শ্রী সারদা মা ও ভারতের বিপ্লবী আন্দোলন

সারদা দেবী কি কেবলই শ্রীরামকৃষ্ণের পত্নী? কেবলই তিনি সঙ্ঘজননী? নাকি তিনি রাধুর পিসীমা? শিবুলালের খুড়িমা? নাকি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের এক অগ্নিময়ী দীপশিখা?

 

 

 

তাঁর সারা জীবনের কর্মধারায় তিনি পরিচিত জ্ঞান, করুনা ও সরলতার  প্রতিমূর্তি, উচ্চম আধ্যত্মিক চেতনা সমন্বিত এক সমুন্নত মানুষ। ভক্তের কাছে আদ্যশক্তি মহামায়া আর শ্রী রামকৃষ্ণ নামাঙ্কিত মহাসঙ্ঘের তিনি সঙ্ঘ জননী। তাঁর নির্দেশনায় সঙ্ঘ হয়ে উঠেছিল  মহীরুহ কত রকম ভাবের  ভাবধারার আধার। কিন্তু তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এর প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন কত বিপ্লবী তাঁর কাছে এসেছে আশীর্বাদ ও  প্রেরণা নিতে নতুন  জীবনবোধে  দীক্ষিত হতে। দেশের আর্থ সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অবহিত। তিনি মনে করতেন ভারতের এই দুঃখ  দুর্দশা অভাব অনটনের মূলে বিদেশি শাসন। তাই তিনি সরকারি অনাচারের প্রতিবিধান ও প্রতিরোধ  করতে  দেশবাসীর উদ্যম প্রয়োয়োজনীয় তথা প্রশংসনীয় এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। 

 

 

 

দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা স্পৃহা ছিল তাঁর  মর্মভেদী প্রেরণা।  জয়রাম বাটীর  মাটিকে স্পর্শ করে বলেন জননী  জন্মভূমিসচ স্বরগাদপি গরীয়সী। দেশবাসীর  দুর্দশা  তাঁকে  ব্যাথিত করত। মানুষের দুঃখ তিনি সহ্যই করতে  পারতেন নাচেষ্টা  করতেন প্রতিকারের।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের  কালে  সীমাহীন বেকারত্ব, দুঃখ্‌ খাদ্যা ভাব, মানুষ পীড়িত  করেছিল।  দেশের মধ্যে বস্ত্রাভাব দেখা দিল। বস্ত্রের জন্য হাট  লুট হচ্ছিল। অনেক মহিলা বস্ত্রের অভাবে  আত্মহত্যা করেন। অনেকে  সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে  বস্ত্র সংগ্রহ করছিল। এসব কথা শুনে মা উচ্চস্বরে কেঁদেছিলেন  বলেছিলেন কাপড় না পেলে তো মেয়েরা আত্মহত্যা করবে  সমবেত ভক্তমণ্ডলীর সামনে সখেদে  বলেছিলেন ওরা   কবে  যাবে  গো?  এরপর কিঞ্চিত  সামলে নিয়ে বললেন তখন ঘরে ঘরে  চরকা ছিল ক্ষেতে কাপাস চাষ হত নিজের  কাপড় মানুষ নিজে বানাত। কাপড়ের অভাব ছিল না। কোম্পানি সুখ দেখিয়ে দিলে টাকায় চারখানা কাপড় এক খানা ফাও সব বাবু হয়ে গেল  এখন সব বাবু  কাবু হয়ে গেছে।

 

 

 

