শব্দবাজি ক্রমশঃ যেন আকীর্ণ করে ফেলেছে আমাদের দীপাবলীর আকাশকে।আমরা আমোদে মেতে ভুলে যাই অসুস্থ রোগীর কথা। ভুলে যাই প্রবীণ নাগরিকদের। তাঁরা তো আমাদেরও বাবা, মা। ভুলে যাই পশুপাখি, গাছগাছালি সবাইকে-
দীপাবলী। আলোর উৎসব। এই উৎসব ঘিরে বাজি ফাটানোর চল বহুকালের। সেই বাজি এককালে লোকের আকর্ষণের বিষয় ছিল, যখন সেটা ছিল আলোর রোশনাই। মধ্যকালীন ভারতে নানা উৎসবে আলোর রোশনাই উঠত বাজির মধ্যে দিয়েই। তখন তো আর বিজলী বাতি ছিল না। আলোর রোশনাই কীভাবে উনিশ শতক অতিক্রম করে বিশ শতকের ক্ষয়িষ্ণু বাবুজীবনেও আলোড়ন তুলত, ' তা আমরা দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম জলসাঘরে' । আলোর রোশনাইয়ের থেকে ক্রমে শব্দের আধিপত্য দীপাবলীর সেই, ' হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে' , ক্রমশঃ যেন অন্যরকম করে দিতে শুরু করেছে। সংস্কৃতির প্রবাহমানতা ঋদ্ধ করে সংস্কৃতির আঙিনাকে। মানবজীবনের চলমান প্রবাহকে স্রোতস্বিনী করে। সেই ধরা যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সংস্কৃতিকে গতিময় করেছে। ভারতবাসীর জীবনধারাকে করেছে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারায় পরিপুষ্ট।সেই পরিপুষ্টির মধ্যে আমরা নিজেদের শিকড় কে ক্রমে আরো গভীরে প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছি।শিকড়ের টান গভীর থেকে গভীরে নিজেকে বিকশিত করে যে রস সংগ্রহ করেছেসেই রসের সঞ্চারেই সে ভরিয়ে দিয়েছে আমাদের জীবন।
কিন্তু ক্রমেই দেখা যাচ্ছে সেই বহুমাত্রিক সংস্কৃতির ধারা কেমন যেন একটা ধর্মীয় আধিপত্যের আভাস নিয়ে আমাদের সমাজজীবনকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা শুরু করল গত শতকের শেষের দিক থেকে। উনিশ শতকের শেষ পর্ব, যখন ইংলন্ডের শিল্পবিপ্লবের জেরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ধীরে ধীরে ভারতের সমাজজীবনকে একদিকে তাদের ইংলন্ডের কাঁচা মালের যোগানদার হিসেবে ঠাওরে নিল আর তার অপরপ্রান্তে এই দেশে উৎপাদিত সোনালী পাটকে কেন্দ্র করে ভারতের বুকে শিল্পায়নের সূচনা ঘটাল, ধীরে ধীরে বিন্ধ্য পর্বত পেড়িয়ে বস্ত্র শিল্পের বাজার তৈরি করল তখন শ্রমের বাজার হিসেবেও একটা বড় ক্ষেত্র উন্মোচিত হলো। সেদিন শ্রমের বাজারের যে স্ফুরণ ঘটল তারই ইতিবাচক একটা প্রভাব বাংলার সমাজজীবনেও এল। ভিন রাজ্যের মানুষেরা তাঁদের সামাজিক জীবনকে, , খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সেগুলিকেও বয়ে নিয়ে এলো। শিল্প প্রতিষ্ঠার জেরে বাংলাতেও তখন গ্রামীণ সামাজিক জীবনে একটা বদল ঘটছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার ভূমি কাঠামোটাকেই বদলে দিতে তৎপর হলো। এই ব্যবস্থা বাংলার ভূমি নির্ভর ধনীদের উপর এক ধরণের প্রভাব বিস্তার করলো। অপরপক্ষে জমি আঁকড়ে বেঁচেবর্তে থাকা সাধারণ বাঙালিদের উপর আর এক ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাগু করবার ক্ষেত্রে ব্রিটিশের বাংলার প্রেক্ষিতে অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, প্রায় ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসা বাংলার মুসলমান সমাজ যেন কোনও অবস্থাতেই অর্থনৈতিক ভাবে কোমর সোজা করে আর দাঁড়াতে না পারে। ইংরেজদের মুৎসুদ্দি গিরি করে ধীরে ধীরে ধনী হয়ে ওঠা অনভিজাত হিন্দু বাঙালিদের একটা বড় অংশ তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জেরে কাঁচা টাকার অভাবে যেসব হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পুরনো অভিজাত জমিদারেরা জমিদরি হারাতে শুরু করেছেনতাঁদের জমিদারি কিনে নিয়ে নব্য অভিজাত হয়ে উঠছেন।
