সকালের আকাশে সোনালী আভা। শিউলি ফুলের গন্ধে ম’ম করছে চারদিক; হাওয়ায় এক অদ্ভুত আনন্দের সুর। বাংলার প্রকৃতিতে শরতের উদযাপন প্রায় শেষ হতে চলল, তবু যেন গ্রামের পরিমণ্ডলে উৎসবের ঢেউ বয়ে চলছে। মানুষজন ঘরগেরস্তির কাজে ফিরে গেছে, , কিন্তু চারদিকে আজও যেন একটা প্রাণময় স্ফূর্তি! ধূপ-ধুনোর গন্ধে মিশে আছে শারদোৎসবের আমেজ। আজকেই শেষ হয়েছে লক্ষ্মীপুজো কয়েকদিন পরেই কালীপুজো।
হেমন্ত ভট্টাচার্য ওর ছোট উঠোনের সিঁড়িতে বসে তাকিয়ে ছিল ধানক্ষেত থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসা কুয়াশার দিকে। এ বছর উৎসবের মরসুমটা ওর খুবই ভালো কাটল। পশ্চিমপাড়ার মোমবাতির কারখানায় বিশ্বকর্মা পুজো থেকে শুরু করে গ্রামের একমাত্র বারোয়ারি দুর্গাপুজো— কাছাকাছি প্রত্যেক বড় পুজোয় ওই ছিল পুরোহিত। পুজোয় ওর সুকণ্ঠে উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারণ, একাগ্রতা আর নিষ্ঠা প্রশংসা কুড়িয়েছে। আমদানিও হয়েছে ভাল। তবে এখন যেন সবকিছু শেষ হয়ে আসছে। গ্রামের কালীপুজোতেও ও ডাক পেয়েছে, কিন্তু ওর মনের ভেতরে কেমন যেন একটা অবসাদগ্রস্ত বিষণ্ণতা। পুজো শেষের এই সময়টা ওকে অতীতের দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
তিরিশে পা দিল ও, কিন্তু এখনও জীবনে থিতু হতে পারল কই! পড়াশোনায় মন ছিল, পরীক্ষায় ফলও খারাপ হত না। কিন্তু বাবা চলে গেলেন কৈশোরে, কলেজের পাট চোকানোর আগেই মা’ও অনন্তে পাড়ি দিলেন। ওর বাবা বসন্ত ছিলেন সাধারণ যজমানি বামুন। স্থায়িত্ব বলতে গ্রামের দক্ষিণাকালীর মন্দিরে নিত্যপূজার দায়িত্ব। আয় ছিল সামান্যই। অ্যাকাউটেন্সিতে অনার্স করে হেমন্ত একটা কাজও পেয়েছিল দুটো গ্রাম দূরে, একটা চটকলে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। প্রতিবেশিনী বছর পাঁচেকের ছোট অনিন্দিতার সাথে ওর মন দেওয়া নেওয়াও হয়ে গেছিল। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক, হঠাৎ কোত্থেকে একটা সংক্রামক ভাইরাস এসে সারা পৃথিবীর মত ওর জীবনটাকেও তোলপাড় করে দিল। অনিন্দিতার বাবা চলে গেলেন। হেমন্তর চটকলের চাকরিটাও লোপাট হয়ে গেল।
নিজের সংসারের হাল ধরতে অনিন্দিতা দূরের এক প্রাইমারী স্কুলে চাকরি নিল। কিন্তু হেমন্তর কপালে মজুরের চাকরি ছাড়া জুটল না কিছুই। বাবার খুব সাধ ছিল, ছেলে সংস্কৃততে উচ্চশিক্ষা নিয়ে পৌরোহিত্য করবে। এখন সেই সাধ হয়ত কিছুটা মিটেছে। অনিন্দিতার চাপে পড়ে আগের বছর হেমন্ত কয়েকটা বাড়িতে সরস্বতী পুজোও করেছে। তারপর থেকে স্থায়ী কাজ না থাকলেও টুকটাক আয় চালু আছে। আর এই বছর তো ওর অর্থাগম আশাতীত।
বেলা বাড়তে থাকলেও হেমন্ত হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসেই থাকে। ওর মন বর্তমান ও অতীতের মধ্যে দোল খায়। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় গ্রামের কালীপুজোর জন্যে ওকে ডাকা হয়েছে। আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কালী মন্দিরের পুজো, ওর বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই পুজোর সাথে। বাবা এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। মায়ের মুখে শোনা বাবার শেষ পুজোর সেই ঘটনা আজও ওর মনে গাঁথা। মা বলতেন, বাবা নাকি কালীমায়ের পুজো সেবার যথাযথভাবে করতে পারেননি, আর সেই অভিশাপে ওঁর জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার সময়। কালীপুজোর পরই, এক অজানা রোগে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার কয়েক মাসের মধ্যেই দেহাবসান হয়। মায়ের কান্নাভরা মুখে বারবার এই অভিশাপের গল্প শুনে বড় হয়েছে হেমন্ত।
আশেপাশের পাখিদের কিচিরমিচির হেমন্তকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। একে তো পুজোর মরসুম শেষ, হাতে আর কোনও বড় কাজ নেই। অন্যদিকে মায়ের কথাগুলো আজও হেমন্তের মনে একটা অমোঘ ভীতির সঞ্চার করে। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসা কালী মায়ের সেই অভিশাপের গল্প, বাবার মৃত্যু, মায়ের সতর্কবাণী মনে নিয়ে আসে একরাশ দ্বিধা। মা বারবার বলতেন, “কালীপুজো নিষ্ঠাভরে না করলে, দেবীর অভিশাপ নেমে আসবেই।”
