ডেলিভারি -এই শব্দটার বাংলা যে সরবরাহ, সেটা আমরা বাঙালিরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। ইংরেজি উচ্চারণেই আমাদের তৃপ্তি। আর সেই তৃপ্তির ভিতরেই লুকিয়ে থাকে কিছু মানুষের গুমরে ওঠা কান্না-
কোম্পানির লোগোওয়ালা টিশার্ট পরে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায়। ছিল বলাটা ভুল হল, ছিলেন। রাত নটা। প্রবল বৃষ্টি তখন। বছর পঁয়ত্রিশের মানুষটা কাঁপছিলেন। পাশে যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁকে বললেন, “একটু কপালে হাত দিয়ে দেখবেন দাদা, জ্বর এলো কিনা? শরীরটা বড় খারাপ লাগছে। গা বমি বমি। সেই সকাল সাড়ে আটটায় খেয়েছি। খিদে নেই মোটে।” পাশের ভদ্রলোক টলছিলেন। শরীর থেকে ভকভক করছিল দেশি মদের গন্ধ। বললেন, “আমি কি আপনার রক্ষিতা নাকি? নিজের গায়ের টেম্পারেচর নিজেই দেখুন না দাদা। যত সব আলফাল লোকের উদয় হয় এই সন্ধেবেলায়।” টিশার্ট পরা লোকটি এবার আমার দিকে মুখ ফেরালেন। কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের পাশে আমি তখন হন্তদন্ত। অফিসফেরত বাড়িমুখো। হাত দিলাম কপালে। দেওয়ালে ফোটো হয়ে যাওয়া দিদুনের কথাগুলো ধার করে বললাম, “সেকি! গা পুড়ে যাচ্ছে তো। বাড়ি ফিরুন এক্ষুণি।” ভদ্রলোক আমার দিয়ে কেমন যেন তাকালেন। বললেন, “বাড়ি যাব বললেই কি ঘরে ফেরা যায় দাদা! এখন যে আমার মেলা কাজ!” এর পরে যে কথোপকথন মনের রেকর্ডারে রেকর্ড করেছিলাম, তা অনেকটা এ রকম।
-কটা পর্যন্ত ডিউটি?
-রাত দুটো পর্যন্ত দাদা। কোনওদিন আড়াইটে তিনটেও হয়ে যায়।
-একটা কথা বলি,কিছু যদি না মনে করেন! বারোটার পরে যে অর্ডারগুলো আসে তা কিসের?
-বলব না। আপনি কে? যদি ফাঁস করে দেন আমার চাকরি চলে যাবে।
-আপনার নামই তো আমি জানতে চাইনি এখনও। নির্ভয়ে বলুন।
-মা কালীর দিব্যি?
-দিব্যি।
-যে অর্ডারগুলো আসে, তা মূলত মদের। এগুলো ফোন মারফৎ আসে। অ্যাপে নয়।
-খাবার দাবার?
-তুলনায় অনেক কম। কোল্ড ড্রিংক আসে টুকটাক।
-আপনাদের কোম্পানির কি সারারাত সাপ্লাই?
-সারারাত।
-আপনারা কি ওষুধের সাপ্লাইও করেন?
-আমি করি না। আমার বন্ধুরা করে। অন্য কোম্পানির।
-মধ্যরাতে ওষুধের অর্ডার আসে না?
- বলব না। আমার চাকরি চলে যাবে। বারণ আছে।
-আপনার নামই তো আমি জানতে চাইনি এখনও।
- তা হলে বলি?
-বলুন। নির্দ্বিধায় বলুন।
-কেন এত রাতে খাটি জানেন? কেন ঘুমোই না জানেন?
-বলুন না।
-রাত্রিবেলায় রোজগার বেশি হয়। মধ্যরাতে যে বাড়িতে কলিংবেল টিপি, তারা তো অধিকাংশ সময়েই টলমল করেন। বাইকের অ্যাক্সিলেরাটের আক্রোশে চেপে যখন গতি বাড়াই, ফোন আসে হঠাৎ। কাস্টমার বলেন, পাড়ার মোড়ের কোনও দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসবে ভাই, কিং সাইজ? আমি আরো একশ টাকা এক্সট্রা দেবো। এটাই আমার টিপস্ দাদা।
-লিকারের অর্ডার নেওয়া তো তোমাদের অ্যাপ বন্ধ করে দেয় দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ। তার পরে?
-সেটিং আছে দাদা।
-দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আবার কি সেটিং? এ তো আইন বিরুদ্ধ।
ডেলিভারি বয় আমার দিকে চেয়ে এবারে হাসলেন। তির্যক। পকেট থেকে একটি নোংরা, তেলচিটে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। ঘাড়েরও।
-কত লোক রেগুলার মদের অর্ডার দেয় জানেন? হেড অফিসে যে বাবুরা বসেন মাসে লাখখানেক টাকা মাইনে পেয়ে, তাদের কাছে ডেটাবেস আছে। যে কাস্টমারগুলো অর্ডার করে রোজ, ওদের কাছে ওরা লয়্যাল কাস্টমার।
-তাই নাকি? লয়্যাল খরিদ্দাররা আর কি করে?
