'৮৫ এর কোনও একদিন। কনে দেখা গোধুলিতে বন্ধু বাবুর হাত ধরে হেঁটেছিলাম ওর বাবার শেষযাত্রায়। বাবুরমা, যাঁকে জ্যেঠিমা বলতাম। সুরমা ঘটক। দুম করে ওঁদের চেতলার ফ্ল্যাটের বারান্দার দরজা খুলে বললেন; আগে কিছু খাবার খাও। তারপর ছাইভষ্ম গেল-
বাবু(ঋতবান ঘটক) আমার আশৈশবের বন্ধু। গত শতকের শেষ দিক থেকে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বার আগে পর্যন্ত তাঁর বাবাকে ঘিরে একটু টুকরো কোনও ঘটনা শুনলেই সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে একেবারে পাগল হয়ে উঠত। নৈহাটি পুরসভার সেকালের চেয়ারম্যান রবীন ভট্টাচার্য, স্থানীয় নাটকের দল 'যাত্রিক' ঘিরে মফসসলে খুব পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি একবার নৈহাটিতে গণনাট্য সঙ্ঘের সন্মেলন ঘিরে ঋত্ত্বিকের থিয়েটার করতে আসার কথা বললেন। রবীনবাবু, নৈহাটিতে 'দলিল' নাটকটি নিয়ে ঋত্ত্বিকের অভিনয় ঘিরে বলেছিলেন। কথাটা বাবুকে বলায় ওঁর আর উৎসাহ থামছেই না। কবে ওঁর কাছে নিয়ে যাবি? কয়েকদিনের মধ্যেই বাবু এলো নৈহাটিতে। আমরা গেলাম রবীনবাবুর কাছে। কিন্তু দলিল নাটকটি অভিনয় ঘিরে মঞ্চ সজ্জার প্রয়োজনে নৈহাটির হরিদাস ঘোষ লেনে একটা মাঠ থেকে ঋত্ত্বিকের ঘাসের চাঙর কেটে আনা ছাড়া একটা কোনও নতুন তথ্য দিতে পারলেন না রবীনবাবু।
বাবু বেশ হতাশই। শুধু আমাদের একটা কথাই সেদিন মনে হয়েছিল, ঋত্ত্বিককে ঘিরে কিছু গল্পকথা তৈরি করতে একটা অংশের লোক ভালোবাসেন। দেশভাগ -এই বিষয়টা যেহেতু কমোডিটি হিসেবে বেশ জনপ্রিয় আর সেই সময়ে দূরদর্শন পরপর কয়েকদিন ঋত্ত্বিকের ফিল্ম দেখানোর ফলে তখনকার নতুন প্রজন্মের ভেতরে ঋত্ত্বিক ঘিরে একটা ইমোশন তৈরি হয়েছে, তাই, 'আমি কত ঋত্ত্বিককে জানতাম' -এটা বলবার, দেখাবার একটা ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতার শুরু সেই তখন থেকেই। সত্যজিৎ রায়কে ঘিরে তাঁর জীবৎকালে বা প্রয়াণের অব্যবহিত পরে এটা সম্ভব হয়নি বিজয়া রায়ের সতর্ক দৃষ্টির ফলে। এ নিয়েও একটা ঘটনা আছে। একটা বেসরকারি চ্যানেলে তখন 'এবং ঋতুপর্ণ' নামে অনুষ্ঠানটি তখন খুবই জনপ্রিয়। সেখানে একবার নির্ধারিত হয়েছে বিজয়া রায়ের সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষের সাক্ষাৎকার। অনুষ্ঠানটির রেকর্ডিং শুরু হওয়ার আগে ঋতুপর্ণ বললেন বিজয়া রায়কে; অনুষ্ঠানে আমি আপনাকে 'তুমি' করে বলব। বিজয়া রায়ের সটান উত্তর; আমার সঙ্গে আপনার পরিচয়ের কোনও গভীরতাও নেই, অন্তরঙ্গতাও নেই। আপনি আমাকে 'তুমি' কেন বলতে যাবেন? বিজয়া রায়ের এই প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে আর দ্বিতীয় কথা বলেননি ঋতুপর্ণ। আসলে সেলিব্রেটিদের সঙ্গে একটা মেকি অন্তরঙ্গতা দেখানোর এই অভ্যাসটার কথা ঘিরে বিজয়া রায়ের এই ঘটনাটির কথা বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক পার্থ বসু খুব বলতেন।
অন্তরঙ্গতা দেখাতে এই ধরনের দস্তুর এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সেই অন্তরঙ্গতার সুর ঋত্ত্বিককে ঘিরে ভারি সুন্দর করে উঠিয়ে আনবারও চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই চেষ্টাতে প্রথম বৈশিষ্ট্যই দেখা যাচ্ছে যে, ঋত্ত্বিক যেন দেশভাগের বাইরে আর কোনও কিছু নিয়েই সেভাবে ভাবেননি। 'তিতাস একটি নদীর নাম' ঘিরে আলোচনা কি খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়?
