মাগরিবের ছায়া

উনিশ শতকের বেরাদর কালো পাথরের মতো চেপে বসে আছে ভাটপাড়ার বুকে। আশেপাশের শহরগুলোতে বাইরের বাতাস ঢুকলেও এখানকার বামুনঠাকুরেরা বামনাইয়ের শুদ্ধাচার বজায় রাখতে বাইরের হাওয়া এতোটুকু ঢুকতে দেয়নি। তেমন দমবন্ধ করা পরিবেশে গরিব-বড়লোক, হিন্দু-মুসলমান সবাইকে বুকে ধারণ করে এই শহরটা গোটা বিশ শতকটাও কাটিয়ে দিল। এখন এই একুশ শতকের প্রায় মধ্যযামে বিশ শতকের প্রান্তিক কালের তারামন বিবি ভাটপাড়ার কুমোরপাড়া ছেড়ে চলে এসেছে সদরের উপকন্ঠে।

 

 

তারামনের ছেলে হাফিজ, যাকে ছোটবেলায় কেবল ধর্মের দোহাই পেড়ে তারাদের মতোই গরীব, চটকলে কাজ করা হিন্দিভাষী শ্রমিকেরা ঢাকতো 'হাতি' বলে। হাফিজুল শব্দের অর্থ বোঝার মতো প্রথাগত শিক্ষা তারামনের ছেলেমেয়েদের -ও তখন যেমন ছিল না, ওদের প্রতিবেশি বিহার - উত্তরপ্রদেশের নিরক্ষর ব্রাহ্মণদেরও ছিল না। ভাটপাড়ার বশিষ্ঠ গোত্রীয় বামুনেরা এইসব দেহাতি বামুনদের কখনো মানুষ বলেই মনে করতো না।তা বলে নীচুজাত আর মনুষ্যতর বলে যাদের তারা মনে করতো, সেই মুসলমানদের শায়েস্তা করতে এই 'হিন্দুস্থানী' বামুন, যাদের তারা সেকালে 'পশ্চিমা' বলে সম্বোধন করত, সেইসব লোকেদের একটু আধটু তোয়াজ তাবিজ অবশ্যই করে চলত। শ্রীরামপুর গাঁয়ের তারামন বিবির ভোলা মিঞার বৌ হয়ে এই ভাটপাড়ার কুমোরপাড়ায় আসার পরের যে বেঁচে থাকার লড়াই, সেই লড়াই ভোলার ইন্তেকালের পরে তারাকে টেনে এনেছিল খাদের কিনারে। লোভ ছিল সমাজের তার উপর।

 

 

সেই লোভের পুকুরে গোসল করলে তারামন বিবিকে আর ভারতী দেবী হয়ে ষড়ানন ঠাকুরের ভাইপোর বাড়িতে ঝি গিরি করে পেটের ভাত জোগার করতে হত না। তবু কোনও হাতছানির কাছে একটা দিনের জন্যেও নিজেকে সঁপে দেয়নি তারা। তারার কাছে সেদিন সকালে ছোট বাড়িউলির ফোন। রামনরেশ মাঝির ছোট বউ বাঙালি হলেও হিন্দিভাষীদের সাথে জীবন কাটিয়ে এখন তার বাংলার ভিতরে বেশ ভালোরকম ভাবেই হিন্দির, মানে দেহাতি হিন্দির টান এসে গিয়েছে। একটু খ্যারখ্যারে গলা নতুন বাড়িউলির। প্রথমটায় তাই কথা গুলো ঠিক মতো বুঝতে পারছিল না তারামন। বাড়িউলির কথা যত না আসছে, তার থেকে অনেক বেশি কান্না তার গলায় শুনতে পাচ্ছে তারামন।শেষ পর্যন্ত কান্নাভেদ করে ভেসে আসা কথা থেকে তারামন বুঝলো, দুলুর ছেলে ননী কাল রাতে মারা গেছে। দুলুর ছেলের মৃত্যু সংবাদ দিতে গিয়েই আলগোছে বাড়িউলি বলে ফললো, কাল রাজকুমারেরও বৌ মারা গেছে। দ্বিতীয় কথাটা ভালো করে শুনলো তারামন। নতুন বাড়িউলি কয়েকবার রিপিট করলো দেওসুন্দরীর ছেলে রাজকুমার বৌ, কাল রাতে মারা গেছে।

 

 

