দেবরাজ রায়। একটা সময়। যে সময়ের স্মৃতি রোমান্থনে আজ ও অনেক মানুষ বিভোর হয়ে ওঠেন। ফিল্মের সেই যুগের মেধা আর মননশীলতা, একই সঙ্গে বিনোদন- সেই ত্রিবেণীসঙ্গমের ধারা- তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য-
‘টুনুকে জন্মদিনে,
দাদা
৮/১২/৬৮’
কেবল এইটুকুই। সাদা পাতায়, কালো কলম। রায়, সত্যজিতের ফ্রেম। ১৯৭০ সাল। সিনেমার নাম ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। মুক্তির তারিখ ২৭ অক্টোবর। কালের পরিহাসে সেই ছবি-মুক্তির ৫৫ বছরের প্রাক-মুহূর্তেই, মাত্র দশদিনের ব্যবধানে ‘টুনু’ চলে গেলেন। ‘সিদ্ধার্থ’ ধৃতিমান হয়তো কখনও আর তাক থেকে টুনু’র সম্পত্তি বিপ্লবী গ্যেভারা’র সমগ্র রচনা সংকলন হাতে তুলে নিয়ে কেদারায় পিঠ ঠেকিয়ে বসবেন না। অতীতের সেই যুগ অতিক্রান্ত আজ। বিপ্রতীপে সেই সম্পর্ক আজ সরাসরি সমানুপাতিক না হলেই বরং, গড়পড়তা মানুষের মনে আলোচ্য মানুষটির সম্পর্কে এক সপ্রশ্ন বিস্ময় জেগে ওঠে।
তাই ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় বিজন ভট্টাচার্যের চরিত্র অথবা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র ‘টুনু’ ওরফে দেবরাজ রায় – প্রত্যেক প্রজন্মের এমন প্রবল আদর্শবাদী, আপস করতে না চাওয়া, বাস্তব একেকটি চরিত্র, আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙালির নিজস্ব মননে, পারিপার্শ্বিক সবকিছুর বিপরীতে আরও বেশি করেই কাল্পনিক, অপার্থিব অথবা আশ্চর্য রূপকথার কোনও আশ্চর্যতর সৃষ্টি বলে প্রতিভাত হয়। গুরুদেব যদিও সকলের ভাবনাতে আছেন। তাঁরই কথায় আমরা আউড়ে চলেছি, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমরা পথে এগিয়ে চলেছি। তবুও তেমন মানুষ। দূরদর্শনের পঞ্চাশতম জন্মদিন আগস্টে পেরুলো। মাস না পুরতেই চলে গেলেন ছন্দা সেন। আরও এক মাসের ব্যবধান। নক্ষত্রলোকের যাত্রী হলেন দেবরাজ রায়। সাদাকালো থেকে দূরদর্শনের রঙিন হয়ে ওঠা অনেকদিন। আমাদের প্রজন্মেও আমরা দেখেছি রঙিন স্টুডিওতে, রঙিন পোষাকে আলোচ্য শিল্পীদের সংবাদ উপস্থাপন। তবু অনেক মানুষেরই স্মৃতিতে, আলোচনায় দেবরাজ-ছন্দারা থেকে গিয়েছেন সাদাকালো নস্টালজিয়ায়। দেবরাজ রায়ের ছিল তারও এক বাইরের পৃথিবী। বিশেষ করে যে পৃথিবীর অংশ হয়ে উঠেছিল ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘কলকাতা ৭১’। জহুরীর চোখে জহর চিনেছিলেন মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়।
১২ অক্টোবর, ১৯৭২। কলকাতায় মুক্তি পেল ‘কলকাতা ৭১’।
যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চিত মনে পড়ে গিয়েছে দেবরাজ রায়ের সেই সুপষ্ট, গম্ভীর উচ্চারণ। মানুষ এভাবেই মানবতার ইতিহাসে, সৃষ্টিশীলতার ইতিহাসে নিজের নজির রেখে যায়। মৃণাল সেনের ছবি ‘কলকাতা ৭১’ ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদরের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। এছাড়াও ছবিটি জাতীয় পুরষ্কার লাভ করে। সেই সিনেমার অন্যতম সম্পদ হয়ে থেকে যাবে দেবরাজ রায়ের অভিনয় ও নেপথ্য কণ্ঠের প্রয়োগ। সমাজের বিরুদ্ধে, সমস্ত সামাজিক বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উচ্চবিত্তের তরফে নিম্নবিত্তের শোষণের বিরুদ্ধে – উঠে আসা এক আপাত রুক্ষ, কর্কশ, অথচ চির-প্রতিবাদী ও লক্ষ্য-স্থির রেখে চলা, নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবিবরণীর যেন এক সুপ্ত অথচ প্রকট উপস্থাপন – কালজয়ী শিল্পী দেবরাজই পেরেছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক স্থায়ী কীর্তি রেখে যেতে সক্ষম হয়েছিল সেন, মৃণালের ‘কলকাতা ৭১’। সেই সৃষ্টির সঙ্গেই আদ্যন্ত জড়িয়ে থাকা একজন, সেই সৃষ্টির অন্যতম সহ-স্রষ্টা হিসেবে উল্লেখ করা চলে - এমনই একজন মানুষ ও অভিনেতা দেবরাজ রায় – আজ বিদায় নিয়ে গেলেন। যুগাবসান কেবল তাঁর নিরিখেই বলা চলে না। বাংলা শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রজ গোটা এক প্রজন্মের বিবিধ প্রতিনিধিরাই ক্রমে ক্রমে একেকজন, চলতি সময়েই আমাদের স্নেহের, আকুতির, ভালোবাসার পরম বাহুপাশ কাটিয়ে ছায়াপথে পাড়ি জমিয়েছেন। আমরা যেন তাঁদের যাপন বিস্মৃত না হই। দেবরাজ রায় আজ ‘টুনু’ হয়েই আমাদের অন্তরে থাকবেন।
