হেমন্তকাল, চন্দননগর আর জগদ্ধাত্রীর সংসার

শীতের আমেজর শুরুয়াত বাংলার বুকে যেন জানান দিয়ে যায় জগদ্ধাত্রী পুজো। হেমন্তলক্ষ্মীর আগমণের এক অসাধারণ আভাসবার্তা। আঞ্চলিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এই পুজো এখন বাংলার আনাচা-কানাচে একাংশের বাঙালির হৃদয়রক্তরাগে রাঙা হয়ে উঠেছে -

 

 

 

জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই শীত আসছে! কার্তিকের রাতে ঠাকুর দেখতে বেরোলে আশির দশকের শেষ অবধিও চন্দননগরে সোয়েটার লাগত। জগদ্ধাত্রী পুজো চন্দননগর ছাড়াও পাশের ভদ্রেশ্বর, মানকুন্ডুতেও কম হয় না। আর মফঃস্বলের হেমন্তকাল মানেই তো প্রায় শীত! মানকুন্ডু স্টেশনের কিছুকাল আগেও স্থানীয় নাম ছিল হিমকুন্ডু। চন্দননগর আর মানকুণ্ডু রেল লাইনের পাশেই প্রচুর গাছ, আমবাগান। শহরেও তখন অনেক গাছ, পুকুর, খোলা মাঠ। হেমন্তের রাতের শিরশিরে হাওয়া গায়ে মেখে ঠাকুর দেখা হত। হালকা চাদর, টুপি, মাফলার সঙ্গে থাকত প্রায় সবার।

 

 

  

চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী ঠাকুর দেখতে প্রচুর মানুষ আসেন, কিন্তু সবাই থাকেন কোথায়? ভাইফোঁটার পর থেকেই চন্দননগরে প্রায় সকলের বাড়িতে অতিথি আসার ঢল নেমে যায়। এখন অবিশ্যি একটু মেপে চেপে চলা জীবন এসে হাজির হয়েছে, যৌথ পরিবার প্রায় নেই, বাড়ি কমছে, ছোট ছোট  ফ্ল্যাট বাড়ছে। আগে লোকে অত বলে কয়ে আসত না। এই হয়ত কল্যাণী থেকে মেজমামা এল, সঙ্গে মামী, দিদি, দাদা আবার পাড়ার দুই বন্ধু পরিবার আর তাঁদের ছানা। আসানসোল থেকে মাসতুতো এক দাদা তাঁর ইসিএলের প্রায় পুরো অফিসের বন্ধুদের নিয়েই হাজির হলেন। বর্ধমান থেকে পাশের বাড়ি এক দল মানুষ এলেন, বাড়ির ছোট মেয়ের শ্বশুড়বাড়ির সবাই। শোয়ার জায়গা নেই তো কী, পাড়াতেই এর ওর ঘরে ঠিক জায়গা হয়ে যাবে। শীত কমবেশি যেমনই থাকুক, লেপ, কম্বল, বালিশ, তোষক সব জোগাড় হয়ে যাবে ঠিক। 

 

 

 

