আমাদের অন্ধকর থেকে আলোতে উত্তরণের আলো বিকরণকারী এক মহাগ্রন্থ। কোনও সাধারণ মানুষের লেখা কাহিনী নয়। এক সাধকের কলমের আঁচর--
শঙ্করীপ্রসাদ বসু, উনিশ শতকের নবজাগরণের চেতনায় উদ্ভাসিত এক হিউম্যানিস্ট, মানবপ্রকৃতিবেত্তা। এমন মানুষের আত্মকথন যেন আমাদেরই নিজেদের গড়ে তোলবার এক পথ নির্দেশিকা। শঙ্করীবাবুর জীবনের নানা দিক, বিশেষ করে শ্রীরামকৃষ্ণ পরিমন্ডলের সঙ্গে তাঁর সংযুক্ত হবার একদম প্রথম যুগের নানা ঘটনার পরম্পরা, তাঁর পারিবারিক বিন্যাস এবং পারিবারিক বিন্যাসের সঙ্গে সামাজিক বিন্যাসের সংযোগ সাধন -একজন মানুষ কিভাবে তার নিজের জীবনের চলবার পথকে সঠিকভাবে নির্ধারিত করতে পারবে, তার যেন এক প্রজ্ঞাপিত অনুধাবন।
এই অনুধাবনের মধ্যে দিয়ে মনুষ্য চরিত্রের রূপরেখা নির্মাণের যে দিগন্ত প্রসারিত মাঠ, তা যেন আমাদের চেতনার জগতকে একটা নতুন ধারায় উদ্ভাসিত করছে। এক অতি সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই প্রজ্ঞা, যেভাবে সামাজিক পটভূমিকায় জাতীয় আন্দোলনের নানা প্রেক্ষিত আর সেই সবের সঙ্গে আধ্যাত্মিক জগৎকে আত্মস্থ করে চেতনার তরবারিকে শানিত করছেন শঙ্করীবাবু, সেই শান যেন গ্রন্থটি পড়তে পড়তে আমাদের হৃদয়ের তন্তুকে আরো ক্ষুরধার করে তুলছে।
আমরা এক অনির্বচনীয় আনন্দের সাগরে নিজেদের ভাসিয়ে নিতে পারছি। হৃদয়ের অন্তস্থল থেকেই উৎসরিত হয়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথের সেই গান ,আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান। এই বান যেন আমাদের অন্তরলোককে প্লাবিত করছে শ্রী রামকৃষ্ণ সাহিত্যের নানা দিগন্তের দিকে। সেই দিগন্তে যেমন আধ্যাত্মিকতা আছে, মানবিকতা আছে, জীবনবোধ আছে, সমাজবোধ আছে, আবার রয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শ্রীরামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলের বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভগিনী নিবেদিতার আত্মোৎসর্গের বহু জানা কাহিনীর অজানা বিশ্লেষণ।
আবার সেই সঙ্গে বহু অজানা কাহিনী, যা একদিকে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে একটা নতুন চেতনাতে উদ্ভাসিত করছে। অপরদিকে কিছু অপরিণত পাঠক, যারা, শ্রীরামকৃষ্ণ আদর্শে আত্মনিবেদিত এবং স্বামী বিবেকানন্দের কাছে হাতে কলমে দীক্ষা নিয়ে সেবাব্রত, শিক্ষা বিস্তার, বিশেষ করে নারী শিক্ষা আর সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে এসে উড়ে আমাদের শাসন ক্ষমতায় জুড়ে বসা ইংরেজদের সম্পর্কে প্রবল বিরক্তিকে ,কিভাবে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে সংকল্পিত করতে পারা যায়, সেই কাজে ভগিনী নিবেদিতার যে আত্মনিবেদন, তার গভীরে প্রবেশ না করে, এক ধরনের বিপ্লবীয়ানা দেখাতে রামকৃষ্ণ মিশনকে খাটো করবার প্রবণতা দেখায়। সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে যেন তত্ত্ব, তথ্যপ্রমাণ এসব দিয়ে একেবারে সমস্ত রকমের অসত্যের জালকে এই ঐতিহাসিক গ্রন্থে কেটে টুকরো টুকরো করে দিয়েছেন ক্ষণজন্মা মানবিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু।