-আমাদের নম্বর সেভ করে রাখে স্যার। জিজ্ঞেস করে, দোকান বন্ধ করে দেওয়ার পরেও যদি আমার তেষ্টা পায়, তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে, বাডি? বাডি মানে জানেন তো? বন্ধু।
-তুমি কি বলো?
-ব্ল্যাকে কিনি। আপনাকে একটা কথা বলে দিই স্যার। মদের দোকানের শর্ট ফর্মও হল এটিএম। এনি টাইম মদ। দুশো টাকা বেশি দিয়ে কিনে চারশ টাকা এক্সট্রা আদায় করি কাস্টমারের থেকে। নো দরাদরি। রাতের ডিউটির মজা তো এটাই। আপনাকে এতো কথা বলে ফেললাম, আপনি আমার চাকরি খাবেন না তো? আমি তো দিনের শেষে একটা দালাল স্যার।
-ভাল লাগে এ কাজ করতে তোমার?
-পাপী পেট কা সওয়াল। তবে তিন বছর এ কাজ করে বুঝেছি, পাপী পেট শুধু ভাত চায় না। আরও কিছু চায়। রাত বাড়লে টিপস্ উপচে পড়ে আরও।
শুধুমাত্র একজনের সঙ্গে কথা বলে কোনও বাক্যের সামনে ‘বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী’-র তকমা সেঁটে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন ডেলিভারি অ্যাপের একাধিক ডেলিভারি বয়ের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি, তা হল, যত রাত বাড়ে, আমদানির সুযোগ বাড়ে তত। একজন তো বলেই দিলেন, “খিদে মানে যে শুধু খাবার, এ কথা আপনাকে বলল কে?” শুনেছিলাম, “অনেক ফোন পেয়েছি কাস্টমারদের কাছ থেকে দাদা। শুনতে হয়েছে, তুমি তো রাতবিরেতে ডেলিভারি দাও। ভাল মাংসের সন্ধান দিতে পারো? কত টাকা লাগবে বলো। মাংস মানে কি মিন করছি, আশা করছি আর এক্সপ্লেন করতে হবে না।”
সমীক্ষার রিপোর্ট বলে, অনলাইন খুচরো বিপনির ব্যবসা বাড়ছে ক্রমশ। করোনাকাল আমাদের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে বসে থাকার যে প্রবণতা তৈরি করেছিল, তার থেকে অনেকাংশেই আমরা বাইরে বেরিয়ে উঠতে পারিনি আজও। ঘরে বসে পণ্যের ডেলিভারি পাওয়ার বিভিন্ন অ্যাপ-সখার বাড়বাড়ন্ত তো সেই সময় থেকেই। এখনও না ছাপা ক্যালেন্ডারের পাতাগুলোয় আমাদের কেনাকাটার পরিণতি অনলাইনই কি না, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক করেছেন ওয়াকিবহাল মহলের বিশেষজ্ঞরা। এ তর্ক নিরন্তর। একদল বলেছিলেন, “ইন্ডিয়ার মোড়কমাখা দেশটির মধ্যে আসলে ভারত বাস করে। পাড়ার মোড়ের চিরাচরিত, সাবেকি লক্ষ্মী ভান্ডার কিংবা শান্তি স্টোরস-এর ঝাঁপ বন্ধ হবে—এমন ঘটনা ঘটানোর সাধ্য নেই কারও।” অন্য পক্ষের মানুষরা মুচকি হেসে বলতেন, “ওয়েট, ব্রাদার, ওয়েট। কয়েকটা বছর যেতে দাও! মালুম হবে সবই।”
একটি সাম্প্রতিক দেশজ সমীক্ষা বলছে, গত এক বছরে দেশে যে পরিমাণ মুদির দোকান বন্ধ হয়েছে তার সংখ্যা দু লক্ষ ছাড়িয়েছে। এর ৪৫ শতাংশ দোকানই মেট্রো শহরে। মানুষের অনলাইন আসক্তিই ত্রিশূল গেঁথেছে এই সাবেকি দোকানের গায়ে। সাবেকি দোকানের থেকে কম দাম, তড়িৎগতিতে ডেলিভারি, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিল মেটানোর সুবিধা, অর্ডারের সঙ্গে কখনও কখনও সারপ্রাইজ গিফ্টের প্রাপ্তিযোগ আর সর্বোপরি বাড়ির কোটরে বসে অ্যাপের আরাম—এগুলিই সম্ভবত অনলাইন বিপনির বাড়বাড়ন্তের মূল কারণ। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য খুচরো বিপনির অফলাইন চেইনগুলিও পাশাপাশি চালু করে দিয়েছে অ্যাপ পরিষেবা। পিছিয়ে নেই পণ্যের উৎপাদক সংস্থাগুলিও। ওয়েবসাইট খুললেই ঝালরের মতো চলে আসে প্রথম পেজ—ডেলিভারি অ্যাট ইওর ডোরস্টেপ। এক্সপ্লোর নাউ। শুন্য আর এক দিয়ে ঘেরা বাইনারি দুনিয়ায় বাঁচার জন্য বিভিন্ন সংস্থা স্নাত হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের ফান্ডিংয়ে। আর আমাদের, উপভোক্তাদের আরাম বাড়ছে রোজ। হাল আমলে বাজার করার জন্য ঘাম ঝরানো পুরনো হয়ে যাওয়া বইয়ের হলুদ, বিবর্ণ পাতার মতো লাগে। শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত শপিং মলে ট্রলি ঠেলে বিলিং কাউন্টারে দাঁড়ানোর কাহিনীও কি ‘এবার তাহলে চলি বলার’ অপেক্ষায়? জানা নেই।
