বড়দিন এখন বাঙালির বারোমাসে চোদ্দ পার্বণ। অনেকে হয়ত এখনও এই উৎসব পালনের ভিতরে ঔপনিবেশিক আমলের প্রবাহমানতা খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেখানে বলে ওঠেন; একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে...
সেদিন ফ্লাইটে প্রোফেসর পার্কার আর আমি দু'জনে একটা ভুল করেছিলাম; আমাদের দেখা করার জায়গা বাছতে। দায়ভাগ ওঁরই বেশি, বিশেষ করে ওঁর মতন একজন ইউরোপিয়ান ইতিহাসবিদ, যিনি ক্রিসমাস মার্কেট নিয়ে রিসার্চ করছেন। মিউনিখে দুটো ক্রিসমাস মার্কেট বসে – ছোট একটা রিন্ডামার্কৎ-এ এবং বিশাল বড়টা মারিয়ানপ্লাৎসের বুকে খোদ নিউটাউন হলের ঠিক সামনে। ১১৫৮ সাল থেকেই মারিয়ানপ্লাৎস মধ্যযুগের মিউনিখ শহরের প্রাণভোমরা। এই জায়গাটা থেকেই ব্যাভেরিয়ার রাজা পুরো রাজ্য পরিচালনা করত। প্রথম নাম ছিল মার্কৎ অর্থাৎ মার্কেট। ১৬৩৮ সালে সুইডিশ শাসন থেকে মুক্তিলাভের স্মারক হিসেবে নির্মিত হয় ভাস্কর্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন, মারিয়ানজয়েলে – ভার্জিন মেরীর এক সোনার মূর্তি। তার উত্তরদিক বহুদিন ধরে পাহারা দিচ্ছে নিউ টাউন হল, পূর্বদিক ওল্ড টাউন হল। এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে প্রমাণ সাইজের একটা ফুটবল মাঠের মতো আয়তাকার ফাঁকা একটা জায়গা। বছরের অন্য সময় ফাঁকাই থাকে। আজ ২ ডিসেম্বর সেই জায়গাটাই পুরো ভোল পাল্টে ফেলেছে। আমি পৌঁছেছি পৌনে চারটেয়। গাঢ় কালচে সবুজ রঙের শামিয়ানার নিচে তখন সারি সারি দোকানপাট বসে গেছে। এখনও বিকেল তাই দোকানগুলো সাজানো হচ্ছে। ক্রেতারা আসতে শুরু করলে ভিড় বাড়বে, এখানে দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না। তার আগেই আশা করি প্রোফেসর চলে আসবেন।
ক্লক টাওয়ারের ঠিক ডানদিকে একটা বিশাল উঁচু ক্রিসমাস ট্রি – প্রায় ছ’তলা একটা বাড়ির সমান। ঠিক তিনটে সাতান্নতে দেখলাম প্রোফেসর পার্কার একটা কালো রঙের লং কোট পরে হেঁটে আসছেন মারিয়ানপ্লাৎস আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বেরিয়ে। এই স্টেশন মিউনিখের ট্রেন আর পাতালরেলের অনেকগুলো সংযোগস্থলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা।
হাত বাড়িয়ে দিয়ে একটু হেসে আমাকে বললেন,
“তুমি তোমাদের দেশ থেকে সূর্যকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ দেখছি মিস্টার বিসওয়াস!”
আমিও হাত বাড়িয়ে একটু হাসলাম। রোদ আছে ঠিকই, কিন্তু ঠাণ্ডাও জবরদস্ত; একটু আগে দেখছিলাম আসল টেম্পারেচার চার ডিগ্রি, রিয়াল ফীল শূন্য ডিগ্রি, অথচ আমার মনে হচ্ছে মাইনাস চার ডিগ্রি!
দোকানগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকল। আমাদের দেশের মেলার দোকানগুলো আর এই দোকানগুলোর গঠন একইরকম, একমাত্র পার্থক্য এই যে কাঠামো, ছাউনি, আলো এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যবস্থা এখানে অনেক উন্নত। জনসংখ্যা কম বলে দোকানগুলোর পরিসর একটু বেশি। আমরা ক্রিসমাস ট্রি’র তলা থেকে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘুরতে শুরু করলাম। প্রথম দোকানটা বিশাল – প্রায় ষোলো ফিট চওড়া, মনে হয় এই মেলা-চত্বরের সবথেকে বড়। ভেতরে দু'জন বৃদ্ধা আর একজন বৃদ্ধ। দোকানের কাছাকাছি যেতেই নাকে এল নিউ মার্কেটের নাহুমের কেকের দোকানের মতন একটা মনমাতানো গন্ধ। নাহুমের গন্ধে যেমন মাখন, ডিম, ময়দা আর চিনি মিশে থাকে, এখানের গন্ধে যেন তার সঙ্গে আর একটু কোকো, একটু আমন্ড মেশানো আছে। দোকানে ঝুলছে বিভিন্ন সাইজের হার্ট শেপড্ জিঞ্জারব্রেড কুকিজ। সেগুলোর মাঝখানটা বাদামি রঙের, আর বর্ডারে উঁচু করে হলুদ, সবুজ, গোলাপি রঙের ফুলকারি। প্রত্যেকটার গায়েই কিছু না কিছু লেখা, অবশ্যই জার্মান ভাষায়।
“এটাকে জার্মান ক্রিসমাস মার্কেটের ট্রেডমার্ক আইটেম বলতে পারো। রাইয়ের ময়দা, মধু, আদা, দারচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করে। বাই দ্য ওয়ে, কবে থেকে ক্রিসমাস মার্কেট শুরু হয়েছে বলে তোমার মনে হয়?”
“ফার্স্ট সেঞ্চুরি?”
“হলো না, সেকেন্ড গেস…”
আমি ভেবে পেলাম না কতটা এগোবো সামনে, বললাম, “ফিফথ সেঞ্চুরি?”
“না, আরও অনেক পরে। হিস্টোরিকাল রেকর্ডস জানাচ্ছে, ১২৯৮ সালে ভিয়েনায় প্রথম ‘ডিসেম্বর মার্কেট’ অনুষ্ঠিত হয়। তখনকার ডিউক আলব্রেখ্ট ডিসেম্বর মাসে চোদ্দদিনব্যাপী মেলার অনুমোদন দিয়েছিলেন। সেই মেলা কিন্তু ক্রিসমাসের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল না। ধর্মীয় প্রকৃতির ছিল বলেও মনে হয় না।” প্রোফেসর আর একটা কেক আর কুকিজের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
“আর মারিয়ানপ্লাৎসের ক্রিসমাস মার্কেট?” আমার বেশ লাগছে দোকান থেকে ভেসে আসা জিঞ্জারব্রেডের খুশবু।
“এখানে ক্রিসমাস মার্কেট শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ থেকে। প্রথম ক্রিসমাস ট্রি-র উল্লেখ পাওয়া যায় জার্মানির মেইনজে পাওয়া ষোড়শ শতাব্দীর এক পুঁথিতে।”
“ওই সময় থেকেই কি এটা ক্রিস্টমাসের সাথে জুড়ে যায়?” আমি আন্দাজে তীর ছুঁড়লাম।
“সেরকমই তো মনে হয়।” পার্কার সাহেব মাথা নাড়লেন। একটু থেমে বললেন, “বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি জানো ক্রিসমাস ট্রি-র বৈশিষ্ট্য?”
