একটা ভাল দিন, অন্তহীন

অন্তহীন সময়ের এক পরিক্রমা। সময় যখন থমকে দাঁড়াতে চায়,  মানুষ তখন মুক্ত করতে প্রয়াসী হয় সময়ের অবরুদ্ধ গতি। এই গতির মধ্যেই খুঁজে পেতে হয় জীবন -যা মৃত্যুর থেকেও বড় -

 

 

ঝড়ের পরে  রোদ ওঠে, রোদ উঠলে সহজেই বেয়ে আসে আলো। আলো আসলেই আবার হেঁটে যাওয়ার পথ মসৃণ হয়ে যায়। আলুথালু জড়তা ছেড়ে দিব্যি গায়ে রোদ মেখে ছুটে চলা শুরু। সবুজ পাতার উপর সোনালী জলের মোড়ক মনে খুশির বার্তা আনে। বাঁধ মেরামতির কাজে কোমড় বেঁধে ফের নেমে পড়া। ঝড়ের বিষণ্ণতা ভুলে রৌদ্রস্নানে গা ভিজিয়ে নেওয়া। আসলে প্রতিটা ঝড়ের পড়েই আবার নতুন করে শুরু করতে ইচ্ছে করে। আবার নতুন করে পেতে ইচ্ছে করে। পুরোনো প্রেম, নতুন চাকরি, সদ্য পাওয়া জামা, নতুন ওয়েব সিরিজের ট্রেলার, গলির অন্ধকারে চুম্বন! সবকিছুই ফের পেতে ইচ্ছে হয়। অক্টোবরের শেষে, একটা মন খারাপের বিকেলকে স্কিপ করে দিব্যি বলা যায়, ভাল আছি। ভাল থাকার জন্যই তো বেঁচে থাকা। সাময়িক প্রেমকে হাসিমুখে টাটা বাইবাই বলে আনন্দে থাকার নামই তো জীবন। 

 

 

 

বৃষ্টির রাতে তোমার শরীরের গোপন তিল গুনে ফেলাই তো একটা রহস্য সমাধান করার মতো।  তোমার শরীর থেকে একের পর পোশাকের আস্তরণ খুলে, কোনও এক স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দেওয়া। আহা! সে এক অপরূপ সৌন্দর্য। তবুও তোমাকে ছাড়া দিব্যি আছি। দিব্যি আছি চাকরি হারানোর এবং চাকরি পাওয়ার মাঝে।  চেষ্টা করলে বাঘের দুধও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই দুধ হজম হবে কিনা সন্দেহ আছে। তাই খেয়ে নিলেই হল না, খাওয়ার আগে দেখতে হবে সেটা হজম হবে কিনা। তাই আকাশের দিকে চেয়ে এগিয়ে যাওয়া অর্থহীন। যত তিরিশের কাছাকাছি যাচ্ছি, মনে হচ্ছে, স্থিতধী হচ্ছি। রিলের দুনিয়ার বাইরে একটা দুনিয়া আছে, সেটা বারবার অনুভব করছি। যে দুনিয়া থেকে আমার পূর্ববর্তী প্রজন্ম এসেছে। যারা সত্যিই জীবনটা দেখেছে। আমরা তো পডকাস্ট দেখি। তাও জল মেশানো। অমুক ডাক্তার থেকে তমুক অভিনেতার ডায়েট রেসিপি! কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? কোথায় পাবো তারে?    

