উত্তরের কবিতা

এখানে মৃত্যু দায়ী...
শুভঙ্কর পাল 

কে যেন লিখে রাখে উটের পিঠে স্বদেশ চলেছে 
আর ভাতের পরে মৃত্যু লেখে দি লাস্ট সাপারের দৃশ্য 
সত্যি বলছি বুকের নীচে হাজারটা ব্যথা ঘুমোতে দেয়না আমাকে 
কতগুলি নগ্ন হাত আর পেঁচাদের ইশরায় প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে নিচ্ছে উল্লাস 
উন্মাদের পাঠক্রম ভেঙে গোটা দেশ এখন ধর্মের উগ্র কাফন টেনে নিয়েছে 
একটা কাঁটাতার পেড়িয়ে এলেই সারারাত মুখ ও মুখোশ বদল
শকুনেরা খুবলে খায় পাঁপড়ির সুগন্ধী ঘাস 
কতটা জেনে গেলে মানুষ পিশাচের মতো দাঁত নখ বের করে হাসতে পারে 
আর ঘাসেদের নরম ফুলের আত্মহননের গল্প শোনায় 
একটা মেয়ে উপন্যাসের প্লট জুড়ে মশাল আর মুঠিবদ্ধ হাতের আদল হয়ে ওঠে 
সারারাত জেগে থাকে শহর থেকে গ্রাম 
অক্ষরহীন শব্দের সাঁকো পেরিয়ে বিচারের বাণী চিরন্তনী হয়ে ওঠার উপাখ্যান।

 

 


বারান্দাকথা ৩

সপ্তর্ষি বনিক

সকাল জুড়ে মেঘ করে। বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিদিনের আওয়াজ মিশে যায় গানের দোতরায়। বারান্দা তখন হাসির পুকুর, আমাদের ষষ্ঠীদিনের রোদ। গান ফুরিয়ে এলে বুক কেঁপে ওঠে, যেমন বৃষ্টি ফুরিয়ে এলে ব্যাঙ। দিনযাপন চলছে। সময়ের হিসেব রাখতে আঁক কাটি। জল ফুরিয়ে যায় গ্লাসের। সময় কতটুকু বাকি। পেরিয়ে গেল শরতের দুপুর। প্রসাদ খাবার বিকেল। ধীরে ধীরে কমে আসে বেলা। রাতের সময় বাড়ে। ভয় কাটানোর জন্য ধুপ জ্বালি। রাত বাড়ে, টিকটিক শব্দে ঘড়ি জানান দেয় সময় আসছে, ফুরিয়ে যাবার। বারান্দার জন্য ভয় ধরে, খুব ভয়, স্বপ্ন না দেখার প্রার্থনা করতে করতে চোখ বুজে আসে…

 

 


ভালবাসতে গেলে 
বিনীতা সরকর 

ভালবাসতে গেলে ঝড় জলের কথা ভাবতে নেই 
ভালোবেসে যেতে হয় 
আগে পিছে ডানে বায়ে ঘনঘন দেখতে নেই 
সোজা পথে হেঁটে যেতে হয় 
চোখ বন্ধ করে শুধু ভালোবেসে যেতে হয় 
বুকের মাঝে মাথা গুঁজে শুধু হৃদস্পন্দন শুনে যেতে হয় 
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে অমৃত বা হলাহল পান কোরে যেতে হয় 
কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতে নেই 
হাতে হাত রেখে দীর্ঘপথ একসাথে হেঁটে যেতে হয় 
ভালবাসতে গেলে 
নদীর পাড়ের খোলা বাতাস গায়ে মাখতে জানতে হয় 
ভালবাসতে গেলে রোদের বৃষ্টিকে উপেক্ষা কোরে 
পথে চলতে হয়
উড়ে আসা আঘাতকে হাসি মুখে বরণ কোরে নিতে হয়
ভালবাসতে গেলে লাভ ক্ষতির অংক কষতে নেই 
ওসব ভুলে যেতে হয় 
ভালবাসতে গেলে শুধু ভালবাসতেই হয় 
কিচ্ছুটি ভাবতে নেই
ডুবে যেতে হয় গভীর থেকে গভীরে 

উপেক্ষা অবহেলার ধুলো নিমেষে ঝেড়ে ফেলতে হয় 
কিছু কিছু গাছ যেমন অনাদরে বেড়ে ওঠে 
কিছু কিছু ভালবাসাও তেমন 
শত অবহেলা উপেক্ষা সয়েও একদিন ঠিকই 
মাথা তুলে দাঁড়ায়
তাই ভালবাসতে গেলে থামতে নেই 
শুধু ভালোবেসেই যেতে হয় 
বিনিময়ে পাবার জন্য তো ভালবাসা নয় 
ভালোবাসা দেবার জন্য ভালবাসা 
ভালবাসার জন্য শুধুমাত্র ভালবাসা হওয়া চাই