“নো আইডিয়া স্যর।” আমি আত্মসমর্পণ করলাম।
“ক্রিসমাস ট্রি’কে যীশুর জন্ম ও পুনরুত্থানের সূচক হিসেবে ধরা হয়। যীশুর কাঁটার মুকুটের সঙ্গে নাকি এর সাদৃশ্য আছে। ফারের মতন এভারগ্রিন গাছ হল অমরত্বের প্রতীক। জগতসমাজের অন্ধকারের মাঝে যীশু আলো নিয়ে এসেছিলেন, তাই ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয় আলো দিয়ে। আর এর বিরাট আকার বোঝায় ঈশ্বরের বিশালত্ব।” প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন প্রোফেসর।
কেকের দোকানের পাশের দোকানটা ঠাসা ছোট ছোট পুতুলে। সেগুলোর মাঝে পুরুষ্টু, বিশাল গোঁফওলা দশাসই চেহারার মালিককে দেখে মনে হচ্ছে লিলিপুটদের মধ্যে গালিভার।
“ক্রিসমাসে প্রিয়জনদের গিফট দেওয়ার ব্যাপারটা কবে থেকে এল? যীশুর জন্মের সময় পারস্য থেকে তিন জ্ঞানী লোকের উপহার নিয়ে আসা থেকে?” এবার আমার জিজ্ঞেস করার পালা।
“ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে সঠিক বলতে পারব না, কিন্তু কথিত আছে 'মেলচিয়া' এসেছিলেন পারস্য থেকে, 'ক্যাস্পার' তোমাদের দেশ থেকে আর 'বালথাজার' আরব দেশ থেকে। বাই দ্য ওয়ে, তোমার খিদে পায়নি?”
“পেয়েছে তো। ব্রাঞ্চটা যদিও বেশ হেভি ছিল, কিন্তু এখন চারদিকে এত খাবার দেখে খিদে পাচ্ছে। প্রশ্নটা হল, কী খাওয়া যায়?”
“গুড পয়েন্ট। এত চয়েস থাকলে বেছে ঠিক করাটা বেজায় মুশকিল।” মুচকি হাসলেন প্রোফেসর।
আমি এক মুহূর্ত ভেবে বললাম, “ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, কিছু কিনে যদি আমরা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করি তাহলে বেশ কয়েকটা আইটেম ট্রাই করা যাবে।”
“গুড প্রপোজাল।” প্রোফেসর হাসলেন।
পাশেই এক বৃদ্ধা বসে আছেন একটা ছোট ছাউনির নিচে। সামনে বিভিন্ন ছোট বড় কাঠের বাক্সে সুন্দরভাবে সাজানো বিভিন্ন ছোট ছোট ফল – চেরি, ব্লু বেরি, কিশমিশ, আঙুর, প্লাম ইত্যাদি। একটু বড় জায়গায় আছে আপেল, পিচ, কমলালেবু, কিউয়ি। অন্যপাশে পেঁপে, শশা আর হরেক রকম ফলের শুকনো মোরব্বা। আমাদের রাজ্যের সিউড়ির মোরব্বার কথা মনে পড়ে গেল। এখানে দামটা চড়ার দিকেই। কোনওটার একশো গ্রামের দাম ১.৯৯ ইউরো, আবার কোনওটার ২.৯৯ ইউরো।
আমি ডিএসএলআর ক্যামেরাতে আর মোবাইলে এন্তার ছবি তুলছি মার্কেটে আসার পর থেকেই। এই ফলের বাহারের ছবিও তুললাম।
“জিঞ্জারব্রেড কুকি বাড়ির জন্যে নেব, কি বলো?” প্রোফেসর জিজ্ঞেস করলেন।
“একমত আমি। প্রথমে তাহলে কিছু নোনতা বা স্পাইসি আইটেম দিয়ে খাওয়া শুরু করা যাক, শেষে না হয় মিষ্টি জাতীয় কিছু…”
“বেশ। তবে একটা জিনিস আমিও তোমাকে খাওয়াব। ওখানে তুমি কিন্তু পার্স বের করবে না।”
আমি মুখে কিছু না বললেও ভাবনায় এল যে, তোমাদের ব্রিটিশদের খাবার আমার চেনা আছে। সবচেয়ে স্বাদু সুখাদ্য হল – ফিস অ্যান্ড চিপস। সোজা বাংলায় যা মাছভাজা আর বড় বড় আলু ভাজা। সেই পদ আবার অল্প তেলে ভাজা! মনে মনে ভাবলাম - সাহেব যা খাওয়াবে খাওয়াক, একেবারে শেষে যেন না খাওয়ায়।
প্রথমে খেলাম ডিপ ফ্রায়েড পট্যাটো প্যানকেক – তার ওপর বিভিন্ন ধরনের টপিংস চলে। প্রোফেসর চাইলেন অ্যাপেল সস। নোনতা-মিষ্টির যুগলবন্দী স্বাদ বেশ ভালই লাগল।