বদলে যাওয়া পুরনো শহরে এসে তারামন ভাবে, ভেবেই চলে, সেই ছেরমপুর গ্রামে যখন তাকে নিকা পড়তে হয়েছিল এক থুথ্থুরে বুড়ো ভোলা মিঞার সঙ্গে, কেমন ছিল সে কালটা?
ভরা বাজার তখন লাল পাট্টির। তবু ধরমনাথ সিং রাজ করছে নদিয়া জুট মিলে। শ্যামসুন্দর, চাঁন্দুবাবু আর লাল পার্টির বিপ্লব, কি সুন্দর বন্দোবস্তি করে মিল চালাচ্ছে। কে বলবে রাইটার্সের কুর্শিতে জ্যোতিবাবু?
বিপ্লব বলে জ্যোতিবাবু তো ধরমনাথ সিং পুকারে ইন্দ্রারা গান্ধী।
হ্যাঁ, ধরমনাথ সিংয়েরা তখন ইন্দিরা বলতো না, শ্রীমতী গান্ধীর প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব দেখাতে উচ্চারণ করতে অভ্যস্থ ছিল,' ইন্দ্রারা' ।
প্রফুল্লচন্দ্র সেনের একগুয়েমির জেরে বাংলার তখতে তখন জ্যোতি বসু। '৮০ সাল তখনও আসেনি। দিল্লিতে রাজ করছে মোরারজি আর বাজপেয়ী রাজ। অতুল্য ঘোষের বদুবাবু, যে নির্মলেন্দুদের বিভা মাইতির জন্যে অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে যূপকাষ্ঠে তুলে এ পোড়া বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়কে, সেই বদুবাবু একদিন গেলেন প্রধানমন্ত্রী দেশাইয়ের দরবারে। বদুবাবুকে ঘরে ঢুকতে দেখেই প্রধানমন্ত্রী দেশাই হিন্দিতে বলে উঠলেন; আসুন, আসুন বদুবাবু। আপনার দাদা ভালো আছেন তো? আরে, আমি তো প্রধানমন্ত্রী হয়েই গেছি। আসলে দেশাই বলতে চেয়েছিলেন নির্মলেন্দু দেকে; আরে বদুবাবু, আপনার দাদা অতুল্য ঘোষ, সেবার আমার প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকাটে কম চেষ্টা তো করেননি। দেখুন এবার আমি কেমন আপনার দাদার ভূমিকা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছি। দুষ্টু লোকেরা বলে, অতুল্য ঘোষের আবার রাজনীতিতে ভেসে ওঠবার শেষ চেষ্টাটা নাকি এভাবেই মোরারজি দেশাই ভেস্তে দিয়েছিলেন। তারামন যখন ভোলা মিঞার বৌ হয়ে এই নদিয়া মিল লাগোয়া রামনরেশ বাড়িওয়ালার বাড়িতে ভোলার ঘরে এল সে সময়টাতে রাজনীতির রঙেও বেশ ওলোটপালট ঘটছে। জরুরি অবস্থার অবসান রূপশ্রী সিনেমা হল ঘিরে টিকিট ব্লাকারদের এই দল, সেই দলের হুটোপাটি, বোমাবাজি, পাইপগান নিয়ে দৌড়োদৌড়ির যুগটাকে একটু অন্যরকম করে দিয়েছে।
জরুরি অবস্থার সময় এইসব সিনেমা হলের টিকিট ব্ল্যাকার মদনা, বাবুনিদের নিয়ে পুলিশের খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না।