বাগবাজার স্ট্রীটে পটলার ডালপুরি।যাকে বলে কিনা অমের্ত্য। এই পটলার ডালপুরি খেয়েই দেবকিশোর রেলগাড়িতে করে কু ঝিক ঝিক তালে সোজা চলে যায় দমদমার অর্ণবপোতের আশে পাশে।রেল গাড়ির হুইসেল তখন বাজতেই থাকে --
পটলার দোকানে সেদিন ডালপুরি খেতে গেছি।পটলার ডালপুরির নামটা শুনলেই আবার আমার খিদেটা কেমন যেন বেশ একটু চেগে ওঠে। ডালপুরির অর্ডার দিতে যাব , এমন সময় হঠাৎ ই পাশ থেকে কানে এলো, পার্সেল হবে তো ডালপুরি?
পটলার উত্তরসূরি, যাঁকে ই আজকে সবাই পটলা বলে মনে করতে চায়, সেই দীপুদা, একটা অসাধারণ সেকেলে ব্যক্তিত্ব, কথা বড্ড ই কম বলেন।শব্দহীন পরিষেবা দেওয়াই যেন ওঁর কাজ। দীপুদাকে দেখলে মনেহয়, কোয়ালিটি শব্দটার প্রকৃত অর্থ কী।জিনিষের মান যদি নিজের যোগ্যতাতেই নিজের প্রমাণ রাখে, তবে যে সেল্ফ ক্যানভাসিং করতে হয় না খরিদ্দারদের সামনে জিনিষ গছানোর জন্যে - এটা দীপুদাকে দেখে শেখা উচিত।
তেলেভাজার সঙ্গে বাঙালির একটা অন্তরের সম্পর্ক।বিকেলের জল খাবারে তেলেভাজা-- এটা কোন বাঙালি না ভালোবাসেন।বাঙালি রাজনীতিক থেকে কবি, সাহিত্যিক, রকবাজ, গায়ক বা রিক্সাচালক -- প্রত্যেকের বিকেলের পছন্দে আছে তেলেভাজা।অনেকে আবার সকালের জলখাবার ও সারেন তেলেভাজা দিয়ে।গ্রামবাংলায় সকালের জলখাবারে তেলেভাজার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। রাঢ় বাংলায় তেলেভাজার জনপ্রিয়তা চোখে পড়বার মতো।
জয়রামবাটীতে শ্রীশ্রী মাতৃ মন্দিরে অনেক সময়েই দেখা যায় , সকালের জলখাবারে ভক্তদের মুড়ি আর গরম তেলেভাজা দেওয়া হয়। তবে কামারপুকুর আর জয়রামবাটি, দুজায়গাতেই সাদা বোঁদের খুব চল।বরবটির বীজের ব্যাসন থেকে এই সাদা বোঁদে হয়।স্থানীয় ভাষায় বলে, রামা কলাই।এই রামা কলাই অবশ্য ঘুগনির মতো করে খাওয়ার ও রেওয়াজ হুগলী জেলাতে দেখা যায়। এই রামাকলাইয়ের বোঁদে শ্রীরামকৃষ্ণ খেতে খুব ভালোবাসতেন।তেলেভাজার প্রতিও তাঁর যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব ছিল। তবে পেটরোগা মানুষ হওয়ার দরুন তিনি ছিলেন খুব ই মিতাহারী।আর অতিরিক্ত তেল মশলার খাবার সহ্য করতে পারতেন না।দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর ভোগের প্রসাদ ও স্বাস্থ্যের কারনে খেতে পারতেন না শেষ দিকে।মা সারদামণি তাঁর জন্যে অল্প তেল মশলাতে রেঁধে দিতেন।জিওল মাছ , শ্রীশ্রী মায়ের হাতে প্রস্তুত করা-- খুব আনন্দের সঙ্গেই তিনি খেতেন।
তবে দেশের খাবারের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিল।একবার তিনি দক্ষিণেশ্বর থেকে কামারপুকুরে গেছেন।আছেন দেশে কিছুদিন।একদিন রান্নার কালে শোনেন ঘরে পাঁচফোড়ন নেই। পাঁচফোড়ন ছাড়াই যখন রান্নার আয়োজন করতে চলেছেন বাড়ির মেয়েরা, শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন; যাতে যেটা দেওয়ার সেটা না দিলে কি চলে? তোমাদের এই ফোড়নের গন্ধের টানে দক্ষিণেশ্বরের মাছের মাথা ফেলে ছুটে এসেছি যে।