অবাক খুব একটা হলো না তারামন। অনেকের কাছেই রাজকুমারের বৌয়ের শরীরের গতিকের খবর যা শুনেছিল, আর এক-দুবার ওই বৌকে চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতা থেকে এই মৃত্যু সংবাদ তারামনের কাছে খুব আশ্চর্যের কিছু ঠেকল না। তবে রাজকুমারের বউয়ের মৃত্যুসংবাদ দিতে যতো না ব্যস্ত ছোট বাড়িউলি, তার থেকে অনেক বেশি ব্যস্ত সে দুলুর ছেলে, ননীর মারা যাওয়ার খবরটা দিতে। তারামনের কাছে দুলুর ছেলের মারা যাওয়ার খবরটা কম আশ্চর্য নয়। প্রায় দশ পনের বছর আগে, তারামন যখন ভাটপাড়ার এই কুমোরপাড়া ছাড়ে, দুলুর ছেলেটা তখন ছোট ছিল। বলা যায়, তারামনের ছেলে হাফিজুল, আর দুলুর ছেলে ননীরা সব পিঠোপিঠি। তাই অতটুকু একটা ছেলে মারা গেছে, এই খবরটা পেয়ে, সাত সকালে তারামানের মনটা বড় বিষন্ন হয়ে রইল। রামায়ণ পাঁড়ের বউ দেওসুন্দরীর সঙ্গে তারামনের কোনদিনই খুব একটা বনিবনা ছিল না। নানা ছলছুতোয় দেওসুন্দরী তাকে, সব রকম ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করেছে। তারামনের চরিত্রে কালি ছিটিয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন তারামন আর দেওসুন্দরী ঝগড়া ছিল প্রায় রোজকারের একটা ঘটনা। 

 

 

তখনও লোকের বাড়িতে ঝি-গিরিটা ঠিক মত রপ্ত করতে পারেনি তারামন। এই কুমোরপাড়ার ভেতরে ঝি রাখার মতো আর্থিক সামর্থ্য তখন খুব বেশি মানুষজনের ছিল না। তাই ভোলা মিঞাঁ মারা যাওয়ার পর ছেলে মেয়ে দুটোর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার তাগিদে, যখন লোকের বাড়িতে ঝিগিরি করা ছাড়া আর কোনো অন্য উপায় তারামনের ছিল না, তখন তাকে দুগ্গার মা তারা, তারকদাসী, পরামর্শ দিয়েছিলভাটপাড়ার ন্যায়লঙ্কার ঠাকুরপাড়া, পাঁচ মন্দির, জয়রাম ন্যায়ভূষণ লেন, শ্রীধর ঠাকুর লেন থেকে শুরু করে ষষ্ঠীতলা, মোকামতলা, বকুলতলা এইসব জায়গায় কাজ খোঁজবার তাগিদে দৌড়ঝাঁপ করবার। দুগ্গা মা তারাই, তারামন বিবিকে সেদিন পরামর্শ দিয়েছিলভুলেও কখনো বলোনি কো তুমি মোচোলমানের মেয়ে। তোমার এই মোচুলমানি নামখানা বদলে ফেলো। ওদিকে ওই বামুন বাবুদের পাড়ায় কাজ করতে গেলে, আমাদের মতো কোনো হিন্দু নাম তোমাকে নিতে হবে।

               

 

আর সেই থেকে দুগ্গার মা তারার পরামর্শে, ভোলা মিঞার বউ তারামন বিবি, হয়ে গেল ভারতী। এই ভারতী নাম নিয়ে সে ষড়ানন তর্কভূষণের এক ছেলের বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়লো। ষড়ানন ঠাকুর নামেই ষড়ানন তর্কভূষণের পরিচিতি ভাটপাড়ায়। শতাব্দী প্রাচীন' ঠাকুরবিশেষণটি কী করে এখানকার পন্ডিত সমাজের নামের সঙ্গে যুক্ত হলো, তা ঘিরে অনেক লোকশ্রুতি এখানে আছে। তবে ষড়াননের পাণ্ডিত্যের দ্যুতি তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মানুষজনের আছে কেবলমাত্র এক গোছা পৈতের জোরে। এইসব লোকেরাই পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর হয়ে বসলো, তার যে কত কাহিনী, যা ঘিরে সমাজতত্ত্ববিদেরা কখনো কোনো রকম আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

               

 

আসলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও, 'বামুন', অর্থাৎ; ব্রাহ্মণ মানেই দেবতা, এই দৃষ্টিভঙ্গি ঘিরে সামাজিক কুপমন্ডুকতা যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, আজকের এই একুশ শতকের মানুষ হয়তো সবটা কল্পনাও করতে পারবেন না। আর কল্পনা করতে না পারার জন্যই, এই একুশ শতকের মানুষ, যাঁরা ভাটপাড়া নামক বদ্ধ জলাশয় টিতে কখনো স্নান করবার সুযোগ বা দুর্যোগ, কোনো কিছুরই অধিকারী হননি, তাঁরা বুঝতে পারবেন না, এই যে ভাটপাড়া নামক এঁদো পুকুরের জল, কেবলমাত্র ডার্মাটাইটিস নয়, আরো কত ধরনের রোগব্যাধি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য রীতিমতো সফল এক রোগব্যাধির সংক্রামক সমুদ্র। ষড়ানন তর্কভূষণের নাতির বাড়িতে যখন ঝিয়ের কাজ করতে প্রথম ঢোকে তারামন বিবি, তখন সেই বাড়ির ব্রাহ্মণ সারল্যের রকমফের ঘিরে ভাটপাড়াইয়ার ভয়ঙ্কর রূপ সেভাবে জানা ছিল না তার। তারামন শুনেছিল, সত্যজীবন মাস্টার খুব আলাভোলা ধরনের মানুষ। ধর্ম-কর্ম আর ছাত্রদের নিয়ে থাকে। মানুষের সাথে পাঁচে সত্যজীবনকে কখনো দেখতে পাওয়া যায় না।

               

 

তবে মানুষের সাত পাঁচ নিয়ে সত্যজীবনের বউ একটু যে বেশি রকমের উৎসাহী, সেটা ওই বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই বেশ ভালো করে বুঝতে পেরে গিয়েছিল তারামন। বড়ো মেয়ে উত্তরার তখনো বিয়ে হয়নি। দূরে কোথাও একটা সরকারি কলেজের উত্তরা তখন নার্সিং পড়ে। আর বামুন বাড়ির মেয়ে, বাইরে গিয়ে নার্সিং পড়ছে, ছত্রিশ জাতের রুগী নাড়াচাড়া করছে, এই ঘিরেই তখন সত্যজীবন মাস্টার আর তার বউয়ের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল।

               

 

তর্কভূষণ বাড়ির মতো খানদানি বাড়ির মেয়ে গিয়ে বাইরে ছত্রিশ জাতের রোগী নাড়াচাড়া করবে, এটা মেনে নেওয়া সত্যজীবন বা তার বউ, দুজনের পক্ষে বেশ কষ্টকর ছিল। কিন্তু দু তিনটে বাড়ি আগে বাঙাল ভাদুড়ীদের বাড়ির ছেলের সঙ্গে নিজের বড় মেয়ে উত্তরা প্রেম করছে। মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে চলে যাচ্ছে। এমন কি রাত কাটিয়েও আসছে। এটা তখন মেনে নেওয়াটা সত্যজীবন আর তার বউ, দুজনের পক্ষে ছিল বেশ কষ্টকর ব্যাপার। তাই ইছাপুরে মেয়ের স্কুল জীবন শেষ হওয়ার পরপরই, যখন সিভিল ডিফেন্সের লোকজনদের ধরে করে, সরকারিভাবে নার্সিং পড়বার একটা সুযোগ পেয়ে গেল মেয়ে, তখন আর যাইহোক, এই প্রেমের ভূত মাথার থেকে নামবে, এটা মনে করেই সত্যজীবন বা তার বউ, বড় মেয়ের নার্সিং পাড়া ঘিরে খুব একটা আপত্তি করেনি।

               

 