ফনুয়ার বাংলা মদের আড্ডা ঘিরেও তমন একটা মাথাব্যথা ছিল না পুলিশের। এইসব মদের আড্ডা র প্রতিশব্দ তখনও 'ঠেক' হয়ে ওঠেনি। বরংচ বাঙালির নির্ভেজাল প্রিয় শব্দ 'আড্ডা' ছিল বাংলা মদের সঙ্গে জুড়ে থাকা বেশ একটু জুৎসই শব্দ। ফনুয়ার আড্ডা, বাবুনির আড্ডা -এসব শব্দের মধ্যে দিয়েই বুঝে নিতে হতো, এ আড্ডার রকমফেরের বিষয়টা। গোরস্থান লাগোয়া মদের আড্ডা, নেশার উপকরণ পাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ছিল শ্মশান লাগোয়া জায়গাতে এসব পাওয়ার অবাধ সুযোগ। বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে মরা পুড়তে এসে গলা ভেজাবে -এটা বেশিরভাগ শবযাত্রী দলের একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ই যেন ছিল। শ্মশান ঘিরে যে ব্যস্ততা , সেখানে আদার ব্যাপারিও কোনোমতে নিজেকে গলিয়ে দিয়ে করে কম্মে খেতে পারে। এ তল্লাটে তখন মুক্তারপুর, চলতি উচ্চারণে মুক্তোপুর শ্মশানের বেশ নাম ডাক। অনেকটা কাশীধামের মণিকর্ণিকার মত আর কী। এখানে পুড়লে স্বর্গের সিঁড়িটা সোজাসুজি ধরতে পারা যাবে -এমনটাই ধারণা এই তল্লাটের মানুষজনদের।
খানিকটা তফাতে শ্যামনগরের রত্নেশ্বর ঘাট আছে। ওদিকে উত্তরে আছে গরিফার রামঘাট। কিন্তু সেসব শ্মশানের মাহাত্ম এই মুক্তোপুরের মত গগনবিদারী নয়। রামঘাটে এই কিছুকাল আগে এক সাধুর বেশ খায় খাতির তৈরি হয়েছিল। তন্ত্রমন্ত্র ঘিরে এই এলাকার মানুষজনদের বিশেষ একটা মাথাব্যথা ছিল না কখনোই।কারন, কালী সাধনাকে ভাটপাড়ার বামুনেরা কখনও খুব একটা আমল দেয়নি। খোদ ভাটপাড়ার আনাচে কানাচে আটচালা, দোচালার অনেক শিবমন্দির, এমন কি বশিষ্ট গোত্রীয় বামুনদের একেবারে মৌরসীপাট্টা, পাঁচ মন্দিরে দারুন টেরেকোটার কাজে পরিপূর্ণ পাঁচ পাঁচটা শিবমন্দির। তার একটু পাশেই শেতলা মন্দির থাকলেও, কালী মন্দির ছিল না। অথচ নৈহাটির শ্যামাসুন্দরী ছিলেন কয়েকশো বছর আগে থেকেই। অনেকের বিশ্বাস, এখন যেখানে মায়ের মন্দির, এককালে তার পাশ দিয়ে বয়ে যেত গঙ্গা। আর সেই গঙ্গাতেই নাকি ভেসে এসেছিল মায়ের ঘট। সেই ঘট আজ পূজিত হয় মা শ্যামাসুন্দরীর মন্দিরে।
একটু দূরে হালিসহরে রামপ্রসাদ আর তাঁকে ঘিরে হাজার কিংবদন্তী থাকলেও বলদেঘাটায় গঙ্গার ধারে মা সিদ্ধেশ্বরীর অধিষ্ঠান আরো অনেক অনেককাল আগে। গোটা এলাকার একটা অংশের মানুষের জীবনের সঙ্গে এসব দেবদেবীর বেশ আত্মিক সংযোগ গড়ে উঠলেও চটশিল্পের বিকাশ, গোটা এলাকাটিকে যেভাবে ভাষা-ধর্মের এক মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম দিলো, তাতে সত্যিই আশ্চর্য হতে হয়, কয়েক শতাব্দী তো দূরের কথা, শতাব্দী প্রাচীন একটাও মুসলমানদের মসজিদ বা মাজারের দেখা এখানে মেলে না। সূফী সাধক চশমাবাবাকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি মানুষের যে আবেগ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, নির্ভরতা -এসব বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে।
