৫০০ জনকে ফর্সা হওয়ার ক্রিম গছানোর টার্গেট ছিল। ৫১৭ জন হল। কলারটা তুললাম। গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালার কেবিনের দরজায় দুবার টকটক করে দরজাটা আলতো করে খুললাম। গলার মধ্যে কে যেন অ্যাম্পলিফায়ার বসিয়ে দিয়েছিল। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। না হলে নিজের যে গলায় মিউধ্বনি শুনে এসেছি বরাবর, সেখানে সিংহনাদ মিশে গেল কেন! গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা আঙুল দিয়ে ইশারা করতেই সদর্পে ঢুকে গেলাম গর্ভমন্দিরে। মানে, বসের কেবিনে আর কি। জিরাফের মতো গলা উঁচু করে বললাম, “ডান স্যার। ডান ডানাডান ডান। টার্গেট অ্যাচিভড স্যার।” দালের মেহেদির মতো নাচতে ইচ্ছে করছিল। বোলো তা রা রা রা। ভেবেছিলাম ইউটিউবে দেখা ফাস্ট ফরোয়ার্ড মোশনে কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার মতো স্যারের মুখে এক লহমায় খেলে যাবে হাসি। হল না। উনি বললেন, “বসো। শুধু নাম্বার্স উইল প্রুভ নাথিং। গভীরে যেতে বলেছিলাম। গিয়েছো? শেড-এর স্কোরবোর্ডটা কই? তার অ্যানালিসিসটা কই?” এমন কথা শুনে মম আহ্লাদ ধূলায় হইল ধূলি। যত তারা ছিল আকাশে, সবই হয়ে গেল ফ্যাকাশে। দরজা খোলা পেয়ে সিংহ পালালো। সিংহনাদও। লেজ গুটিয়ে ফের বসে পড়ল বিড়ালছানা। মম কানের পাশে মিউ বলে ডেকে গেল কে! গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, এটিএম মেশিনের উপরে থাকা সিসি ক্যামেরা আপনার দিকে যেমন করে তাকায়, ঠিক তেমন। উনি ফের বললেন, “কই? শেড এর স্কোরবোর্ডটা কই?” এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, স্যার আমাকে মাসখানেক আগে এক বান্ডিল শেড-এর স্কোরবোর্ড দিয়েছিলেন। রাস্তা আটকে সরস্বতী কিংবা কালীপুজোর চাঁদা চাওয়ার সময় যে পেটমোটা বিলবই বের করে লোকাল দাদারা, শেড এর বইটা ঠিক ওরকম দেখতে। শুধু কাগজ একটু মোটা। তার উপরে তিরিশটা বৃত্ত আছে। প্রতিটা বৃত্তের মধ্যে রং পুরে দেওয়া আছে। বাঁদিক থেকে ডানদিকে রংগুলো ক্রমশ হাল্কা হচ্ছে। ফর্সা হওয়ার ক্রিমটা যেদিন মাখতে শুরু করা হল সেদিন ত্বকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে টিক মারতে হবে একটা সার্কেলে। এক সপ্তাহ ব্যবহার করার পরে, কতটা ফর্সা হলেন দেখে পরবর্তী বৃত্তে টিক মারতে হবে। আরও দুসপ্তাহ একই জিনিস করতে হবে। এই ক্রিমের সঙ্গে নাকি মিশে রয়েছে ২৩ দিনের চ্যালেঞ্জ। রংবদলের গ্যারান্টি। ক্রিমের বাক্সের মধ্যেও পুরে দেওয়া রয়েছে এমন একটি শেডকার্ড। লেখা রয়েছে, ‘২৩ দিন পরে আমাদের জানান ইমেলে। শেড কার্ডের ছবি তুলে ট্যাগ করুন আমাদের কোম্পানিকে। ভাগ্য ভাল থাকলে নায়িকার সঙ্গে দুবাইয়ে ডিনার। আপনার এই জিতে যাওয়ার ছবিতে উপচে পড়ুক ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রাম।’ গোরাচাঁদস্যার বলেছিলেন, “জিতে যাওয়ার পরে হাত ধরে জেতালো যে, তার কথা ভুলে যাওয়াই কলিযুগের নিয়ম।” বলেছিলেন, “কাস্টমারদের ঝাঁকিয়ে দিয়ে এই কথা পেট থেকে বের করে নিতে হবে। তাই শেড কার্ড।” আমি সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। এ শপিং মল, ও শপিং মল ঘুরে এই ক্রিমের বিক্রিবাটার খবর নেওয়া আমার কাজ। আমাদের কোম্পানির ক্রিমের নাম মুনলাইট। মানে জোছনা। কোম্পানি বড় চালাক। আগের নামের মধ্যে ফর্সা কথাটা মেশানো ছিল। চারদিকে কি সব হইহট্টগোল শুরু হল। বলা হল, ব্র্যান্ডের নামের মধ্যে ফর্সা কথা ব্যবহার করা চলবে না, চলবে না। নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুললেন, ফর্সা হওয়াই জীবনের একমাত্র মাপকাঠি নাকি? ফাঁপড়ে পড়ে প্রোডাক্টের নাম বিলকুল বদলে দিল কোম্পানি। জোছনা কথাটার মধ্যেই তো ঘাপটি মেরে থাকে দ্যুতি। কোম্পানি বলা শুরু করল, ‘জোছনা করেছে আড়ি, আসেনা আমার বাড়ি। তাহলে? লোককে বাড়ি আনতে গেলে আপনার মুখ থেকে জোছনা হারালে চলবে না।’ ব্যাস। ছোট্ট দুটো লাইনের মধ্যে সব কথা বলা হয়ে গেল। ঠিক কি না? এই তো চারদিক থেকে শুনতে পেলাম, ঠিক, ঠিক, ঠিক।
এই যে এতক্ষণ ধরে এত বকবক করলাম, এগুলোকে কোম্পানির ভাষায় বলে ডাউনলোড দেওয়া। মানে, আমি যে কচকচিগুলো শুনে এসেছি, সেগুলো অবিকলভাবে পরের লোকজনদের বলে দেওয়া। আনন্দ-হ্যালোজেনের তার কেটে যাওয়ার পরে স্যার আর আমার মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল তা অনেকটা এরকম।
-দেখি, শেড স্কোরকার্ডগুলো দেখি।
-টার্গেট তো অ্যাচিভ হয়ে গিয়েছে স্যার। আবার এই স্কোরকার্ড কেন?
-এজন্যই তুমি সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ আর আমি জেনারেল ম্যানেজার। বুঝেছো?
-বুঝেছি স্যার।
-বিক্রি মানে শুধু টার্গেট অ্যাচিভ করা নয়। প্রোডাক্টকে প্রথমে ভালবাসতে হবে। না হলে যতই চেষ্টা করো না কেন, দিনের শেষে বিক্রি শুধু নম্বর হয়ে থেকে যাবে। তোমার মুখে ওই ৫১৭-র মতো। বুঝেছো?
-বুঝেছি স্যার।
-প্রোডাক্টকে তুমি ভালবাসো?
-বাসি তো স্যার।
-আমার মতো ভালবাসো?
-চেষ্টা তো করি স্যার।
-হোপলেস।
-মানে স্যার?
-আমার নাম গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা আছে। নামের মধ্যে গোরা আছে, চাঁদও আছে। প্রডাক্টের নামটাও মুনলাইট আছে। তোমার নাম কি আছে?
-গোধূলি বন্দোপাধ্যায় স্যার। বাবা মা খুব শখ করে নাম রেখেছিল।
-গোড়াতেই তো গলদ আছে। এমন আন্ধেরাওয়ালা নাম নিয়ে তুমি কিভাবে বেচবে মুনলাইট, আই মিন, ফর্সা হওয়ার ক্রিম?
-টার্গেট তো হয়ে গিয়েছে স্যার।
-রাবিশ। বেঁচে থাকার সারশিক্ষা দিয়েছিলাম, গৌতম বুদ্ধের মতো, তোমাকে জয়েন করানোর প্রথম দিন। মনে আছে, নাকি সব ভুলে মেরে দিয়েছো?
-মনে আছে স্যার। আপনি বলেছিলেন, প্রতিটা কাজের পেট চিরে তিন ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। এক নম্বর, হোয়াট ইজ গোয়িং ওয়েল। মানে, কি কি ভাল হচ্ছে। দু নম্বর, হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার। মানে, কাজগুলোকে আরও কিভাবে ভাল করা যেত। আর তিন নম্বর হল, আরও ভাল করতে গেলে আমার অ্যাকশন প্ল্যান কি।
-রাইট। কি নাম দিয়েছিলাম এগুলোর?
-গোরা অমরকথা স্যার।
-রাইট। আর কি বলেছিলাম?