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী মানেই আসলে পাড়ায় পাড়ায় দল বেঁধে পুজো করার ইতিহাস। সব পুজোই পাড়ার পুজো। মাত্র উনিশ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় দুশোখানা পুজো হয়। উত্তরের বিবিরহাট থেকে দক্ষিণের বারাসাত, আরও এগিয়ে ভদ্রেশ্বর ছুঁয়ে ফেলেছে বহুদিন। বারোয়ারি পুজোয় বেশ কয়েকটি দেড়শো, দুশো বছর পার করা। চন্দননগরের বারোয়ারি পুজোর নামগুলোতেই তো কত এলাকার কথা লুকিয়ে আছে। চাউলপট্টি, কাপড়েপট্টি যেমন ব্যবসায়ীদের পুজো। বাগবাজার, বড়বাজার, ফটকগোড়া, পালপাড়া, হালদারপাড়া এমন সব এলাকার পুজোর পাশে হরিজনপল্লী বা মেথরপট্টির পুজো। আবার হলদেডাঙ্গা, দিনেমারডাঙ্গা, মহাডাঙ্গা নামের ঔপনিবেশিক কলোনির সঙ্গে হেলাপুকুর, কলুপুকুর, হরেরপুকুর এমন বেশ কিছু প্রাচীন পুকুর ঘেরা পাড়ার পুজো। একজন জগদ্ধাত্রী দেখতে এসে আমায় বলেছিলেন, “বেশ ইন্টারেস্টিং নাম এখানকার বারোয়ারীগুলোর - বিদ্যালঙ্কার, হেলাপুকুর, ডুপ্লেপট্টি, বেশোহাটা, হাটখোলা….এরা প্যান্ডেলে এই সব নামের ইতিহাস লিখে রাখতে পারে তো একটু।” কিন্তু ইতিহাস জানার আগ্রহ আর কটা মানুষের থাকে! লোকে আসে ঠাকুর দেখতে, টুনি লাইটের কারিকুরি দেখতে। এখন টুনি পাল্টে গিয়ে এলইডি হয়েছে। প্যান্ডেল কিছু নতুন হয়, কিছু আসে অন্য জায়গার দুর্গাপূজার খোলা স্ট্রাকচার। এই নিয়ে প্রতি বছর সোশ্যাল মিডিয়ায় দুঃখ করেন কিছু মানুষ। পুজোর উদ্যোক্তারা বলেন, টাকা কোথায় অত? আর দুর্গাপুজোর আগে প্যান্ডেলের বায়না  দিলেও জগদ্ধাত্রী তো শেষেই হবে! এক্সক্লুসিভ না হলেও, সব প্যান্ডেল তো আর লোকে দুর্গাপুজোয় দেখতে পারেনা, আর একবার হলে ক্ষতি কী

 

 

এক মাসি বলতেন, “আমি আসি মূর্তি দেখতে। মাথা উঁচু করে অমন সুন্দর মূর্তি দেখার পর আর কিছু না দেখলেও চলে।” জগদ্ধাত্রী প্রতিমার এই রূপ, এই সাজটাই কিন্তু চন্দননগরের সব থেকে বড় আকর্ষণ। সেই দুর্গাপুজোর দশমীতে বা লক্ষ্মীপুজোর দিন প্রতিটা বারোয়ারিতে স্থায়ী কাঠামোর পুজো দিয়ে মূর্তি গড়া শুরু, তারপর একে একে প্যান্ডেলই হয় খড় বাঁধা, এক মেটে, দু মেটে, রঙ, চক্ষু দান, সাজ সজ্জা। ঠাকুমা বলতেন, “জগদ্ধাত্রী নিজে এসে এখানে বসে পড়ে বুঝলি। যা তো দেখে আয় গলার পাশে সাপ উঁকি মারছে কিনা!” এই ঠাকুর হয়ে ওঠা দেখতেই সারাদিন হাঁ করে প্যান্ডেলে বসে থাকা কচি কাঁচাদের। সদ্য গোঁফ গজানো কিশোরের ঠাকুর গড়া দেখতে গিয়ে অন্য কিশোরীর চোখ খুঁজে নেওয়ার গল্পও ছিল! প্যান্ডেল প্রেম, নতুন আর কী? জগদ্ধাত্রী এত বড়, তাঁর নীচে ভালবাসার আয়োজন তো থাকবেই! প্রথমবার আসা বেশ কিছু মানুষ জিজ্ঞাসা করেন এখনও, সব ঠাকুরের গায়ে এত গয়না! এগুলো সত্যিকারের নাকি নকল? মাথা উঁচু করে দেখার জন্য উচ্চতম ঠাকুর করার একটা রেষারেষি আছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থিম গান করেছে এক বারোয়ারী দেখুন মাথা উঁচু করে!” 

 

  