চিন্তাসূত্রে ছেদ পড়ে, ফোন আসে অনিন্দিতার। হেমন্তর গলার স্বর যেন অন্যরকম শোনায়।
“কিসের চিন্তা করছ?” দরদ মাখানো গলায় অনিন্দিতার প্রশ্ন।
হেমন্ত এক নিঃশ্বাসে সবকিছু বলে। “এই কালীপুজোটা করব কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। বাবার চলে যাওয়ার পর মা বারবার বলতেন, মা কালীর পুজোতে কোনও ত্রুটি হলে পরিণাম মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু জানোই তো, এই কাজটা করলে আগামী বছর আমার জন্যে আরও বড় সুযোগ আসতে পারে।”
অনিন্দিতা মৃদু হাসে, “তাহলে ছেড়ে দাও। আমাদের জীবন শান্তিতেই কাটবে। কালীপুজো না করলে কি এমন ক্ষতি হবে?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমন্ত। “সবাই চাইছে বাবার পর আমিই পুজোটা করি। লোকজন খুব চাপ দিচ্ছে।”
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার মা’ও আজ বলছিল, তুমিই সঠিক উত্তরসূরি।”
একটু যেন উৎসাহ পেল হেমন্ত, “বাবাকে ছোটবেলায় বলতে শুনেছি, বহুকাল আগে আমাদের এখানে কার্তিক মাস ছিল বছরের শেষ মাস। নতুন বছর শুরু হত অগ্রহায়ণ দিয়ে; ‘অগ্র’ মানে আগে আর ‘হায়ণ’ মানে বছর। এই পুজোটা যদি ঠিকমতো করতে পারি, তবে আগামী বছর বড় পুজোর দায়িত্ব আসবে। আমাদের জীবন একটা নতুন মোড় নেবে। তুমি বুঝতে পারছ না অনিন্দিতা, এই সুযোগ একবার হাতছাড়া হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে যাবে।” অনিন্দিতা চুপ করে যায়। গত চার বছর রোজ দেখা হলেও ওদের বিয়েটা এখনও দানা বাঁধেনি।
অবশেষে কালীপুজোর দিনটা আসে। আয়োজন জমজমাট। সন্ধ্যের পর থেকেই গ্রামের মানুষের ভিড় বাড়ছে। বিশাল মণ্ডপে বাঘছালের মত কাপড় পরা কালীপ্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে, রক্তাভ চোখ আর মুণ্ডমালা নিয়ে সাক্ষাৎ রুদ্রাণী। মন্ত্রপাঠের ধ্বনিতে, ধুনোর ধোঁয়ার আড়ালে ভয় আর রহস্য মিশে যায়। হেমন্ত পূর্ণ একাগ্রতা নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করে, প্রতিটা শব্দ যেন দেবীর কানে পৌঁছয়। মনে পড়ে বাবার কথা —“কালীপূজো শুধুমাত্র পুজো নয়, এটা ভক্তির অর্ঘ্য। এখানে কোনোরকম ত্রুটি মার্জনা হয় না।” মনের সেই চাপা ভয়কে দমিয়ে রেখেও আরও মনোযোগী হয়ে উঠে। কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে, অন্তরের গভীরে এক প্রবল শঙ্কা। দেবীর কৃপা না পেলে কী হবে? রাত্রি গভীর হয়। পুজো যখন শেষ পর্যায়ে, আচমকা একটা বিষয় ওর মনকে গ্রাস করে। ওর ঠাকুর্দা শরতের মৃত্যু হয়েছিল দুর্গাপুজোর দশমীতে। অর্থাৎ শরতকালে। বাবা চলে যান সরস্বতী পুজোর পরের দিন, বসন্তে। মনে একটা কনকনে শীতল বাতাসের মতো ভয় এসে ঢোকে। সম্বিৎ ফিরলে ও বুঝতে পারে যে পুজোর কয়েকটা আচার বাদ পড়ে গেছে ইতিমধ্যে।
প্রায় ভোরবেলা গ্রামবাসীরা ওর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে মন্দির ছাড়ে। সব কাজ শেষ হলে, হেমন্ত আরেকবার দেবীমূর্তির দিকে তাকায়। মায়ের কাছে প্রার্থনা করে পুনর্জন্মের; যেন এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় তার। বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে একটা সন্তুষ্টির অনুভূতি জাগে মনে। পরীক্ষায় ও উত্তীর্ণ! মনের সেই দ্বিধা আর ভয় যেন এ বার মুছে গেছে। ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে এসে ঢোকে, — ক্লান্তি ওকে গভীর ঘুমের মধ্যে টেনে নেয়। মনে একটাই আশা আগামী বছর আরও বড় পুজোর দায়িত্ব পাবে, , খ্যাতি আরও বাড়বে, আর্থিক অবস্থা আরও জোরদার হবে। ঘরের পুবদিকের জানলা বন্ধ করা হয়নি। সূর্যের আলো প্রবেশ করে ধীরে ধীরে। ওর বুক থেকে একটা ব্যথা উঠে ছড়িয়ে যেতে থাকে ঘাড়েচোয়ালে, হাতে, পিঠে সর্বত্র। নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে। সিলিং ফ্যানের হাওয়া ওর শরীরের ঘামকে বাগে আনতে পারে না। হাত বাড়িয়ে ও ফোন করতে যায় অনিন্দিতা’কে। সুইচড্ অফ। মাথাটা এবার আস্তে আস্তে হাল্কা হয়ে যেতে থাকে। ওর অস্তিত্ব ক্রমশ আত্মসমর্পণ করে মিশে যেতে থাকে হেমন্তের হিমেল হাওয়ায়।