নদীর ওপারে রয়েছে জাফর খাঁ গাজির দরগা। বাংলার দ্বিতীয় মাদ্রসা এই জাফর খাঁ গাজির দরগাকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল। প্রথমটা ছিল আজকের বাংলাদেশের সোনারগাঁওতে। বারাসত-বসিরহাটের আশে পাশে যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি থেকেছে। ঝগড়াঝাটি যে কখনও সখনও হয়নি তা নয়। তারই মধ্যে পীর গোরাচাঁদ কীভাবে ধর্মের বেড়াজাল ভেদ করে বাঙালির হৃদয়ের সঙ্গে মিশেছে। অথচ এই ভাটপাড়া, নৈহাটি এসব শহরকে বেড় দিয়ে পানপুর, শঙ্করপুর থেকে আওয়ালসিদ্ধি, রামচন্দ্রপুর হাট, দেবক -এসব গ্রামগুলোতে তো কত মুসলমানের বাস। অথচ সেই আমডাঙা পর্যন্ত না গেলে একটা বড় মসজিদও দেখা যায় না। ঘোষপাড়া রোডের ধারে ধারে এক আধটা মসজিদ আছে বটে। কিন্তু সেগুলোতে আধিপত্য অবাঙালিদেরই। বাঙালি মুসলমানের যাতায়াত প্রায় নেইই বললে চলে।
গাঁ ঘরে যেসব বাঙালি মুসলমানের বাস, সেসব গাঁয়ের বেশিরভাগ জমি জিরেতের মালিক ভাটপাড়া-নৈহাটির বামুনেরা। যারা নিজের নামের সঙ্গে 'ঠাকুর' এঁটে হিন্দুর কাছে দেবতা সেজে, হিন্দুদের দিয়ে চোখ রাঙিয়ে চলে মুসলমানদের। সেসব ঠাকুরেরা বড় একটা দিনের বেলায় জমি জিরেতের দেখাশুনো করতে এককালে গাঁয়ে যেত না। তাদের হয়ে তখন সেসব কাজ করতো তাদেরই চ্যালা চামুন্ডারা। এদের কাউকে কাউকে আবার মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে স্বর্গের সিঁড়ির দরজা খুলে দেওয়ার লোভ দেখাত এসব বামুন ঠাকুরেরাই।
শহর লাগানো গাঁগুলোতে এককালে মুসলমানদের বেশ জমি জিরেত ছিল। জমিদারির মত দশা না হলেও মাঠের ফসলে চলে যেত তাদের বছরের অনেককটা দিনই। ধান, আনাজপাতি বেচে আসতো তেল, নুন, মশলাপাতি। ঘরে পালা হত মুর্গি, ছাগল। কাছাকাছি পুকুর ছিল অনেকই। সব পুকুরেই নিজেদের হক ছিল না। তবে যেসব পুকুরের মালিক ছিল মুসলমান, সেসব পুকুরে খাওয়ার জন্যে এক আধদিন মাছ ধরলে পুকুরের মালিক রে রে করে তেড়ে আসত না। মুসলমানের দুঃখ বুঝত মুসলমান।
আবার হিন্দুদের মধ্যেও অনেকেই ছিল যারা ভাটপাড়া-নৈহাটির বামুন ঠাকুরদের নিমকের তোয়াক্কা করতো না। তাদের ঘরের চালে হওয়া লাউ, চালকুমড়ো মনের আনন্দে বিলোতো পাড়া পড়শীকে। সেই বিলোনোতে হিন্দু-মুসলমান ছিল না। আর একটেরে মুসলমানপাড়া সেই '৬৪ র দাঙ্গার আগের কালে এ চত্ত্বরের গাঁগুলোতে তেমন একটা ছিলও না। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি ঘর বেঁধে থাকতো তখন। হিন্দুর মেয়ে পোয়াতি হলে জ্বিন পরীর হাওয়া বাঁচাতে কেবল দূরের মসজিদ থেকেই জলপোড়া এনে খাওয়াতো না। পাশের বাড়ির মুরুব্বির পড়ে দেওয়া পানি তে বিশ্বাস ছিল গাঁয়ের গরীব হিন্দুদের। না তাঁরা বামুন ছিল না। আর বামুন ছিল না বলেই ভাটপাড়ার কাঁচা খাওয়া বামুন ঠাকুরদের কাছে তারা ছিল হেটা খাওয়া মানুষ। (ক্রমশঃ)