পাঠকচিত্তকে বইয়ের অক্ষরে মানসভ্রমণের স্বাদ পাইয়ে দেওয়া, ভ্রমণ কথাকারের সবথেকে বড় সাফল্য। এই সাফল্য অর্জনের মুন্সিয়ানা যাঁর ঝুলিতে আছে, তিনিই সফল ভ্রমণ কথাকার-
সার্থক ভ্রমণনামা আমাদের বাড়িতে বসেই বেড়ানোর একটা আমেজ এনে দেয়। আমাদের মনুষ্য চোখে ভেসে ওঠে বেড়াতে যাবার নানা ধরনের আনন্দ। আমরা বেড়ানর নাম শুনলেই পাই উৎসাহ। আজকাল প্রকাশনীর অল্প কিছুকাল আগে প্রকাশিত 'সেরা সফল' গ্রন্থটি হাতে নিয়েই প্রথমেই আমাদের মন বিষন্ন হয়ে যায় সদ্য প্রয়াত মৌ রায়চৌধুরীর 'সফর নামা' নামক ছোট্ট নিবন্ধটি পড়ে। বেড়াতে যাওয়া ঘিরে বাঙালিকে উৎসাহিত করবার ক্ষেত্রে মাত্র দুটি স্তবকে লেখা তাঁর এই অসাধারণ আলেখ্যটি আমাদের স্মৃতি মেদুর করে তোলে। আমরা সৃষ্টি কাতর হয়ে যাই সেই অসামান্য মহীয়সীর প্রতি। বইটির সম্পাদক পল্লব বসুমল্লিক অসাধারণ লিখেছে; 'দেখার চোখ নাই' নামক ছোট্ট নিবন্ধটি। যে কোনো ভ্রমণে, এটা মানস ভ্রমণ হোক বা সরাসরি ভ্রমণ হোক, দেখবার চোখটাই হল সবথেকে বড় কথা। এই দেখবার চোখ থাকলে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দুর কথা বলেছিলেন, তেমনভাবেই সবকিছু দেখতে পাওয়া যায়। জানতে পারা যায় যায়। বুঝতে পারা যায়। আর দেখার চোখ যদি না থাকে, তাহলে গোটা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে ঘুরে বেড়ালেও আমাদের দেখা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।
সত্যম রায়চৌধুরী নিবন্ধ 'শীতের বিকেলে ডাক দিল বনলতা সেন' আমাদের নিয়ে চলে যায় এক স্মৃতি কাতরতার মধ্যে। সীমান্তকে অস্বীকার করে বাঙালি মানসের সেই চিরন্তন গহীনে অবগাহন আমাদেরকে নিয়ে চলে যায় এক নস্টালজিক ভুবনে। নাটোরের বনলতা সেনের অভিব্যক্তির ভেতর দিয়ে লেখক যেখানে জাগিয়ে তুলছেন বাংলাদেশ-ভারত পঞ্চম সংস্কৃতিক মিলনমেলার এক অসামান্য আলেখ্য। সেখানে আমাদের মনে হয় একটাই কথা; অনুকরণ খোলস ভেদি শাশ্বত বাঙালি হওয়ার যে চিরন্তন ধ্বনি এখানে সত্যমবাবুর লেখার মধ্যে দিয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল, তা যেন আমরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। আর সেই উপলব্ধি যেন আমাদের জীবনের প্রতিটি তন্তুকে উদ্ভাসিত করে। বাঙালির ভ্রমণ মানুষের এককালের অবিভক্ত ভারত একটা বড় জায়গা করে আছে। তাই বাঙালি, সেদিনের ভারতের অংশ, আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বা আর এক প্রতিবেশি রাষ্ট্র পাকিস্তা,ন যার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক চাপান-উতোরের পারদ থাকলেও, সুযোগ করতে পারলে এইসব জায়গাগুলিতে যেতে ভালবাসে। বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যাপারটা যতটা সহজ, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যাওয়াটা তত সহজ নয়। সেসব অতিক্রম করে শিল্পী শুভাপ্রসন্নের হরপ্পা মহেঞ্জোদারো ভ্রমণের যে আলেখ্য এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা আমাদের কাছে একটা বড় রকমের প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তির রেশ আমাদের খুব সহজেই পৌঁছে দিয়েছে ভারতের ইতিহাসের এক আদিগন্ত পর্বে। শুভাপ্রসন্ন এখানে কাগজ-কলমে লেখেননি, কাগজ-কলমে যেন তিনি ছবি এঁকেছেন, হরপ্পা মহেঞ্জোদারো যাকে এক কথায় আমরা হরপ্পা সভ্যতা বলি, তার নানা দৃশ্যমান বিষয়বস্তুর।
