আমার মায়ের একটা দুনিয়া আছে। সেটা মায়ের নিজস্ব দুনিয়া। সে দুনিয়ার উত্তর-দক্ষিণ, পুব-পশ্চিম সব মায়ের নিজস্ব। এমনকি সে দুনিয়াটা গোল না লম্বা, সরু না মোটা তাও মায়ের নিজের ভাবনায় ঠিক করা। এ তো হল দিক আর আকার-আকৃতির কথা। সে দুনিয়ার মেঘ-রোদ, আলো-ছায়া, সুখ-দুঃখও মায়ের নিজস্ব। সেই দুনিয়াখানাই মায়ের বেহেস্ত। কতদিন বলেছি, ‘দুনিয়া পাল্টাচ্ছে মা, একটুখানি তো বদলাও’। আমার সে কথা শুনে মা হেসেছেন। শ্যামা মুখের ছোট ছোট চোখের ওপর সে মিষ্টি হাসিখানা বড়ই মাটি-মাটি। চোখের চাহনিতেও কোমল ভাব। মা বলেছেন, ‘সব মানুষের দুনিয়া বদলালেও মায়ের দুনিয়া কখনও বদলায় না রে।‘ আমি যখন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি, ‘একাত্তর বছর ধরে এই পৃথিবীটা একই রকম আছে!’ মা আমার কথায় বিন্দুমাত্র অবাক হন না। ঠোঁটের ওপর সেই মাটি-মাটি হাসিখানা হেসে বলেন, ‘একই আছে তো। বৃষ্টি কি আকাশ থেকে ঝরার বদলে জমিন থেকে ওঠে? না, রোদটা সূর্যের বদলে চাঁদ থেকে আসছে?’ ‘তা কেন হবে?’ আমি বললে মা বলেছেন, ‘তাহলে কীসের বদল হল?’ মাকে কোনোভাবেই বোঝানো যায় যে পৃথিবীটা ওই রোদ আর বৃষ্টির মধ্যে আবদ্ধ নেই। পৃথিবী এখন প্রযুক্তিতে চলছে। ইন্টারনেট হচ্ছে এ পৃথিবীর রুহ। ইন্টারনেট নেই তো পৃথিবী মৃত। মা’র অবশ্য ওসব ভারি ভারি কথা বোঝার ক্ষমতা নেই। আমার মা নিরক্ষর। না আছে অক্ষরের জ্ঞান না আছে পুঁথির জ্ঞান। আমি যেদিন জীবনে প্রথম বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম সেদিনও মা বিদ্যালয়ের আঙিনায় যাননি, গিয়েছিলেন বাবা। বাবার হাত ধরে আমি গিয়েছিলাম। পর-পুরুষের কাছে পর্দা বে-পর্দা হয়ে যাবে বলে মা লম্বা ঘোমটা টেনেও কোনও দিন ছেলের বিদ্যালয়ে যাননি। মা যখনই বাড়ির বাইরে যান, মাথার ঘোমটাটা নাক পর্যন্ত টানা থাকে। ঘোমটার আড়াল দিয়ে পথ দেখেন। আমি তখন ভাবি, মা তো ঘোমটার আড়াল দিয়ে ওইটুকু সামান্য পৃথিবী দেখতে পান! কিছুটা হাঁটার পথ আর আড়ালে-আন্দাজে বাবার মুখ কিংবা আমার মুখ, ওইটুকু দেখাতেই মায়ের দুনিয়া! অথচ মা যখন মুখে এক খিলি পান পুরে সুখ-চিবান চিবান তখন বলেন, মায়ের ওই পৃথিবীটা নাকি আমার পৃথিবীর চেয়েও বড়! অথচ মায়ের সেই পৃথিবীতে ইন্টারনেট নেই! অ্যাটম বোমা নেই! ভিসি নেই! গুগল মিট নেই! ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ নেই! ট্যুইটার নেই! এক্স-হ্যান্ডেল নেই! এমনকি ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনও নেই! শুধু একটা ‘ছিরিপপুর’ আর একটা ‘ছলেডাঙ্গা’ আছে। আর আছে একটা বড় উঠোন! শ্রীপুর হল মায়ের বাবার বাড়ি। অর্থাৎ আমার নানাবাড়ি। মা শ্রীপুরকে বলেন ‘ছিরিপপুর’। আর সলুয়াডাঙ্গা হল আমার দিদির শ্বশুরবাড়ি। মা সলুয়াডাঙ্গাকে ‘ছলেডাঙ্গা’ বলেন। এত বড় আকাশের দুটো মাত্র দিক আছে আমার মায়ের দুনিয়ায়। ঈশান কোণের যেদিকটায় শ্রীপুর গ্রাম আছে সেই উত্তর-পূর্ব দিক আর নৈঋত কোণের যেদিকটায় সলুয়াডাঙ্গা গ্রামটি অবস্থিত সেই দক্ষিণ-পশ্চিম দিক। যদি উত্তর কিংবা পূর্ব দিকে মেঘ ওঠে তাহলে মা বলেন, ‘ওই দ্যাখ, ছিরিপপুরে বৃষ্টি হচ্ছে।‘ আর যদি দক্ষিণ কিংবা পশ্চিম আকাশে কালো হয়ে মেঘ ওঠে তাহলে মা বলেন, ‘ওই দ্যাখ, ছলেডাঙ্গাকে আজ ডুবাচ্ছে’। মায়ের কথা শুনে মনে হয় এই দুটো গ্রাম ছাড়া যেন পৃথিবীতে আর কোনও জায়গা নেই! মায়ের সবচেয়ে বড় পৃথিবী হল আমাদের বাড়ির উঠোনটা। মা গর্ব করে বলেন, এই উঠোনটা আছে বলে দুনিয়াখানা এখনও আছে। যেদিন উঠোনটা থাকবে না সেদিন দুনিয়াখানাও থাকবে না। আমি তখন বিরক্ত হয়ে বলি, তাহলে বড় বড় শহরে যে হাজার হাজার মানুষ লক্ষ লক্ষ মানুষ ফ্লাটবাড়িতে থাকেন তাঁদের তো কোনও উঠোন নেই, কই, পৃথিবীটা তো ধ্বংস হয়ে যায়নি?’ মা তখন বলেন, ‘ওসবে জীবন নেই, শুধু শরীর আছে। আকাশ নেই শুধু দেওয়াল আছে। যেখানে জীবন থাকে না, আকাশ থাকে না, সেখানে দুনিয়া থাকে না।‘ সেদিন সাদাসিধে মায়ের মুখে এত ভারি কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেছিলাম। ঠাহর করেছিলাম, একাত্তর বছরের মানুষের পৃথিবী তো বড় হবেই? আর সে মস্ত বড় পৃথিবীটা নেমে আসে আমাদের উঠোনে। এই উঠোনেই পালা দেওয়া থাকত আমন ধান। মায়ের সেদ্ধ করা ধান শীতল পাটিতে মেলা থাকত। আমি, আমরা অর্থাৎ মায়ের সাত ছেলে আর এক মেয়ে কিতকিত খেলে বড় হয়েছি। বাবা বলদের জন্য শানি কাটতেন। ভাদ্রের গরমে এই উঠোনে শুয়েই আমরা আকাশের চাঁদ দেখতাম। গুনতাম তারা। হন্যে হয়ে খুঁজতাম কালপুরুষ। মা বলেন, আল্লাহর ফেরেশতারা এই উঠোনে নেমে এসেই আমাদের রিজিক দিয়ে যান। এই উঠোনে যখন প্রথম হেঁটেছিলেন মা, তখন তাঁর বয়স ছিল এগারো। সেদিন এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন মা। তিন কুড়ি বছর ধরে এই উঠোনে হাঁটছেন! উঠোনটা তাঁর কাছে মস্ত বড় পৃথিবী তো হবেই? আমি যখন মাকে আনন্দে ডগমগ হয়ে বলি, ‘জানো মা, এই পৃথিবীটা এখন একটা ছোট্ট উঠোন। আর এত বড় পৃথিবীকে ছোট্ট উঠোন বানিয়েছে ইন্টারনেট।‘ মা তখন আমার কথায় অত উৎসাহ দেখান না। কেমন উদাসিনী হয়ে যান। তখন তাঁর ঘোলা চোখগুলো ঘুলঘুল করে ওঠে। যেন মা তখন তাঁর সেই ঝাপসা চোখ দিয়ে অন্য একটা পৃথিবী দেখতে পান! সে পৃথিবীটা বড় খারাপ! বড় নিষ্ঠুর! তারপর মা মিনমিন করে বলেন, ‘ভয় তো সেখানেই রে! দুনিয়াখানা ছোট হওয়া ভালো লক্ষণ নয়।’ আমি তখন রীতিমত রেগে যাই। খিটমিট করে বলি, “পৃথিবী ছোট হওয়াতে মানুষের কত সুবিধা। মানুষের কাছে দূর বলে কিচ্ছু থাকছে না! সব অচেনা মুহূর্তে চেনা হয়ে যাচ্ছে! আর তুমি বলছ, পৃথিবী ছোট হওয়া ভালো লক্ষণ নয়?” মা তখন আবারও ভারি কথা বলেন, “উঠোন আর আকাশ যেদিন থাকবে না সেদিন আমরাও কেউ থাকব না।“