আমার কাকু দুর্গাপুর থেকে জগদ্ধাত্রী পুজোয় যখনই আসতেন, স্টেশন থেকে নেমেই শুরু হত মিষ্টি খোঁজা। সূর্য মোদক, বাবা পঞ্চানন, মৃত্যুঞ্জয় আরও কত চমৎকার সব দোকান। এই তো মতিচুর, ক্ষীরপুলি, এই তো লট চমচম (কেউ বলে লর্ড চমচম), আতা ছাপ কড়া পাক দেখি কিছু -ওহ নলেন গুড় এসে গেছে! তালে দাও দিকি মাখা সন্দেশ! জলভরা? পুজোর সময় শুনেছি জল কম থাকে? ওহ এটা স্পেশাল!, চন্দননগর এলাম জলভরা তো একটু খেতেই হয়” সকালে তেমাথার মোড়ে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে কচুরি আর মালপো কিনে এনে হাঁক পেরে সবাইকে তুলতেন কাকু। ওঠ ওঠ। লাইন দিয়ে নিয়ে এলাম।” সকাল থেকে সেই শুরু খাওয়া দাওয়া। বিরিয়ানি, পিৎজা, ফ্রায়েড চিকেন তখনও জাঁকিয়ে বসেনি বাঙালির জিভে। গঙ্গার ধারে চার্চের পেছনে বলাইদার ফিস ফ্রাই, পকোড়া, আর কাটলেট তখন সবে বিখ্যাত হতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে ফুচকা, ঝালমুড়ি, ঘটি গরমের অপূর্ব কম্বিনেশন। নেপালের মোগলাই, লক্ষীদার এগরোল ছাড়াও পুজো প্যান্ডেলগুলোর বাইরে অস্থায়ী স্টলে গুড় কাঠি, বুড়ির চুল আর অবশ্যই বরফ পান খেতেই হত। নবমী পুজোতে প্রায় সব বারোয়ারীতে বিনি পয়সায় ভোগ পাওয়া যায়। পাশের বাড়ির বন্ধুর এক কলেজ পড়া দাদা বলেছিল, “তোদের চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী ঠাকুর দেখতে গিয়ে সব প্যান্ডেলেই দেখি ভোগ দিচ্ছে। চার জায়গায় খিচুড়ি খেলাম, এক জায়গায় চাটনি, পায়েসও দিল। আর এক জায়গায় বোঁদেকী দারুণ জায়গা রে, ঠাকুর দেখার সঙ্গে খাওয়া ফ্রি!

 

  

চারদিনের পুজো দশমী পেরোলেই শেষ। দশমীর রাতের বিখ্যাত শোভাযাত্রা দেখতেও অনেক লোক আসেন। সবার তো আর চেনা পরিচিত বাড়ি নেই, তাই হেঁটে, রাস্তার ধারে কাগজ পেতেই বসে পড়েন অনেকেই। এখন অবশ্য শোভাযাত্রা দেখার সিট ভাড়া পাওয়া যায়। মথুরাপুর থেকে চন্দ্রপুলি, নলেন গুড়, জয়নগরের মোয়া বেচতে আসত সনাতন রাজ। মা আর ঠাকুমার স্নেহের সনাতন মাটির হাঁড়ি নামিয়ে, প্রণাম করে মিষ্টি দিয়ে টাকা নিতে চাইত না পুজোর সময়। 

সারা বছর বিক্রি করি মা, এইটা আমি আপনাকে দিলাম।” 

ঠাকুমা বলতেন, “তোমার বউ ছেলে মেয়েকে নিয়ে এস জগদ্ধাত্রী পুজোয়।” 

একবার সনাতন জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় এসে হাজির, সঙ্গে ঘোমটা দেওয়া বউ, হাফ প্যান্ট পরা ছেলে আর পুচকি দুই মেয়ে। বাড়ির সব আত্মীয় স্বজনের মধ্যে তাদেরও ঠিক জায়গা হয়ে গেল। ওর ছেলে মেয়েগুলো পাকা বাড়ি, সাদা কালো টিভি আর শহুরে মানুষ জন দেখে প্রথমে ভয় পেলেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেল। সনাতন চলে গেল হাঁড়ি মাথায় মিষ্টি বিক্রি করতে, ওর বউ রান্নাঘরে দিব্যি কুটনো কুটতে বসে গেল মা, পিসীদের সঙ্গে। লোক যতই আসুক সবার জন্য রান্না হবে,খাওয়া হবে, তারপর তো ঠাকুর দেখা! 

ঠাকুমা বলল, “জগদ্ধাত্রীর অনেক বড় সংসার বুঝলে, কখন কাকে পাঠিয়ে দেয়..।” 

দূর পাড়াতে তখন ঢাকের বোল, সঙ্গে ডুলি, সানাই আর কাঁসর বাজছে। পুজোর আরতি শুরু হল। 

….………

  • অয়ন ভট্টাচার্য 
img
আগের পাতা
পটলচরিতনামা