             

 

 

যারা রয়ে যায়, তাদেরই সইতে হয়। কলকাতার বুকে হাজার দশেক টাকার চাকরির জন্য দলাদলি হয়। সেই বাজারে দাঁড়িয়ে পডকাস্ট দেখা বিলাসিতা। তবুও এগিয়ে যাওয়ার শেষ নেই। কখনও ছিল না। জীবন থেকে কষ্ট পাওয়ার অনুভূতির সুইচ অফ করে দিলেই বিন্দাস। জীবনে আর কোনও সমস্যা নেই। পাশের বাড়ির অমুকের ছেলে, অমুক জায়গায়,  তমুক টাকার চাকরি করছে! এই গল্প তো আমাদের ছোট থেকে শোনা। সেই তুলনায় তুমি তমুক জায়গায় অনেক কম মাইনের চাকরি করছো  তো? সুখে আছো কী?  সুখে থাকাটা আসল! ওটাই ভাল থাকার প্রাথমিক শর্ত। জীবনে ভাল থাকাটাই আসল। আর কিচ্ছু এই জীবনে প্রাসঙ্গিক নয়। কীভাবে আছো, কার সঙ্গে আছো সেটা আপেক্ষিক।

           

 

 

দিনের শেষে এইগুলোর কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। বুঝতে শিখেছি। শিখছি, ভাল থাকার কৌশল। জীবনে প্রতি পদে সমস্যা আসবে। রক্তচাপ বাড়বে। দীর্ঘদিনের প্রেম হঠাৎ করে ভাঙবে। তবুও হাসিমুখে থাকতে হবে। নিজের জন্য, নিজের ভালর জন্য।  যখন এডিটর আমাকে কাঁচের ঘরে ডেকে বলল, আগামীকাল থেকে আর আসতে হবে না, তখন একটু  মুষড়ে পড়লেও, নিজের পিঠ চাপড়ে বলেছিলাম; একটা গেলে একটা আসবে। দুঃখ পাওয়া অমূলক। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে ভাবি, কেন উঠছিকেন এই দিনটা আমার জীবনে প্রাসঙ্গিক? প্রশ্ন করলেই উত্তর পেয়ে যাই! আর উত্তর পেলে সহজ হয়ে যায় অনেক কিছু। জীবনের উদ্দেশ্যটা কী, সেটা বুঝতে পারলেই জীবনটা মাখন। এই গতিময় জীবনে একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস করা এবং বিশ্বাস হারানোর মধ্যেখানের সময়টায় আমরা ফেঁসে থাকি। আমরা হঠাৎ থমকে যাই। পাহাড়ে যায় শান্তির খোঁজে। অথচ নিজের বাড়ির ছাদের তলায় যে অপরূপ শান্তি আছে, সেটাই আমরা কখনও খুঁজি না। অন্যকে দেখানোর প্রবণতা বাড়ছে। দিনের পর দিন আমরা আরও চঞ্চল হয়ে উঠছি। কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছি না। কথায় কথায় ব্যবসা করব, এই ডায়লগ ঝেড়ে জামার কলার উঁচু করছি। পাড়ার মোড়ে মোড়ে ক্যাফে গজিয়ে উঠছে। বিরিয়ানির দোকানের রমরমা। উজ্জ্বলদা, আমেরিকান দাদা, অরুণদার পরোটা, একান্ত আপনের বিরিয়ানি -এইসব ভিডিও দেখতে দেখতে বাংলার নবপ্রজন্ম বেড়ে উঠছে। 

                 

 

 

আর একটা প্রজন্ম হতাশা নিয়ে দিন গুজরান করছে। আমরা বড্ড তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিচ্ছি। একই ভুল ঠিক করার ইচ্ছে আমাদের নেই। চটকে যাওয়া সম্পর্ককে আরও চটকে ঠিক করার চেষ্টায় আছি, অথচ সেই সম্পর্ক থেকে বেরনোর কথা আমরা ভাবছি না। লোকে কী ভাববে -এই ভেবেই আমরা একটা পদক্ষেপ ফেলতে ভয় পাচ্ছি। অথচ ওই একটা পদক্ষেপের ভয়ে আমরা কত কত যুগ পিছিয়ে যাচ্ছি। কত কত রাত নিদ্রাহীন। কত কত দিন, অর্বাচীন! অর্থহীন।  তুমি যেমন আছো, ভাল আছো। কারণ, তোমার চেয়ে আরও খারাপ অনেকে আছে। যেটুকু আছে, সেইটুকুর মূল্য অসীম। এটাই আমরা বুঝি না। একটা প্রেমকে বেঁধে রাখার চেয়ে তাকে উড়তে দেওয়া ভাল। একে অন্যের প্রতি বাঁধনটুকু থাকলেই হবে। বাকিটা অপ্রাসঙ্গিক। ছেঁড়া ঘুড়ি যেমন উড়তে উড়তে দিকভ্রান্তের মতো দিশেহারা হয়ে যায়, ঠিক তেমনিআমরাও দিনের পর দিন দিকভ্রান্তের মতো বিভিন্ন দিকে ছুটে বেড়াচ্ছি। কোথায় শেষ করব জানি না। জানি না সুখের ঠিকানা। কিন্তু আমরা বয়ে চলেছি। ভাল থাকার জন্য কতকিছুই করছি। কিন্তু ভেতরটা কী বলছে সেটা শুনছি না।

