পটলচরিতনামা

বাঙালির রসনাতৃপ্তি ঘিরে আগ্রহ কেবল ভারতবাসী কেন, গোটা বিশ্ববাসীর। বাঙালির তথা বাংলার রসনা ঘিরে মীর মোশাররফ হোসেন থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে সুফিয়া কামাল কে না কলম ধরেছেন। সেই কলমেই একটা নতুন সংযোজন-

 

 

জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে/তিন বিধাতা নিয়েযদি জীবনের চরম ও অমোঘ সত্য হয়, ভোজনপ্রিয়, রসিক বাঙালির জীবনে কোন খাদ্যবস্তুটি অবিচ্ছেদ্য হয়ে জুড়ে আছে? এক নিঃশ্বাসে যে উত্তরটি বেরিয়ে আসে তা হল মৎস্য’- মাছ। কিন্তু এ হেন মাছে ভাতে বাঙালির জীবনে তস্য পুষ্টি, প্রোটিন এর পর ভিটামিন, মিনারেল নিয়ে যে সব্জি দ্বিতীয় তালিকায় স্থান জুড়ে আছে, তা কিন্তু পটল। আলু, ডাঁটা, ভেন্ডি, বেগুন মায় টমেটো নিয়ে আমাদের যত গদগদ মাখামাখিই থাক, ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও তৎসহ প্রসঙ্গ কিন্তু বলছে জন্ম, মৃত্যু, বিয়েতে বাঙালির জ্বলজ্বলে জীবনে টলটলে হয়ে ঢুকে পড়েছে পটল। পটলনামার ম্যাপটি যদি বাঙালির জীবনকথার ভূগোলে একটু ঠিকঠাক চিহ্নিত করতে পারি, অনেক পুরাণ-এর পাশে পটলপুরাণও স্বচ্ছন্দে লেখা হতেই পারে। 

 

 

অমরকোষ টীকা’-য় পটলকে তৃনাদিবেষ্টিত চালের ছাঁচ বা প্রান্তের মতো আকার জাতীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। লক্ষ করে দেখবেন, চালের যে ক্ষুদ্র আকার তার সঙ্গে কিন্তু পটলের মিলটি চোখে পড়ার মতো। জন্মের পরে আমাদের মুখে যে ভাত দেওয়া হয়, আভিধানিক অর্থে ধরলে পটলের আকার মুখে তুলে দিয়েই আমরা ভোজনের পৃথিবীতে নবজাতককে স্বাগত জানাই। বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর প্রণেতা শ্রদ্ধেয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু নিজের অভিধানে অমরকোষ টীকার এই রেফারেন্সটি গ্রহণ করেছেন। 

 

 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পটলকে দেশি শব্দ হিসাবে চিহ্নিত করে আচ্ছাদন, চোখের পাতা, বাক্স, পরিচ্ছদ, তিলক, রাশি, ফল শাকবিশেষ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। প্রাকৃত সংস্কৃতে রচিত রঘুবংশ’-এ পটলকে বলা হয়েছে ক্ষৌদ্রযার আভিধানিক অর্থটি বাংলায় খুঁজে বসিয়েছিলেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই- রাশি। শিবরতন মিত্র সম্পাদিত ও লিখিত রামায়ণের সীতার বনবাসপর্বে সীতার রাম ও লক্ষণ এর সঙ্গে বনবাস সম্পর্কে যে অভিধায় লেখক সূচিত করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা হল, ‘জলধর পটলসংযোগে। কথাটির চলতি বাংলা হল, প্রিয় পরিজন পরিবৃত হয়ে। এখন যে পটল প্রিয়জনের সংজ্ঞা দেয়, পরিভাষিত করে, তাকে ছেড়ে বাস্তবিক জীবন কাটাই কী করে। বসুমতীপত্রিকায় একসময় খুব ছোট করে প্রকাশ পেত অমৃতগ্রন্থাবলী’, যাতে বৃদ্ধ স্বামীর অচিরে মৃত্যু প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল - এদিকে গৌরীর গৌর পটল তুলেছে।’ 