১৯০৫ সালের স্বদেশী আন্দোলনের সময়  কোয়াল পাড়া  কিছু  যুবক  দেশ সেবার উদ্দেশ্যে  একটি  আশ্রম  স্থাপন করেন। এই আশ্রমের  কর্মীদের প্রতি মায়ের স্নেহদৃষ্টি  ছিল। কলকাতা   যাওয়া- আসার পথে তিনি এখানে বিশ্রাম নিতেন। পরে এখানে তিনি  শ্রী রামকৃষ্ণ  ও তাঁর  ছবি   প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। এই আশ্রামটি স্বদেশী  আন্দোলনে  অংশগ্রহণ করেছিল। বিলাতী দ্রব্য   বর্জন বিলাতী দ্রব্যের  অগ্নিসংযোগ এই আশ্রমের  কর্মীদের আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত। পুলিশের নজরে  পড়ল  এই আশ্রম।  মা একদিন কর্মীদের  উদ্দেশ্য  করে বললেন    দেখ   বন্দেমাতরম  করে হুজুগ করে বেড়িও না। তাঁত কর কাপড় তৈরি কর। মায়ের  আদেশের পরে এই আশ্রমে কাপড়   বোনা শুরু হয়।  এই রকম এক খানা  কাপড়  মাকে  পরতে দেওয়া হল।   মা এতে খুব সন্তোষ প্রকাশ করেন। মা এর   এই  মানসিকতায়   আমরা একটি  চিন্তাশীল   গঠনমূলক মনের   পরিচয়  পাই।

 

 

 

স্বামী বিবেকানন্দর প্রয়াণের পর শ্রী মাই ছিলেন বিপ্লবীদের আশা আকাঙ্খা ও প্রেরণার প্রতিক।   বিপ্লবীদের  অনেকেই মাকে প্রাণের ভক্তি জানিয়ে যোগ   দিয়েছেন  দেশমাতৃকার মুক্তি  সাধনায়। মায়ের কাছে  বিপ্লবীরা শান্তিলাভের  আশায় আসতেন। ১৩১৩  খৃষ্টাব্দের ১০ চৈত্র   বৈদান্তিক  জাতীয়তা বাদী সন্ন্যাসী ব্রম্ভবান্ধব উপাধ্যায়  স্বরাজ পত্রিকায়   লেখেন যদি  তোমার  ভাগ্য সুপ্রসন্ন হইয়া থাকে তো একদিন সেই রামকৃষ্ণ  পূজিত লক্ষ্মীর চরণপ্রান্তে গিয়া বসিও আর তাঁহার প্রসাদ কৌমুদীতে বিধৌত  হইয়া   রামকৃষ্ণ   শশী সুধা পান  করিও -তোমার সকল পিপাসা মিটিয়া যাইবে।   স্বদেশী আন্দোলনের  কালে বহু তরুণ বিপ্লবী  বেলুর মঠে  যাতায়াত করতেন।  মঠ কর্তৃপক্ষ  তাঁদের মনোভাব  জানতেন। পরে   এঁদের অনেকেই মায়ের নিকট মন্ত্র দীক্ষা নেন।  কেউ  কেউ    মঠের সন্ন্যাসী হয়েছিলেন   যেমন দেবব্ব্রতবসু  (স্বামী    প্রজ্ঞানন্দ) নগেন্দ্র নাথ সরকার (স্বামী  সহজানন্দ) রাধিকা গোস্বামী  (স্বামী  সুন্দরানন্দ),   সতিশ  দাসগুপ্ত   (স্বামী  সত্যানন্দ),   ধীরে ন  দাশগুপ্ত (স্বামী  সম্বুদ্ধানন্দ)অতুল গুহ (স্বামী  অভয়ানন্দ   বা ভরত  মহারাজ) সহ অনেকে। ১

 

                                     

 