 

 

 

ভাল থাকার একটাই মন্ত্র, নিজেকে ভাল রাখা। নিজের সবটুকু চেটেপুটে নেওয়া।  দেবাঞ্জলি রায়, একজন ডাক্তার। শুধু তাই নয়, খুব সুন্দর লেখেন। সারা দেশ ঘুরে বেড়ান। ওটাই ওনার নেশা। ওনার কথা ভেবে খুব হিংসে হয়। ইসসস, আমারও তো ইচ্ছে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর। এই হিংসেই তো খারাপ থাকা তৈরি করে। আমাদের প্রতেক্যের সময় খুব সাময়িক। তাই অত ভাবলে হবে না। নিজের জন্য বাঁচতে হবে। নিজেরটুকু শুষে নিতে হবে।  জীবনকে চমক দিয়ে বলতে হবেআমি ভাল আছি। নিজের জন্য সবটুকু উজার করে দিতে হবে। স্বার্থপর হতে হবে। নয়ত ভাল থাকা আর হবে না। শুনতে একটু বেমানন লাগলেও এটাই সত্যি। সেদিন দেবীর জন্য মন কেমন করছিল। যে প্রেমটা হবে না জেনেও বারবার ছুটে গিয়েছি। ওর বাড়ির সামনে দিয়ে বহুবার চক্কর দিয়েছি। তবুও ওকে মনের জানলা থেকে মুছতে পারিনি। 

 

             

 

এই খারাপ লাগার শেষ কোথায়? বহুবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তর পাইনি।  মনে হয়েছে ওকে একবার কাছে পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই দীর্ঘ রাত কেটে যাবে। আসলে আমি ওর প্রতি ভীষণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল, ওকে ছাড়া বাঁচব না। আসলে আমি নিজেকেই গুরুত্ব দিইনি। আর ঠিক যখন নিজেকে গুরুত্ব দিতে ভুলে যায় তখনই আমরা হারিয়ে ফেলি নিজেদের। কষ্ট পাই। দুঃখ ভিড় করে। বাবা গত বছর এই সময়ও বেঁচে। তখনও কি জানতাম, বাবার হাতে সময় আর এক মাসবাবা চলে যাওয়ার পরে, ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি, জীবনটা ঠুনকো। রাগ, দুঃখের জন্য নয়। আক্ষেপ করার জন্য নয়। রোদের মতো উজ্জ্বল এবং প্রখর হওয়ার জন্য।  ঝড়ের পড়ে রোদ ওঠে, রোদ উঠলে সহজেই বেয়ে আসে আলো। আলো আসলেই আবার হেঁটে যাওয়ার পথ মসৃণ হয়ে যায়। আলুথালু জড়তা ছেড়ে দিব্যি গায়ে রোদ মেখে ছুটে চলা শুরু। সবুজ পাতার উপর সোনালী জলের মোড়ক মনে খুশির বার্তা আনে। ভাল থাকার ইচ্ছে জন্ম নেয়। একটা ভাল দিন, হোক না অন্তহীন।

  • আদিত্য ঘোষ