 

 

যে-চর্যাপদে খাদ্যতালিকায় তেঁতুল, মধু, লাউ, হরিণের মাংস, ভাত, মাছ-এর উল্লেখ, সেখানে পটলের উল্লেখ নেই। ঘটা করে পটল-ব্যঞ্জনের উল্লেখ করেছেন মধ্যযুগের মধ্যপর্বে কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতগ্রন্থেও বাঙালির পটলবিলাসের বেশ ঘটা করে বর্ণনা দিয়েছেন। চৈতন্যদেবের মা ওঁকে যে কুড়ি রকমের শাক রান্না করে খাইয়েছিলেন তার মধ্যে পটলের বিচিত্র পদও ছিল,- ‘সাদ্রক বাস্ততক-শাক বিবিধ প্রকার। পটোল কুষ্মাণ্ড বড়ি মানচাকি আর/ দই মরীচ সুক্ত দিয়ে সব ফলমূলে/ অমৃতনিন্দক পঞ্চবিধ তিক্ত ঝালে/ কোমল নিম্বপত্র সহ ভাজা বার্তাকী/ পটোল ফুল বড়ি ভাজা কুষ্মাণ্ড মানচাকী। তবে পদের সবটাই কিন্তু নিরামিষ। একটা সিদ্ধান্ত জোর গলায় নেওয়াই যায়, পটল কিন্তু বাঙালির পাতে অন্তত আলুর পূর্বপুরুষ। অন্তত মধ্যযুগের বাঙালির সামাজিক সাহিত্যের ইতিহাস-ধারা তাই বলছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ যখন বাঙালির ক্রমশ মাথায় চড়ছে, মধ্যযুগ শেষপাদে, তখনও ব্রাহ্মণের পাতে অন্তত নিমন্ত্রিত হিসাবে আলুর প্রবেশাধিকার ছিল না। শংকর সযত্নে জানিয়েছেন, ‘কলকাতার নিমন্ত্রণ বাড়িতে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণেরা লুচি, চিনি অথবা সন্দেশ স্পর্শ করতেন না। পরবর্তীকালে এঁদের প্রধান আহার লুচি ও ছক্কা, এই ছক্কার উপাদান বিলিতি কুমড়ো, পটল এবং ভিজে মটর। নুন অবশ্যই থাকত না, নুন দেওয়া হত পাতে, কারণ নুন সংযোগ হলেই খাবার হয়ে উঠত উৎকৃষ্ট।’ 

 

 

আশ্চর্যের কথা, বাঙালির জীবনে যে বিভিন্ন সংস্কার-কুসংস্কার-বিধিনিষেধ তৈরি হয়েছিল, তাতে বেশ ঘটা করেই জায়গা করে নিয়েছিল পটল। যে বিধিনিষেধ মতে তৃতীয়ায় পটল খেলে নাকি শত্রুবৃদ্ধি হয়। তবে এটা সত্যিই এই যে পাতের এক কোণে নুন পড়ত, তার সঙ্গে সব্জির সংযোগে স্বাদ কোরকের যে সন্ধি-মিলন-বিস্ফোরণ ঘটল, বাঙালির নিরামিষ তরকারির বিবর্তনের মূল সূত্র সেখানেই লুকিয়ে। পটল তোলাবা পটল পদ কতটা স্বাদবাচ্য হবে সে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় আসব। তার আগে বলি, বাংলা সাহিত্য ও কাব্য কিন্তু বেশ পটলবহুল। এবং যে কবিতা পটলের মহিমা অন্তত বাংলা সংস্কৃতিতে বেশ ঘটা করে বাড়িয়েছে, সেটি কিন্তু মহান সাহিত্যিক, কবি, ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা –‘পটল নামে লোক ভালো/ পটল চেরা চোখ ভালো/ পটল খেতে ভালো যে/ কিন্তু পটল তুলবে কে’ -এ যেন রসিক বাঙালিকে এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ ছোড়া। খাদ্যপ্রিয়, প্রেমিক বাঙালি, সে এমনকী পটল নাম নিতে পারে নিজের, কিন্তু আত্মত্যাগে?- নৈব নৈব চ। 