 

 

 

বাবা নামের যে গাছটি আজও খুঁজে ফিরি
মিহির দে

জানি,যেখানেই আছো খুব ভালো আছো। আজও তোমার দেখানো সোজা পথটা ধরেই চলছি। বড্ড অভাব বোধ হয়। এখনও কানে শুনতে পাই সেই ডাক। নেই কোনও ঝড় তুফানের সংকেত অথচ মধ্য গাজন রাতে হঠাৎই ভেঙে পড়ল মস্ত বটগাছটা আর আজীবন ছাদ সরে গেল মাথার ওপর থেকে। 

 

 

গুচ্ছ কবিতা/সুবীর সরকার


প্রসাধন
সুবীর সরকার

আধখাওয়া আপেলের মত একটা জীবন
কুটিরশিল্পের গ্রামে বিষাদ ও শূন্যতা রেখে
                                                      আসি
#
প্রসাধন লেগে থাকে চিরুণির গায়ে।

 

পাখিরা
সুবীর সরকার

'ডিমা নদীর জলে কেবলই ভেসে যাওয়ার গল্প।'
সুপুরিগাছের ছায়া।
কুয়াশা পেরিয়ে আসে 
                              পাখিরা।

 


হাসি ও হাসপাতাল
সুবীর সরকার

হাসি ও হাসপাতাল নিয়ে বসে থাকি।
চাদরে চাঁদের আলো।
পুতুল হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে বরফে 
                                 ঢেকে যায় হাসপাতাল।

 

 

ছোবল
সুবীর সরকার

'সাপের ছোবল থেকে ফিরে আসা মানুষ আত্মজীবনী
                                                        লিখছেন'
ঘামের গন্ধ।
টেবিল ফ্যানের বাতাস।
'সারারাত বাতাসা বিলি করা হবে মৃতদের
                                                            শহরে'

 


গল্প
সুবীর সরকার

ঝলসে ওঠা আলো,একটা সাদা রঙের পৃথিবীর গল্প
                                                             শোনাবো।
আততায়ীর মুখে লণ্ঠনের আলো।
গল্প শেষ হলে দেখি আপেল ভেসে
                                             আসে।

 

 


আক্ষেপ 
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ 

ভস্মীভূত বেলায় চিরকুটে 
লালন জড়িয়ে ধরে ভূমি 
আক্ষেপ ফুরিয়ে গেলে
ভেসে যায় পথের হিসাব...

 

 

 

সময় 
সৈকত সেন 


চারিদিকে এত বিজ্ঞাপন, বন্ধু চাই বন্ধু চাই 
অথচ দিন দিন কেমন নিসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে
চেনা ডাকবাক্স, মুখর চিঠিঘর।
দু'একজন পুরনো বন্ধুকে দ্রুত পায়ে সেদিকে
হেঁটে যেতে দেখি কখনও কখনও
হাতে শুকনো জুইফুলের মালা
ফিরে আসবার সময় অজান্তেই 
দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টি বিনিময় হয়।

আমিও তো চেয়েছিলাম 
সকাল থেকে রাত অবধি বান্ধবময় জীবন 
অথচ আজকাল সিগারেটের ধোঁয়াগুলি
কেমন কুণ্ডুলী পাকিয়ে দৃষ্টির বাইরে
একা একা উপরে উঠে যায়।
খেলার মাঠ, চৌমাথার মোড়, রেস্তরাঁ
বড় অচেনা লাগে।
আমি তো এমনটি চাইনি, কেউই চায় না।

আসলে একটা সময়,
আমরা কেবল একটা বড় গাছ হয়ে বেঁচে থাকি।

 

 


সমর্পণ 
মনামী সরকার


সবটুকু বিলিয়ে দিতে পারলে জল হওয়া যায়। 
জলের কাছে এলে ধুয়ে যায় সব পাপ
নাভিমুল থেকে উঠে আসে জন্মের কথা 
কত রোদ ঘাম সংস্কারি  দুপুর পেরিয়ে 
হাঁটু গেড়ে বসেছি তোমার দালানে 
সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বুঝেছি 
সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত 
তারপর শুধুই সমর্পণ।

 

 


