প্র্যাকটিস

বাজারের থলেটার দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও একবার যেন পিছিয়ে এলো গদা। যাব বাজারে? মা তো বলেনি কিছু বাজারের কথা। কালকের যা আছে তা দিয়ে চলে যাবে না আজকের দিনটা?- একটু যেন বেমানান আলসেমিতেই ভাবে গদা। আসলে কাল নাইট শিফ্টে কাজের পরই লক আউট নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে মিল মালিক। সকালে যখন ছটার বাঁশি বাজার একটু আগেই ও কেটে পড়বার ফিকির খুঁজছিল দেখলো ওদের ঘরে সকলেরই কেমন যেন একটা ঢিলে ঢালা ভাব। আসলে রাতে বয়লার ঘরে দুটোর পর সত্যিই তেমন কোনো আর কাজ থাকে না। তাই পাটের ফেঁসোর গাঁটরির উপর গদা একটু গা এলিয়ে দিতেই চোখটা লেগে গিয়েছিল। পাটের গাঁটরির নরম লেগেই হোক আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির জেরেই হোক ডিউটি আওয়ার্সের ভিতরে মোদ্দা কথা হলো গদা একটু ঘুমিয়েই পড়েছিল। পাটের গাঁটরির উপরে চিৎ হয়েই শুতে হয়। পাশ ফিরে শুয়েছো কি প্রপাত চ মমাত চ। এমনিতেই পাটের গাঁটরি গুলো একটু স্লিপারি হয়। তারপর স্তুপ করে রাখা থাকে। একদিকে ভার পড়লেই অন্যদিকটা গড়িয়ে পড়ে। গদার আবার চিৎ হয়ে বেশিক্ষণ শোবার অভ্যাস নেই। আসলে ওদের ঘরখানার যা ছিরি। সেই ঘরে শোবার জন্যে যে চৌকি খানা আছে তাতে বাড়ির সকলের হয় না। গরমকালে লাইনঘরের সামনের দিকের বারান্দাতেই পুরুষ মানুষদের সব ঢালা বিছিনা হয়। তবে সেই রোয়াকেও অল্পই জায়গা থাকে। ফলে চিৎ হয়ে শোবার আরাম থেকে গদারা চিরদিনই বঞ্চিত। তাই বাড়ির শোবার অভ্যাসেই পাটের গাঁটরিগুলোর উপরে একটু পরেই পাশ ফিরে শুতে গিয়ে সুড়ুৎ করে একদম পাটের পাহাড় থেকে নীচে গলে গেল গদা। আর তখনই কাঁচা ঘুমটা ভেঙে শুনতে পেল সকাল ছটার বাঁশি বাজছে মিলের।

                       

 

 

এই সকালের বাঁশিটা মিলের নাইট ডিউটি দেওয়া লেবারদের কাছে "ছুটির বাঁশি"। এরা কেউই প্রায় রবীন্দ্রনাথ পড়েনি। আগে তো এই চটকলে লেবারের কাজে বাঙালিরা প্রায় ছিলই না। গদাদের আগের জেনারেশন জুটমিলের লেবার ফলতে ছিল হিন্দিভাষী মানুষজন। তখন ছাপড়া, সিওয়ান, বালিয়া, মজফফরপুরের লোকেরা ভিড় জমাতো গঙ্গার দুপারের যতো চটকলগুলোতে। সেসব দেশভাগের আগেকার কথা। দেশভাগ দিল সব উল্টে পাল্টে। ছাপড়ার পরসতিপুরের রামায়ণ পাঁড়ে কি দানাপুরের হানিফের সঙ্গে মিলের তাঁত ঘরে হাত লাগালো বরিশালের বজ্রযোগিনী থেকে এক বস্ত্রে এই নৈহাটি জুটমিল লাগোয়া মুক্তোপুর শ্মশানের পাশের বস্তিতে বসত করা গুরুপদ। এই গদারই বাবা। গুরুপদ যখন জুটমিলে চাকরি নিয়েছিল তখন জুটমিলে মেয়ে লেবার বলতে ছিল সব বিহারীরা। চটের বস্তা সেলাই ছিল ওদের কাজ। ওই ডিপার্টমেন্ট, চটকলিয়া ভাষাতে ডিপাটের নামই হয়ে গিয়েছিল 'মাদী কল' । এখন এই 'মাদি কলে' কতো বাঙালি শ্রমিক। তবে বেশ কয়েক বছর আগে এই 'মাদি কলে' রাতের বেলায় পুরুষের বীরত্বের কারণে ইউনিয়নের আন্দোলনের জেরে এখন রাতের বেলা 'মাদি কল' সম্পুর্ণ বন্ধ।