অস্ত্রহীন, ছুটতে থাকা আদর্শবাদী, সেই প্রশ্নবাজ ছেলেটা, ট্রামলাইন ধরে ছুটতে ছুটতে যাঁকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে ময়দানের পশ্চিম কোণে, (সময়ঃ সত্তর দশকের কোনও এক ভোর), তাঁকে গুলি করে ‘নেই’ করে দেওয়া হল, - সেই চরিত্রের মধ্যে দিয়েই দেবরাজ বেঁচে থাকবেন। এর কারণ দেবরাজেরা ‘হ্যাভ’ আর ‘হ্যাভ নট’দের বৈপরীত্য বোঝেন। তাঁরা সেই বৈপরীত্যের অংশীদার হতে চেয়েছিলেন। মানুষের কাছে সেই কালব্যাপী বৈপরীত্যকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই আজ দূরদর্শন ছাড়িয়েও দেবরাজ রায়।
এমনকি সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ছাড়িয়েও বাঙালির আটপৌরেমি তিনি। একদিকে তিনি দূরদর্শনের দুঁদে সংবাদ-উপস্থাপক। অন্যদিকে ‘মর্জিনা-আবদাল্লা’র মতো বাণিজ্যিক-পারিবারিক সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেও তিনি চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। তপন সিংহের ‘রাজা’ ছবিতে তাঁর অভিনয় উচ্ছসিত প্রশংসা পায়। জীবনের এক বিরাট অংশ জুড়ে তিনি নিয়মিত স্টুডিওপাড়ায় যাতায়াত করেন, এবং ক্রমশই অভিনেতা হিসেবে তিনি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
দূরদর্শনের অন্যতম বরিষ্ঠ ও সুপরিচিত সংবাদ-উপস্থাপক হিসেবে তখনই তাঁর নাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এর কারণ একদিকে তাঁর সুস্পষ্ট উচ্চারণ ও অন্যদিকে সংবাদ-উপস্থাপনের সময় তাঁর আবেগহীন পরিমিতি-জ্ঞান। এই একই বৈশিষ্ট্য তাঁর ব্যবহারিক অভিনয়-প্রতিভাকেও স্বতন্ত্র ও স্বাভাবিক করে তোলে। উচ্চকিত উচ্ছাসের বদলে স্বাভাবিক, স্থানোপযোগী, ভারসাম্যযুক্ত আচরণ – সাধারণ মধ্যবিত্তের এমন প্রতিটি কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের সবকটিকেই দেবরাজ তাঁর অভিনয়ে, সমমনোভাবাপন্ন চরিত্রগুলির ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করেন। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির প্রতিটির ক্ষেত্রে, তাঁদের প্রতিজনের যে বিবিধ মানসিক স্তর ও সেগুলির যে স্বতন্ত্র বিন্যাস, সেই বিবিধতাকেই যেন তিনি এভাবে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের মাধ্যমে সকলের কাছে উপলব্ধির জন্য পৌঁছিয়ে দেন। তিনি ছিলেন যখন, আমাদের প্রজন্মের বড় একটা কেউ তাঁকে নিয়ে তেমন উচ্ছাস প্রকাশ করেনি। তাঁর প্রয়াণের খবরে অনেকেরই তাঁকে মনে পড়ছে আজ। ময়দান পেরিয়ে অল্পবয়সী দেবরাজের অবয়ব এক শুকনো, নিস্তব্ধ জায়গায় এসে দাঁড়ায়। চারপাশে বড় বড় গাছ। গুলির শব্দ হয়। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর পর্দা জুড়ে কেবলই তার মুখ। কপালের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে যায়। সে আবারও আবৃত্তি করে, (কলকাতা ৭১)
দারিদ্র
মালিন্য
আর
মৃত্যুর ভিড় ঠেলে
আমি পায়ে পায়ে চলেছি
হাজার বছর ধরে
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে শেষমেশ ‘সিদ্ধার্থ’ চাকরি পায়। ‘টুনু’র ভবিষ্যতের কোনও হদিস মেলে না। তাঁদের জীবনে কোনও নিশ্চয়তা নেই। পাঁচ দশক পেরিয়ে যায়। ‘টুনু’ ওরফে দেবরাজ রায় দূরদর্শন থেকে শুরু করে সত্যজিৎ-মৃণালের পৃথিবীতেও নিজের অস্তিত্বের আঁচড় কেটে দেন। সেই অস্তিত্বের না-ফুরনো ইতিহাসেই শেষবারের মতো ছেদ পড়ল আজ। আর কখনও ‘টুনু’দের কেউ দূর দেশে চাকরি করতে গিয়ে তার ছোটবেলাকার সেই পাখির ডাক শুনতে পাবে না। আর কখনও ‘টুনু’ তার দাদাকে ডেকে বলবে না, “তোর তো কোনও রাস্তাই নেই, তুই কোনদিকে যাবি নিজেই বুঝতে পারছিস না!”