-বলেছিলেন, উল্কি করে এই তিনটে লাইন বুকে লিখে রাখতে। বলেছিলেন, হনুমান বুক চিরে দেওয়ার পরে যেমন রামসীতার ছবি দেখতে পেয়েছিল সবাই, আমার বুক চিরে ফেললেও যেন এই গোরা অমরকথা দেখে ফেলতে পারে এ বিশ্ব চরাচর।
-তুমি যে গরিলার মতো বুক বাজাতে বাজাতে আমার কেবিনে ঢুকেছিলে, সেটা শুধুমাত্র আমার প্রথম বাণীর উত্তর দিয়েছে। দু নম্বর আর তিন নম্বরের জবাব কই? কজন কাস্টমারের বাড়ি গিয়েছিলে ঠিকানা জোগাড় করে? ৫১৭টা এক হাজার হল না কেন? এক হাজার পিস ক্রিম বেচার জন্য তোমার পরিকল্পনা কি?
মনে আছে, গোরাচাদ ঝুনঝুনওয়ালার টেবিলে রাখা এক লিটারের জলের বোতল ঢকঢক করে মেরে দিয়েছিলাম আমি। ভরসা না পেয়ে সহসা আসা বর্ষার মতো ঘামছিলাম। এক সেকেন্ডের জন্য অবশেষে জেগে উঠেছিল শোষিত।
-একটা কথা বলব স্যার?
-স্পিক আউট। আমার টাইম নষ্ট করবে না। যা বলবে, সেন্সিবলি বলবে।
-৫১৭ টা ১০১৭ হলেও তো আপনি একই কথা বলতেন। বলতেন, সেটা দেড় হাজার হল না কেন? বলুন, বলতেন না? আপনার দুনম্বর বাণীটা তো ছোটগল্পের মতো। শেষ হয়ে হইল না শেষ। হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার। বেটারের কি শেষ আছে স্যার?
-তুমি আমার সঙ্গে ফাজলামি করতে এসেছো? এক ফুঁতে তোমায় ছবি করে দেবো, দেখবে? ডাকব আমি এইচআর কে?
-না স্যার। তার প্রয়োজন হবে না। শপিং মলে মুনলাইট বিল করতে দেখেই মোট ৬২ জন মহিলার কাছে গিয়ে হামলে পড়েছিলাম স্যার। বলেছিলাম, ম্যাডাম। ও ম্যাডাম। আপনার ফোন নম্বরটা দিন না। আমার আইকার্ডও দেখিয়েছিলাম।
-গুড। ম্যাডামরা কি বললেন?
-বললেন, কেন দেবো? আমি একটা শেড-এর স্কোরকার্ড হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, এক সপ্তাহ পরে ফোন করব ম্যাডাম। আমাকে জানতেই হবে হোয়াট ইজ গোয়িং ওয়েল আর হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার। বেশিরভাগ ম্যাডামই চোখ বড় বড় করে বললেন, মানে? আমি বললাম, সাত দিনে কতটা ফর্সা হলেন জানার জন্য ফোন করব ম্যাম।
-ম্যাডামরা কি বললেন?
-৬২ জনের মধ্যে আটজন থাপ্পড় মেরেছিলেন সপাটে। আমি দমিনি স্যার। ১৮জন ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। বাড়ির ঠিকানাও। এক ম্যাডাম তো বাড়িতে পৌঁছনোর পরে যাতা করলেন।
-অল দিজ আর গুড ইনিশিয়েটিভস। খরিদ্দারদের সঙ্গে এভাবেই ইনভলভমেন্ট বাড়ে। বাড়ে ব্র্যান্ড ইকুইটি। বাড়তে থাকে মাউথ মার্কেটিং। মুখে মুখে বিজ্ঞাপন। তা ওই ম্যাডাম কি করলেন?
-জিজ্ঞেস করলাম, সাত দিন ক্রিম ইউজ করে শেড মিলিয়েছেন, ম্যাম? শেড কিছু এগোলো? উনি বললেন, এটা জানার জন্য তুমি আমার বাড়ি উদয় হলে রাত সাড়ে নটায়? জল খাবে? আমি বললাম, খাবো। উনি এক গ্লাস জল নিয়ে এলেন। আমি ঢকঢক করে মেরে দিলাম। উনি বললেন, হ্যাপি? আমি বললাম, ইয়েস ম্যাম। উনি একটু এদিক ওদিক দেখলেন। তারপরেই আমার নাকে ঘুষি মারলেন। হাতে আংটি ছিল। আমার নাক ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। উনি স্কোরকার্ডটা নিয়ে এলেন। বললেন, দেখোতো! তোমার নাকের আগের কি শেড ছিল আর এখন কি হলো।
-ওহ মাই গড। বাট, এগুলো সবই ব্র্যান্ড ইকুয়িটির লক্ষণ। তুমি কি বললে, গোধূলি?
