ফিকশনে 'প্রজাপতি', 'বিবর' 

দুটি চরিত্রের দেখা হওয়া। দুজনের মধ্যে জমে থাকা অনেক কথার আদান-প্রদান। যে কথা নিয়ে কতকাল ধরে, কত পাঠকের মনে জমে থাকা প্রশ্ন, বিস্ময় এমনকি বিরক্তিও। সে সবের মাঝেই মুখোমুখি দুটি চরিত্র--
 
 
সেদিনের বিকেলটা ছিল ছন্নছাড়া। 
বীরেশ বোস শহরের উপকণ্ঠে একটা চায়ের দোকানের বাইরে কোম্পানির গাড়িটা পার্ক করলেন।
মেঘের গর্জন দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছিল; যেন একটা পুরনো রেকর্ড বারবার বাজছে প্রায় ভেঙে পড়া বাড়িগুলোর মাথার ওপর। দমকা হাওয়ায় বেসামাল সবকিছু। বীরেশের জ্বলন্ত সিগারেটটা সদর্পে তার মোকাবিলা করছিল।  
চারপাশে অন্ধকার ঘনাচ্ছে, গলির কোণা থেকে হঠাৎ একজনকে নিজের দিকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।
সুখেন।
 
 
মাথার চুল এলোমেলো, দিশেহারা চোখে একরাশ আগুন। কাদামাখা পা’দুটো টলোমলো, যেন সদ্য শিকলমুক্ত। বীরেশ সিগারেটে একটা টান দিয়ে ভাবলেন, একে উনি কোথায় দেখেছেন।
"বীরেশবাবু?" সুখেনের কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ।
বীরেশ কটমট করে তাকালেন। "আমাকে চেনো?"
সুখেন হেসে ফেলল; হাসিটা নিরুত্তাপ।"আপনার খবর কে না জানে? শহুরে বড়লোকদের কুখ্যাত কসাই বীরেশ বোস – ঋণ আটকে দেন, ঝগড়া বাধিয়ে দেন।"
তীব্র একটা অস্বস্তি খচখচ করে উঠল বীরেশের ভেতরে। "তুমি কে? কী চাও? দেখে তো মনে হচ্ছে আন্দোলন-টান্দোলন করো"।
সুখেন কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা পুরনো ক্রেট তুলে তার ওপর বসে পড়ল। ওর আঙুলগুলো দ্রুত তাল ঠুকতে থাকল হাঁটুর ওপর। যেন একটা অদৃশ্য বোমার টাইমার চলছে। "হুমমম…আমার ভাইদের তাহলে আপনি ঘেন্না করবেন। রাজনীতিবিদ। মিথ্যেবাদী পুতুল সব।" একবার পেছন ফিরে কী যেন দেখে নিল ও। "কিন্তু আপনি নিজেও তো সাধু নন, বোস।"
 
 
সুখেনের এই সম্বোধনে বীরেশ হতভম্ব। মুহূর্তের জন্যে। সুখেন ওঁর আত্মার কালো ছোপগুলো যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। অন্তকার হলেই নীতার ঘৃণামিশ্রিত অসহায় চোখদুটো এখনও ওঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বীরেশ তীক্ষ্ণভাবে যুবকের দিকে তাকালেন।
"আপনার মতো আমিও শান্তি চাই", সুখেন হাসিমুখে শান্তস্বরে বলল। দৃষ্টিটা দূরে। "নিজের জন্যে নয়, তার জন্যে।"
"কার জন্যে?" বীরেশ নিজের প্রশ্নে নিজেই অবাক। 
সুখেন এবার দাঁত বের করে হাসল। পায়ের কাছে উড়তে থাকা ছোট্ট প্রজাপতিটার দিকে ইঙ্গিত করল। হলুদ ডানাগুলোর প্রান্ত ছিঁড়ে গেছে।
 "কখনও কি ধরার চেষ্টা করেছেন?"
"কেন? ডানা ভেঙে ফেলার জন্যে?" বীরেশের কণ্ঠে এবার শ্লেষ। 
"না"। সুখেনের দৃষ্টিতে যেন আঁধার নেমে আসে। "আরও খারাপ ভাগ্য থেকে ওকে বাঁচানোর জন্যে"।
বীরেশ আরেকটা সিগারেট ধরালেন। সামনের ছেলেটার ঘামের মতো আঁকড়ে থাকা দুঃখ ওঁকে নিজের কথা মনে করিয়ে দিল, যখন ধমনীতে হুইস্কির পরিবর্তে আদর্শের নদী বইত।
"কার জন্যে? কে সে?"
একটা বিরতি। সুখেন প্রজাপতিটার দিকে তাকাল, বিড়বিড় করে বলল, "শিখা…একমাত্র ওকেই আমি বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের মতো মানুষ যা কিছু স্পর্শ করে তাই-ই ধ্বংস হয়ে যায়।"
 