প্রেম নিয়ে যে সত্যজীবনের খুব একটা আপত্তি ছিল তা কিন্তু নয়। তাদের আপত্তিটা ছিল বাঙাল বাড়ির ছেলের সঙ্গে প্রেম করা ঘিরে। কারণ, সত্যজীবনদের কাছে তখন হাঁড়ি, দুলে, বাগদী, তাঁতী আর বাঙালবাড়ির মানুষ, সমগোত্রীয়। হাফিজুলের আব্বার ইন্তেকালের পর যখন সংসার কিভাবে চলবে এই ভাবনায় চোখের পাতা এক করতে পারত না তারামন, তখন এই ঝি-গিরি করে পেট চালাবার বুদ্ধিটা কেবল দুগ্গার মা তারাই, তাকে দিয়েছিল তা নয়, তখন তারামানের বাড়িতেই ভাড়া ছিল পারদেশী আর তার বউ আশা। দুগ্গার মার বাড়ির ভাড়াটে হচ্ছে লাইচিয়ার মা। লাইচিয়ার মায়ের ছেলে পরদেশী হলো তারামনের বাড়িওয়ালা রামনরেশ মাঝির বাড়ির আর একজন ভাড়াটে। সেই পরদেশীর বউ আশাও যখন লোকের বাড়ি ঘর মোছা, বাসনমাজার কাজ করে পেট চালানোর আড়ালে শরীর বেচারও পরামর্শ দিয়েছিল, তারামনের গাটাই কেমন যেন গুলিয়ে উঠেছিল।

                         

 

সত্যজীবন মাষ্টারের বৌ যেদিন প্রথম কাজ দেখিয়ে দিচ্ছিল তারামনকে, সেদিন বলেছিল, ঘরদোর মোছবার সময়ে জলের মধ্যে একটু গোবর দিয়ে নিতে। তারামন ঘরদুয়োর নিকোতে জানে। মুছতে তো জানে না। শান বাঁধানো মেঝে নিকোনোকে যে বাবুলোকের বাড়িতে,'ঘরমোছা' বলে, তারামন কী করে জানবেমাস্টারের বউয়ের কথা শুনে তারামন একেবারে অবাক। শান বাঁধানো মেঝেতে গোবর দিয়ে কী করে নিকোবে - এটা  বুঝতেই সে কূল-কিনারা ভেবে পায়নি। তারামন, বাপের বাড়ি ঘরদোর নিকোতে জলের মধ্যে ভাতের ফ্যান দিয়ে দিত। তাতে মেঝেটা বেশ ভালোরকম আঁট আঁট হতো। এভাবেই ঘর নিকোতে ছোট থেকে তারামন দেখেছিল তার আম্মাকে। সেখান থেকেই ঘরদোর নিকোনোর সব নিয়মকানুন কেতাদুরস্ত ভাবেই রপ্ত করে নিয়েছিল সে। বিয়ের পর যখন ছোট্ট একটা খুপরি ঘরের মধ্যে তাকে নিয়ে তুলল ভোলা মিঞা, তারার একেবারে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ঘরে একটা ছোট জল চৌকি। তারপরে আর হাঁটাচলার জায়গায় ছিল না। তো কোথায় ঝাঁটপাট দেবে আর কি কোথায় নিকোবে সেই ঘরের- তা ভেবে ভেবে ইয়ত্তা করতে পারে নে সে।

                   

 

প্রথম যখন ঝিয়ের কাজ ধরে তারামন, কুমোরপাড়াতেই, সেইবাড়িতে বলেছিল, ঘর মোছার সময়ে জলে ফিনাইল দিয়ে নিতে। ফিনাইল দিলে নাকি ঘর জীবানুমুক্ত থাকে। রোগভোগ কম হয়। ওই বাড়ির মাসীমা ফলেছিল। সেটাই মনে ছিল তারামনের। কিন্তু সত্যজীবন মাস্টারের বৌ ফিনাইলের ধারপাশ দিয়ে গেল না। ও ভারতী ঘর পুঁছতে গেলে বালতির জলে এট্টু খানি গোবর দিও কিন্তু। হেঁশেল মুক্ত করবে যখন তখন ও কিন্তু জলের ভেতর গোবল দিও। তোমরা সব জয় বাংলার লোক নাকি? এঁটোকাটার বিচার তোমাদের কি আছে বাপু কে জানে- সত্যজীবন মাস্টারের বৌয়ের কথায় একটু কুঁকড়েই গিয়েছিল তারামন। এই বাড়ির কাজে যখন দুগ্গার মা তাকে লাগিয়ে দেয়, পই পই করে বলে দিয়েছিল, তারামন যেন বেশি কথা না বলে। ভারতী নাম নিয়ে বামুন পন্ডিতের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে কোনো আদবকায়দায়, কথায় যদি আসলটা ধরা পড়ে যায়, তাহলে কাজ যাওয়া তো বটেই, এই ভাটপাড়াতে থাকাই যে অসম্ভব হয়ে পড়বে- তা খুব ভালো করেই জানে তারামন, এখনকার ভারতী।

                     

 