ব্রিটিশ ইংলন্ডের শিল্প বিপ্লবের জেরে আমাদের দেশকে ঘিরে তাদের শাসনের নামে শোষণকে আরও জোরদার করতে যে শিল্পায়নের প্রক্রির সূচনা করলো, তা বাংলার বুকে কিভাবে সামাজিক কাঠামো, বিশেষ করে গ্রাম বাংলার সামাজিক কাঠামো উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ভেঙে দিতে শুরু করলো তার অনবদ্য আলেচ্য খোচিত রয়েছে সমরেশ বসুর ' ছিন্নবাধা' নামক উপন্যাসে। সেই পটভূমিও ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলাতে শুরু করে। বিশ শতকে সেই বদলের অনেক প্রেক্ষিত সংযুক্ত হয়। কিন্তু সেই সংযোগের সঙ্গে গত শতকের আটের দশক পর্যন্ত ধর্মীয় অনুসঙ্গের তেমন কোনও যোগ ছিল না। ধর্মীয় অনুসঙ্গের প্রবেশের আগে বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রতিবেশির সংস্কৃতি আত্মস্থতার যে ধারা ছিল, ওই আটের দশকের সময়কাল থেকেই ধীরে ধীরে তার চরিত্রের অদলবদল ঘটতে শুরু করল। আজকাল পত্রিকার শ্রদ্ধেয় সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত এই পরিবর্তমান সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করেছিলেন, ' পান পরাগ' , সংস্কৃতি বলে। এত সার্থকনামা ছিল সেই নামকরণ যা আমরা আজকে বুঝতে পারছি। এই পান পরাগ সংস্কৃতির হাত ধরেই একটা ধর্মান্ধ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করে বাংলার সংস্কৃতির আঙিনাকে। এককালের বিহার, , আজ সেই অংশটি ঝাড়খন্ড' আর আমাদের রাজ্যের বীরভূম লাগোয়া মালুটি (উচ্চারণ অপভ্রংশে মুলুটিও অনেকে লেখেন) গ্রামের দীপাবলীর এক অনবদ্য চিত্র রয়েছে কালকূটের কোথায় পাবো তারে' তে।
ধর্মীয় আচারের সঙ্গে একটা অসাম্প্রদায়িক, জাত্যাভিমান বর্জিত আঞ্চলিক সংস্কৃতির যে অনবদ্য বর্ণনা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেখানে লিপবদ্ধ করেছিলেন সমরেশ বসু, সেসব এখন বাঙালি জীবনে ইতিহাস।বাঙালির ধর্মীয় সংস্কৃতিতেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতাপে এখন এমন একটা আচার আচরণ প্রবেশ করেছে, যে আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে আর বাঙালি সংস্কৃতির আদলটাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। উত্তরপ্রদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতির যে হিন্দুত্বকরণের রূপ, সেটাকেই এখন বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর সেই চেষ্টারই একটা বড় অঙ্গ হল, আতসবাজির পরিবর্তে শব্দবাজি। শব্দবাজি যে ছিল না , এমনটা নয়। কিন্তু শব্দবাজির দাপট এমন গগনবিদারী ছিল না। ক্রমে মানুষের রচির দুনিয়াকে যে ভাবে একটা ভিন্নধারায় আকীর্ণ করে কেবল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকেই বিদীর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে না নয়। এই শব্দবাজির দাপটে যে ভাবে সদর থেকে মফসলল, , অসুস্থ প্রবীণ নাগরিকদের, হার্টের রোগীদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়, তেমনটাই হয় পশুপাখিদের। গৃহপালিত সারমেয়দের প্রভুর নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা জুটলেও পথেঘাটে থাকা সারমেয়দের যে প্রাণান্তকর অবস্থা হয়, তা চোখে দেখা যায় না। একাংশের মানুষের নির্দয়তার ভিতর দিয়ে আনন্দপ্রকাশের এই ভঙ্গিমায় আমরা শিউরে উঠি। আতঙ্কিত হই। পুলিশের সাহায্য চাইলে অনেকক্ষেত্রেই মেলে। কিন্তু উৎসবের দিনে পুলিশের ব্যস্ততাও থাকে যথেষ্ট। ফলে বহু সচেতন নাগরিকও একান্ত অপারগ না হলে পুলিশকে বিরক্ত করতে চান না। তার বাইরেও একটা বিষয় থাকে। পুলিশ এলো। সমস্যার একটা বাস্তবসম্মত সমাধান করে চলেও গেল। তারপর?
পুলিশ তো সারারাত ধরে কোনও একটা বিশেষ জায়গাতে বসে থেকে শব্দবাজির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের আরও বহু কাজ আছে। একজন ব্যক্তিবিশেষ বা একটা বাড়ি বা একটা মহল্লায় শব্দবাজির দাপটে তো দীপাবলীর মত উৎসবের দিনে পুলিশের পিকেট বসিয়ে রাখা সম্ভব না। আর সেটা কোনও বাস্তবসম্মত সমাধানও নয়। তাহলে? , একজন নাগরিক পুলিশের সাহায্য নিয়ে সাময়িক শব্দবাজির হাত থেকে নিস্তার পেতে পারেন। কিন্তু পরে যে তিনি ওই বাজি যারা ফাটাচ্ছেঅনেক টাকা খরচ করে বাজি কিনে, অন্যের অসুবিধা করে যাদের আমোদ হয়, ? সেইসব লোকেরা কি ছেড়ে দেবে ওই শব্দবাজির দাপটে পর্যুদস্ত একজন সহনাগরিককে এই সমস্যার একমাত্র সমাধান জনসচেতনতা। কেবলমাত্র দীপাবলীর সময়েই এই সচেতনতার জন্যে উঠে পড়ে লাগলে চলবে না। গোটা বছর ধরে এই সচেতনতা তৈরির উদ্দেশে চাই ধারাবাহিক কার্যক্রম।