 
বীরেশের গা গুলিয়ে উঠল নিজের জীবনের কথা ভেবে। নীতা। ইতি। ইস্পাতের মত কঠিন, নিঃস্পৃহ নিজের দুটো হাতের কথা মনে পড়ে গেল যেদুটো সেই রাতে নীতার শ্বাসরোধ করে। নীতার থরথর করে কাঁপতে থাকা দেহটার সাথে অদ্ভুত মিল যেন - 
"প্রজাপতিটার?" সুখেন চেঁচিয়ে ওঠে। থামে না ও। "জানেন কিভাবে মারা যায় ওরা?" নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হেসে ফেলে ও। "প্রথমে, আপনি একটা ডানা ভেঙে ফেলুন। যেন স্রেফ অসাবধানতায়। তারপর ওকে মরতে দিন।"
বীরেশের সিগারেটটা আঙুলে মধ্যে সামান্য কাঁপছিল। "আমার কাছ থেকে তুমি কী চাও, সুখেন?"
সুখেন উঠে দাঁড়াল। চোখ চকচক করছে, হিংস্রতায়। "আপনি ভুল প্রশ্ন করছেন, বোস।" আরও কাছে এল, ফিসফিসিয়ে বলল, "আপনার জিজ্ঞেস করা উচিত - কে আমাকে পাঠিয়েছে।"
শব্দগুলো বীরেশকে যেন চিরে দিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, "কে পাঠিয়েছে তোমাকে?"
সুখেনের হাসি আরও চওড়া হয়ে ওঠে আর তারপরেই ও শিস দিতে দিতে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে যেতে থাকে। বজ্রপাতের গর্জন বেড়ে যায়। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা ফুটপাথের ওপর ছিটকে পড়ে। সুখেন কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, কেবল ওর হাসির একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি রয়ে যায়।
 
 
সেই রাতে বীরেশ ঘুমোতে পারলেন না।
অন্ধকার ঘরটা যেন চেপে ধরছে ওঁকে। সিলিং ফ্যানের আওয়াজটা ঠিক বেড়ালবাচ্চার কান্নার মতন একঘেয়ে। নীতার কথা মনে পড়ে। ওঁর হাত নীতার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল … নীতার নখগুলো ছিল একমাত্র প্রতিরোধ; ওঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছিল। তবে কিছুক্ষণেই শেষ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে নীতার। নিখুঁত অপরাধ। ইতি তাঁর জন্যে মিথ্যে বলেছিল। পুলিশ কোনও প্রমাণ পায়নি। তবুও প্রতি রাতে, নীতার আত্মা কাছে এসে ওঁর ঘুমকে অপরাধবোধে টুকরো টুকরো করে দেয়।
আর কে এই ছেলেটা? কে ওকে পাঠিয়েছে? তবে তার থেকেও আশ্চর্য ব্যাপার, নামটা জিজ্ঞেস করতে কি করে ভুলে গেলেন উনি!
অস্থির বীরেশ স্কচ ঢাললেন গেলাসে, জানলার পাশে বসে পড়লেন। বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে দূর থেকে রাস্তার ক্ষীণ আলো দেখতে পেলেন। ‘উচিত ছিল সুখেনকে হত্যা করা’…নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠলেন। 
 
 
 