উঠোন না থাকতেই পারে? কিন্তু আকাশ আবার কোথায় উঠে যাবে? আকাশ কি কখনও ধ্বংস হওয়ার জিনিস না ফুরোনোর জিনিস। প্রশ্নগুলো আমার মনে তিড়বিড় করে ওঠে। তবুও মাকে প্রশ্নগুলো করি না। আমি ভাবি, মায়ের বয়স হচ্ছে, এখন মাথা আর অত ঠিকঠাক কাজ করবে না। এখন ভুল বকার সময়। তারপরে আবার মান্ধাতার আমলের মানুষ। যুগের এগিয়ে যাওয়ার আর কী বুঝবেন?
দুই
যেদিন গাজা ভুখন্ডে প্রথম পারমাণবিক বোমাটা পড়ল সেদিন আমার মাথায় মায়ের কথাটা সূচ ফোটার মতো ফুটল! বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে! পুরো পৃথিবী দু-ভাগ! বোমায় একের পর এক শহর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! মানুষ আকাশে দেখছে, অস্ত্রের আস্ফালন! যতটা না যুদ্ধ হচ্ছে জমিনে তার চেয়ে বেশি যুদ্ধ হচ্ছে আকাশে! যেদিন পরিবার ভেঙে যেতে লাগল। মা-বাবাকে ছেলেরা খেতে দিল না। বৃদ্ধ মা-বাবাকে ফেলে রেখে ছেলে আলাদা বাড়ি বানাল। ভাইয়ে-ভাইয়ে মিল থাকল না। মানুষ আত্মীয়-কুটুমকে চিনতে পারল না। সেদিন আমি বুঝতে পারলাম, পৃথিবী থেকে উঠোন উঠে গেছে! আর ঠাহর করলাম, উঠোন ফুরিয়ে যাওয়া মানে মা সেদিন আমাকে উঠোনের মাটি ফুরিয়ে যাওয়ার কথা বলেননি, তিনি মানুষের সঙ্গে মানুষের এই সম্পর্ক ফুরিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। আর এখন আকাশে শুধু অস্ত্রের বহর দেখে ঠাহর করছি, আকাশটাও ফুরিয়ে যেতে বসেছে। আর এসবকে হত্যা করছে, প্রযুক্তি! অর্থাৎ যে উন্নত পৃথিবীর কথা আমি মাকে গর্ব করে বলেছিলাম, সেই উন্নত পৃথিবী।
অনেকদিন পর মা আমাদের উঠোনে নামলেন। আমাদের সেই দীঘল উঠোনটা আর নেই। ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব লেগে সাত টুকরো হয়ে গেছে। প্রতি টুকরোর ওপর গড়ে উঠেছে বড় বড় বাড়ি। মায়ের হাতে লাঠি। মা এখন তিন-পেয়ে মানুষ। চোখেও কম দেখেন। চামড়াতে আরও থাবা বসিয়েছে বয়স। কথা বললে কথা জড়িয়ে যায়। মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আকাশে অত বু বু করে শব্দ হয় কেন রে নিয়াজ?”
আমি আঁকুপাঁকু করে বলি, “যুদ্ধ লেগেছে মা। ওসব যুদ্ধ বিমান আর মিশাইল ছোঁড়ার শব্দ।“
মা তখন তাঁর ঘোলা চোখ দিয়ে আকাশের দিকে তাকান, তারপর আমাকে দোষারোপ করে বলেন, “দেখলি তো, তোর গর্বের দুনিয়াটা আমার দুনিয়াটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।“