নার্সিসাস 
জয় দাস

আমাদের প্রত্যেকের কাছে এক আয়না ছিল, 
সময়মত নিজেকে দেখবার,
দোষ-গুণ-বিয়োগের ভাগ শেষে দিনের শেষে মুখোমুখি হবার নিজের সাথে...
আমাদের প্রত্যেকের কাছে এক আয়না ছিল-
নিজেদের মুখগুলি দেখতে দেখতে 'শ্রী' আস্তে আস্তে 'বিশ্রী হয়ে গেলে আমরা সাজতে শুরু করলাম,
সরলতা ঢাকলাম, 
তারপর আমরা থেকে আমি হলাম...
আমাদের প্রত্যেকের কাছে একটা আয়না ছিল-
'আমি' হওয়া সাজতে থাকা মুখগুলি একে অপরের সাথে টেক্কা দেওয়া শুরু করলাম...
আমাদের প্রত্যেকের কাছে এক আয়না ছিল, 
সব আমি হওয়া মুখগুলি এখন যতটা নিজেদের মুখ দেখি অপরের মুখ দেখতে বেশি শুরু করলাম...
আমাদের প্রত্যেকের কাছে এক আয়না ছিল, 
এখন আমরা আর নিজেদের মুখ দেখিনা তাতে, 
বলা ভাল দেখতে ভয় পাই,
অন্যের সাজানো মুখ গুলি দেখতে শুরু করলাম...
আমাদের প্রত্যেকের কাছে এক আয়না ছিল, 
এখন আমরা কেউ কারো মুখ দেখিনা তাতে, শুধু মুখোশ গুলি দেখতে থাকি...

 

 

রুদ্রকার 
বর্ণজিৎ বর্মণ 

তোমার জন্য সে নয় ঋতু বারোমাস
শাসক পুরুষ ছলে; নারী সর্বনাশ।

আগুন জ্বালো আগুন শরীরে শরীরে
গাছে গাছে তোল-পাড়। শত্রুর কবরে-

অন্ধকার ঢেকে দাও। পৃথিবী দখলে

তুলে নাও কোলে; শিশু; নিরাপদ বলে
নিশি । মুখে চাঁদ হাসি -  শিরদাঁড়া যে শক্ত
তুমি নারী, তুমি নদী, তুমি জল, রক্ত ;


আগুনে আগুনে খেলা- ধরা শান্ত করো
তুমি জেগে উঠলে; শত্রু -ভয়ে জড়োসড়ো


দুর্বল নও;  সবল তুমি রুদ্রকার
দুষ্টের দমনে; কন্যা- করো সংহার 


জয় জয় ধ্বনি হোক আশ্চর্য ধরায় 
শোভা পাক চির শান্তি উজ্জ্বলতায়

 

 

ছেলেবেলা
অমর মিশ্র 

দূর থেকে আরো দূরে সরে চলেছি,
সামনের টুকু মরীচিকাই লাগছে।
তবুও কেন, কিসের কারনে তাকিয়ে বুঝে ওঠার আগেই 
হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেল
চোখ মেলে দেখলাম আকাশ জুড়ে জোনাকিদের মেলা
প্রতি রাতে এভাবেই ঘুম ভাঙে 
উঠে দেখি আমার গ্রাম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে,
ফিরে তাকাই আমার ছেলেবেলাটিকে।
রাত যায় কোলাহলে ভাঙে ঘুমের আড়ষ্ঠতা কাটে।
ছেলেবেলা কোলাহলে হারিয়েছে...

 

 

পলল
বাবলি সূত্রধর সাহা 

তাকে শব্দহীন মনে হয়েছে বরাবর 
উদাসীন, মৌন বলেও ভেবেছি অনায়াস, 
অথবা সমান্তরাল অভিযাত্রায় 
কখনও অনাত্মীয়, আড়ম্বরহীন! 
অথচ বিশ্বস্ততার দীর্ঘ পললে 
সে আমার প্রথম সংসার।

 

 


শল্যপর্ব
দেবাশিস ভট্টাচার্য 

সাদা তুলোর ভেতর কিছু মায়া জমে থাকে 
সইতে পারে না রক্তপূঁজ ক্ষতের গায়ে শুধু
বুলিয়ে দিতে পারে নরম প্রলেপ 
                                    অদৃশ্য গোলাপ জল
তোর্ষার গায়ে ঝড়ে পড়া কুয়াশার শীতলতায় 
যেমন সেড়ে যায় মন খারাপি অসুখ 

নদীর আকাশে বারেবারে উড়ে যায় সাদা বক 
উদাসী পাখিরা তাই 
শল্য পর্ব শেষে ঘরে ফিরে চোখ মোছে মায়াবী 
চিকিৎসক।

  • কবি