১৯০৮ সালে ২ মে  রাষ্ট্রদোহীতার   অভিযোগে   শ্রী  অরবিন্দ ও তাঁর অনুচর রা  বন্দী হন।   শুরু  হয়  আলিপুর বোমা মামলা।  শ্রী অরবিন্দর পত্নী মৃণালিনী দেবী  হতাশায় ভেঙে পড়লেন।  তিনি বলেছিলেন   স্বামীর  সঙ্গছিন্ন  আমার  মৃত্যুর  সামিল।   বিপ্লবী দেবব্রত বসুর  ভগিনী  সুধীরা  মৃণালিনী  দেবীকে  শ্রী  মায়ের কাছে  নিয়ে যান। মা  মৃণালিনীকে  বলেন  চঞ্চল  হইও না   তোমার  স্বামী  শ্রী ভগবানের পূর্ণ আশ্রিত পুরুষ  ঠাকুরের   আশীর্বাদে শীঘ্র নির্দোষ  ও মুক্ত  হয়ে  ফিরে আসবেন। শ্রীমা  মৃণালিনী দেবীকে বৌমা বলে  ডাকতেন। শ্রী  অরবিন্দকে সন্তানতুল্য  ভেবে।  শ্রী মা   মৃণালিনী দেবীকে  রামকৃষ্ণ কথামৃত বা অন্য কোনও  ধর্ম পুস্তক পড়তে  বলেন। অরবিন্দকে দেখে  মা তাঁকে  আমার বীর  ছেলে  বলে অভিহিত করেন। অরবিন্দ পুদুচেরিতে  যাওয়ার পর  মৃণালিনী গভীরভাবে  মাকে আঁকড়ে  ধরেন। তিনি মায়ের কাছে  দীক্ষা নিয়েছিলেন। এ কথা শুনে অরবিন্দ  বলেছিলেন  “I was glad to knowthat She had found so great a spiritual refuge”.

 

 

 

১৯০৯ সালে মানিকতলা  বোমার  মামলার  দুই  মুক্তি প্রাপ্ত বিপ্লবী  দেবব্রত বসু ও শচীন্দ্রনাথ   সেন  শ্রী মায়ের অনুমোদনে মঠে থাকতে শুরু করেন।   মঠ কে এর জন্য  অনেক ঝুঁকি নিতে  হয়েছিল। দেব্ব্রত  মহারাজের উপর  বহুদিন  পুলিশের দৃষ্টি  ছিল। ১৯১২  সালে  লর্ড   হার্ডিঞ্জ যখন  দিল্লিতে নতুন রাজধানীতে প্রবেশ করেন তখন বিপ্লবী  নায়ক  রাসবিহারী বসুর   নির্দেশে বসন্ত বিশ্বাস তাঁকে লক্ষ্য  করে  বোমা ছোড়েন। বড়লাট গুরুতর আহত  হলেন।  খবর  এল বোমার মামলার পুরানো আসামীদের  পুলিশ  খুঁজছে।  এমন সময়  সহ সন্ন্যাসীরা অনেকেই  দেব্ব্রত   মহারাজকে অন্যত্র সরে যেতে  বললেন। কিন্তু  মা এত  নির্ভীক ছিলেন তিনি  এই প্রস্তাবে  আপত্তি  জানালেন। মহারাজকে   নিজের  কাছেই রেখে দিলেন।

      

 

 

বিপ্লবীরা  মায়ের  কাছে  আশীর্বাদ নিতে  আসতেন।  মাও বিপ্লবীদের কাউকে  নিরাশ করেননি। আনন্দবাজার পত্রিকার  সম্পাদক  হয়েছিলেন   সত্যেন্দ্র নাথ  মজুমদার।  তিনি  ছিলেন প্রথম জীবনে  স্বাধীনতা  সংগ্রামী।  তিনি মা -এর কাছে দীক্ষিত।৩

 

 

 

দেশবন্ধু  ঘনিষ্ঠ বিজয়কৃষ্ণ  গোস্বামী  মায়ের কাছে  মন্ত্র  দীক্ষা নিয়েছিলেন।   এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী  গান্ধীবাদী নেতা  ডঃ প্রফুল্ল  চন্দ্র  ঘোষ    ১৯১৬ সালে  মায়ের  পায়ে  মাথা  রেখে  চরণ  বন্দনার সুখ স্মৃতি  তাৎপর্যের  সঙ্গে স্মরণ করেছেন। তিনি  বলেছিলেন সেদিনের স্মৃতি আমার  নিকট  অক্ষয় সম্পদ। ১৯১৫ সালে  পলাতক অবস্থায় বিপ্লবী  নায়ক  বাঘাযতীন  মায়ের  আশীর্বাদ  নিতে আসেন  ট্রেনের মধ্যে।  তিনি  শুনেছিলেন  মা  ওই  ট্রেনে  আছেন।৪

 