 

 

পটলের দোলমা নিরামিষ ভাল না কি আমিষ, অথবা পিঁয়াজ তাতে চলবে কি না, সে নিয়ে ঘটি-বাঙালের শত তর্কের মাঝেও সুকুমার রায়ের পটল কিন্তু কেন জানি না একটু ঘটিঘেঁষা মনে হয়। বাড়ির ধারায় ময়মনসিংহের ছোঁয়া তাতে খুব বেশি আছে কি – ‘পোলাও ভালো কোর্মা ভালো,/ মাছ-পটোলের দোলমা ভালো/ ঠেলার গাড়ি ঠেলতে ভালো,/ খাস্তা লুচি বেলতে ভালো।’ অন্তত খাদ্যের পথ হিসাবে যখন পটলকে ধরি, দুই কবির কলমেই বেশ মুগ্ধতা। কাব্যপ্রাণ আর খাদ্যপ্রাণদুজনের কারোরই পটলকে এড়িয়ে  যাবার  সাধ্য  নেই। 

 

 

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে পটল, ব্যাকরণ ও নারীর রূপসৌন্দর্য উচ্চমার্গীয় সাহিত্যকলায় মিশে গেছে। দুর্গেশনন্দিনীলেখার সময় বঙ্কিমের বয়স সাকুল্যে সাতাশ, গা থেকে কালেজের গন্ধ যায়নি। উপন্যাসের দ্বাদশ পরিচ্ছেদে, ‘আশমাণির অভিসার’ -এ বঙ্কিম আশমাণির রূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে সে সুন্দরীকে বিশাল রসাল দীর্ঘ সমাস পটল সৃষ্টিকারিণীরূপে দেখিয়েছিলেন। পটল-সমাস, বেগুনসন্ধি ও কাঁচকলার চড়চড়ির সংমিশ্রণ করে সে সুন্দরকে ভোগ দেবার অঙ্গীকার করেছিলেন। সমাসকে ব্যাকরণে কেউ সহজ বলবেন না নিশ্চই। পটল আর সমাসকে মিশিয়ে নারীর রূপের কথা বলতে গিয়ে পটলকে কি তিনি উচ্চবর্গীয় রাখতে চেয়েছিলেন? আমরা জানি না। আন্দাজ করি মাত্র। অবশ্য ঊনবিংশ শতকে পটলকে সবাই যে বঙ্কিমের মতো রোমান্টিসাইজ করেছেন এমন নয়। শরৎকুমারী চৌধুরানীর শুভবিবাহউল্টেপাল্টে দেখলে পটল প্রসঙ্গে অবশ্যই একটি জায়গায় স্থির হতে হয়। যে-সমস্ত কাজের লোক বা মহিলা বিয়েবাড়িতে তত্ত্ব এনেছেন, তাঁদের বাড়ির মেয়েরা আহারে বসাচ্ছে বেশ যত্ন করে। আর পাচক ব্রাহ্মণরা পরিবেশন করছেন, ‘লুচি, কচুরি, পাঁপড়ভাজা, পটলভাজা, বেগুনভাজা, ছোকা, ছোলার ডাল আর চাটনি।শরৎকুমারী যজ্ঞিবাড়ির মূল যে মেনুটি পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তাতে ভাজার তালিকায় একেবারে জ্বলজ্বল করছে পটল। 

 

 

পুরনো কলকাতা প্রসঙ্গে, বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দী সম্পর্কে বেশ পরিষ্কার ছবি স্বামী বিবেকানন্দের মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় উঠে আসে। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমরা যখন পাঁচ-ছ বৎসরের তখন এইরূপ প্রচলিত ছিল, যথা বড় বড় লুচি, বিলাতি কুমড়া, পটল, মটর ভিজা দিয়ে ছক্কা হইত।বোঝা যাচ্ছে তরকারির যে মিশ্রণ তাতে পটলের চাহিদা ক্রমশ বেড়েছে। তবে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও নুন তরকারিতে সরাসরি যোগ করা হত না। দেওয়া হত পাতের এক কোণে। মিশ্র স্বাদের সব্জির বড়সড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চরমে ওঠে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে। সব্জির দামের বাড়াকমা শুরু হয় সেইসময় থেকেই। ফলে বিভিন্ন রকমের সব্জি খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। 