তাঁর এই গবেষণা, মননশীলতা, মেধা আর আত্মনিবেদনের ভেতর দিয়ে আমরা কেবল যে ভগিনী নিবেদিতা বা স্বামী বিবেকানন্দের মতো মানুষকে এই গ্রন্থের ভেতর দিয়ে নতুন করে চিনতে পারছি তাই নয়। আমাদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের বিভিন্ন ধারা-উপধারা গুলি ঘিরে এক সুখ পাঠ্য তথ্যবহুল নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও পাচ্ছি। নিজেকে জাহির করার প্রবণতার বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে খুব কম আত্মকথন আমরা পেয়েছি। সেই দিক থেকে বলতে হয়, শঙ্করীবাবুর আলোচ্য গ্রন্থটি একেবারে যেন রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি' বা অন্নদাশঙ্করের 'বিনুর বইয়ে'র মত, আমার আমিত্বকে একেবারে বাইরে রেখে, সমকালকে উপস্থাপিত করবার এক অভ্রান্ত দলিল।
সময়কে সঠিক বৃন্তে বিকশিত হবার সুযোগ দিয়ে ফুল ফোটার বেলাকে প্রসারিত করবার লক্ষ্যে যখন প্রয়োজন হয়েছে, খুব গৌণভাবে নিজেকে যে মেলে ধরেননি শঙ্করীবাবু তা নয়। কিন্তু সেই মেলে ধরবার মধ্যে এমন একটা বিনীত এবং নম্র মাধুর্যময় ভঙ্গিমা রয়েছে, যা বারবার বিস্ময়ের এক মনমুগ্ধকর আবেশের মধ্যে আমাদের আবিষ্ট করে। নিজের আত্মকথনের মধ্যেই গবেষণার নানা পর্বকে মেলে ধরেছেন তিনি। আর সেই গবেষণার পর্বকে মেলে ধরবার মধ্যে সবথেকে বড় যে বিষয়টি আমাদের সামনে উঠে আসে, তা হল; তাঁর অসামান্য অধ্যাবসায়ের বিষয়টি। কোনও একটি বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে, একটি তথ্যের সঠিক সন্ধানে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতেও তিনি দ্বিধা করছেন না। তাঁর চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির স্বপক্ষে সিদ্ধান্তে আসতে গিয়ে কোনও অবস্থাতেই নথি, সাক্ষ্য, তথ্য প্রমাণের বাইরে কল্পিত কোনও বিষয়কে তিনি এতোটুকু স্থান দেন না।
কিংবদন্তীতুল্য অধ্যাপক গবেষক শঙ্করীবাবুর শ্রীরামকৃষ্ণ অন্বেষণে সবথেকে বড় গুরুত্ব পেয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের 'যত মত তত পথ'। শ্রীরামকৃষ্ণের চিন্তা চেতনায় যে গণতান্ত্রিক মমত্ববোধ, এটাকে ফুটিয়ে তোলবার ক্ষেত্রে এহেন অধ্যাবসায়, ( পৃষ্ঠা--২১৫) তেমনটা অন্য অনেকেরই যে কোনও গবেষণাতে আমরা খুব কম দেখতে পাই। শঙ্করীবাবু একজন আত্মনিবেদিত ভক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি শঙ্করীবাবুর আত্মসমর্থন সর্বজনবিদিত। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের একটি বিখ্যাত নির্দেশ; ভক্ত হবি তো, বোকা হবি কেন? এই বিষয়টি যেন শঙ্করীবাবুর সামগ্রিক গবেষণার মধ্যে বারবার ফুটে উঠেছে। আর এই আত্মকথা বা বিভিন্ন সময়ে লেখা ছোট ছোট নিবন্ধ, সেগুলির ভেতরেও এই বিষয়টার গুরুত্ব আমরা দেখতে পাই।
অন্ধ ভক্তি কখনো শঙ্করীবাবুর গবেষণায় স্থান পায়নি। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেন; গুরুকে দিনে দেখবি। রাতে দেখবি। সব সময় দেখবি। তবে তাকে বিশ্বাস করবি। ঠিক তেমনি ভাবেই শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা- শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলন ঘিরে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভারতীয় সমাজ জীবনের শ্রীরামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং অবদান, তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শঙ্করীবাবু কিন্তু কখনওই অন্ধভক্তির ধার পাশ দিয়ে না হেঁটে, তীক্ষ্ণ যুক্তিবোধ আর ইতিহাস বীক্ষার প্রতি সবথেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
