কাঠের সিঁড়িতে কে

সেকালের যৌথ পরিবার। আত্মীয় পরিজন। তাঁদের মধ্যেকার নিবিড় সম্পর্ক। আবার ঘটি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সেকালের 'কোলকেতা'। শাঁটুল গুপ্ত আর সুনীলের 'সেই সময়' এর আমেজ-

 

 

ব্রিটিশ আমলে দোতলা বাড়ির সিঁড়ি সাধারণত কাঠের তৈরি হত। কাঠের ফ্রেমের ওপর রেলিং, পাদানী সব কাঠের তৈরি। সেই যুগের বড় দোতলা বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে বাস করত যারা তাদের সংখ্যা তিরিশের আশেপাশে থাকত। কোনও কোনও বাড়িতে তা অনেক বেশি এমন কী দ্বিগুণ পর্যন্ত হতে পারত। আমার এক পিসিমার মুখে শুনেছি বাবার মামার বাড়ি রোজ সাতষট্টি জন লোক খেত। সে গল্প আর একদিন হবে। এই সব বাড়ির ঘরে জানালা থাকত বাড়ির অন্তর্মুখে। বাড়ির সামনে রাস্তার দিকে কোনও জানালা রাখা হত না। তার কারণ বাড়ির মহিলারা রাস্তার দিকে দেখবেন না বা রাস্তার লোকে বাড়ির মহিলার দিকে দৃষ্টি দিতে পারবেন না। আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা বা অন্য কিছু লেখাতেও তা জানা যায়। বাল্যকালে আমি কিছু আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি কাঠের সিঁড়ি চকোলেট রঙ করা। বহুবার ব্যবহারের ফলে অনেক সময় সিঁড়ির ধাপের মধ্যিখানটা রঙ চটে সাদা হয়ে যেত, আবার অনেক সিঁড়ির কাঠের ক্ষয় হতে দেখা যেত। সে সব বাড়ির বয়স তখন আশি থেকে একশো ছিল হয়ত। বাড়ির দোতলার ভিতরে লোহার গ্রিল দেওয়া বারান্দা থাকত। 

             

 

এমন বাড়িতে বাস করতেন সব ভাই এবং তাদের স্ত্রী এবং পুত্র কন্যাগণ। তাছাড়া অনেক বাড়িতেই কোনও বিধবা পিসিমা এবং তাদের সন্তানদের বাস করতে দেখা যেত। স্থায়ীভাবে অনেক সময়ই তাঁরা থাকতেন না। তবে যাওয়া আসা লেগেই থাকত। আমার মায়ের কাছে শোনা অনেক পিসির মধ্যে মেজপিসি, সেজপিসি প্রায় সময়ই আসতেন। মায়ের কাছে শুনতাম পিসতুত দাদা দাশুদা, পঞ্চুদা, যুগলদার কথা। দুএকজনকে পরে দেখেওছি। তাদের সবার বাড়ি ছিল বড় জাগুলে (জাগুলিয়া), বদ্যিবাটি (বৈদ্যবাটি), সর্ষে (সরিষা) ইত্যাদি অনেক স্থানে। লক্ষ্য করার মত সব অঞ্চলের মানুষ ভাষার বিকৃতি করে থাকেন। মায়ের দেশ ছিল হালিশহর, তা হল চব্বিশ পরগনার (এখন উত্তর চব্বিশ পরগনা) মধ্যে। সেখানকার শব্দের বিকৃতি এমন ছিল। প্রতি জেলায় তা পৃথক হত। সে সময়ে বিধবা মহিলার সংখ্যা বেশি হত, কারণ স্বামী স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য অনেক সময়ই বছর দশেক বা তার বেশি হত। জাত কূল সব দেখতে গিয়ে এমন হত। মা বলত 'পালটি' ঘর না হলে বিয়ে সুখের হয় না। শুধু স্বামী স্ত্রীর মনের মিল হলেই হবে না, দুই পরিবারের মতামতের মিল থাকাটা জরুরি ছিল। 

                 

 