সত্যজীবন মাস্টারের বৌয়ের ঘর মোছার আদবকায়দা শুনে বেশ মুশকিলেই পড়ে গেল ভারতী। ভাটপাড়ার বামুনরা, ঘর মোছা কে, 'মুক্ত করা' বলে, এটা তারামন জেনে গিয়েছিল। কিন্তু শান বাঁধানো মেঝেতে গোবর জলে নিকোবে কী করে, এই চিন্তায় প্রায় রাতের ঘুম চলে যেতে বসলো তারামনের। এইসব আদবকায়দা ঘিরে যদি প্রশ্ন করে কিছু মাস্টারের বৌকে, তাহলে, সে যদি পাছে বাড়ির ঝিয়ের হিন্দুয়ানী নিয়ে সংশয়ী হয়ে পড়ে? - এই প্রশ্নটাই তখন কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে তারামনের মাথায়। এই সঙ্কটকেই কি ধর্মসঙ্কট বলে? এতো সাজিয়ে গুজিয়ে কথা ভাবতেও কখনো শেখেনি তারামন। তাই নিজের ধর্মপরিচয়কে চেপে রাখার বিষয়টা তার কাছে প্রচন্ড রকমেরই অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার হচ্ছে। তারামন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কখনো সখনো নামাজ আদায় করে। রোজার কালে সেহরির জন্যে যখন মসজিদ থেকে ডাক দিয়ে যেত বাড়ি বাড়ি, তখন উঠে পড়ে ফজরের নামাজ আদায় করতো তারা।

               

 

তেমনই এক ফজরের নেমাজ আদায়ের আগে রাস্তার কলে মুখ চোখ ধুতে গিয়েছিল তারা। রাস্তার কলে মুখ চোখ ধুয়ে রাতের আলসেমি কাটিয়ে ঘরে ওজু করে নামাজ আদায়ে বসবে- এমনটাই ভেবে রেখেছিল তারামন। আর ঠিক তখনই রাস্তার কলের পাশে চরণ ঘড়িওয়ালার বাড়ির দিকে নজর গিয়েছিল তারামনের। নজর যেতেই তারা দেখেছিল হাওয়ায় ভাসছে চরণের লাশটা। ভাঙাচোরা বাড়ির লোকটা কী করে, কী খায়, কী পড়ে -তার কোনো সুলুক সন্ধানই তারামনের জানা ছিল না। লোকটার যে অতসী সিনেমা হলের পাশে ঘড়ি সারাইয়ের দোকান ছিল, সে সবকিছু তারামন জানতো না। বড় রাস্তা ধরে ওই পথে কতবার তারামন আসা-যাওয়া করেছে। কিন্তু যাওয়া-আসার তাড়ায় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, হেলতে-দুলতে রাস্তায় চলার অভ্যাস যে তারামনের নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে ঝড়ের গতিতে তাকে ছুটতে হয় কাজের বাড়ির দিকে। একটু এদিক ওদিক দেখেদু-দশ জনের সঙ্গে একটু সুখ দুঃখের কথা বলে, কাজের বাড়ি পৌঁছতে গেলে যে দেরি হয়ে যাবে। আর দেরি হয়ে গেলে যে মুখ ঝামটা অবধারিত।

             

 

লোকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করলেও তারামন তার নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতাকে একটিবারের জন্য ছাড়তে পারে না। কাজের বাড়িতে নানা ধরনের মুখ ঝামটা তাকে শুনতেই হয়। সেই সব মুখ ঝামটার কথাগুলো যখন সে রাতের বেলায় সামনের বাড়ির রোয়াকে বসে দুগ্গার মাপরদেশিয়ার বউ আশা বা হানিফের বউকে বলে, তখন তারা প্রত্যেকেই পরামর্শ দেয়, কাজের বাড়ির মালকিন কখন কী বলল, সেসব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার। কিন্তু ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে কোথায় তারামন? আসলে তখন বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ লোকের বাড়ি ঝি গিরি করার কথা প্রায় ভাবতেই পারত না। আর পারতো না বলেই, সেই অংশের মানুষেরা যখন পেটের দায়ে এই কাজ করতে বাধ্য হতো, তখন তাদের গৃহস্থালি মনটাকে তারা পাষান চাপা দিয়ে মেরে ফেলতেও পারতো না। পারতো না বলেই কাজের বাড়ির মালকিন, একটু কথা বলতেই তারামনের মত মানুষের মনের ভিতরটা বিষন্নতায় ভরে যেত।