 

 

 

মোটামুটি শখানেক বছর আগের বিবাহের একটি মেনুকার্ড ধন্য বাগবাজারগ্রন্থে ছাপা হয়েছে। পাত্র প্রভাতকুমার ঘোষ, পাত্রী ঠনঠনের দেব বংশের রমাদেবী। মোট ১১২ পদ খানা ও পিনা। তাতে একুশ নম্বরে গর্বিত চাউনি নিয়ে বিরাজ করছে পটলের দোলমা। পটলকে ঝাঁ-ঝকঝকে তরকারিতে রূপান্তরের প্রথম বাণিজ্যিক প্রয়াস কিনা জানা নেই। কিন্তু মেনুকার্ডে ঝুরঝুরে আলুভাজাআর আলুর পাঁপড়থাকলেও কোথাও আলুর তরকারির কোনও উল্লেখ নেই। আমরা পটলের যে তরকারির ফর্ম তার গ্রহণযোগ্যতার বয়স সহজেই এখান থেকে অনুমান করে নিতে পারি। যেহেতু সে ক্যাটারিং-এর দায়িত্বে ছিল বিজলি গ্রিল, তারা নিশ্চই মানুষের গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষা না করে পটলের দোলমা নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানোর সাহস করেননি। 

 

 

অন্তত দুটি ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের নীরবতা আমাকে অবাক করে। নিজের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও সব্জি হিসাবে পটল। বিশেষত যে দ্বারকানাথকে ফরাসীরাজ স্বয়ং রাজা লুই ফিলিপ ভার্সাই প্রাসাদে অভ্যর্থনা করেছেন, দেদার ভোজ খাইয়েছেন, যার কথা নীরদ চৌধুরী মহাশয় ম্যাক্সমুলরের জীবনীগ্রন্থ লিখতে গিয়ে সগর্বে বলেছিলেন। এমন মানুষটি সম্পর্কে নিজে ভোজনরসিক হয়েও রবীন্দ্রনাথ সবিশেষ মন্তব্য করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ এলমহার্স্ট শ্রীনিকেতনে যোগ দিয়ে সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিলেন কৃষিস্নাতক কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ, বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদার এবং জামাতা নগেন গঙ্গোপাধ্যায়কে। তাঁদের প্রচেষ্টাতেই কৃষ্টির পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রেও বিপ্লব রচনা করে শ্রীনিকেতন। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, আখ, সয়াবীন, জোয়ার, কলাই, বিট, গাজর, ফুলকপি, টম্যাটো, ঝিঙে, পেঁপে, কলা, পেয়ারা, আনারস, আম, লেবু, কুল এমনকী গো খাদ্য হিসাবে নেপিয়ার ও গিনি ঘাসেরও চাষ করা হত। এই গোটা তালিকায় লক্ষ করে দেখুন অদ্ভুতভাবে পটল কিন্তু অনুপস্থিত। তাঁর কাব্যে উপেক্ষিতার মতোই উপেক্ষিত ছিল পটল। জীবনের সঙ্গে নামজনিত বৈরিতার কারণেই পটল কবির স্নেহস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকল কি না, তা অবশ্য কোনও রবীন্দ্রগবেষকই নিশ্চিত করতে পারবেন। 

 

 

কথাসাহিত্যে পটল-এর সঙ্গে যাঁর ওতপ্রোত সম্পর্ক তিনি নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধেয় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। কুবেরের বিষয় আশয়’, ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’, ‘হাওয়া গাড়ি’ -সব্জির প্রতি ওঁর প্রেম, মায়ামমতা অবিশ্বাস্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ওঁর সৃষ্টিকে, যাতে থরে থরে সাজানো ঝিঙে, পটল, আলু, ঢ্যাঁড়স, পুঁই, লাউ এমনকী কুমড়ো ফুল। মন দিয়ে পড়লে ও তুলনা টানলে আমার অন্তত মনে হয় সব্জির কথায় শ্যামল বিভূতিভূষণের থেকেও এগিয়ে। 