-আমি আয়নায় দেখে শেড কার্ড মেলালাম স্যার। লালের দিকে একটা শেড ছিল। ওটায় টিক মারলাম।
-গুড। তারপর কি হল?
-ম্যাডাম আমায় বললেন, এক মিনিটের মধ্যে বাড়ি থেকে না বেরোলে পুলিশ ডাকব। গেট আউট, ইউ রাস্কেল।
-তুমি কি বললে?
-বলার কিছু ছিল না স্যার।
গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা তাঁর পাশে রাখা প্রিন্টার থেকে একটা পাতা টেনে নিলেন। পাতার মাঝামাঝি লাইন টানলেন, লম্বালম্বিভাবে। বললেন, কামিং ব্যাক টু মাই ওল্ড পয়েন্ট। কি কি ভাল হল আর আরও কি ভাল হতে পারতো। হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার।
আপনাদের চুপিচুপি কয়েকটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সারাদিনের অফিস সামলে, এ শপিং মল, ও শপিং মল চক্কর কেটে, মহিলাদের বাড়ি গিয়ে আমার বাড়ি ফিরতে রাত হচ্ছিল খুব। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পার করে বারোটার দিকে এগোত। আমার বাহাত্তুরে বাবা, সারাজীবন কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি করা বাবা উতলা হতেন বড়। একদিন আর সামলাতে না পেরে গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালাকে ফোন করেছিলেন। দুজনের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল, অন্তত যেটুকু শুনেছি আমার পিতৃদেবের কাছ থেকে, তা অনেকটা এরকম।
-আমি গোধূলির বাবা কথা বলছি স্যার। আমি কি গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা স্যারের সঙ্গে কথা বলছি?
-হ্যাঁ, বলুন।
-গোধূলি এখনও বাড়ি ফেরেনি স্যার। সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো। আপনি কি জানেন, ও কোথায় আছে?
-গট ইট। আপনার হাতের কাছে কি একটা পেপার আর পেন আছে?
-আছে স্যার। কিন্তু ছেলে এখনও বাড়ি ফেরেনি।
-ওটাতেই আসছি। আপনি সাদা কাগজটা নিয়েছেন তো?
-নিয়েছি স্যার। ঘড়ির কাঁটা পৌনে বারোটা ছুঁইছুঁই।
-নট অ্যান ইস্যু। কাগজটায় তিনটে দাগ কাটুন। লম্বালম্বিভাবে। কেটেছেন?
-কেটেছি স্যার।
-বাঁদিকে লিখুন, হোয়াট ইজ গোয়িং ওয়েল। মানে, এই চাকরিটা করার ফলে গোধূলির জীবনে কি কি ভাল হচ্ছে। মাঝখানের কলামে লিখুন, কিভাবে আরও ভাল হতে পারতো। হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার। মানে তাড়াতাড়ি বাড়ি এলে ও কি কি বাড়তি কাজ করতে পারতো। এর মধ্যে অবশ্য ওয়ার্ক ফ্রম হোমটাই প্রধান। আর তৃতীয় কলামে লিখুন, আরও ভাল করার জন্য অ্যাকশন প্ল্যান কি। সবগুলোর একটা ওয়েটেড অ্যাভারেজ করুন। ফর্মুলা না জানলে গুগল থেকে দেখে নিন। তারপরে আমাকে একটা রিপোর্ট পাঠান।
-এগারোটা পঞ্চান্ন স্যার। গোধূলি এখনও বাড়ি ফেরেনি।
-দ্যাট ইজ নট ইমপরট্যান্ট। আগে আপনি এই ডেটাগুলো ভর্তি করে শেয়ার করুন আমার সঙ্গে। আমি ডেটা ছাড়া কথা বলি না। আরও একটা জিনিস আছে। আরও ভাল কি ভাবে হতে পারতো, তার একটা সাপোর্টিং শিট আছে। মানে, বিল্ডিং ব্লকস্ আর কি। ভাল বাড়ি বানানোর জন্য ভালো ইঁটের দরকার। ওটাও ভর্তি করে পাঠান আমায়। ডেটা ছাড়া কথা বলতে আমার সাফোকেটিং লাগে। মানে, দমবন্ধ আর কি। বুঝেছেন?