                   

 

সত্যজীবন মাস্টারের বউকে যখন প্রথম নিজের নামটা উচ্চারণ করতে যায় তারামন, একটা মুহূর্তের জন্য হলেও ওর জিভটা আটকে গিয়েছিল। আসলে মিথ্যে কথা বলা, এই জিনিসটার সঙ্গে কোনোদিন নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে নিতে পারেনি সে। তারার মনে মনে একটা ভয় যে তখন কাজ করেনি তা নয়। সেটা কেই হয়তো বলে ধর্ম ভয়! তারার একবার মনে হয়েছিল, সত্যজীবন মাস্টারের যখন মুসলমানের ছোঁয়া ঘিরে এত ওজর-আপত্তি, তখন সে মুসলমান মেয়ে হয়ে, হিন্দু নাম নিয়ে, তার বাড়িতে কাজ করার ফলে, যদি সত্যিই সত্যজীবনের জাত চলে যায়, তাহলে রোজ কেয়ামতে কি জবাব দেবে তারামন? বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠেছিল বেচারির। ভেবেছিল দরকার নেই এভাবে নিজের পরিচয় গোপন করে কাজ করবার। ভেবেছিল সে, যদি কেউ তার সঠিক নাম, সঠিক পরিচয় জেনে কাজ দেয়, তবে কাজ করবে। আর তখনই তারার মনের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল, তার ছেলে হাফিজুল, আর মেয়ে রোহিমার মুখটা। ছেলে-মেয়ে দুটো তাদের মায়ের মুখের দিকে চেয়ে, সামনে ঘোষেদের বাড়ির রোয়াকে বসে আছে। তারামন ফিরলে, কাজের বাড়িতে যে জল খাবার দেবে, সেই জল খাবারটা নিজে না খেয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য নিয়ে আসবে তাদের মা। ছেলেমেয়েরা দুটো খেতে পাবে। সেই প্রত্যাশাতেই পথের দিকে চেয়ে, চুপ করে বসে আছে হাফি আর রোহিমা।           

 

 

তারামনের পাশের ঘর ,রামায়ণ পাড়ের।রামায়ণের বউ দেওসুন্দরীর রামনরেশের বাড়িতে নিজের আধিপত্য কমে যাওয়ার ভয়ে ভোলা মিঞা মারা যাওয়ার পর থেকেই, তারামনকে এখান থেকে তাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তারামনের ঘর দখল করতে চায় দেওসুন্দরী। নিজের ঘরে দুই ছেলে নিয়ে দিন গুজরান সত্যিই কষ্টের। তাই নিজের ঘর লাগোয়া ভোলা মিঞার ঘরটা যদি দখল করা যায়, ভোলার বিধবা বউকে এখান থেকে তাড়িয়ে, তাহলে তো দেওসুন্দরীর সোনায় সোহাগা। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তারামন সত্যজীবন মাস্টারের বউয়ের প্রশ্নের জবাবে, নিজের নাম বলে ফেলে, ভারতী পাত্র। হিন্দুদের 'পাত্র' উপাধিটা আগে জানা ছিল না তারামনের। স্বামীর ঘর করতে এসে, সরস্বতী সাউয়ের পেছনের বস্তিতে গুরুপদর পদবী পাত্রটা নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে তারামন। এক নিঃশ্বাসে নিজের নাম আর পদবী বলতে পারার পরে সত্য জীবন মাস্টারের বাড়িতে ঝিয়ের চাকরিটা তখন পাকা হয়ে গিয়েছিল তারামন বিবির। দমদম স্টেশন থেকে ট্রেন কখন বেলঘড়িয়া, সোদপুর, আগরপাড়া, ব্যারাকপুর, শ্যামনগর, এমনকি কাঁকিনাড়া ছাড়িয়ে নৈহাটি স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে, সময়ের স্রোতে সাঁতার কাটতে থাকার কারণেই তারামন ঠিক বুঝতে পারেনি। ট্রেন থেকে নেমেই একটু অবাক হয়ে দেখল সে, এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে রেলের রেস্টুরেন্ট, ক্যাটার্সটা নেই। সেই জায়গায় নেমে গেছে সাবওয়ে। প্রায় কুড়ি বছর পর আবার নৈহাটিতে পা দিলো তারামন বিবি।

 

(ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়
  • দশম