ঘরের মেয়েরা পাঁচফোড়ন আনিয়ে ব্যাঞ্জন রাঁধলেন।তবে সেই ব্যঞ্জনে তৃপ্তি পেলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
আসলে রসনা তৃপ্তির সঙ্গে মনের একটা সংযোগ থাকে।সেই সঙ্গে থাকে পকেটের বিষয়টিও। তবে রসনার উপকরণ আর সরঞ্জামের যে বিশ্বায়ন ফেসবুক আর ইউটিউবের কল্যাণে ঘটে চলেছে তাতে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী বা রেণুকা লাহিড়ীচৌধুরীর মত ব্যক্তিত্বেরা আজ জীবিত থাকলে সত্যিই চমকে উঠতেন।
বাঙালি রসনা তৃপ্তিতে অতি উপাদেয় উপাদান হিসেবে ' ডালনা' যথেষ্ট সমাদর।আলু- কপির ডালনা থেকে ডুমুরের ডালনা- বাঙাল- ঘঁটি নির্বিশেষে সকলেই পাতে পড়লে চেটেপুটে খেতেই অভ্যস্থ।হরেক রকমের ডালনা আর ডালনা ঘিরে পরীক্ষা - নিরীক্ষা , বাঙালর হেঁশেল কে দিনে দিনে পরিপুষ্ট করেছে।যেমন ধরা যাক ধোঁকার ডালনা।ঘঁটি উচ্চারণে একটা অতিরিক্ত চন্দ্রবিন্দু সহযোগে ' ধোঁকা' আর বাঙাল উচ্চারণে কেবল ই ' ধোকা' ।শ্রীরামকৃষ্ণ অবশ্য তাঁর উপদেশামৃতে সংসারকে ' ধোঁকার টাটি' বলে উল্লেখ করলেও , পাতে যখন ধোঁকার ডালনা পড়ে , তখন মনেহয়, এমন সুন্দর খাবারটার কেন ' ধোঁকা' রাখা হলো? ধোঁকা বলতেই ধোঁকাবাজির যে ছবি ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে অবশ্য রসনা তৃপ্তিকারী ধোঁকার ডালনার কোনও সম্পর্ক নেই।
ধোঁকার ডালনায় ডালের ধোঁকার ই প্রচলন ছিল। কিন্তু অনেক বিদূষীরা নিয়ে এলেন বাঁধাকপির ধোঁকা।ডালের পরিমাণ তাতে অনেকটাই কম।আর খেতেও অনেকটাই মুচমুচে।তবে সেকেলে ঢঙে মুচমুচে বললে আবার একেলে রমণীরা এমন কি পুরুষেরাও খুব উৎসাহ দেখাবেন না।
তাঁদের বলতে হবে,' ক্রিসপি' ।সেই ভবাণীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়ার সুরেই বোধহয় তাঁদের ' মুচমুচে',' কুড়মুড়ে' এইসব শব্দগুলো ' ঠিক আসে না!' তবে এই ' মুচমুচে' শব্দটা এখন হালফিলের বাংলা গদ্যের প্রশংসা করতে খুব ব্যবহৃত হয়।
কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা কেমন লাগে?
অনেকক্ষেত্রেই উত্তর আসবে; ভালো ।বেশ ভালো।কী সুন্দর মুচমুচে লেখা।গদ্যটা কেমন কুড়মুড়ে।
স্মরণজিৎ নিজে হয়তো বলতেন; ভালো বেশ।কারন, বিশেষণ টা আগে উচ্চারণ করা ওঁর কথ্যরীতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য।
দেখেছেন, খাওয়া- দাওয়ার সাতকাহন থেকে কোথায় চলে এলাম? একেই বলে কথার লাগাম না থাকা।কথার লাগাম থাকলেও ভালো আবার না থাকলেও।তেমন ভাবেই বলতে পারা যায় ,কথার লাগাম থাকলেই যে , কথা আমাকে বিপদে ফেলবে না- এই গ্যারান্টি হতে পারে কখন ও?