উনিশ শতকের নবজাগরণে শ্রীরামকৃষ্ণকে ঘিরে যে ভক্তিবাদী সমন্বয়ী চিন্তা, যা চিরন্তন ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের এক অনন্যপ্রকাশ। সর্বোপরি উনিশ শতকের নবজাগরণের পূর্ণতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের যে সর্বধর্ম সমন্বয়ী চেতনা যা গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের এক নতুন অবদান হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। এই সার্বিক বোধ এবং ঘটনা পরম্পরা ঘিরে ইতিহাস বেত্তাদের মধ্যে বেশ কিছু মতাদর্শগত বিরোধ রয়েছে। সেই মতাদর্শগত বিরোধের মধ্যে সবথেকে বেশি দেখতে পাওয়া যায় সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শ্রীরামকৃষ্ণকে ঘিরে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় দ্যোতনার অভিনিবেশের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অথচ শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা বা শ্রীরামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলের বিশিষ্ট সন্ন্যাসীরা, তাঁরা কেউ এই সংকীর্ণতার মধ্যে কখনো আবদ্ধ থাকেননি। সংকীর্ণতার পক্ষে একটি শব্দ কখনও উচ্চারণ করেননি।
ধর্ম এবং জাতপাতের বেড়া যেভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ ভেঙ্গে চুরচুরে করে দিয়েছিলেন, তেমনটা ভারতের বুকে আগে কখনও ঘটেনি। আগে কখনও ঘটেনি শব্দটা এই জায়গা থেকে উল্লেখ করা হল যে ,শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে জাতপাতের বেড়াজাল ভেঙেছিলেন, সেখানে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সমন্বয়ের দিকটা, শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গির মতো করে উঠে আসেনি। এই উঠে না আসাটাকে কোনও দুর্বলতা, ত্রুটি বা সংকীর্ণতা এমনটা কিন্তু একবারও বলা হচ্ছে না। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সমকালে যে সমাজ বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, তার কোনও নজির সেই সময়ের, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মেলে না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ যেটা করেছিলেন, মনে রাখতে হবে, সেটা আরও প্রায় ৪০০ বছর পরের ঘটনা। গোটা বিশ্বের সামাজিক চিত্রে তখন একটা বদল ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা জেরই হোক, সময়ের দাবিকে মান্যতা দিয়েই হোক, উনিশ শতকের নবজীবনের যে ধ্বনী প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, সেই জায়গা থেকে তাঁর সমকালে শ্রীরামকৃষ্ণ যে ঐতিহাসিক অবদান স্থাপন করেছিলেন, তা আজকে তাঁর প্রয়াণের প্রায় দেড়শ বছর অতিক্রান্ত সময় দাঁড়িয়েও যে অভিনবত্ব প্রকাশ করে, তাকে ফুটিয়ে তোলবার ক্ষেত্রে এই আলোচ্যগ্রন্থে শঙ্করীপ্রসাদ বসু যে আত্মনিবেদিত বিভাসার উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন, কোনও শব্দই বোধহয় যথেষ্ট নয় তাকে প্রকাশ করবার ক্ষেত্রে।
রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দে নিবেদিত আমা জীবন আমার গবেষণা
শঙ্করীপ্রসাদ বসু
লালমাটি
৬০০ টাকা