 

 

এ বার কলকাতা তথা বাঙালির জীবনে পটল পদের বাণিজ্যিকিকরণের দু-চার কথা শোনাই। নিজের ঠাকুমাকে হারিয়ে একবিংশ শতকের গোড়ায় খিদিরপুরের ইয়ংবেঙ্গলহোটেলে পটলের দোলমা (তখন বোধহয় প্লেট ছিল ২৫ টাকা) চাখার সুযোগ হয়েছিল। পরে একবারই পিয়ারলেস ইন হোটেলের আহেলিতে বাঙালি খাবার খেতে গিয়ে এক বন্ধুর সৌজন্যে পটলের দোলমা পাতে নেবার সুযোগ হয়েছিল। দুটিই অনবদ্য। কিন্তু প্রথমটি আমার ঠাকুমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়টি চেখে মনে হয়েছিল বিশ্ববাজারকে বাঙালির পটল কী তা দেখানোর জন্য। আজ যখন রসগোল্লা, জলভরা বা হরেক মিষ্টির আন্তর্জাতিক স্ট্যাম্প পড়ে, আর বাঙালি রসনার অনবদ্য পটল অভিজাত হয়ে উঠতে পারে না, বুদ্ধদেব বসুর কথা বিদ্ধ করতে থাকে, ‘বাঙালি রান্নার মস্ত খুঁত এই যে তা বিশ্বের হাটে অচল। আমরা তাকে নিয়ে ঘরে ঘরে সুখী হতে পারি কিন্তু ব্যবসায় খাটাতে পারি না।ওড়িশা, আসাম, বিহার, উত্তরপ্রদেশেও পটল হয়। পটলের দোলমার আদি উৎস নিয়ে আর্মেনিয়ানদেরও নাকি অবদান আছে। সে থাক। পটলকে যুগান্তকারী যে করেছে সে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা। আফসোসটা সে কারণেই আরও। 

 

 

আমার নিজের জীবন এক কথায় পটল সুবাসিত। ঠাকুমা পটলের দোলমার সঙ্গে দই পটল, পটল পোস্ত, পটল সরষেটাও করতেন অনবদ্য। মামার বাড়ির দিদার সূত্র ছিল খুলনার মেঠোজমি-জলা। দিদার হাতে খেয়েছি পূর্ব বাংলার স্টাইলে পটল চিংড়ি আর পটল বাটা। পটল বাটা করার আগে তিনি চুলোর আগুনে পটলগুলোকে সামান্য পুড়িয়ে নিতেন। ওটাই ইমপ্রোভাইজেশন। পূর্ব আর পশ্চিমের পটল মিলে প্রমথ চৌধুরীকে অনুসরণ করে বলি আমার পেটে উত্তরের খিদের জানলা খুলে গিয়েছিল। জন্ম হল, বিয়ে হল, যাপনও হল। শুরুতেই বলেছিলাম মৃত্যুতেও আছে পটল। মানে বাঙালিই বোধহয় একমাত্র জাতি যাকে পটল তুলতে হয়। মানে তুলতে হবেই। একেবারে মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্যর সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক। এখন পটল সব্জি তুলে নিলে গাছটি মারা যাক বা আমাদের মৃত্যুর পর অক্ষিপটল উপরে উল্টে যাক অর্থাৎ, পটল তোলা হলযাই-ই হোক, প্রবাদবাক্যের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। 

 

 

যে দেহ, যে জীবন ক্ষিতি, ব্যোম-এর কাছে সমর্পণ করে দিতে হবে, একবার ভাবুন, সে মুহূর্তে অন্য কোনও সব্জি সঙ্গে নেই আমাদের। 

এরপরেও পটলকে মুখে বা কাছে টেনে নেবেন কিনা, তা আপনার সিদ্ধান্ত।

__ 

  • মানস সরকার