আচ্ছা , ধোঁকার ডালনার গল্পে একটা কথা একটু ভুলেই যেতে বসেছিলাম। এককালে ছানার ডালনার খুব কদর ছিল বাঙালির পাতে।নিরামিশাষী মানুষজনের কাছে ছানার ডালনা র কদর ছিল খুব। তখন ছানা কাটানো হতো বাড়িতেই। ক্যালসিয়াম ল্যাকটেট তখন ও বাঙালির পাকঘরে প্রবেশ করে নি।পাতি নেবুই ছিল ছ্যেনা কাটাবার সেরা উপাদান।আজকাল যেমন ইউ টিউবে রান্না শেখাতে গিয়ে তেঁতুল দিয়ে ছানা কাটানোর পদ্ধতি দেখানো হয়, সেসব কিন্তু বাঙালির রান্নাঘরে আগে কখনও ঢোকে নি।
তবে এই ' ছ্যেনা' লিকলুম, এটি কিন্তু একদম বাগবাজারি ' ঘঁটি' লব্জ।আর ছানা খাওয়ার বিষয়ে ঘঁটিদের আত্মনিবেদন ' বাঙাল' দের থেকে একটু বেশিই। পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি, হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে দুধ খেতে বেশি ভালোবাসেন। আবার কয়েকশো বছর আগে উত্তরভারত বা বিন্ধ্য পর্বতের ওপার থেকে এসে , নিজেদেল ভাষা ভুলে , ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিমূর্তি হয়ে নিজেদের নৈকষ্য ' ঘঁটি' বলে প্রতিষ্ঠিত করতে আজ ও প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তারা আবার মেধার উর্বরতা বৃদ্ধিতে খাঁটি জিনিষ খাওয়ার ভীষণ রকমের পক্ষপাতী।তাই তারা দুধের থেকে ' ছ্যানা' র প্রতি অতিরিক্ত দুর্বল!
হিন্দিভাষী বামনাইগিরি সমাজে এককালে ছানার গুরুত্ব আর জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়বার মতো।ছানা না হলে এসব বামুন ঠাকুরদের রাতের খ্যাটন ই সম্পন্ন হতে পারতো না। নন্দ ময়রার দোকানে এসব বামনাইদের ছিল মাসকাবারী খাতা।মাসের শেষে ' গুরুদেবে' র ছ্যেনার ধার শুধতেন কোনও না কোনও মুরিদ।এমন সব গুরুঠাকুরদের কথা সমরেশ বসু লিখে গেছেন তাঁর ' জগদ্দলে' ।সেখানেই আছে ' বনমালী ঠাকুর' ।এলাকাতে যাঁর খ্যাতি- কুখ্যাতি ' মাল ঠাকুর' বলে! 'মাল ' কামানো থেকে ' মাল ঠাকুর ' উপাধি প্রাপ্তি।
মাল ঠাকুরের ছেলে নিজেকে যতটা প্রগতিশীল দেখাতে চাইতো,নাতিদের চেষ্টা ছিলো শতগুণ।তাই স্থানীয় এক নার্সিংহোমে মাল ঠাকুরের পুত্রের জীবনাবসানের পর , বাড়ির ভিতরে তাঁর শ্রাদ্ধাদি কর্ম মাল ঠাকুরের নাতিরা বেশ ভক্তি ভরেই করলো। তবে সেখানে বাইরের লোকের প্রবেশ নৈব নৈব চ।তখন ও কাগজে কলমে টিকে আছে বাম শাসন।আর টিকে থাকার কালে ব্রিটিশের মত ই তাঁরাও কখন ও স্বপ্নে কল্পনা করতে পারে নি যে, বাম শাসন ও একদিন কালের গতিতে পশ্চিমে ঢলে পড়বে।
আর সেই কারনেই মাল ঠাকুরের নাতিপুতিরা , মাল ঠিকুরের পুতের যথাবিধি অশংচান্তাৎ দ্বিতীয়াহ্নে , শাস্ত্র বিধি মোতাবেক শ্রাদ্ধাদি, পিন্ডদানাদি সমাপয়েৎ , বেশ সে যুগে প্রচলিত ' কমুনিষ্টি কমুনিষ্টি' ধারাতে করলে এক বিশাল স্মরণ সভা।
সেই স্মরণসভা তে অবশ্য পটলার ডালপুরি খাওয়ায় নি মাল ঠাকুরের নাতপুতিরা।তারা খাইয়েছিল গোবিন্দের ডালপুরি।পিঁয়াজ - রসুন দিয়ে ডালপুরির তরকারিরা জব্বর করে গোবিন্দ।বামুন ঠাকরেরা মাংস খাব না।আলুটা খাবো করে , ডালপুরির তরকারিটা একদম গোগ্রাসে সাপটে দেয় মনের সুখে।তবে এদিক ওদিকে ভালো করে দেখে নিয়েই সাবটায়।কারন? হ্যাঁ, কারন টা হলো সাপটানো কেউ দেখলে বামনাই গিরি, চলছে না।চলবে না।