বেশি কথা বলার আগেই সুখেনকে চুপ করিয়ে দিতে হবে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ওঁকে আরও হতবাক করে দিল। এক মুহূর্তের জন্যে পৃথিবীর সবকিছু যেন নিশ্চুপ। বৃষ্টিও থেমে গেছে। ধীরে ধীরে বীরেশ দরজার কাছে গেলেন।
আরও জোরে কড়া নাড়া। 
খুলে দিলেন।
খালি পায়ে ভিজে শাড়িতে দাঁড়িয়ে - শিখা।
"আপনি আমাকে চেনেন না", ওর চুল থেকে মেঝেতে জল ঝরতে থাকে; এক ভঙ্গুর অথচ স্থির কণ্ঠস্বরে সে বলে, "সুখেন কিন্তু আমাকে বলেছিল, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।"
বীরেশের হৃদস্পন্দন থেমে গেল। সুখেন! আবার! 
মেয়েটা সাধারণ। ট্র্যাজেডি সাহিত্যে যেমন মেয়েদের দেখা মেলে। অস্ফুটে বললেন উনি, "সাহায্য?"
বিনা আমন্ত্রণে শিখা ওঁর ঘরে ঢুকে পড়ে। চোখদুটো ঘরের চারদিকে ঘুরছিল। "ওরা সুখেনকে মেরে ফেলেছে, বোসবাবু।" হিসহিস করে বলে। 
বীরেশ চোখদুটো একবার জ্বলে উঠে যেন নিভে গেল। মুখে বললেন, "সেকী!"
"ওরা বলেছে, একটা দুর্ঘটনা। একটা বোমা, ধর্মঘটের মিছিলে। কিন্তু তা নয়"। কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে, পাতলা ঠোঁটদুটো থরথর কাঁপে। "ওরা সুখেনকে ভয় পেত। আপনার লোকেরা ভয় পেত…"
"আমার লোকজন?" বীরেশ জ্বলে ওঠেন। "আমি কে বলে তোমার মনে হয়?"
শিখা আরও কাছে আসে। কাঁপানো আঙুল উঁচিয়ে বলে। "আপনিও বাকিদের মতোই। ধনীদের রক্ষা করেন, দুর্বলদের মেরে ফেলেন।"
বীরেশের ক্ষীণ প্রতিবাদ, "আমি মারিনি…"
"আমাকে সাহায্য করুন তবে", চোখের জল গাল বেয়ে নামে, "বলুন এখানে কী ঘটেছে।"
বীরেশ মুখ ফিরিয়ে নিলেন, "আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না।"
"তাহলে আপনি ইতিমধ্যেই মারা গেছেন, বোসবাবু", শিখা ফিসফিস করে বলে। "ঠিক সুখেনের মতো।"
পরদিন সকালে বীরেশ রক্তাক্ত চোখ নিয়ে অফিসে গেলেন। চারপাশে একঘেয়েমির নিয়মিত গুঞ্জন। কেরানিরা ফাইল চালাচালি করছে, ফোন বাজছে, নিজেকে বেমানান লাগল ওঁর। হরলাল ভট্টাচার্যের মামলার ফাইল তখনও তাঁর ডেস্কে, একটা অসম্পূর্ণ অভিশাপের মতো ওঁর দিকে তাকিয়ে।
 
 
মনের চোখে, সুখেন সামনে দাঁড়িয়ে, প্রজাপতির দিকে ইঙ্গিত করছে।
"আপনি একটা ডানা ভেঙে দিয়েছেন, বোসবাবু।"
বাইরে কিসের যেন জোর কলরব। জানলায় উঁকি মেরে বীরেশ দেখলেন গেটের কাছে জড়ো হতে থাকা - পতাকা হাতে ছাত্র, শ্রমিক। শোরগোল ছাপিয়ে একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ। 
‘শিখা’, ওনার মন যেন চেঁচিয়ে বলে।
হঠাৎ কাঁধে এক অদ্ভুত ব্যথা অনুভব করলেন বীরেশ। স্তিমিত, বিরামহীন চাপ। যেন একটা হাত ওঁকে চেপে ধরেছে।
তিনি জানেন কী করতে হবে।
মামলার ফাইলটা নিয়ে অফিস থেকে বেরোলেন। সামনের দালান যেন অন্তহীন। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কেউ একজন ওঁকে অনুসরণ করছে।
বীরেশ সদর দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যে পা রাখলেন। প্রস্তুত হলেন শিখার, জনতার, সুখেনের ভুতের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে।  
পেছনে পায়ের শব্দ থেমে যায়।
সুখেন বলে ওঠে, "কে আমাকে পাঠিয়েছে? শিগগিরই জানতে পারবেন।"

  • প্রান্তিক বিশ্বাস