বহু প্রশ্ন বাদুড়ের ডানার মতো ঝাপটাতে থাকে মাথার গভীরে। কেনাকাটার নয়া কৌশল নিয়ে অভিমানমাখা অভিযোগ এ যুগে মূর্খামি। বদলে যাওয়া সমাজের সঙ্গে বদলে যেতে হয় নিজেদেরও। মহাকালের গায়ে লাগানো চাকাগুলো না হলে ঘুরবে না কখনও। যোগ্যতমরাই বেঁচে থাকে। ক্রেতাদের অর্ডার করা বিরিয়ানির সংখ্যা কোটি ছাড়ালে কলার তুলে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দেয় কোনও ফুড ডেলিভারি অ্যাপ। অর্ডার করার পরে বাড়িতে পণ্য পৌঁছনোর জন্য গড়ে কত মিনিট কত সেকেন্ড লাগছে আর তা প্রতি বছর কি হারে কমছে তা নিয়ে জানা যায় গর্বমাখা পরিসংখ্যান। জানতে পারি, সপ্তাহে গড়ে ছটি মহার্ঘ ঘন্টা আমরা ব্যয় করি অ্যাপমাধ্যমে বাজার করার জন্য। এই সময় বেড়েই চলেছে ক্রমশ।
এক বাজার বিশেষজ্ঞকে আকাশের দিকে চেয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুনেছিলাম, “কোনটা যে আমাদের ঠিক কতটা প্রয়োজন এবং কত তাড়াতাড়ি প্রয়োজন, সেটাই আমরা বুঝতে পারলাম না আজও। কোনও ওষুধ ডেলিভারির অ্যাপকে কি গর্ব করার মতো পরিসংখ্যান দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে দেখেছো কখনও?” বিজ্ঞাপন তো দূরের ব্যাপার। তথ্যই মেলেনা। আমিও আন্তর্জালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম প্রাসঙ্গিক তথ্য। সার্চ ইঞ্জিনের পর্দা মুখ লুকিয়েছিল লজ্জায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, অ্যাপ মারফৎ রাত দেড়টায় ফিশফ্রাই অর্ডার করলে চলে আসে ঠিক দশ মিনিটে। প্যারাসিটামল পেতে চাইলে ঘন্টাচারেক লেগে যায়। কোনটা বেশি আপৎকালীন কিংবা জরুরি, বুঝতে পারি না। ফিশফ্রাই না পেলে ঘরে থাকা বিস্কিটে হয়তো কাজ চলে যেতো সে রাতে। তবে, ট্যাবলেটটি প্যারাসিটামল না হয়ে হতেই পারতো কোনও জীবনদায়ী ওষুধ। মধ্যরাত্রে অ্যাপে অর্ডার করে ওষুধ না পেয়ে কিংবা অনেক দেরি করে পেয়ে কত মানুষ আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন—এমন পরিসংখ্যান জানতে চাওয়া বৃথা। কিন্তু যদি জানতে চাই মাটন বিরিয়ানির সঙ্গে কত লোক চিকেন চাঁপের কম্বো হাঁকিয়েছেন, প্রজাপতির মতো ল্যাপটপের পর্দায় পাখা মেলে স্ট্যাটিসটিক্স।
মুঠোফোনের জমানায় আমাদের এখন এক ছোঁয়াতেই সমুদ্দুর। কিংবা দশ মিনিটেই গন্ধমাদন বাড়ির দোরগোড়ায়। লেখাটি শুরু করেছিলাম লিকার ডেলিভারির প্রসঙ্গ তুলে। ওয়াইন শপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে দোকানি-ক্রেতা-বিক্রেতা-ডেলিভারি বয়দের ব্যাক্তিগত ‘সেটিং’-এর দায় কোনওভাবেই অ্যাপ ডেলিভারি সংস্থার উপরে বর্তায় না। এ কথা বলাই বাহুল্য। তবে অ্যাপের অন্দরে ঘটছে যা, বাইরে ঘটছে তার হাজারগুণ।
তুমুল নিঃসঙ্গ কোনও মানুষ যদি রাত আড়াইটেয় কারও সঙ্গে কথা বলে ভারমুক্ত হতে চান, কিংবা বাথরুমে পড়ে গিয়ে জরুরি সাহায্য চান কোনও একাকী বৃদ্ধা অসময়ে, দশ মিনিটে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিতে আমাদের আধুনিক পৃথিবীর অ্যাপ তৈরি তো?
সহমর্মিতার কি ইনস্ট্যান্ট ডেলিভারি হয়?