-বুঝেছি স্যার। বারোটা বেজে গেলো।
-বাজুক। আগে ডেটা। পরে কথা কেমন? গুড নাইট।
ফোনটা কেটে যায় সত্ত্বর।
রাত সোয়া বারোটার সময় বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন, আংটিওয়ালা হাতের ঘুষি খেয়ে। বললাম, “সব হারালাম, বাবা।” বাবা জিজ্ঞেস করল, “হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার?” আমি ফেলু, বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি, ফ্যালফ্যাল। ফের মুখ খুলল বাবা। “জলদি। গোরাচাঁদবাবু জানতে চেয়েছেন।”
আমি চুপ করে থাকি। আমার গা ভুরভুর করছিল ঘামের গন্ধে।
আমি চাকরির ওয়েবসাইটে, অ্যাপে ছিপ ফেললাম। আমার মাইনে অল্প। অনেক সাধ্যসাধনার পরে, মাসদেড়েক পরে, অন্য একটি সংস্থা থেকে অফার এলো। ওরাও ফর্সা হওয়ার ক্রিম বিক্রি করে। আমাদের প্রতিযোগী। ইন্টারভিউ ভালই দিলাম। অফার লেটার এলো। রেজিগনেশনের ইমেল করলাম গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালাকে।
বস্ আমায় পরের দিন ডেকে পাঠালেন।
-গোধূলি, তুমি কি চললে?
-ইয়েস স্যার।
-কি বললে? চললে?
-হ্যাঁ স্যার।
-বেটার অপরচুনিটি পেয়েছো?
-ইয়েস স্যার।
-রেজিগনেশনের ইমেলটা পেলাম। কিন্তু আমি সেটা অ্যাকসেপ্ট করবো না।
-কেন স্যার?
-একটা সাদা কাগজ নিয়ে এসো। সেটাকে লাইন টেনে তিনভাগে ভাগ করো। গোরাচাঁদ অমরবাণী মনে আছে তো?
-আলবাৎ স্যার।
-একদিকে লিখবে, কি কি ভাল চলছিল এখানে। পরের কলামে লিখবে, হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার। মানে, পরের কোম্পানির অফার লেটারের মাইনে। তারপরে লিখবে, এই মাইনেটা অ্যাচিভ করতে গেলে আমাদের কি কি করণীয়। বিল্ডিং ব্লকস্ কিংবা অ্যাকশন প্ল্যান।
-আমি মুক্তি পেতে চাই স্যার।
-এত সহজে মুক্তি আসে না । মুক্তি ইজ সাবজেক্ট টু হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার।
মম চিত্তে কে যেন নাচতে শুরু করে দিয়েছিল ভাংড়ার মতো, আমফানে দোলা ঝাউগাছের মতো। ব্যাঙের মতো লাফালাম। টেবিল টপকে গোরাচাঁদের সামনে হাজির হয়ে গেলাম। আমার কাঁধে তখন পেখম। চিবুকে হাত দিলাম। নাড়িয়ে দিলাম শিশুর মতো। বললাম, “এটা হল হোয়াট ইজ গোয়িং ওয়েল, স্যার।” এর পরে স্যারের দুদিকের ঝুলপি ধরে দুটো টান মারলাম। বললাম, “হোয়াট কুড হ্যাভ বিন বেটার স্যার।” থামলাম খানিক। তারপরে বললাম, “অ্যাকশান প্ল্যানটা আর নাই বা বললাম। একটা ফার্স্ট এইড বক্সে হবে না।”
আমার বুকে ধামসা মাদল।
গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা আমার দিকে চেয়ে থাকলেন মরা কাতলার মতো চোখ নিয়ে। আমি কলার তুলে কেবিন ছেড়ে বেরোই। বেরনোর আগে থামলাম খানিক। গোরাচাঁদ বললেন, “কিছু বলবে?” আমি বললাম, “বিল্ডিং ব্লকসটা বাকি থেকে গেল সার। প্রেজেন্ট করি?”
গোরাচাঁদ ঝুনঝুনওলা বললেন, “এক সেকেন্ড।” টেবিলের তলায় কি সব যেন খুঁজতে লাগলেন। পাঁচ-সাত সেকেন্ডের ব্যবধানে বেরিয়ে পড়ল একটা হেলমেট। স্যার সেটা পরে নিলেন অক্সিজেন সাপোর্টের মাস্কের মতো। মনে হল বললেন, “বাতাও।” মনে হল বললেন, “ডেটা ছাড়া আমি যেন মণিহারা ফণি।”
ধিতাং ধিতাং বোলে কে মাদলে তান --