অনেককাল আগে একদিন খবরের কাগজে দেখলাম, নন্দনে দেখানো হবে, 'তিতাস একটি নদীর নাম'। সম্ভবত তার আগে প্রকাশ্যে ছবিটি দেখানো হয়নি। অন্নদাশঙ্করকে বললাম, যাবেন? এইসব বিষয়ে তাঁর কিছু শিলুর মত উৎসাহ। গিয়েই আমরা টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছি, কি করে যেন খবরটা চলে গেছে প্রবোধ মৈত্রের কাছে। নন্দনের সেই সময়ের কর্তা। তিনি তো অন্নদাশঙ্করকে নিয়ে সোজা প্রদর্শনী কক্ষে চলে গেলেন। আর অন্নদাশঙ্করকে দেখে সুরমা ঘটক, প্রদর্শনীর প্রদীপ প্রজ্জ্বোলন করালেন তাঁকে দিয়েই। বাবু ছিল। সুনেত্রাদি(ঘটক) ছিলেন। আজ যাঁরা ঋত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, সেদিন অবশ্য তাঁরা ছিলেন না। কারণ, তাঁর তখনও 'বিশেষজ্ঞ' হয়ে ওঠেননি আর কী! প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন অন্নদাশঙ্কর। বললেন; ঋত্ত্বিকের সঙ্গে পরিচয় আমার তাঁর দাদা মনীশবাবুর মাধ্যমে। কর্মসূত্রে আমাকে তখন থাকতে হয় বহরমপুরে। মনীশবাবুরাও তখন দেশভাগের সেখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা। মনীশবাবুর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বও আমার গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রেই তাঁর ভাই ঋত্ত্বিকের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। দেশভাগের যন্ত্রণা আমাকে তখন ছিঁড়েখুড়ে খাচ্ছে। গোটা ঘটক পরিবারটিও দেশভাগের যন্ত্রণায় ক্লিন্ন। মনীশবাবু লেখালেখি করেন। ক্রমে ইনকাম ট্যাক্সে চাকরিও পেলেন। কিন্তু কোথায় যেন একটা গভীর যন্ত্রণা। ক্রমে বন্ধুত্বের বনিয়াদ দৃঢ় হতে বুঝলাম, যন্ত্রণাটা দেশ হারানোর।
সেই দেশ হারানোর যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়ার দুঃখই ঘটক পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেতু তৈরি করেছিল অন্নদাশঙ্করের। সেই সেতুপথই যে ঋত্ত্বিকের প্রতি স্নেহের উৎস সেদিন সেটা মুক্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর। উনিশ শতকের নবজাগরণের শেষ প্রতিভুর সেই উচ্চারণ সেদিন সমবেত মানুষদের মুগ্ধ করে দিলেও ঋত্ত্বিক সম্পর্কে সব থেকে দরকারী যে কথাটা সেদিন অন্নদাশঙ্কর উচ্চারণ করেছিলেন সেটি ছিল; গুরুদেবের 'অতিথি' গল্পের 'তারাপদে'র মত যেন ছিলেন ঋত্ত্বিক। হেথা নয়, হেথা নয়। অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে -র প্রতিই ছিল যেন ঋত্ত্বিকের এক অদম্য আকর্ষণ। তাই এই অন্যের সন্ধানে যুক্তবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের যে যৌথ সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতির আঙিনায় সে লালিত পালিত হলেও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে নিজের সৃষ্টির ভুবনকে মেলে ধরতে গিয়ে নিজের সাংস্কৃতিক বোধের সবটাকে বিকশিত করতে পারেননি ঋত্ত্বিক।