                       

 

 

 পাটের গাঁটরির উপর থেকে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে গড়িয়ে পড়েই মিলের বাঁশি শুনে ধরফরিয়ে উঠে গদা কেমন যেন একটু অবাকই হয়ে গেল। শিফট বদলির কোনো বোলচাল নেই। অন্যদিন এ শিফট শুরুর সময়ে সকালে লেবাররা ঢুকে তখনই শোরগোল ফেলে দেয়। আজ একটু কেমন যেন চুপ চাপ লাগছে চারদিকটা। বেশি লোকও দেখা যাচ্ছে না। মাদি কলের দিক থেকে মেয়েছেলেদের হইহুল্লোরও তেমন একটা কানে আসছে না। গদা একবার ভাবল, ও কি একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছিল? অনেকটাই বেলা হয়ে খেছে? পরের শিফটের ডিউটি চালু হয়ে গেছে? ভাবতে ভাবতেই ওর কানে মিলের পরের ভোঁটা আবার কানে এলো বলে মনে হলো। কান খাড়া করলো গদা। কৈ? না তো? ছটার ঠিক পরের বাঁশীটা তো বাজলো না, -ভাবে গদা। তাহলে কি অনেকক্ষণ হয়ে গেল পরের শিফটের? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ এক নম্বর গেটের খেটের দারোয়ান যমুনা সিং এসে তাড়া দেয় কা হো? ঘর যানে কো ইচ্ছা নইখে? এহিযাই রহোগি? নিকল যাও। জলদি সে নিকালো। মিল কে গেট পর আভ্ভি তালা লাগ যায় গি। না দেখলে বারণ নোটিশোয়া? বাইরের দিকে তাকিয়ে গদা দেখে মিল প্রায় ভোঁ ভাঁ। তাড়াতাড়িতে বেরোতে গিয়ে লুঙ্গিটাই নড়তে ভুলে যায়। রাতে কাজের সময়ে লুঙ্গি খুলে আন্ডারপ্যান্ট পড়ে ওদের সকলেরই কাজ করা অভ্যাস। আবার ডিউটি শেষ হলে যে যার মতো লুঙ্গি, কেউ বা ফুল প্যান্ট পড়ে আবার গরে ফেরাটাই চটকলিয়া রেওয়াজ। সেদিন দারোয়ান যমুনা সিংয়ের তাগাদায় সাধের লুঙ্গিখানা পাটের গাঁটরির উপরে রেখেই মিলের গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে গদা দেখে চাথিদিক লোক লোকারণ্য। দুটো পুলিশের গাড়িও এরই মধ্যে এসে গিয়েছে। চারদিকে একটা চাপা উত্তেজনা।

                     

 

 