নির্যাতিত দেশপ্রেমিক, মুক্তিপ্রাপ্ত  বিপ্লবী অন্তরিনে থাকা বিপ্লবীরা  দলে  দলে মায়ের  কাছে  দীক্ষা নিতে  আসতেন   নতুন  জীবনচর্যায়  অনুপ্রাণিত হয়ে।   তারা  নব  জীবনের অঙ্গীকারে  গঠনমূলক  ভূমিকায়  তাদের  জীবন উৎসর্গ  করেছেন।   পুলিশি  নির্যাতন যদি কোনও বিপ্লবীর  উপর  হত তাঁর  মাতৃহৃদয়  কেঁদে উঠত।  মায়ের  চিত্ত দেশে  ছিল এক  অতল স্পর্শ  বহুমুখিতা। তিনি শুধু আধ্যত্মিক  গুরু  আর সাধন  ভজন নিয়ে নির্লিপ্ত  থাকেননি। বহুজন সুখায় বহুজন হিতায় রামকৃষ্ণ মিশন  যে  কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল তার শ্রী মায়ের অনুপ্রেরণাতেই সম্ভবিত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের  প্রতি  ছিল তাঁর       অপরিসীম আগ্রহ    মুক্তি সংগ্রামীদের প্রতি  সহানুভুতিস্নেহ, সহমর্মিতা। নইলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার  অভিযোগে  অভিযুক্ত বা পুলিশি নজরদারিতে সন্দেহজনক যুবকদের এরকম অকৃপণভাবে  স্নেহ  বিলাতে পারতেন না বা  আশ্রয় দিতে  পারতেন না।  তাঁর মাতৃহৃদয়ের  বহুমুখী  সত্ত্বার  মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি এই সহমর্মিতা  শুধু  অভিনব নয়  এক উজ্জ্বল মহিমায় মহিমান্বিত।

 

 

 

১শতরূপে  সারদা  পৃষ্ঠা ৫১০

 

         তদে ব    পৃষ্ঠা ৫১২-১৩ গিরিজা শঙ্কর রায় চৌধুরী উদ্বোধন   পত্রিকায় লিখেছিলেন চন্দননগর  যাত্রার  পূর্বে  শ্রী  অরবিন্দ মাকে প্রনাম করে যান।  শ্রী অরবিন্দ সুহৃদ চারুচন্দ্র  দত্ত  উদ্বোধনেই এই বক্তব্যের  প্রতিবাদ  করে জানান  শ্রী অরবিন্দর সঙ্গে মায়ের  সঙ্গে  কোনওদিন সাক্ষাত হয়নি। অরবিন্দ আশ্রমের সম্পাদক নলিনীকান্ত  গুপ্তও এইরকম  মত পোষণ  করতেন। কিন্তু  শ্রী অরবিন্দ নিজে সারদা  দেবীর  সঙ্গে সাক্ষাৎকার এর  বিরুদ্ধে কোনও  বিবৃতি দেননি।  উদ্বোধনের  কর্মাধ্যক্ষ  স্বামী  বিশ্বেশ্বরানন্দ এক পত্রে  লিখে ছিলেন শ্রী অরবিন্দ  শ্রী শ্রী মাকে  প্রণামও করেছিলেন  এ কথা  ধ্রুব সত্য। কারণ  এ সকল ঘটনা  আমার চোখের  সামনে ঘটিয়াছিল। গিরিজা শঙ্কর রায়চৌধুরী   শ্রী অরবিন্দ  ও বাঙলায়  স্বদেশী  যুগ  গ্রন্থে  উল্লেখ  করেছিলেন   যে  অনেক  বাদানুবাদের পর এটা প্রমাণিত চন্দন নগর  যাওয়ার পূর্বে  শ্রী অরবিন্দ  সস্ত্রীক মায়ের   সঙ্গে সাক্ষাৎ  করেছিলেন।

 

৩ তদে ব    পৃষ্ঠা ৫১৫

 

৪ তদে ব    পৃষ্ঠা ৫১৭

 

  • সরোজ উপাধ্যায়