আজ ঋত্ত্বিকের এই না পেরে ওঠার যন্ত্রণাটাকে তাঁর শতবর্ষের প্রাক্কালে কেউই ফুটিয়ে তুলতে উৎসাহী নয়। আসলে জীবৎকালে ঋত্ত্বিককে বেশিরভাগ সময়েই শুনতে হয়েছিল গঞ্জনা। শুনতে হয়েছিল বিদূষণ। তাই তাঁর শৈল্পিক সত্তার সবটুকু প্রকাশের সুযোগ যে ঋত্ত্বিক পরিপূর্ণভাবে পেয়েছিলেন- একথা কখনওই জোর দিয়ে বলতে পারা যায় না। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণের ক্ষেত্রে কখনও এতটুকু কার্পণ্য করেননি ঋত্ত্বিক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি' র পরিপূর্ণ প্রকাশ আমরা সার্বিক ভাবে দেখতে পেয়েছিলাম ঋত্ত্বিক ঘটকের মধ্যে। তবু, জীবনানন্দের ভাষায়, তবু সেই মায়া রয়ে যাওয়ার মতই বিষয় শেষপর্যন্ত থেকে গেছিল। বন্ধু সেজে তাঁর সমকালের এক পরিচালক ঋত্ত্বিককে কিভাবে ব্যক্তিজীবনে অন্ধকারের ঘন আবর্তে নিমজ্জিত করতে আত্মনিবেদন করেছিল সেটা কলিম শরাফির দৌলতে জানি। অনেকেই সেটা জানতেন। কিন্তু কলিম শরাফি তাঁর ব্যক্তিবৃত্তে সেই ফরিদপুরীয় বন্ধু সম্পর্কে যতটা সোচ্চার ছিলেন তার ভগ্নাংশও ঋত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা লোক এবং মানুষেরা জেনে শুনেও কখন গলা তুলে কিছু বলেননি। কেন বলেননি? কারণ, স্বাধীন ভারতে ফরিদপুর ছিল শাসক ঘনিষ্ঠ। পাবনা-নগরবাড়ি, ভারেঙ্গা, নতুন ভারেঙ্গা, যমুনা নদীর মুশায়ারেরা কেউ কখনও শাসকের তাঁবেদার হয়নি।
অন্নদাশঙ্কর সেদিন একজন স্রষ্ঠাকে বিশেষ কোনও তকমা দিয়ে দেওয়ার প্রবণতারকে একেবারেই সমর্থন করতে পারেননি। বিশেষ করে দেশভাগ ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার যে ঝোঁক, মুসলমানদের জন্যেই হিন্দু বাঙালিকে সেদিন ছিন্নমূল হতে হয়েছিল, এই অনৈতিহাসিক বোধের সঙ্গেই ঋত্ত্বিককে মিলিয়ে দেওয়া হবে ভবিষৎতে যদি তাঁকে, তাঁর সৃষ্টিকে কেবলমান দেশভাগের প্রতিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো হয় -এই সতর্কবাণীটি সেদিন খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর। ঋত্ত্বিক যে দেশভাগের যন্ত্রণাক্ষুব্ধ হৃদয় নিংড়ানো কান্নার কথা বলেছিলেন, সেই কান্নাতে একমাত্র বিষয় ছিল মানুষের কান্না। সে কান্নাতে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের লেবাস ছিল না। ছিল না ধনী-দরিদ্রর সীমানা। উচ্চারিত হয়নি জাতপাতের দীর্ণতা।
কিন্তু তাঁর শতবর্ষ ঘিরে আলাপ আলোচনাতে এমন একটা ছবি উঠিয়ে আনবার চেষ্টা হচ্ছে যে, মানুষের মনে হবে, দেশভাগ ছাড়া আর কোনও বিষয়কেই ঋত্ত্বিক তাঁর সৃষ্টির ভুবনে এতটুকু অগ্রাধিকার দেননি। এভাবে খন্ড ক্ষুদ্র করে ঋত্ত্বিক ঘটককে দেখবার প্রবণতার মধ্যেও একটা বড় রকমের রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতিটা হল, যে কোনও উপায়ে ঋত্ত্বিক বিদূষণের পাল্লায় হাওয়া দেওয়া। ঋত্ত্বিককে অপদস্ত, তাঁর প্রতিভার অপচয় ঘটিয়ে তাঁর মেধাকে বিনষ্ট করে দেওয়া -এই হীনচক্রান্তের জন্যে কলিম শরাফির মত 'ভবা' র খুব কাছের বন্ধুরা, তাঁদের বন্ধুবৃত্তের মধ্যে থাকা এক ফিল্মমেকারের কথা দ্বিধাহীনভাবে বলতেন।
থাক। সেসব পুরনো কাসুন্দি না ঘেটে, তিতাস একটি নদীর নাম -ফিল্মে সিলেট, মানে শ্রীহট্টে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গাওয়া বিয়ের গান; লীলাবলী লীলাবলী কি দিয়া সাজাইমু তরে -ই একবার গাওয়া যাক। ঋত্ত্বিক, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, রণদাপ্রসাদ সাহা আর আমাদের রঞ্জুদা -সুপ্রিয় চক্রবর্তী- সিলেট, রোজী সামাদ আর অদ্বৈত মল্লবর্মণ, দি মুসলমান পত্রিকা তার সম্পাদক বসিরহাটের মুজিবর রহমান -মেলাবেন তিনি মেলাবেন-