সেই ছবি আমাদের কাছে, আমাদের ঐতিহ্যের মূলধারা সম্পর্কে এক আনন্দের যোগান দেয়। আমরা যেন চোখের উপরে দেখতে পাই, হরপ্পা সভ্যতার নানান বিষয়বস্তুকে। সেই সময়কালের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তাকে। সামাজিক নানান আচার-আচরণগুলিকে। অবশ্যই অর্থনৈতিক জীবনেরও একটা স্বাদ আমরা শুভাপ্রসন্নের এই আলেখ্য থেকে পাই। শুভাপ্রসন্নের এই ভ্রমণ আলোক্যটি যে কেবলমাত্র হরপ্পা মহেঞ্জোদারো ভ্রমণ বৃত্তান্ত তাই নয়। এটি আমাদের কাছে প্রায় অচেনা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, তাঁদের খাদ্যাভ্যাস, তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদ, তাঁদের চিত্রকলা ঘিরে আগ্রহ, সাহিত্য ঘিরে আগ্রহ, সংগীত ঘিরে আগ্রহ -এই সমস্ত কিছুকেই একটা বোধে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেগুলি সম্পর্কে সেভাবে আলোচনা, আমাদের সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না, সেই সমস্ত অঞ্চলগুলিও তাঁদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসহকারে উঠে এসেছে শুভাপ্রসন্নের এই অসামান্য আলোচ্যের ভিতর দিয়ে। আমরা যেন বিভাগপূর্ব ভারতের সেই সময়কালের অনেক ছায়াচিত্র এক জায়গায় দেখতে পেলাম শুভাপ্রসন্নের এই লেখার ভেতর দিয়ে। লেখাটির মধ্যে দিয়ে আমাদের যেমন ইতিহাস বোধের একটা নবনির্মাণ ঘটলো, ঠিক তেমনি আমাদের ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির একটা বিশেষ ধারা সম্পর্কে ধারণা তৈরি করল। দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিবর্তনে ভারতীয় সংস্কৃতির ধারা, রাজনৈতিকভাবে তার বিকিকরণ ঘটলেও, প্রাণের সুরে যে একটা অদ্ভুত মানুষের ঐক্যের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, সেটাই উঠে এসেছে শুভাপ্রসন্নের এই অনবদ্য আলেখ্যটির ভেতরে।
শ্যামলী আচার্যের' ম্যাকলাক্সিগঞ্জে উষ্ণতার খোঁজে 'আমাদের পৌঁছে দেয় যেন এক জাদু বাস্তবতায়। আমরা খুঁজে পাই বুদ্ধদেব গুহের পরশ। আমরা খুঁজে পাই আমাদের একটা সময়ের পাওয়া না পাওয়ার খতিয়ানে এক ধরনের অদ্ভুত ভালোলাগা। সেই ভালোলাগারে রেশ যেন ছড়িয়ে আছে শ্যামলী আচার্যের লেখাটির প্রায় প্রতিটি পরতে। যে পরতে আমরা অনুভব করতে পারি, আমাদের অস্তিত্বের সার্বিক সত্তার একটা গুন। অনুভব করতে পারি, আমাদের মননশীলতার সঙ্গে ভ্রমণপিপাসু মানসিকতার মেলবন্ধনের এক অনবদ্য দিক। শুভঙ্কর দে র 'নিজেকে সত্যিই গরু মনে হয়েছিল', তেমনি আরও একটি জাদু বাস্তবতা মেলানো লেখা। যে লেখার ভেতর দিয়ে স্বপ্ন-সত্য-বাস্তব এবং পরাবাস্তব কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আর তার ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমরা যেন চলে যাচ্ছি এক অচিন লোকে। যে অচিন লোকের মধ্যে আমাদের স্বপ্ন বাস্তবতার ছবি বেঁচে থাকে কোন গহীন লোকের প্রত্যাশায়।
'কাঁকড়াঝোড়ের দিনরাত্রি' প্রচেত গুপ্তের এই লেখা যেন তাঁর কথাসাহিত্যের মতোই এক অনবদ্য স্বাদু ভ্রমণ কাহিনী। এই দিনরাত্রির মধ্যে আমরা খুঁজে পাই, আমাদের জীবনের ফেলে আসা দিন। মুছে যাওয়া দিন। আবার তার মধ্যেই উঁকি দেয় আগামীর ভবিষ্যৎ। এটাই বোধহয় প্রচেতবাবুর লেখার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য যে, দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যেও একটা প্রত্যাশা তিনি জাগিয়ে রাখেন পাঠক চিত্তে। পাঠককে তিনি কখনো হতাশ হতে দেন না। দুরাশায় নিমগ্ন হতে দেন না। দুরাশা থেকে আশার অভিনিবেশে প্রচৃত গুপ্তের যে যাত্রা, তা আমাদের কাছে একটা নতুন ধরনের প্রত্যাশা জাগায়। সেই প্রত্যাশার মধ্যে দিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি এবং বাস্তবের ভিত্তি নির্মাণ করি।
সেরা সফর
প্রধান উপদেষ্টা
মৌ রায়চৌধুরী
সম্পাদনা
পল্লব বসুমল্লিক
আজকাল
২৫০ টাকা।