মিল মালিকের পোষা দারোয়ানরা মিলের ভিতরে যেকজন লেবার ছিল তাদের প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে ছাগল গরুর মতো বের করে দিচ্ছে। ততোক্ষণে এসে গেছে পরমনাথ সিং। মিলের ট্রেড ইউনিয়নের কংগ্রেসী নেতা। বিহারের মানুষ। নিজের গ্রাম থেকে যতো পেরেছে দেশোওয়ালী ভাইদের ধরে ধরে এনে মিলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটু পড়াশুনা জানা লোকগুলোকে ঢুকিয়ে দিয়েছে "বাবু" র পোস্টে। ধরমনাথের সঙ্খে আছে শ্যামু মুখার্জী। আছে চাঁদু বাবু। এরা মিলটাকে এমনভাবে গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের ভিতরে যে লাল পার্টির ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে বিশেষ ঝামেলা ঝঞ্ঝাট কারোকেই পোয়াতে হয় না।  এই তো কদিন আগে লাল পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন লিডার গনোবাবু সাত সকালে মক্কেশর ঘাটে মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে ফ্রি হান্ড এক্সারসাইজ করতে গিয়ে ঘাড় মটকে পড়ে গেল। ডাক্তাররা সেরিব্রাল অ্যাটাক বললেও কুলি লাইনের সবাই একবাক্যে বললো; লেবারদের পিএফের টাকা জমা না করে বড়ো রাস্তার ধারে বিরাট বাড়ি হাঁকিয়েছে বলে চূড়ন এসে ওর ঘাড় মটকে দিয়েছে। আসলে এটাই এখন লাল, নীল, সবুজ, হলুদ -যে কিসিমের ই হোক না কেন -ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সম্পর্কে এক্কেবারে খেটে খাওয়া লেবারদের একটা বড়ো অংশের কমন ভিউ।              

 

 

 

লেবারদের ট্রেড ইউনিয়ন লিডারদের সম্পর্কে এই কমন ভিউয়ের বাইরের লোক এই গদা নয়। শ্রেণি সচেতনতার বিরাট কিছু ফান্ডা ওর নেই। তা বলে ট্রেড ইউনিয়ন লিডারদের প্রতি অচলা ভক্তিও ওর নেই। গনো অর্থাৎ, গণপতি দে মারা যাওয়ার পর শ্যামুদার সামনে ওর টক দইয়ের চাট দিয়ে বাংলা মাল খাওয়া নিয়ে একদিন বেশ মশকরা করছিল গদা, কালা, সত্য, আলগুরা। ওদের সেই মশকরা শুনে শ্যামুদার কি রাগ। তোরা মরা মানুষটাকেও ছাড়ছিস না? - বেশ ঝাঁজের সঙ্গেই বলেছিল শ্যামপদ মুখার্জী। আড়ালে বলেছিল গদা; একেই বুঝি বলে চটকলিয়া দিমাগ। শালা লাল পাট্টির গনোবাবুর জন্যে দেখোনা কংগ্রেসী লিডারের পেরাণটা কেমন আকুলি বিকুলি করছে। এসব ভাবতে ভাবতে আর বাজারের থলেটা নিলোনা গদা। মনে মনে বলল; লক আউটের বাজারে রোজ রোজ বাজারে যাওয়া কি? একদিনের বাজারে দুদিন খাওয়া এই লক আউটের প্রথম দিন থেকেই প্রাকটিস করতে হবে। প্রাকটিসে কি না হয়? প্রাকটিসের জোরেই তো সব ট্রেড ইউনিয়নকে ম্যানেজ করে নিয়ে মিল লক আউটের সাহস পায় মিল মালিক। বাজারের ব্যাগের দিকে হাত না বাড়িয়ে বালিশের নীচে বিড়ির কৌটোটার দিকেই আপাতত হাত বাড়ায় গদা। ছেলের মতিগতি ঠাওর করতে না পেরে ঘরের বাইরের এজমালি রোয়াকে বসে উনুন ধরানোর জন্যে ল্যাম্ফোটা জ্বালে গদার মা। হাত বাড়ায় তেলজুটের কৌটোটার দিকে।

  • শুভ্রদীপ্ত ভট্টাচার্য
img
আগের পাতা
ডেলিভারিকাহন