। আর আমার  শাড়িটা দেখো। এই ধনেখালি শাড়িটাও উপহার  দিয়েছে।"

     

 

 

অবন দেখল। হলুদ জমি। পাড়ে  বেগুনি  ফুল। আঁচলে সাদা আকাশে উড়ে  যাওয়া  নীলকণ্ঠ পাখি। অজস্র। কাটলেটের পর চায়ের পেয়ালায় চুমুক  দিতে  দিতে  মুকুল বলল, "সত্যিই! আমাকে নিয়ে  যাবে সেই  নদীর ধারের বাড়িটায়! কবে! কবে নিয়ে  যাবে!” অবন চায়ে চুমুক  দিয়ে  বলে,  "আমাদের  একটু  অপেক্ষা  করতে হবে। আগে সেই  রেলগাড়িটাকে খুঁজে  পাই।" মুকুল বলে, "কোন  রেলগাড়ি!" অবন বলে, "সেই  যে স্বপ্নে যে রেলগাড়িটাকে দেখেছিলাম।" মুকুলের মুখ  ফ্যাকাশে হয়ে  যায়, "কিন্তু   সে তো অন্ধকার  রেলগাড়ি!" অবন হাসে, "তুমি  যদি আমার  সঙ্গে  থাক তবে সেই অন্ধকার  রেলগাড়িতে আলো জ্বলে উঠবে।" আনন্দের বিভায় মুকুলের মুখ  আলোকিত  হয়ে  ওঠে। বাইরে তখনও  বিকেলের আলো। আজ রবিবার। অবনের অফিস  ছুটি। ঝুম্পাদির টেলারিং শপের ঝাঁপ বন্ধ।

 

 

 

নিরিবিলি  থেকে  বেরিয়ে অবন একটা  সিগারেট  ধরায়। মুকুল বলে, "আবার  তুমি  সিগারেট  খাচ্ছ!  কথা  দিয়েছিলে তুমি  আর  খাবে না। কথা  রাখলে কই!" অবন বলল,  "বেশ। এটাই শেষ। এটা খেয়ে  নিই।" মুকুল বলল, "না। এটাও  খাবে না। ফেলে  দাও।" অবন বাধ্য ছেলের  মতো সিগারেটটা ফেলে দিয়ে  জুতো  দিয়ে ঘষে সেটা নষ্ট করে দিল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ওরা বড় রাস্তার  মোড়ে  এসে দাঁড়াল।

 

 

 

 

মুকুল বলল, "এবার আমরা  কোথায়  যাব?" অবন বলল, "এক্ষুনি  বাড়ি  ফিরতে  ইচ্ছে  করছে না। একটা  ট্যাক্সি  নিয়ে  চলো গঙ্গার ধারে যাই।" মুকুল বলল, "সেখানে  গিয়ে  কী করব!" অবনের মুখে  সারল্যের আলো ফুটে উঠল। ঠিক আজ বিকেলের আলোর মতো। অবন বলল, " মুকুল, আমার  অনেকদিনের ইচ্ছে  গঙ্গার  পাড়ে বসে তোমাকে  পাশে নিয়ে  জাহাজ  দেখি। কতরকমের যে জাহাজ  আছে তুমি  জানো কি? "  মুকুল বলল, " বেশ। গঙ্গার  ধারেই চলো।" অবন দেখল মুকুলের মুখেও বিকেলের অপরূপ  আলো। অ্যাপ থেকে  কীভাবে  ক্যাব বুক করতে হয়  তা অবন কিংবা  মুকুল কেউই  জানে না। অবন হন্যে  হয়ে একটা  ফাঁকা হলুদ  ট্যাক্সি  খুঁজতে লাগল। 

  • বাণীব্রত চক্রবর্তী