মায়ের কাছে কত গল্প শুনেছি। তাদের পিসেমশাইদের কেউ কেউ নাকি রেলে চাকরি করতেন। সেই সময়ে রেলের চাকরি মানে পোয়া বারো। এক সময় শুনেছিলাম, তখন লোক তিন প্রকার হত, ভদ্র লোকঅভদ্র লোক আর রেলের লোক। রেলের লোকেরা নাকি এই দুই ভাগের কোনও ভাগেই পড়ত না। রেলের চাকরি মানে রেলের পাশ, তা দিয়ে দেশের সর্বত্র সপরিবারে যাওয়ার সুযোগ। মাহিনাও নাকি অন্যদের তুলনায় ভালই ছিল। তাছাড়া অনেকের উপরিটা মন্দ হত না। রাখ ঢাক করে লাভ নেই আমাদের অনেকের চাকুরিরত পূর্বপুরুষের এমন উপরি কামাই ছিল। ঘুষ শব্দটা শুনতে একটু নোংরা লাগে। তাই উপরি শব্দটা চালু ছিল। এটা কিন্তু 'ওভার টাইম' নয়। সত্যি কথা বলতে ইংরেজদের কাছে ভারতের মানুষ ব্রাইবারী শিখেছিল। এখন অবশ্য সরকারি কাজে না ঢুকেই লোকেরা অন্যরকম আয় করে, যার একটা উন্নত নাম হল তোলা। বাংলা ভাষায় দেদার সুযোগ, শব্দের অভাব হয় না, একটা কিছু বানিয়ে নিলেই হল। সাহেব আধিকারিকরা তখন ভেট, মানে উপঢৌকন, পেলেই অনেক কিছুর অনুমোদন করতেন, এমন কী পদোন্নতি পর্যন্ত।  সে সব অনেক কথা আমার শোনা।

 

 

মায়ের কাছে শোনা গল্প, রাতবিরেতে একজন পিসেমশাই এলেন, সঙ্গে কিছু বাজার মাছ তরিতরকারি। জামাই এসেছেএটাই বড় কথা, কিছু জিজ্ঞেস করার প্রশ্নই নেইআবার কিনা একা এসেছে, তাদের পরিবার ছাড়া। সে সময় পরিবার বলতে স্ত্রীদের বোঝাত কোনও সময়ে। বাড়ির বউরা ঘুম থেকে উঠে মাছ ধুয়ে, ভেজে, রান্না বসিয়ে দিত। বৃদ্ধা রাঁধুনীকেও উঠতে হত। বেচারা বাবাজীবন অনেক পরিশ্রম করে এসেছে। জামাই বলে কথা, তার খাবারের ব্যবস্থাটুকু তো করতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে খালি পায় বা চটি পরে নামলে একটা ধপ ধপ আওয়াজ হত। দিনের বেলা কিছু বোঝা না গেলেও রাতে বেশ ভালই শোনা যেত। সে সময় রাতে কেউ প্রসাধন ঘরে গেলে তাকে নীচে নামতে হত। বাড়ির মধ্যে এমন ঘর রাখার রেওয়াজ ছিল না। গ্রামের বাড়ির ক্ষেত্রে তা বাড়ির থেকে বিচ্ছিন্ন থাকত বলে দেখেছি। শহরে তা না হলেও এক নির্দিষ্ট প্রান্তে রাখা হত। রাতে সিঁড়ির ওপর শব্দ হলে সবাই, বিশেষ করে নীচের তলার লোকে, বুঝত কেউ বাথরুম যাচ্ছে। একবার হল কী প্রতিদিন মাঝরাতে এমন শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এমন রোজ হবার পর এক সময় সবাই বলাবলি করত, কে যেতে পারে। শেষে জানা গেল কেউই রোজ রাতে নামে না। এরপর অনেকে ঘরের জানলার ওপরের কপাট ফাঁক করে দেখত কোনও আওয়াজ শুনলেই। কিছু দেখা গেল না। সন্দেহ বাড়তে লাগল। বাড়ির মূল ফটক সারাদিন খোলা থাকতএত লোক যাওয়া আসা করে, কে বারবার খুলবে। যদিও এখানে চোর ডাকাতরা বিশেষ আসে না। শেষে ঠিক হল, বাড়ির পুরুষ সদস্যরা প্রস্তুত থাকবে, শব্দ শোনামাত্র একটা লাঠি নিয়ে দরজা ফাঁক করে দেখবে। তেমন কিছু হলে বাইরে বের হয়ে দেখবে। 

 

 

প্রথম দিন আওয়াজ হল, কিছুই দেখা গেল না। তারপর একদিন, প্রথমেই সবাই লাঠি নিয়ে বের হল। শেষ পর্যন্ত বড়মামার ছেলে আন্দুদা, তখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, দেখাল অন্ধকারের মধ্যে মেঝের কাছে দুটো গোল কালোর মধ্যে একটা সাদা আলো জ্বলজ্বল করছে। সবাই তার দিকে একটু এগোতে শুনল, মিঁয়াও! বাড়ির কালো হুলোটার কীর্তি! হুলোটা হঠাত রোজই কেন এক সময় নীচে যেতে আরম্ভ করল সে রহস্য আর উদ্ঘাটিত হল না।

  • প্রদীপ নারায়ণ ঘোষ